সৌগত ভট্টাচার্য
লেখক গল্পকার, শিক্ষক।
চারপাশে কথাবার্তা বলার পরিসর প্রতিদিন যত সঙ্কুচিত হচ্ছে, শিক্ষক হিসেবে জমে থাকা বক্তব্যের ছায়ারা ততই দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। গত এক দশকের শিক্ষকতা জীবনে আমি এতটা বিপন্নবোধ কখনওই করিনি যতটা আজকে করছি। সেই বিপন্নতা থেকেই তোদের এই খোলা চিঠি লেখার অসম্ভব একটা তাগিদ অনুভব করছি। ক্লাসরুমের বাইরে কিছু কথা বলার এটাই সময়। চারিদিকের মুখোশের ভয় থেকে বেরিয়ে, মুখোশ ঢাকা স্বেচ্ছাচারীর চোখে চোখ রেখে কথা বলার আবেদন জানিয়ে তোদেরকে এই খোলা চিঠি বলতে পারিস।
তোদের গ্রাজুয়েশনের ফাইনাল পরীক্ষার দুমাস বাকি। গত তিনবছর তোদেরকে আমি ক্লাসে ১৯৩৫ থেকে ১৯৫০ সময়কালের ভারতের ইতিহাস পড়াতাম। আর পড়াতাম, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস। তোরা সকলেই গ্রাম থেকে আসা প্রথম প্রজন্মের ছাত্রছাত্রী। তোরা জেনেছিস, স্বাধীনতার আগের কয়েক দশক ধরে তিলে তিলে গণতান্ত্রিক বহুত্ববাদের ভ্রূণ জন্ম নিচ্ছিল ভবিষ্যৎ সংবিধানের জঠরে। আমাদের দেশের রাজনৈতিক সামাজিক সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদের ধারণা প্রাচীনকালের, সে কথাও তোরা জানিস। তারপরই তোদের থার্ড ইয়ারে দুই বিশ্বযুদ্ধের মাঝের সময়কালের আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস পড়িয়েছি। তোরা দেখেছিস নাৎসিবাদ ও ফ্যাসিবাদের ঘৃণ্য চেহারা! ইতিহাস তোদের দেখিয়েছে কীভাবে দাঁত নখ আর বিষ দিয়ে সমস্ত গণতান্ত্রিক বহুত্ববাদী পরিসরকে নিজের প্রয়োজন মত ধ্বংস করে দেওয়ার চেষ্টা চালিয়েছে ফ্যাসিস্টরা সারা বিশ্বজুড়ে। তারপরও শুভচিন্তা শুভবুদ্ধি মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে, নতুন সবুজ চারাগাছের মত। ভাবে দেখ, আধুনিক ভারতের সংবিধান রচনা আর ইউরোপে ফ্যাসিবাদের “বিকাশ” কাছাকাছি প্রায় একই সময়ের ঘটনা। কেন একথা বলছি?
সেদিনের জেএনইউ-এর ঘটনায় রক্ত মাখা একটি মেয়ের মুখে বারবার তোদের মুখের প্রতিচ্ছবি দেখতে পাচ্ছিলাম টিভির পর্দায়! তোরাও এই কয়দিনে নিশ্চয়ই মোবাইল স্ক্রোল করতে করতে একটা নিরস্ত্র মেয়ের রক্ত মাখা মুখ দেখেছিস! মেয়েটি ঐশী ঘোষ! ঐশী আর কিছু ছাত্রদের সঙ্গে কিছু শিক্ষকের রক্তাক্ত মুখও দেখেছিস নিশ্চয়ই! তাঁরাও ওঁদেরকে ইতিহাস ভূগোল বিজ্ঞান কিছু একটা পড়ান! আর সঙ্গে দেখেছিস কিছু মুখোশ! বাকিটা খবরে পড়েছিস নিশ্চই! যাঁদের মুখ রক্তাক্ত হলেও চেনা গেছে, তাঁদের কথা বলছি না, বলছি মুখোশ পরা ঊনমানুষগুলোর কথা। সারা পৃথিবীর কলঙ্কিত ইতিহাস যেখানেই লেখা হয়েছে সেখানেই এঁদের অবাধ বিচরণ!
যে কথাগুলো মাসমাইনে পাওয়া শিক্ষক হিসেবে ক্লাসে বলতে পারিনি, সেই না বলা কথা বলার জন্য এই চিঠি। আজ একদল মুখোশ পরা দুর্বৃত্তের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত ঐশী, যে তোদের মত একজন ছাত্র। আক্রান্ত হয়েছেন সৌগত, সুচরিতা, যাঁরা আমাদের মত একজন শিক্ষক। এবার আমি যদি তাঁদের রক্তাক্ত শরীর দেখে একটি শব্দ উচ্চারণ না করি, প্রতিবাদ বা অনেকটা ঘেন্না বা ক্রোধ না জানিয়ে নিরাপত্তার উষ্ণতায় পিঠ বাঁচাই, কাল তোদের কাছে আমি মুখ দেখাব কী করে? ফ্যাসিস্টদের তো মুখ ঢাকার জন্য মুখোশ ভাড়া পাওয়া যায়! যে মুখোশের নাম দেশপ্রেম! আমার তো কোনও মুখোশের ফেরিওয়ালা চেনা নেই। আমি জানি তোদেরও তো কোনও মুখোশের দোকানে যাতায়াত নেই। তোদের ক্লাসরুম মুখের, মুখোশের না।
জনগণের ট্যাক্সে চলা একটি সরকার সরকারি কলেজে তোদের পড়াশোনার খরচের ফি বৃদ্ধি করতে চায়, যদিও সেই ট্যাক্সের পয়সায়ই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে খয়রাতি করলে দেশমাতা ক্রুদ্ধ হন না! পড়াশোনা ফি বৃদ্ধির সরকারি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে জেএনইউ আন্দোলনের মুখ ঐশী ও আরও অনেকে রক্তাক্ত হয়। ছাত্র আন্দোলনে রক্ত ঝরা নতুন কিছু নয়। কিন্তু সেই আন্দোলন নতুন মাত্রা পায় যখন রক্তপাত ঘটানোর কন্ট্রাক্ট নেয় মুখোশ পরা একটা শক্তি যে সরকারের সরাসরি জল হওয়া মদতে পালিত। এই আন্দোলনের ওপর পরে সরকারি আক্রমণের সীলমোহর। মস্তিষ্ক বন্ধককারী উজবুকদের সীমাহীন সরকারি পদলেহনের পরিবর্তে স্বেচ্ছাচারী সরকারের মুখের ওপর প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় তোদের বয়েসী কয়েকটি “অবাধ্য” ছাত্র। তখন হয় সমস্যা! তখন ফ্যাসিস্ট সরকারের এজেন্ডা হয় বিরোধী স্বরকে বিনা বিচারে সরাসরি ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে দাঁড়া করানো! ফ্যাসিস্ট চায় সীমাহীন আনুগত্য, প্রশ্নহীন নিরঙ্কুশ সমর্থন! না পেলেই রাতের অন্ধকারে মুখোশে মুখ ঢেকে চালায় গার্লস হোস্টেলে অকথ্য অত্যাচার। মুখোশ কেন? কারণ, তাঁদের দিনের আলোর চেহারাটা দেশপ্রেমের মুখোশে ঢাকা। ক্ষমতার ভিকট্রি স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করে নিরস্ত্র মানুষের রক্তাক্ত শরীরের আর্তনাদ।
বলতেই পারিস এই রক্তলীলা উপভোগ্য কেন? আসলে ফ্যাসিস্ট মাত্রই চায় চারপাশে একটি মুখোশ পরা ভয়ের পরিবেশ তৈরি করতে। তার উদাহরণ এই জেএনইউ! তুমি আনুগত্য না দেখালে সরকারি স্পনসরে এই অবস্থা তোমারও হবে। কারণ একটাই: অবিশ্বাস। ভয় ছাড়া যে তার তিনশতাধিক কমলের পদ্মাসন সুরক্ষিত নয়। তাই ফ্যাসিস্ট ভয় পায় সকল রকম প্রশ্নকে। একটি সাধারণ প্রশ্ন একটি একটি করে পদ্মের পাপড়িকে ছিঁড়ে হাতে ধরিয়ে দিতে পারে পারে শাসককে। তাই তাঁর দরকার নিজের মত একটি ইতিহাস নির্মাণের, যে ইতিহাস শুধু ফ্যাসিস্ট গৌরবের বীরগাথার সাক্ষ্য দেবে। কিন্তু সে ইতিহাস সোনার পাথরবাটি। তাই যুগ যুগ ধরে মুক্ত চিন্তার মাথায় সে মেরেছে হকি স্টিকের বাড়ি লোহার রডের বাড়ি, জেলে পাঠিয়েছে ইতিহাসবিদ, সংশয়বাদী বা যেকোনও অবাধ্য প্রশ্নকারী মানুষকে। আমাদের দেশের বহুত্ববাদী ইতিহাসকে পাল্টে দিতে চায় সে, পাল্টে দিতে চায় ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানের গতিমুখ। কী অবিশ্বাস্য মিল, দুই বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময় ইউরোপ জুড়ে একই কাণ্ড ঘটেছিল। অবিশ্বাসের মাছি ভনভন করে ফ্যাসিস্টদের কানের গোড়ায়, মাছির আর দোষ কি! তাজা রক্তের লোভে কসাইখানায় মাছি আসবেই। আরও বেশি রক্তের খেলায় শাসক মেতে ওঠে জামিয়া মিলিয়া আলিগড় জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ে। কারণ এই সব বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা সেই সব বেয়াড়া প্রশ্ন তোলেন যে প্রশ্ন ফ্যাসিস্ট কখনওই শুনতে চায় না। এই ছাত্ররা নিজের মত ইতিহাসকে পাল্টে দেওয়ার অপচেষ্টার পথ আটকায়। মেধায় আঘাত কোনও হঠকারী সিদ্ধান্ত নয়, এগুলো পরিকল্পিত ছক। কারণ মিথ্যার বুনিয়াদে গড়ে ওঠা সরকারের যুক্তিতে ভয়, তর্কে ভয়, বহুত্ববাদী ধারণাকে ভয়, ইতিহাসকে ভয়। মুখোশে তাঁর আশ্রয়।
দুই আড়াই মাস পর তোদের ফাইনাল পরীক্ষা। এই সময় তোদের অনেক ফোন পাই। তোরা আবদার করে বলিস, “স্যার একটা সাজেশন দেন যদি!” দশ বছরের কোনও দিনই আমি পরীক্ষার সাজেশন করে উঠতে পারিনি। পরীক্ষায় পাশ করে তোরা হয়ত কোনও ইউনিভার্সিটিতে পড়তে যাবি বা অন্য কিছু করবি, শুধু তোদের মুখের দিকে তাকিয়ে আজ আমি একটা সাজেশন তৈরি করেছি। জীবনে প্রথমবার আমি শিক্ষক সত্তা ছেড়ে এক ইহুদি নাপিতের মুখোশে ক্লাসের ডায়াসে উঠে দাঁড়াব। আমার সামনে ক্লাসরুম ভর্তি তোদের স্বপ্নমাখা চোখগুলো জ্বলজ্বলে করবে। আর আমি এক নিঃশ্বাসে সাজেশন বলে যাব,
More than machinery, we need humanity.
More than cleverness, we need kindness and gentleness.
Without these qualities, life will be violent, and all will be lost.