হর্ষ মান্দার
হর্ষ মান্দার। মানুষের পাশে থাকেন, মজলুমদের অধিকার-রক্ষার লড়াই করেন। গুজরাতের গণহত্যা কিংবা অসমের অমানবিক ডিটেনশন ক্যাম্প-- সবক্ষেত্রেই প্রতিবাদের পথে তিনি সাহসী ও লড়াকু। তাই অবসরপ্রাপ্ত আইএএস বা লেখক-সমাজকর্মীর শব্দবন্ধে তাঁকে বেঁধে রাখা যায় না। সিএএ-এনআরসি বিরোধী প্রতিবাদ মিছিল ও সমাবেশে যোগ দিতে কলকাতায় এসেছিলেন হর্ষ মান্দার। তাঁর সঙ্গে মুখোমুখি কথোপকথনে গোলাম রাশিদ।
নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন পাস হওয়ার আগে আপনার একটি মন্তব্য দেশে বেশ আলোড়ন তুলেছিল। আপনি বলেছিলেন, এই জনবিরোধী ও সংবিধান-বিরোধী বিল পাশ হলে নিজেকে একজন ‘মুসলিম’ বলে ঘোষণা করবেন। তাদেরকে যদি নথির অজুহাতে ডিটেনশন সেন্টারে পাঠানো হয়, আপনিও যাবেন। বিল তো পাশ হয়েছে। আপনার নাম বদল হয়েছে নাকি?
(একটু হেসে) আমি নাম বদলাব তা তো বলিনি। এর কোনও প্রয়োজনও নেই। আমি শুধু দেশের নির্যাতিত একটি সম্প্রদায়ের পাশে দাঁড়াবার কথা বলেছি। সেই সিদ্ধান্তে আমি এখনও অনড়। হাম কাগজ নেহি দিখায়েঙ্গে। এর জন্য ডিটেনশন ক্যাম্পে পাঠানো হলে, আমি রাজি। মহাত্মা গান্ধি ১৯৩০ সালে ব্রিটিশ আইন ভঙ্গ করে লবণ তৈরি করেছিলেন। সেই সময় আইন অমান্য আন্দোলনে গান্ধি-সহ ৬০,০০০ আন্দোলনকারীকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন অমান্য করার জন্য স্বাধীন দেশের বিজেপি সরকার আমাকেও যদি গ্রেফতার করে, সাজা দেয়, আমার আপত্তি নেই।
তাহলে স্বাধীন ভারতের এই জ্বলন্ত পরিস্থিতিতে হর্ষ মান্দার কি নয়া গান্ধি?
মহাত্মা গান্ধির আদর্শ আমরা অনুসরণ করে চলতে পারি। তাঁর জীবন থেকে অনেক কিছু শেখার আছে। বিজেপি সরকারের আমলে ধর্মকে কেন্দ্র করে যেভাবে বাঁটোয়ারা করা হচ্ছে দেশের জনগণকে, সেই পরিস্থিতিতে গান্ধির অহিংস, আইন অমান্য নীতি খুবই কার্যকরী।
সিএএ-এনআরসির বিরুদ্ধে যেভাবে দেশজুড়ে আন্দোলন চলছে, তাতে বিজেপি সরকার বেশ ব্যাকফুটে। প্রশাসন, গুন্ডাবাহিনীকে কাজে লাগিয়ে আন্দোলনকে দমিয়ে দিতে চাইছে। হিংসার বিপরীতে মহাত্মা গান্ধির অহিংস আদর্শকে আঁকড়ে ধরে দেশের প্রতিবাদী, মজলুম মানুষজন কতদিন টিকে থাকতে পারবেন?
দেশজুড়ে সিএএ-এনআরসি বিরোধী আন্দোলন দমাতে পুলিশকে কাজে লাগাচ্ছে বিজেপি সরকার। প্রধানমন্ত্রী মোদি ‘পোশাক দেখেই প্রতিবাদীদের চেনা যায়’ বলে বিদ্বেষমূলক মন্তব্য করে এতে বিভেদ সৃষ্টি করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু আমাদের দমে গেলে চলবে না। উনি তো মিথ্যা কথাও বলেছেন। এনআরসি নিয়ে কোনও আলোচনা হয়নি। এমনকি দেশে কোনও ডিটেনশন ক্যাম্প নেই বলেও তিনি দাবি করেছেন। অথচ আমি নিজে গিয়ে অসমে ডিটেনশন ক্যাম্প দেখে এসেছি। কী করুণ অবস্থায় মানুষ সেখানে দিন কাটাচ্ছে, সেসব নিয়ে আমি লিখেছিও। ওরা হিংসার পথ ধরলেও আমরা আন্দোলনকারীরা অহিংসার পথেই চলব। দেশের হিন্দু-মুসলিম সবাই মিলেমিশে আন্দোলন করছে। কারও চক্রান্ত সফল হতে দেওয়া যাবে না। আমরা একসঙ্গে লড়ব। এই লড়াই একা মুসলিম বা হিন্দুর নয়। এই লড়াই সবার।
সবাই কি লড়ছেন? আন্দোলনের কাজে দেশের বিভিন্ন জায়গায় আপনি যাচ্ছেন। মানুষের সঙ্গে কথা বলছেন। কী মনে হচ্ছে আপনার?
সিএএ-টাকে এমনভাবে ফ্রেম করা হয়েছে যে– এনআরসি হলে যেন শুধু মুসলিমদেরই জন্য হবে। তারাই বেশি ভুগবে। নাগরিকত্ব আইনের এই নয়া ধারণাটা তো ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানের কাঠামোটাই নষ্ট করে দেয়।
তাই নাগরিকত্ব সংশোধনী বিরোধী আন্দোলন হল সংবিধান বাঁচানোর আন্দোলন। যারা দেশকে ভালোবাসেন, সংবিধানের প্রতি আস্থা রাখেন, মর্যাদা দেন, তারা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করছেন। হিন্দু-মুসলিম কোনও ভেদ সেখানে নেই। বরং বিভিন্ন জায়গায় সিএএ-এনআরসি বিরোধী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের সৃষ্টি হয়েছে।
সবাই কি সচেতনভাবেই এই আন্দোলনে অংশ নিচ্ছেন?
অবশ্যই। মানুষ অসমকে দেখে শিক্ষা পেয়েছে। বুঝেছে সিএএ-এনআরসি মানুষের জীবনকে খুব খারাপ পরিণতির দিকে ঠেলে দেবে। তাই বহু মানুষ দৈনন্দিন কাজ ছেড়ে হলেও মিছিল, সমাবেশে যোগ দিচ্ছেন।
২০০২ সালে গুজরাত দাঙ্গার পরে আপনি মুসলিমদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। সেই ভয়াবহ ঘটনার প্রেক্ষিতে আপনার বই ‘বিটুইন মেমোরি অ্যান্ড ফরগেটিং: ম্যাসাকার অ্যান্ড মোদি ইয়ারস ইন গুজরাত’ প্রকাশ পেয়েছে। সেই সময়ে দাঙ্গাবিরোধী আন্দোলন এবং আজকের সিএএ-এনআরসি বিরোধী আন্দোলনের মধ্যে পার্থক্যটা কী?
গুজরাত দাঙ্গার পর সেখানকার মুসলিমরা ট্রমার মধ্যে পড়ে গিয়েছিল। মোদির গুজরাত মডেল বড় বড় বিজনেসের প্ল্যান করেছে। কিন্তু সোশ্যাল ফ্যাক্টরগুলির তেমন উন্নতি হয়নি। আমরা সেই সময় সংখ্যালঘুদের মনের আতঙ্ক দূর করার চেষ্টা করেছি। ন্যায়বিচার পাইয়ে দেওয়ার জন্য লড়েছি। এখনও লড়াইটা প্রায় একই। তবে আরও বিস্তৃত প্রেক্ষাপটে। কেন্দ্রের শাসনযন্ত্রের সঙ্গে আমাদের লড়তে হচ্ছে।
আলিগড়, জামিয়া, জেএনইউ-এর মতো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়ারা আক্রান্ত হচ্ছে। শাসক এত অসহিষ্ণু হয়ে পড়ছে কেন?
ছাত্রছাত্রীরাই এই আন্দোলনে বড় একটা ভূমিকা নিচ্ছে। পড়ুয়াদের অংশগ্রহণ জনগণকে বেশি আলোড়িত করেছে। সেটা মোদি সরকার সহ্য করতে পারছে না। তাই তারাই আক্রমণের লক্ষ্য হয়ে উঠছে।
দেশজুড়ে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলন হচ্ছে অসাংগঠনিকভাবে, কোনও নেতৃত্ব ছাড়াই। এর ভবিষ্যত কী হতে পারে বলে আপনার মনে হয়?
অবিজেপি রাজ্যগুলি সদর্থক পদক্ষেপ নিচ্ছে। কেরল ও বাংলার মমতা সরকার খুব প্রশংসনীয় কাজ করেছে। সবাইকে মিলেমিশে কাজ করতে হবে। এনআরসি-এনপিআর যেন রাজ্যে লাগু না হয়, সেই চেষ্টা রাজনীতিকদের করতে হবে। আর সর্বোপরি এটা জনতার আন্দোলন। জনতাই লড়বে। নাৎসি জমানায় হিটলারের নেতৃত্বে জার্মানিতে ইহুদিদের উপর নির্যাতন নিয়ে তেমন বড় আকারের কোনও প্রতিবাদ অ-ইহুদিরা করেনি। কিন্তু ভারতের জনগণ করছে। কারণ, এখানে মানবিক সত্তাটি এখনও মরে যায়নি। আমরা দেশকে ‘ঘৃণার রাজ্যে’ পরিণত হওয়া থেকে রুখব। সংবিধানকে বাঁচানোর জন্য আমরা রাস্তায় নেমেছি। এর ফয়সালা পার্লামেন্ট কিংবা আদালতে হবে না, রাস্তাতেই হবে।
সুন্দর লেখা!