বিনয় চক্রবর্তী
লেখক প্রবন্ধকার ও সঙ্গীতগবেষক।
চয়ন কিংবা সামাজিক ন্যায়, দেশের অর্থনীতি থেকে সামাজিক উন্নয়নের সূচক– যখন যে বিষয়েই কথা বলেন, ভাবনার গভীরতা ও চিন্তার যুক্তিনিষ্ঠ স্বকীয়তায় বরাবরই তিনি নিজের মতো, অনন্য। বয়সে অশীতিপর, অথচ ভাবনায় তরুণ সেই মানুষটিই যখন কথা বলেন তাঁর একদা সহধর্মিণীর গবেষণা বিষয়ে, কতটা দিগন্তদর্শী হতে পারে সে আলোচনা, তা জানার আগ্রহেই সেদিন সারা শহর জড় হয়েছিল রবীন্দ্রসদনে। উপলক্ষ্য ছিল, নবনীতা দেবসেন স্মারক বক্তৃতার প্রথম অধিবেশন। এবং, প্রত্যাশা ছাপিয়ে গোটা বিষয়টিকে এক অন্য উচ্চতায় তুলে নিয়ে গেলেন অমর্ত্য সেন।
শুরু করেছিলেন নবনীতার গবেষণার বিষয় নিয়ে। ‘ওরাল এপিক’ বা মৌখিক মহাকাব্য নিয়ে নবনীতার গভীর আগ্রহ ছিল এবং এই মহাকাব্য বিষয়ে গবেষণার ধারা প্রথম তিনিই শুরু করেছিলেন– এবংবিধ তথ্যের মধ্যে আপাতদৃষ্টিতে নতুনত্ব কিছু ছিল না। কিন্তু প্রায় একই নিশ্বাসে অমর্ত্য যখন উল্লেখ করেন, বিরোধী যুক্তিশৃঙ্খলার পরিসর নির্মাণের কথা, সঙ্গে-সঙ্গে নড়েচড়ে বসতে হয়। তার মানে, উনি কি আসলে নবনীতার গবেষণার মূল্যায়নের প্রসঙ্গে পৌঁছতে চাইছেন অন্য কোনও গভীরতর সমাজবার্তায়?
তার পরক্ষণেই অমর্ত্য আমাদের মনে করিয়ে দেন, সীতায়ণ শব্দবন্ধটির সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে কীভাবে নবনীতা আসলে গবেষণার অন্তর্বতী এক বিকল্প স্বর গড়ে তুলতে চাইছেন, সে কথা। বাল্মিকীর রামায়ণে ন্যায় ও ন্যায্যতার যে কাঠামোয় মেয়েদের চিত্রিত করা হয়েছে, সেখানে নবনীতা বিরোধী যুক্তির প্রাসঙ্গিকতা এঁকে দেখিয়েছেন। অমর্ত্য বললেন, বাল্মিকী রামায়ণে পুরুষপ্রধান দৃষ্টিভঙ্গির প্রাধান্য বিষয়ে পক্ষপাতিত্ব রয়েছে। মাইকেল মধুসূদন দত্ত বাল্মিকী রামায়ণ আত্মস্থ করেই সৃষ্টি করেছেন মেঘনাদবধ কাব্য। কিন্তু এ কথা স্বীকার করে নিতে হবে যে ভারতীয় সমাজে বাল্মিকী রামায়ণের গভীর প্রভাব রয়েছে।
বাঙালি পাঠককূল কিন্তু আগেই জেনে ফেলেছেন নবনীতা দেবসেনের সীতাকথা, রামকথার পাল্টা আখ্যান। রামরাজত্বে রামই প্রধান পুরুষ, সেখানে সীতা এক সাধারণ নারীচরিত্র। ভারতবর্ষে রামভক্তির প্লাবনে সীতা নগণ্য এক নারী। কে বলে তাঁর কথা! নবনীতা আমাদের জানিয়েছেন যে, বাল্মিকী কাব্যটি একমাত্র রামায়ণ গ্রন্থ নয়। বহু রামায়ণ এই ভূমিতে রচিত হয়েছে যার দ্বারা বহু ভারতবর্ষের পরিচয় পাওয়া যায়। এই প্রসঙ্গেই পাওয়া যায় রামায়ণের বিরোধী যুক্তির আদর্শে মৌখিক মহাকাব্যের কাহিনী। নবনীতা চন্দ্রাবতীর রামায়ণকে বিশেষ গুরুত্ব দিতেন।
রবীন্দ্রনাথের বিষয়ে নবনীতার আজীবন অধ্যয়ন, চর্চা, পর্যালোচনা আমাদের আলোকিত করে। তিনি লিখেছেন, প্রথম মহাযুদ্ধের পর ইউরোপ বিধ্বস্ত, বিহ্বল সেখানকার বুদ্ধিজীবী মহল, সাহিত্যিকরা৷ তাঁরা রবীন্দ্রনাথে আ্শ্রয় খুঁজছেন। যে সাম্রাজ্যবাদী রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় ইউরোপ ক্ষতিগ্রস্ত হল, সে সম্পর্কে রবীন্দ্রনাত্থ কিছু ব্যক্ত করলেন না, বরং নীরব রইলেন। নবনীতা লিখেছেন, বড় ভাল হত যদি রবীন্দ্রনাথ কিছু বলতেন!
প্রশ্নোত্তর পর্বে এই নিবন্ধের লেখক অমর্ত্য সেনের কাছে জানতে চেয়েছিলেন, এই ঘটনার কোনও পর্যালোচনা, বিশ্লেষণ পরবর্তী সময়কালে হয়েছিল কি না, বা কেন নীরব ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। উত্তর দিয়েছেন অমর্ত্য সেন৷ তাঁর প্রজ্ঞায়, অনেক সময় ধরে। বলেছেন, সেই সময় রবীন্দ্রনাথ প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের ঐক্য নিয়ে বিশেষ উৎসাহী ছিলেন – যে কোনও রাজনৈতিক মন্তব্য এই ঐক্য প্রয়াসে বাধা হয়ে উঠতে পারে। তাই তিনি সম্ভবত নীরব থেকেছেন। এই প্রসঙ্গে বিভিন্ন সময় রবীন্দ্রনাথ বিভিন্ন দেশে যে ভূমিকা নিয়েছিলেন, তার কথা স্মরণ করা যেতে পারে। শিল্পবাণিজ্যসমৃদ্ধ জাপানে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ ন্যাশনালিজমের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। জাপানবাসীর মনঃপূত হয়নি সে কথা। উনি বলেছিলেন, জাতীয়তাবাদ সঙ্কীর্ণতাবাদে পরিণত হওয়ার আশঙ্কার কথা। যখন চিনে গেলেন, সেখানে বামপন্থী কমিউনিস্ট পার্টি জাতীয়তাবাদীদের সঙ্গে ফ্রন্ট তৈরি করেছে। সেই বামপন্থীরা রবীন্দ্রনাথের বক্তৃতা দেওয়ার সময় হট্টগোল করে। তারা বলে, রবীন্দ্রনাথ প্রাচীনপন্থী, আধুনিক নন, কারণ রবীন্দ্রনাথ বক্তৃতায় বলেছিলেন, প্রাচীন ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ এশীয় দেশ, বিশেষ করে ভারতবর্ষ, চিন কেন সামাজিক উন্নয়নে ইউরোপের মডেলকে অনুকরণ করবে? রবীন্দ্রনাথকে বিভিন্ন সময়ে বিরোধী যুক্তির মোকাবিলা করতে হয়েছে এবং বিরোধীরাও বাধা পায়নি।
এই প্রসঙ্গেই অমর্ত্য সেন জানান, বিরোধী যুক্তি ওঠার আগেই কেন বিরোধ বিষয়ে অবহিত থাকতে হবে। শুধু আবেগ নয়, যুক্তিবুদ্ধির মানদণ্ডে যাচাই করে নিতে হবে।প্রতিবাদ হবে না, এটা ভাবা যায় না। বিরোধী যুক্তিকে মূল্য দিতে হবে।
স্মারক বক্তৃতার বিষয় ঠিক হয়েছিল ‘স্বদেশ ও বিদেশ’। শিরোনাম হঠাৎ বদলে গিয়ে হল, ‘বিরোধী যুক্তি’। এই বিষয় বদলেই মনে হল সারা প্রেক্ষাগৃহ যেন নড়েচড়ে বসল। এই সময়ে ভারতবর্ষে বিরোধ, বিরোধিতার প্রশ্নে সমাজ উত্তাল হয়ে উঠেছে। তাই বিরোধী যুক্তি শ্রোতাদের আকাঙ্ক্ষার বিষয় হওয়াতেই কি এই বিষয়-বদল? কিন্তু প্রশ্নোত্তর পর্বের শুরুতে ঘোষণা করা হল যে, স্মারক বক্তৃতায় আলোচিত বিষয় নিয়েই অমর্ত্য সেনকে প্রশ্ন করা যাবে, এবং তাই ঘটল। কোনও রাজনৈতিক বিষয় বা বর্তমানে দেশে বিরোধী আন্দোলনকে নিয়ে কোনও প্রশ্ন তাঁকে করা হয়নি। কয়েকটি প্রশ্ন এমন ছিল যে, কলকাতার দর্শক-শ্রোতা প্রজ্ঞায় রসবোধে সমৃদ্ধ অমর্ত্য সেনকে কাছে পেয়ে মুগ্ধ হলেন। বিরল এক অভিজ্ঞতা।
সব ভাল ঘটে যাওয়ার পর একটি দুটি নতুন প্রশ্ন উঠে পড়ে। সেদিনের অনুষ্ঠান শুধু আমন্ত্রিতদের জন্য আয়োজন করা হয়েছিল। এখানে তরুণ-তরুণীদের সংখ্যা ছিল উল্লেখযোগ্যভাবে কম। প্রেক্ষাগৃহ কানায় কানায় পূর্ণ ছিল, বরং উপচে পড়ছিল ভিড়ে। মধ্যবয়সী থেকে প্রৌঢ় শ্রোতারাই সংখ্যায় বেশি। তরুণ-তরুণীরা সংখ্যাধিক্যে উপস্থিত থাকলে অমর্ত্য সেনের মতো প্রাজ্ঞ মানুষের কাছে রাজনীতি-সমাজনীতি বিষয়ে অনভিপ্রেত হলেও কিছু প্রশ্ন হয়তো করেই ফেলতেন। বিরোধী যুক্তি নিয়ে ভারতবর্ষে এই সময়ে লড়াই শুরু করেছে ছাত্র-যুবারাই। বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে ছাত্ররা কিন্তু কোনও রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডা নিয়ে আন্দোলন করছে না। প্রত্যেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আলাদা আলাদা ইস্যু নিয়ে শুরু হয়েছিল বিক্ষোভ।
এখন ছাত্র-যুব সমাজ শিক্ষক, অভিভাবক থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষকে প্রশ্ন করতে চাইবে- অধিকার ও কর্তব্যের প্রশ্নে তারা কী পথ দেখাতে চায়।
আমরা বুঝি না ই ইকুয়ালস টু এম সি স্কোয়ার
বুঝি না কণাদের অবাধ্য ওড়াউড়ি
আমরা বুঝেছি আলোর চেয়ে
ছুটবে জোরে আমাদের জেদ
কেউ খুঁজবে যুক্তি, কখনও বা বিরোধী যুক্তি
আমরা বুঝেছি আলোর চেয়ে
ছুটবে জোরে আমাদের জেদ