অর্ক দেব
লেখক সাংবাদিক।
ইতিহাসের এত সুচারু পুনর্নির্মাণ হার মানাবে গ্রোটস্কির নাট্যশালাকেও। ১৯১৯ সালে ব্রিটিশ সরকার রাওলাট আইন প্রণয়ন করে। আইনবলে যে কোনও ভারতীয়কে বিনা বিচারে আটক করার ক্ষমতা বর্তায় ব্রিটিশ সরকারের ওপর। একই সঙ্গে মেলে বিনা ওয়ারেন্টে বাড়ি তল্লাশি, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণের অধিকার। ১০০ বছর পেরিয়ে ইতিহাস যেন নিজেই নিজেকে নকল করে চলেছে। গোটা দেশকেই বধ্যভূমিতে পরিণত করেছে বর্তমান শাসক। কাশ্মির থেকে কন্যাকুমারিকা, দাঁত-নখ আর পেশিশক্তি নিশিদিন দেখিয়েই চলেছে শাসক ও তার প্রতিনিধিবর্গ। দাগী অপরাধীর ভাষাতেই কথা বলছে সরকারের নানা গুরুত্বপূর্ণ পদাধিকারী। যুক্তি ও সত্যনিষ্ঠার পক্ষে যারা, সরকারি নীতির সঙ্গে বিরোধাভাস রয়েছে যাদের তাদের সকলকেই ইচ্ছেমতো ভোগান্তির মুখে ফেলছে সরকার।
এর মধ্যে সবচেয়ে ন্যক্কারজনক অবস্থা উত্তরপ্রদেশের। সেখানে জেলবন্দি সমাজের নানাস্তরের পাঁচ হাজারের বেশি মানুষ। যে সংবাদমাধ্যমগুলি এখনও পুরোপুরি মাথা নোয়ায়নি, সেখানে পালা করে এই পাঁচ-সাড়ে পাঁচ হাজার মানুষের ভোগান্তির খবর পরিবেশিত হচ্ছে। ২০ ডিসেম্বর দ্য টেলিগ্রাফ পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে দেখা যাচ্ছে, মুজফফরনগর জেলে বন্দি মৌলানা আসাদ রাজা এবং তাঁর বেশ কিছু ছাত্র জানিয়েছেন তাঁদের পায়ু্দ্বার থেকে ক্রমাগত রক্তক্ষরণ হচ্ছে। এই রক্তক্ষরণের কারণ দিনভর ধর্ষণ।
এখন এর পাশাপাশি কাশ্মিরের ছবিটাও এখানে তুলে ধরা প্রয়োজন। কাশ্মিরে ৩৭০ ধারা রদের সময় থেকে যে নেতারা বন্দি ছিলেন তাঁরা এখনও বন্দিই। প্রজাতন্ত্র দিবসের প্রাক্কালে এই দেশেরই প্রজা তথা কাশ্মিরের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লার একটি ছবি সামনে এসেছে, তাতে দেখা যাচ্ছে তথাকথিত শৌখিন ‘রহিস’ আবদুল্লাহ এমন একটি বিবর্ণ পোশাক পরে রয়েছেন, এই পোশাক স্বেচ্ছায় কেউ পরবেন না। বন্দি কাশ্মিরি নেতারা এক ঘরে দুজন থাকতে বাধ্য। দুবেলা নিরামিষ খাবার এবং সপ্তাহে একদিন এক পিস মুরগির মাংস পেয়ে আসছেন। সেই বাজেটও কমাতে চাইছে সরকার বাহাদুর। মায়ের শারীরিক অবস্থা নিয়ে মুখ খুলে আটক হয়েছেন মেহেবুবা মুফতির মেয়ে ইলতিজা মুফতিও। ফলে যে দু্র্দশার কথা ইতিহাস বইতে পাঠ্য, সেই অভিশাপ বইয়ের পাতায় আটকে নেই, নেমে এসেছে জাতির জীবনে।
পালা করে গ্রেফতারি চলছে প্রতিদিন। এই তালিকাতেই নতুন সংযোজন ম্যাগসাইসাই পুরস্কারবিজয়ী সমাজকর্মী সন্দীপ পাণ্ড্যে। অনেক আগে থেকেই নিজেরই বাড়িতে বারবার বন্দি হচ্ছিলেন সন্দীপ। গত রবিবার আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে সাভারকারের রাজনীতি বিষয়ে মন্তব্য করার জন্যে সন্দীপের বিরুদ্ধে মঙ্গলবার ১০৫ (ক) ও ৫০৫ (১খ) ধারায় অভিযোগ আনা হয় সিভিল লাইন থানায়। অভিযোগ আনেন হিন্দু মহাসভার প্রেসিডেন্ট রাজীব কুমার। তারপরেই তাকে বুধবার গ্রেফতার করা হয়। কাশ্মিরে ৩৭০ প্রত্যাহারের বিরুদ্ধে মোমবাতি মিছিলের অনুমতি পাননি এই গান্ধিবাদী সমাজকর্মী। ২০১৯ সালের আগস্ট মাসেই তাঁকে তিনাবার গৃহবন্দি করা হয়েছে। এর আগে মাওবাদী কার্যকলাপে যুক্ত থাকার অভিযোগ তুলে ২০১৬ সালে সন্দীপকে কানপুর আইআইটি থেকে বরখাস্ত করা হয়। কাজেই এই রক্তচক্ষু সন্দীপকে ভয় দেখাচ্ছে না। কিন্তু প্রশ্ন অন্য। ২৬ জানুয়ারি ২০২০-তে বসে এই ঘটনাপরম্পরায় আমাদের নতুন করে ভাবতে হচ্ছে ভারতে কি সাধারণতন্ত্র আদৌ জীবিত আছে, একজন সাধারণ নাগরিকের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা কি আইনবলে আর সুরক্ষিত? সন্দীপের রাজনীতির ধরণধারণ এবং প্রাপ্তিযোগ এই প্রশ্নকেই আরও জোরালো করে দিচ্ছে।
ঠিক একমাস আগে সন্দীপ উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীকে একটি চিঠি দেন। চিঠিতে তিনি লেখেন, “আপনি যদি আপনার পুলি্শের অপারগতার কারণে সমাজকর্মীদের জেলে পাঠাতে থাকেন তাহলে আমাদের গণতান্ত্রিক অধিকার খর্ব হতেই থাকবে। সরকারি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদজ্ঞাপনের অধিকার নাগরিকের সাংবিধানিকভাবেই প্রাপ্য। তাতে হস্তক্ষেপ হলে নাগরিকরা ভুল পথেই চালিত হবেন।” বলাই বাহুল্য, সন্দীপের কথায় কর্ণপাত করেননি যোগী আদিত্যনাথ। মহম্মদ শোয়েব, সদফ জাফরদের পথেই চালিত হয়েছে ওঁর নিয়তি।
উত্তরপ্রদেশের এই ছবিটাও কিন্তু একদিনে তৈরি হয়নি। এটা এক লম্বা পরম্পরার একটি খণ্ড মাত্র। একটা পুরনো ঘটনা মনে পড়ে যাচ্ছে লিখতে বসে। ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে উত্তরপ্রদেশে বিধানসভা ভোটের সময়ে আজকের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ একটি ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটিয়েছিলেন। সেবার সঙ্ঘীরা ৩২ লক্ষ লোককে হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের আওতায় নিয়ে এসেছিল। প্রতিদিন সকাল আটটায় সেই গ্রুপগুলিতে অ্যাডমিনের তরফ থেকে বার্তা দেওয়া হত। জানানো হত কীভাবে বিজেপির বিরুদ্ধে ‘ভুল’ তথ্য মিডিয়ায় ছড়ানো হচ্ছে। এক ‘অতি তৎপর’ যুবক এই গ্রুপে একটি ভুয়ো ছবি শেয়ার করেন। ছবিতে দেখানো হয়, সমাজবাদী দলের নেতা, উত্তরপ্রদেশের তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী অখিলেশ যাদব তাঁর বাবা মুলায়ম সিংহ যাদবকে চড় মারছেন। ছবিটি ভাইরাল হয় হোয়াটসঅ্যাপে। অমিত শাহও হোয়াটসঅ্যাপটি পান। তিনি সে সময় জনসমক্ষে দাঁড়িয়ে বলেন, এ কাজ ঠিক নয়। কিছুক্ষণেই জমজমাট আবহ তৈরি হলে মুচকি হেসে তিরষ্কারের সুরে দলীয় কর্মীদের বলেন ‘‘এই হল আসল কাজ, কিন্তু ছেড়ে দিন। আপনারা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন আমি আসলে কী বলতে চাইছি।’’ তিনি আরও যোগ করেন, ‘‘আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে বত্রিশ লক্ষ লোক আছে। কাজেই আমরা যে কোনও কিছুই করতে পারি চোখের নিমেষে।’’
আমরা আজ যা দেখছি তা এই যে কোনও কিছুরই প্রয়োগ। যে কোনও বিরুদ্ধমতকে টুঁটি চেপে খুন করার এক গভীরতম ষড়যন্ত্র। গান্ধির আত্মজীবনী পড়ে মু্গ্ধ হয়ে ক্যালিফর্নিয়ার গবেষক সন্দীপ ভারতবর্ষে মাঠে নেমে কাজ করার স্বপ্ন দেখেছিলেন। এমআইটি প্রকাশিত একটি পুস্তিকা দ্য চাইল্ড অ্যান্ড দ্য স্টেট অফ ইন্ডিয়া পড়ে এ দেশে শিক্ষাছুটদের অবস্থা সম্পর্কে বোঝাপড়া তৈরি হয় সন্দীপের মনে। লখনৌ থেকে ৬০ কিলোমিটার দূরে ৩৫ জন দলিত শিশুকে শিক্ষা দেওয়ার মধ্যে দিয়ে কাজ শুরু করেন সন্দীপ। ক্রমে গড়ে ওঠে আশা ফর এডুকেশন। ১৯৯৭ সাল থেকে এ যাবত সন্দীপ ও তাঁর বন্ধু দীপক গুপ্তর তৈরি করা এই সংস্থা শিশুশিক্ষা খাতে ব্যয় করেছে ভারতীয় মুদ্রায় ২৫৬ কোটি টাকার কিছু বেশি। প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা সুনিশ্চিত করা, শিক্ষাক্ষেত্রে টেকনিকাল এইডকে কাজে লাগিয়ে পিছিয়ে পড়া ছাত্রছাত্রীদের আরও আরও বেশি স্বয়ংসম্পূর্ণতার কাজে নিয়োজিত সন্দীপদের সংস্থা। উল্লেখ থাক, এই সংস্থায় কোনও পাকা মাইনের চাকরি নেই। পুরো কর্মকাণ্ডটাই হয় স্বেচ্ছাসেবকদের শ্রমের নিবিড়তায়।
কাশ্মির নিয়েও সরব সন্দীপ। দু দশকেরও বেশি সময় ধরে তিনি দ্বিপাক্ষিক কথাবার্তার পক্ষে স্বর তুলেছেন। স্পষ্ট বলেছেন, কাশ্মির ভারতের নয়, পাকিস্তানিদেরও নয়। নিজেদের ভাগ্য স্থির করার স্বাধিকার কাশ্মিরিদের দেওয়া হোক। সন্দীপের তত্ত্ব অনুযায়ী, পোখরানে ভারতের ক্ষমতা প্রদর্শনের ঘটনা কার্গিলের মতো রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের জন্ম দিয়েছে। সন্দীপের বলিষ্ঠ মত, মতপ্রকাশের আর্তির কারণে শাসক তাঁকে পছন্দ করবেন না তা তো জানা কথাই। শাসক সন্দিহান তাঁকে ঠিক কোন খাপে বসানো যায় তাই নিয়ে। নকশাল বলা হবে, নাকি মাওবাদী, পাকিস্তানপন্থী বললে কি আরও ভালো করে চিহ্নিত করা যাবে, ইত্যাদি সাতপাঁচ ভাবনায় জেরবার সরকার আপাতত চায় তাঁর নাগরিক অধিকারগুলিই একে একে হরণ করে নিতে। একজন চরমপন্থী-একজন নরমপন্থী দুয়ের জন্যেই একই দাওয়াই দেওয়া ছাড়া আর কোনও উপায়ও নেই রাষ্ট্রের। তাই জেল ভরো নীতি, তাই কণ্ঠরোধের সর্বাত্মক চেষ্টা। তাই লেখার শুরুতে এই অবস্থাকে একশো বছর আগের অবস্থার সঙ্গে তুলনা করেছিলাম।
লেখার শেষে এসে মনে হচ্ছে, অবস্থা আরও ভয়ঙ্কর। ঔপনিবেশিক শাসনের থেকেও ভয়াবহ ফ্যাসিবাদের নিশ্বাস। ২০০৩ সালে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক ডঃ লরেন্স ব্রিট “ফ্যাসিজম এনিওয়ান?” শীর্ষক একটি প্রবন্ধ লেখেন। সেখানে তিনি কয়েক দফা বৈশিষ্ট্য তুলে ধরে দেখান সব ফ্যাসিবাদীরই মুখ মুখোশ একরকমের। ব্রিট দেখান,
- সমস্ত ফ্যাসিবাদীই শক্তির উপাসক, তাদের প্রধান হাতিয়ার জাতীয়তাবাদের জিগির (মনে করুন ভারতমাতা বিষয়ক আস্ফালন)।
- ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রে অত্যাচারকে বারবার মান্যতা দেওয়া হয়, শিকেয় ওঠে মানবিকতা (কেন রক্তপাত হল জেলবন্দি মৌলানা আসাদ রাজার পায়ু্দ্বার থেকে?)।
- সেনার ক্ষমতা এই রাষ্ট্রে ক্রমে বাড়ে (বিপিন রাওয়াত কোন অধিকারে মুখ খুললেন ভারতের সাধারণ মানুষের আন্দোলনের ঠিক ভুল নিয়ে?)।
- শত্রুর গোত্র বাছাই, তাকে বারবার চিহ্নিত করা (চিড়ে খাওয়া মানুষকে শাসকদলের প্রতিনিধি কৈলাস বিজয়বর্গী বলেন ‘বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী’।)।
- মিডিয়া নিয়ন্ত্রণ করে ফ্যাসিস্ট শাসক (হিন্দু পেট্রিয়ট অমৃতবাজারের ভারতবর্ষে জি নামক সংস্থাটির ভূমিকা খুঁটিয়ে লক্ষ করুন।)।
- শাসক ঘনঘন ধর্মের তাস ফেলে (হিন্দুরাষ্ট্র নামক কুমিরছানা বিষয়ে পৃথক লেখা লিখতে হয়।)।
- কর্পোরেট ঘনিষ্ঠতা ফ্যাসিবাদী শাসকের অন্যতম লক্ষণ (একটি ৯৫% হয়ে যাওয়া চুক্তিকে বাতিল করে, হিন্দুস্থান এরোনটিক্স লিমিচেডের মতো নামী রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রকে দূরে ঠেলে কেন অনিল আম্বানির নড়বড়ে দেনাগ্রস্ত সংস্থাকে রাফাল বরাত পাইয়ে দেয় সরকার?)।
- বুদ্ধিজীবীদের কণ্ঠরোধ করে চলে ফ্যাসিবাদী শাসক।
আশা রাখি ৭০তম সাধারণতন্ত্র দিবসে অন্য অনেকের মতোই সন্দীপ পাণ্ড্যের গ্রেফতারি ও ভারতরাষ্ট্রের রূপরেখা নিয়ে ভাববেন বন্ধুরা। আশা রাখি আঘাত তুচ্ছ করে নাগরিক সমাজ মতপ্রকাশের লড়াই জারি রাখবেন সংবিধানের কসম খেয়ে।