অভিজিৎ কুণ্ডু
লেখক দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক।
বর্ধিত করপোরেশনের নির্বাচন হিসেবে অনেকেই দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনকে দেখতে চাইবেন। ছোট রাজ্য, গোটা ভারতের ইলেকটোরেটের মাত্র দুই শতাংশ আগামী আটই ফেব্রুয়ারি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেন। রাজ্য বিধানসভার হাতে স্বরাষ্ট্র ক্ষমতাও নেই। হাজারটা সরকারি প্রকল্পের জন্য তাকিয়ে থাকতে হয় লেফটেন্যান্ট গভর্নরের সই-সাবুদের জন্য। সেই রাজ্যের নির্বাচনে কে জিতল, কে হারল তা খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ কি বৃহত্তর ভারতীয় রাজনীতিতে?
২০১৩ সালে ৭০টা বিধানসভার আসনের মধ্যে মাত্র ২৮টা আসন জিতে আম আদমি পার্টি সংখ্যালঘু সরকার গঠন করে। শর্তসাপেক্ষে সমর্থন করেছিল কংগ্রেস। সরকারে এসেই জনলোকপাল বিল পাশ করার প্রশ্নে ‘আপ’ সরকার ইস্তফা দেয় মাত্র উনপঞ্চাশ দিনের মাথায়। প্রসঙ্গত, ২০১২ সালে দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলন থেকেই তৈরি হয় আম আদমি পার্টি। তাই জনলোকপাল ইস্যু ‘আপ’ সরকারের রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু। এই ইস্যুতে ভর করেই ২০১৫ সালে একতরফাভাবে ‘আপ’ জিতে আসে বিধানসভায়। বিরোধী বিজেপি পায় মাত্র তিনটে আসন। বাকি ৬৭টি আসনই ‘আপ’-এর।
২০১৪-তে মোদি ঝড়ের পরপরই দিল্লিতে ‘আপ’-এর এই জয়জয়কার নিশ্চয়ই বিশ্লেষণের দাবি রাখে। কোন অঙ্কে কেজরিওয়াল থামিয়ে দিলেন গেরুয়া ঝড়? যে ভোটাররা কয়েকমাস আগেই বিজেপি প্রার্থীদের লোকসভায় জিতিয়েছেন, তারাই আবার বিধানসভায় মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে বিজেপির থেকে। একেবারে কোণঠাসা হয়ে পড়া বিরোধীরা কিছুটা আশার আলো দেখেছিল। আর উঠে এসেছিল কিছু প্রাত্যহিক জীবনধারণের প্রশ্ন। চাই বিজলি-পানি। সহজলভ্য হতে হবে মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তের প্রাথমিক চাহিদাগুলো। দলীয় নানা টানাপোড়েন, অনেক অভিজ্ঞ পুরনো মুখ পার্টি ছেড়ে চলে গেলেও আম আদমি পার্টির সরকার এই প্রাথমিক দাবিদাওয়া থেকে সরে আসেনি। গত পাঁচ বছরে উল্লেখযোগ্যভাবে বিদ্যুৎ সহজলভ্য করা, পানীয় জলের উন্নত ও বিনামূল্যে সরবরাহ করার প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। জনসাধারণের পরিষেবায় যে রাষ্ট্রের একটা ভূমিকা থাকে, সেটা মেনে নিয়ে এই সরকার কাজ করছে।
সবচেয়ে বেশি সাফল্য দিল্লি সরকার পেয়েছে শিক্ষাক্ষেত্রে৷ যে কোনও রাজ্যের তুলনায় শিক্ষাক্ষেত্রে অনেক বেশি বাজেট এই সরকারের। স্কুলশিক্ষায় দারুণ সব সরকারি পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। ঝাঁ চকচকে আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে এযাবৎকালের বিবর্ণ সব সরকারি স্কুলে। ভালো ফলাফল করছে ছাত্রছাত্রীরা। একটা নিঃশব্দ বিপ্লব ছড়িয়ে গেছে সেইসব স্তরে, এতদিন পাবলিক স্কুল বা উচ্চশিক্ষা লাভ যাদের সাধ্যের বাইরে ছিল। এর বাইরে, মহিলাদের জন্য ফ্রি সরকারি পরিবহন একটি সুচিন্তিত প্রয়াস। আরও বেশি করে পিছিয়ে পড়া সমাজের অংশকে পাবলিক পরিসরে নিয়ে আসার চেষ্টা। শুরু হয়েছে মহল্লা স্বাস্থ্যকেন্দ্র। অর্থাৎ একটা উন্নত জনসেবামূলক সরকারের ছবি মানুষের মধ্যে এনে ফেলতে চাইছে ‘আপ’ সরকার। আগামী নির্বাচনে প্রতিশ্রুতিও জনমোহিনী।
হতে পারে, অনুদান-ভিত্তিক রাজনীতি করছে কেজরিওয়ালের পার্টি। তবে সেই পথেই হাঁটতে চাইছে প্রধান বিরোধী দল বিজেপি। শুনতে একটু অবাক লাগলেও, সারা দেশে ছড়ি ঘোরালেও কেজরিওয়ালের দিল্লিতে বিজেপির পরিচয় বিরোধী শক্তি হিসেবেই। আর খোদ দিল্লিতেই নির্বাচনী পরাজয় ধাক্কা দেয় তাদের পরাক্রমশালী ইমেজে। অনুদানে ভরিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েই প্রচারে নেমেছে গেরুয়া ব্রিগেড। কিন্তু নানা সমীক্ষায় উঠে এসেছে উল্টো ফল। বিজেপির সম্ভাবনা কম। তাই, শেষ লগ্নে এসে সুস্পষ্টভাবে গেরুয়া অ্যাজেন্ডা সামনে এনেছে বিজেপি। ঠিক এখানেই রাজনৈতিক আলোচনায়, সম্ভাব্য নির্বাচনী ফলাফল আলাদা গুরুত্ব পেয়ে গেছে।
নানা রাজনৈতিক প্রশ্নে আম আদমি পার্টি যে খুব গণতান্ত্রিক বা প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েছে, এমনটা নয়। দেখা গেছে, চূড়ান্ত রক্ষণশীল সামাজিক চিন্তাভাবনার সঙ্গে সুর মিলিয়েছেন কেজরিওয়াল। প্রায় সর্বেসর্বা হয়ে উঠেছেন কেজরিওয়াল এই নয়া পার্টিতে। অনেক অভিজ্ঞ, প্রাজ্ঞ ব্যক্তিত্ব নানা রাজনৈতিক কারণে হয় দল থেকে বেরিয়ে গেছেন অথবা বহিষ্কৃত হয়েছেন। তাতে কিন্তু জনসংযোগ বা সরকারি সক্রিয়তায় কোনও ছেদ পড়েনি। অর্থাৎ এখানেই রয়েছে আম আদমি পার্টির সত্যিকারের আম আদমি হয়ে ওঠার রহস্য। স্রোতের সঙ্গে মিশে থাকাই হল এই সরকারের গতিপথ৷ প্রাজ্ঞ রাজনৈতিক বয়ান নেই, আছে প্রাত্যহিক ও ব্যবহারিক সমাজনীতি।
নির্বাচনে জিতে আসার মূল স্লোগান তাই, ‘আচ্ছে বিতে, পাঁচ সাল/লাগে রহো কেজরিওয়াল’। অর্থাৎ একটা ‘হো সকতা হ্যায়’ ইমেজ কেজরিওয়ালের নেতৃত্বে তৈরি করেছে দিল্লি সরকার। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে আম ভারতবাসীর (এক্ষেত্রে দিল্লিবাসীর), কিছু ব্যতিক্রমী রাজ্য বাদে, ধারাবাহিকতার ওপর একটা অদ্ভুত আস্থা। খুব উথাল-পাথাল না হলে জাতীয় রাজনীতিতে চট করে পালাবদল হয় না। একেবারে জীবন-জীবিকার প্রশ্নে সরাসরি আঘাত এলে ভারতীয় ইলেকটোরেট নড়েচড়ে বসে। এর বাইরে অতিবাস্তব আবেগ একমাত্র নির্বাচনী ফলাফলে প্রভাব ফেলে। ঠিক যেমন ঘটেছে গত লোকসভা নির্বাচনে। বিপর্যস্ত ভোটার মননে সব ছাপিয়ে জায়গা করে নিয়েছিল পুলওয়ামা ও সার্জিকাল স্ট্রাইক।
তাই কট্টর সাম্প্রদায়িক দাওয়াই নিয়ে ভোটের শেষ পর্বে হাজির বিজেপি। গত একমাসেরও বেশি সময় ধরে জাতীয় রাজনীতিকে নাড়িয়ে দিয়েছে নাগরিকত্বের নয়া ফরমান। দারুণ আলোড়ন পড়ে দিল্লি শহরে, শুধুমাত্র সংখ্যালঘু অধ্যুষিত জামিয়া নগরেই নয়, শাহিনবাগের মতো ধরনা শহরের এদিকে ওদিকে মাথাচাড়া দিচ্ছে। লাগাতার বৈচিত্র্যময় বিক্ষোভে সারাদেশের মতো শাহিনবাগও ফুটছে। গেরুয়াবাহিনীর কাছে শাহিনবাগের অবস্থান বিক্ষোভ হয়ে উঠেছে সাম্প্রদায়িক তাস খেলার অস্ত্র। কেউ হুঙ্কার দিচ্ছে ‘গোলি মারো শালোঁ কো’, তো কিছু মিডিয়া হাউস সম্প্রচার করছে কাশ্মির থেকে ৩৭০ ধারা উচ্ছেদের মতোই শাহিনবাগকে মুক্ত করতে হবে৷ যেন একটা রেফারেনডাম-এর দিকে চলে যাচ্ছে এই প্রশ্ন। স্বস্তি দিয়েছে অন্তত এই চরম বৈষম্যমূলক নাগরিকত্বের ইস্যুতে দ্ব্যর্থহীনভাবে কেজরিওয়ালের আম আদমি পার্টি সংবিধানের স্বপক্ষে এসে বক্তব্য রেখেছে। আম আদমি পার্টির নির্বাচনী সাফল্য অনেকাংশেই এই বার্তা ছড়িয়ে দিতে পারে যে— না, এখনও ভারতবাসী তার মৌলিক চরিত্র পুরোপুরি হারিয়ে ফেলেনি।
খুব উচ্চ কোনও রাজনৈতিক আদর্শের জিত হবে ‘আপ’ জিতলে, এমনটা ভাবার কোনও কারণ নেই। কারণ ‘আপ’ একটা নয়া সামাজিক আন্দোলনের ফসল। সুসংহত, সংগঠিত রাজনৈতিক দলের যে আদর্শ বা কাঠামো থাকে, সেসব এখানে পাওয়া যাবে না। তাৎক্ষণিক, ইস্যুভিত্তিক নানা সামাজিক শ্রেণির এক জায়গায় আসা রাষ্ট্রের কাছে কিছু চাহিদাপূরণের আশা নিয়ে। শ্রেণিপ্রশ্ন, শ্রেণিসংঘাত এর মধ্যে খুব একটা জায়গা পাবে না। কারণ, নয়া সামাজিক বিন্যাসে মানুষ আজ আপেক্ষিক বঞ্চনার মুখোমুখি। সারসত্য খোঁজার চেষ্টা অনেকটাই ঢেকে গেছে রাষ্ট্রব্যবস্থার নয়া সক্রিয়তায়। তাই আজ ‘আপ’-এর সাফল্য ফুৎকারে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না।
এসব তো গেল তাত্ত্বিক দিক। ব্যবহারিক দিকে, ঘরে ঘরে মহল্লায় মহল্লায় প্রচারের ক্ষেত্রে বৈপরীত্য আছে। একদিকে আছে গগনভেদী কর্কশ চিৎকারে ‘ভারত মাতা কি জয়’, বিজেপিতে গ্রহণযোগ্য কোনও মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থীর অভাবে খোদ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নেতৃত্বে ভোটপ্রচার। অন্যদিকে, চনমনে স্মার্ট তুখোড় স্বেচ্ছাসেবী দিয়ে সাজানো ‘আপ’ প্রচার, গাঁগঞ্জের দিকে ছড়িয়ে পড়েছে গ্রাম্য বা দেহাতি কর্মীর দল যাদের মাথায় ‘আপ’ টুপি। আর শহরাঞ্চলে শহুরে অল্পবয়সীরা। তারা দরজায় দরজায় টোকা মেরে জিজ্ঞেস করছে— “আপনি কি খুশি? না হলে, বলুন কোথায় কোথায় আমাদের খামতি?” সেইসব ‘ফিডব্যাক’ নোটবইতে লেখাও হচ্ছে। যদি এইভাবে হাঁটতে হাঁটতে মানুষের কাছে গিয়ে, তার সুখ-দুঃখের কথা ভাগ করে নিয়ে আটকানো যায় সাম্প্রদায়িক বিষ, তাই বা কম কী?