আবুল আহসান চৌধুরী
লেখক আন্তর্জাতিক স্তরে খ্যাতিসম্পন্ন বিশিষ্ট লোকসংস্কৃতি গবেষক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক, অধ্যাপনা করেছেন চল্লিশ বছরেরও বেশি। প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা শতাধিক। বর্তমান নিবন্ধটি নবজাতক প্রকাশন কর্তৃক কলকাতা বইমেলা ২০২০-তে প্রকাশিতব্য লেখকের 'লোকসংস্কৃতির বিষয়আশয়' গ্রন্থ থেকে গৃহীত।
পণ্ডিতজনের ধারণা, বাঙালি বর্ণ-সঙ্কর জাতি। বহু জনগোষ্ঠীর রক্তের মিশ্রণ ঘটেছে বাঙালির দেহে। অস্ট্রিক-ভাষী আদি অস্ট্রেলীয় জনগোষ্ঠীই বাঙালির আদিপুরুষ হিসেবে স্বীকৃত। অবশ্য কেউ কেউ নিগ্রোবটু জনগোষ্ঠীকেও বঙ্গ-অঞ্চলের আদিম অধিবাসী বলে মনে করেন। এরপর ক্রমান্বয়ে এসেছে দ্রাবিড়, আল্পীয়, আর্যভাষী নর্ডিক, মঙ্গোল, শক-হুন-তুর্কিরা। বাঙালি জাতির রক্তধারায় এদের সকলেরই কিছু না কিছু উপাদান মিশ্রিত হলেও এক্ষেত্রে অস্ট্রিকদের প্রভাবই সবচেয়ে বেশি। বাঙালির ভাষা-সংস্কৃতি মনন-মানস, চিন্তা আচরণের ক্ষেত্রেও অস্ট্রিক-অবদান উল্লেখযোগ্য। ভাষা-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে প্রভাব-প্রাধান্য থাকলেও বাঙালির রক্তধারায় আর্যভাষী নর্ডিকগোষ্ঠীর উত্তরাধিকার খুবই নগণ্য। তুর্কি-মুঘল-পাঠান-ইরানি-আরব এইসব বহিরাগত মুসলমানদের রক্তও মিশেছে বাঙালি জাতির দেহে, কিন্তু তা বাঙালির ‘দেহ গঠন বৈশিষ্ট্যে’ তেমন কোনও উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে পারেনি। মূলত আদি-অস্ট্রেলীয় নরগোষ্ঠীর দেহ-কাঠামোয় অন্যান্য জাতি-গোষ্ঠীর রক্ত মিশে বাঙালির দেহাবয়বে একটি মিশ্ররূপ এনে দিয়েছে। প্রকৃতি ও আকৃতিতে আজকের বাঙালি ভিন্ন ভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মিশ্র প্রতিনিধিত্ব করছে।
২.
বাংলা বা বঙ্গ নামে যে ভূ-খণ্ড বাঙালির আবাস-ভূমি হিসেবে চিহ্নিত, তার উদ্ভবের পূর্বে প্রাচীন সময়ে এই অঞ্চল অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জনপদে বিভক্ত ছিল। পুণ্ড্র, বঙ্গ, সমতট, হরিকেল, বরেন্দ্র, তাম্রলিপ্ত, দণ্ডভুক্তি ইত্যাদি নানা নামে এইসব অঞ্চল পরিচিত ছিল। এ-সবই কৌম-নাম, এখানে বাস ছিল বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর। পরবর্তী সময়ে এই জনপদগুলো ক্রমশ একত্রিত হয়ে তিনটি প্রধান অঞ্চলে বিভক্ত হয়— পুণ্ড্র বা পুণ্ড্রবর্ধন, গৌড় ও বঙ্গ। রাজা শশাঙ্কের আমলে বঙ্গদেশের এক ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় অন্তর্ভুক্তির প্রক্রিয়া শুরু হয়। তবে রাষ্ট্রীয় ঐক্যের পূর্ণ স্বরূপ লাভ করতে আরও বেশ কয়েক শতাব্দী সময় লেগেছিল।
‘বঙ্গ’ নামের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় ‘ঐতরেয় ব্রাহ্মণে’। ‘বোধায়ন ধর্মসূত্রে’ও বঙ্গের উল্লেখ মেলে। তবে এসব উল্লেখে জাতি-বিদ্বেষ ও দেশ-ঘৃণাই প্রকাশ পেয়েছে। পতঞ্জলিকৃত পাণিনির ‘অষ্টাধ্যায়ী’র ভাষ্যে ‘বঙ্গে’র পাশাপাশি ‘সুহ্ম’ ও ‘পুণ্ড্রে’র উল্লেখও আছে। ‘চর্যাপদে’ও ‘বাঙালি’, ‘বঙ্গাল’-এর পরিচয় পাওয়া যায়। পুরাণ-রামায়ণ-মহাভারতেও ‘বঙ্গ’ নামটি উচ্চারিত। ইবনে বতুতার সফরনামায় পাওয়া যায় ‘বঙ্গালা’। মুঘল আমলে বঙ্গাঞ্চল ‘সুবাহ বাঙ্গালাহ্’ নামে অভিহিত হত। এই নাম পর্তুগিজদের কাছে রূপান্তরিত হয়ে হয় ‘বেঙ্গলা’। এরই সাদৃশ্যে ইংরেজরা নাম দেয় ‘বেঙ্গল’ [‘বাংলা, বাঙালি ও বাঙালিত্ব’, আহমদ শরীফ]।
৩.
বাংলার আদিম সমাজ ছিল বৃত্তিনির্ভর জাতিগোষ্ঠীর কৌমসমাজ। বর্ণপ্রথার অভিশাপ থেকে সে সমাজ ছিল মুক্ত। খ্রিস্টপূর্ব যুগেই বঙ্গ-অঞ্চল ব্রাহ্মণ্যধর্মের সংস্পর্শে আসে। গুপ্ত যুগে বৃহত্তর ভারত থেকে আগত ব্রাহ্মণ-বসতি গড়ে ওঠে বাংলায়। অব্রাহ্মণ জাতিসমূহও বিশেষ প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এই সময় পর্যন্ত অব্রাহ্মণ সমাজে জাতিভেদ প্রথার অস্তিত্ব ছিল না। চর্যাপদে নিম্নবর্গের মানুষের পরিচয় ও সামাজিক অবস্থান জানা যায়। শবর, ডোম, চণ্ডাল ও কাপালিক— এরা ছিল অবজ্ঞাত, অস্পৃশ্য, নগর-জনজীবন থেকে বিচ্ছিন্ন। সেন আমলে রাজশক্তির পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে ব্রাহ্মণ্যধর্ম বিশেষ প্রাধান্য লাভ করে। এই সময়েই প্রবর্তিত হয় কৌলিন্য-প্রথা।
প্রাচীন বাংলায় যে বর্ণ-বিন্যাস গড়ে উঠেছিল তাতে সর্বোচ্চ স্থান ছিল ব্রাহ্মণগোষ্ঠীর। শাসক ও সামন্ত শ্রেণির সঙ্গে এদের ছিল গভীর সম্পর্ক। এর পরেই ছিল করণ-কায়স্থের স্থান। বিত্ত ও বিদ্যার কল্যাণে সমাজে এরাও প্রতিপত্তিশালী হয়ে উঠেছিল। অম্বষ্ঠ বৈদ্যদের অবস্থানও ছিল গুরুত্বপূর্ণ। এর বাইরে ছিল যারা তারা প্রায় সকলেই অন্ত্যজ শ্রেণিভুক্ত শ্রমজীবী মানুষ। তবে বর্ণপ্রথার রাষ্ট্রীয়, ধর্মীয় ও সামাজিক স্বীকৃতির পর ব্রাহ্মণ ব্যতীত অন্য সব বর্ণের মানুষই শূদ্র হিসেবে গণ্য হত। সমাজবিন্যাসের এই ধারা অনুসরণ করলে সহজেই বোঝা যায় কীভাবে সামাজিক অনৈক্য ও বিভেদ স্থায়ী রূপ পেয়েছিল।
প্রকৃতপক্ষে তুর্কি বিজয়ের ফলেই মধ্যযুগের বাংলায় অতি-দ্রুত মুসলিম সমাজ-বিস্তারের সুযোগ ঘটে। মূলত সুফি-দরবেশদের মাধ্যমেই এদেশে ইসলাম ধর্ম প্রচারিত হয়। বাংলায় বহিরাগত মুসলমানের সংখ্যা নিতান্ত নগণ্য। নির্যাতিত-অবজ্ঞাত-অধিকার বঞ্চিত নিম্নবর্ণের মানুষই ইসলামের সাম্য-মৈত্রীর আদর্শে উদ্বুদ্ধ ও সুফি দরবেশদের চরিত্র-মাধুর্যে মুগ্ধ হয়ে এবং ঐহিক স্বার্থের কারণে ধর্মান্তরিত হলেও পূর্বপুরুষের ধর্ম-আচার-সংস্কার কখনও সম্পূর্ণ পরিত্যাগ করেনি। হিন্দু সমাজের বর্ণভেদের আদলে মুসলিম সমাজেও গড়ে ওঠে চারটি বর্ণস্তর: আশরাফ, আতরাফ, আজলাফ, আরজাল। উচ্চবর্ণের অভিজাত মুসলমানের সঙ্গে পল্লীবাসী সাধারণ মুসলমানের কোনও বৈবাহিক সম্পর্ক বা সামাজিক লেনদেন ছিল না। এই ব্যবধান ছিল দূরতিক্রম্য। তাই আশরাফ-স্বধর্মীর সঙ্গে নয়— একই সমতলের প্রতিবেশী বিধর্মী হিন্দুর সঙ্গেই তার মানসিক ঐক্য, সামাজিক মেলবন্ধন ও আত্মিক সম্পর্ক রচিত হয়েছে। অভিন্ন আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট, জীবন-বিকাশের অভিন্ন শর্ত, অস্তিত্বরক্ষার সম-স্বার্থ উভয় সম্প্রদায়কে একই সূত্রে বেঁধেছিল। তাই বৃহত্তর বাংলা ও বাঙালির সংস্কৃতি হিন্দু-মুসলমানের মিলিত সাধনারই ফসল।
৪.
মানুষের জীবন-চর্চা ও চর্যার সমন্বিত রূপই সংস্কৃতি। স্যার ই বি টাইলর সংস্কৃতি প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে বলেছেন, “জ্ঞান-বিজ্ঞান, আচার-বিশ্বাস, শিল্পকলা, নীতিবোধ, আইন-কানুন এবং অনুশীলন ও অভ্যাস এবং অন্যান্য সব সম্ভাবনা যা মানুষ সমাজের সদস্য হিসেবে আহরণ করে তাই সংস্কৃতি” [‘সংস্কৃতি ও সংস্কৃতিতত্ত্ব’, বুলবন ওসমান, পৃ. ১৩]। এই সংজ্ঞা অনুসরণ করলে সহজেই বোঝা যাবে সংস্কৃতির পরিধি কত ব্যাপক।
বাংলার সংস্কৃতিকে নগর-সংস্কৃতি, লোকসংস্কৃতি ও আদিম সংস্কৃতি— এই তিন শ্রেণিতে বিন্যাস করা চলে [‘বাংলার লোকসংস্কৃতি’, ওয়াকিল আহমদ, পৃ. ১৪]। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিনির্ভর আধুনিক জীবনযাপনের সুবিধাভোগী শিক্ষিত নগরবাসীর সংস্কৃতিই নগর-সংস্কৃতি। এই সংস্কৃতি মার্জিত-শোভন ও দ্রুত পরিবর্তনশীল, ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা কিংবা স্বতঃস্ফূর্ত প্রেরণায় এর জন্ম নয়। আদিম সংস্কৃতি বাংলার সুদূর অতীতের কৌম সমাজের স্মৃতিনির্ভর আদিবাসীদের সংস্কৃতি। বাংলার লোকসংস্কৃতির সঙ্গে এই আদিম সংস্কৃতির আছে প্রচ্ছন্ন আত্মীয়তা।
প্রকৃতপক্ষে লোকসংস্কৃতিই বঙ্গসংস্কৃতির প্রধান ধারা, এর মর্মমূলেই আবহমান বাংলা ও বাঙালির ইতিহাস-ঐতিহ্য সভ্যতার প্রকৃত পরিচয় প্রোথিত। যথার্থ পরিকল্পিত আধুনিক নগরায়ণ এখনও এদেশে হয়নি। গ্রামীণ সমাজ ও সভ্যতার স্মৃতি ও ছাপ এখনও এই অপরিণত নগরগুলো বহন করছে। জীবন-জীবিকা, আচার-প্রথা ও প্রকৃতিই সংস্কৃতির নিয়ামক। মূলত কৃষি-জীবন ও নদনদী বাংলার সংস্কৃতিকে নির্মাণ ও নিয়ন্ত্রণ করেছে। স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রামই ছিল বাংলার প্রাণকেন্দ্র এবং সংস্কৃতির উৎস, লালন ও বিকাশ-ক্ষেত্র। এই গ্রামকেন্দ্রিক সংস্কৃতির মধ্যেই বাংলা ও বাঙালির আত্মপরিচয় প্রচ্ছন্ন আছে। এই প্রসঙ্গে আহমদ শরীফের একটি উক্তি স্মরণ করা যেতে পারে:
বস্তুত বাঙালির ইতিহাস লোকধর্মের লোকায়ত দর্শনের, লোকসাহিত্যের, লোকশিল্পের, লোকসঙ্গীতের ও লোকবিশ্বাস-সংস্কারের ইতিকথারই অন্য নাম। [‘বাংলা, বাঙালি ও বাঙালিত্ব’, পৃ. ৯]
৫.
গোপাল হালদার হাজার বছরের প্রবহমান বঙ্গসংস্কৃতিকে ‘পল্লীপ্রধান বাঙালি সংস্কৃতি’ বলে অভিহিত করেছেন [‘সংস্কৃতির রূপান্তর’, পৃ. ২১৭]। আফসোস করে তিনি এই প্রসঙ্গে বলেছেন, “অত্যন্ত পরিচিত বলিয়াই আমরা তাহার সহজ ও অনাড়ম্বর উপকরণ ও উপাদানকে আমাদের সংস্কৃতির প্রধান অবলম্বন বলিয়া ভাবিতে কুণ্ঠিত হই” [ঐ, পৃ. ২১৭]।
বাংলার লোকসংস্কৃতির জগত বিচিত্র ও ব্যাপক। লোকসমাজের জীবনাচরণ ও ভূয়োদর্শনের প্রতিফলন আছে লোকবিশ্বাস, লোকসংস্কার আর লোকাচারে। পালা-পার্বণ-বিবাহ-ক্রীড়া-মেলা-নবান্নে মূর্ত হয়ে ওঠে উৎসব-আনন্দের রূপ। প্রাত্যহিক জীবনযাপনের অনুষঙ্গে আসে পোশাক-পরিচ্ছদ-প্রসাধন-খাদ্যের কথা। শিল্পকলার মোহন ভুবনে রচিত হয়েছে প্রয়োজনে ও সৌন্দর্যের অনন্ত সখ্য। লোকসাহিত্যে জীবনের উপলব্ধি ও আনন্দ-বেদনার আলেখ্য চিত্রিত। এইসব উজ্জ্বল প্রাণময় উপাদানেই রচিত হয়েছে লোকসংস্কৃতির সাতনরী।
বাংলার লোকসংস্কৃতি বঙ্গজনপদবাসীর যৌথ জীবনচর্চার এক আন্তরিক ভাষ্য। সমন্বয়, সহাবস্থান ও সৌহার্দ্যের এক অপূর্ব নিদর্শন বাংলার এই লোকসংস্কৃতি। ইতিহাস-পূর্বকালের বঙ্গ-জনপদের আদিম অধিবাসীদের বিশ্বাস-সংস্কার ও লোকাচারকে কেন্দ্র করেই এই লোকসংস্কৃতির জন্ম। নানা জনগোষ্ঠীর রক্তের মিশ্রণে যেমন বাঙালি জাতি গড়ে উঠেছে, তেমনই তার সংস্কৃতি সম্পর্কেও এ-কথা সত্য। সুদূর অতীতের স্মৃতিচিহ্নবাহী বাংলার লোকসংস্কৃতি তাই ‘বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যে’র ধারণাটি সার্থক করে তুলেছে।
বাংলার লোকসংস্কৃতির উপাদান বিশ্লেষণ করলে পাওয়া যায় আনন্দ-রূপের সন্ধান, প্রবল জীবনাগ্রহ, প্রতিবাদী চেতনা, ধর্ম-নির্বিশেষ মানুষের কথা, মানবিকতা ও ইহজাগতিকতার পরিচয়। লোকায়ত বাংলার উদার মানবিক জমিনের অধিবাসী বাঙালি জনগোষ্ঠী চিরকালই ভাববিদ্রোহী, মিলনপ্রয়াসী, সমন্বয়পন্থী। ‘বিবাদে-বিরোধে-বর্বরতা’— এ-কথা লৌকিক সমাজের মানুষ তাদের জীবনাচরণে সত্য করে তুলেছে। আমরা বাংলার লোকসংস্কৃতির সাধারণ রূপের প্রেক্ষাপটে তার সমাজ-সংলগ্ন ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে পরিচিত হতে চাই, যার সূত্রে আধুনিককালে লোকসংস্কৃতির প্রাসঙ্গিকতা ও তার প্রগতিশীল উপকরণ আবিষ্কৃত হয়ে বর্তমান প্রজন্মকে প্রাণিত ও শ্রদ্ধাশীল করে তুলতে পারে।
৬.
লোকসংস্কার ও লোকবিশ্বাসের সঙ্গে সুদূর অতীতের টোটেম, ট্যাবু ও জাদু-বিদ্যার সম্পর্ক অতি নিবিড়। সঙ্কট-শঙ্কা-অমঙ্গল দূরীকরণের পন্থা-পদ্ধতির সঙ্গে লোকবিশ্বাস ও সংস্কারের গভীর যোগ। ব্রত-মানত-বশীকরণ-জাদু-মন্ত্র-ঝাড়ফুঁক-টোটকা-তাবিজ ইত্যাদির মাধ্যমে ইচ্ছাপূরণ ও মুশকিল আসানের চেষ্টা চলে। এই ক্ষেত্রে যে আচার-পদ্ধতি তা অনেকাংশেই কোনও ধর্মীয় শাস্ত্রাচার অনুসরণ করে না। লোকবিশ্বাস ও সংস্কারে ধর্মের শাসন-গণ্ডি হামেশাই অতিক্রান্ত হয়ে যায়। গার্সি বা ওলাবিবি-ভিটেকুমোরের পূজা, পীর-দরবেশের দরগায় মানত— এ-সব ক্ষেত্রে হিন্দু-মুসলমানের ভেদাভেদ লুপ্ত। মুসলমান কৃষকের মনসা-তুষ্টির পূজা কিংবা হিন্দু মাঝির ‘বদর বদর’ বলে যাত্রা শুরু এ-সব লোকসংস্কারের অন্তর্গত, যা প্রজন্ম পরম্পরায় প্রচলিত। বৃষ্টিকামনায় যেমন কোনও পল্লীবাসী কৃষিনির্ভর হিন্দু ‘আল্লাহ মেঘ দে পানি দে ছায়া দে-রে তুই’ এই গান গাইতে অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে না, তেমনই হিন্দু দেব-দেবীর নাম নিয়ে সাপের মন্ত্র-উচ্চারণে মুসলমান ওঝারও কোনও দ্বিধা থাকে না। আসর-বন্দনায় ভক্তি-নিবেদনে আল্লাহ-ভগবান রসুল-দেবতা সম-পাঙক্তেয়, একই নিঃশ্বাসে উচ্চারিত।
বাংলার লোকাচারেও সম্প্রদায়-নির্বিশেষে অভিন্নতার সূত্র খুঁজে পাওয়া যায়। জন্ম, বিবাহ, মৃত্যু, কৃষিকর্ম এইসব নানা বিষয়ে প্রাচীনকাল থেকে প্রচলিত লোকাচার বাঙালির জনজীবনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। বন্ধ্যা নারীর সন্তান-কামনা, গর্ভবতী রমণীর ‘সাধভক্ষণ’, সন্তান জন্মের পর অনিষ্ট-ভঞ্জন সর্তকতা ও বিবাহের কিছু আচার লোকসমাজে অভিন্ন। কৃষি-সম্পর্কিত লোকাচারেও গভীর সাদৃশ্য আছে। বৃষ্টি-কামনা, বীজ-বপন, ফসল-রক্ষা, ফসল-তোলা ইত্যাদি ক্ষেত্রে যে লোকাচার পালিত হয় তাতে কৃষিজীবী সমাজের ঐক্য-একাত্মতার আন্তরিক চিত্র ফুটে ওঠে।
বাংলার লোকজীবনে আবাস-আসবাব-খাদ্য-পরিধেয়-প্রসাধন-অলঙ্কার-তৈজসপত্রও মূলত এক। খড় বা ছনের দোচালা ঘর, পাটকাঠি বা কঞ্চির বেড়া, একপাশে গোয়ালঘর, এক চিলতে উঠোন, চারপাশে গাছ-গাছালি— গ্রামীণ মানুষের বাস্তুগৃহের এই হল সাধারণ ছবি। মাদুর-কাঁথা, বাঁশের মাচা কিংবা মাটির মেঝে— শয়নের উপকরণ। তৈজসপত্রের মধ্যে মাটির হাঁড়ি-পাতিল-সানকি-কুঁজো, কাঁসার থালা-বাটি-ঘটি-ঘড়া। কেবল স্ব স্ব সম্প্রদায়ের শাস্ত্রনিষিদ্ধ আহার-সামগ্রী বাদে বাঙালিসমাজের খাদ্যাভ্যাসও প্রায় অভিন্ন। লোকায়ত বাঙালির পোশাক-পরিচ্ছদও ছিল এক— ধুতি, লুঙ্গি, চাদর, গামছা, ফতুয়া ইত্যাদি। আর মোটা সুতোর তাঁতের শাড়ি গ্রাম্য রমণীর সর্বজনীন আটপৌরে পোশাক। কোনও কোনও অঞ্চলে হিন্দু সধবার মতো বিবাহিত মুসলিম রমণীর শাঁখা-সিঁদুর ব্যবহারের কথাও জানা যায়।
প্রমোদ-বিনোদন-ক্রীড়ার ক্ষেত্রেও সম্মিলিত অংশগ্রহণের বাতাবরণ ও অবাধ সুযোগ ছিল। নৌকাবাইচ, লাঠিখেলা, দাড়িয়াবান্ধা কিংবা হা-ডুডু এইসব লৌকিক ক্রীড়ার রূপ ছিল সর্বজনীন। মেলা কিংবা নবান্নের উৎসব-অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। বাংলার প্রায় সব লৌকিক মেলাই ধর্মাশ্রিত, তা সাধু-গুরুর জন্ম-মৃত্যু, পূজা-পার্বণ কিংবা ঈদ-মোহররমকে কেন্দ্র করে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। উপলক্ষ ধর্মীয় উৎসব হলেও মেলার মেজাজ-চেহারা কিন্তু পুরোপুরি ধর্মনিরপেক্ষ, আর্থ-সাংস্কৃতিক চেতনায় তা লালিত।
স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রাম-সমবায়ের আনুকূল্যে বাংলায় এক সমৃদ্ধ লোক-শিল্পকলার ঐতিহ্য গড়ে উঠেছিল। মূলত জীবনের প্রাত্যহিক প্রয়োজন ও চাহিদাই ছিল এই শিল্পকলার প্রেরণা এবং তা সিদ্ধ করেই এর মধ্যে শিল্পবোধ আর সৌন্দর্যচেতনার স্বাক্ষর প্রতিফলিত হয়েছে। নকশা-আলপনা, লোকচিত্র-মৃৎ-ধাতু-বেত-কাঠ-সূচি-বয়ন বা বাস্তুশিল্প-লোকশিল্পকলার এই যে বিশাল জগৎ এতে বাংলার লোকশিল্পীদের মেধা, নৈপুণ্য, উদ্ভাবনা ও শিল্পবোধের পরিচয় বিধৃত। লোকবিজ্ঞানী এই লোকশিল্পের মধ্যে যে সম্প্রদায়-নিরপেক্ষ অভিন্ন শিল্পচেতনা খুঁজে পান তা তাৎপর্যপূর্ণ: “এই শিল্পকলার মধ্যে কোনও সাম্প্রদায়িকতা নেই। হিন্দু বাঙালি তার লক্ষ্মীর পা, ঝাঁপি কিংবা সরায় যে বক্তব্য রাখেন, বাঙালি মুসলমান জায়নামাজ ও মহরমের বিচিত্র মটিফসম্পন্ন পিঠেতেও সেই একই বক্তব্য রাখেন। উদ্দেশ্যও একই। ধর্মের মধ্যে যা মহৎ তাকে উৎসাহিত করা” [‘বাংলাদেশের লৌকিক ঐতিহ্য’, আবদুল হাফিজ, পৃ. ১৮]।
বাঙালিসমাজ এক ঐতিহ্যপূর্ণ সমৃদ্ধ লোকসাহিত্যের গর্বিত উত্তরাধিকারী। ছড়া-ধাঁধা-প্রবাদ-মন্ত্র-কিংবদন্তি-লোকশ্রুতি-লোককথা-লোককাহিনি-গীতিকা ও গীতির এক বিপুল ঐশ্বর্য ভাণ্ডার নিয়ে গড়ে উঠেছে বাংলার লোকসাহিত্য। লোকসংস্কৃতির অধিকাঠামোর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ এই লোকসাহিত্য। বাঙালি-মানসের, তার শিল্প-চিত্তের গভীর পরিচয় এখানে ফুটে উঠেছে। লোকসাহিত্যের অন্তর্গত শিল্প-নিদর্শনের মধ্যে লোক-সাধনাশ্রয়ী সম্প্রদায়-গীতি ব্যতিরেকে আর সবই সমাজে সমষ্টিগত সৃষ্টি, যা কালান্তরে প্রসারিত। প্রজন্ম পরম্পরায় লালিত এইসব রচনায় সমাজ-অভিজ্ঞতার স্মৃতি জড়িয়ে আছে, কখনও কখনও ইতিহাসের টুকরো ছবিও দুর্লক্ষ্য নয়। অজ্ঞাতনামা লোককবিদের রচিত গানে পলাশী-যুদ্ধের স্মৃতি, নীল-বিদ্রোহের কথা, গণ-আন্দোলনের চিত্র অম্লান হয়ে আছে। টিপু পাগলার বিদ্রোহ, তিতুমীরের সংগ্রাম, ক্ষুদিরামের আত্ম-বলিদান স্বতঃস্ফূর্ত আবেগের প্রেরণায় লোককবির কাছে ধরা দেয়।
সামন্ত-সমাজের নির্মম শোষণ, শ্রেণিবিভক্ত সমাজের অবিচার, শাস্ত্রাচারশাসিত ধর্মের হৃদয়হীন প্রভুত্ব সমাজে ভাববিদ্রোহী বাউলের জন্ম দিয়েছে। শাস্ত্রদ্রোহী, জিবনজিজ্ঞাসু বাউলসম্প্রদায় সামাজিক বিভেদ, অনৈক্য ও শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে এক ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করে। এই দর্শন-দারিদ্র্যের দেশে বাউলসমাজই অধ্যাত্মসাধনার মোড়কে একটি জীবনবাদী দার্শনিক তত্ত্ব উপহার দিয়েছে। বাউলগান ও সমানধর্মা মরমিসঙ্গীতে তত্ত্ব ছাপিয়ে মানববন্দনা, মর্ত্যপ্রীতি, সম্প্রদায়-সম্প্রীতি ও মানবিকতাবোধের অন্তরঙ্গ প্রকাশ লক্ষ করা যায়।
বাউলমতের শ্রেষ্ঠ ভাষ্যকার ফকির লালন সাঁইয়ের গানে জাতধর্মের বিভক্তি, ছুঁৎমার্গ, অস্পৃশ্যতা নিন্দিত হয়েছে। বর্ণভেদ ও মৌলবাদের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন আপসহীন। ধর্মীয় জাতিত্বে অবিশ্বাসী লালন তাই জাত হাতে পেলে আগুন দিয়ে পোড়ানোর অঙ্গীকার করেছেন। মানবতার আদর্শে অনুপ্রাণিত লালন সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদ লুপ্ত করার পক্ষে দৃঢ় মত প্রকাশ করেছেন। ইহজাগতিকতার উচ্চারণও শুনি লালনের গানে:
এমন মানব-জনম আর কি হবে।
মন যা করো ত্বরায় করো এই ভবে।।
অনন্তরূপ সৃষ্টি করলেন সাঁই
শুনি মানবের উত্তম কিছুই নাই
দেব-দেবতাগণ করে আরাধনজন্ম নিতে মানবে।।
কত ভাগ্যের ফলে না জানি
মন রে পেয়েছ এই মানব-তরণী
বেয়ে যাও ত্বরায় সুধারায়যেন ভরা না ডোবে।।
শুধু তাই নয়, লালন ফকির, লোক সমাজের এই মহত্তম আধ্যাত্মিক-সাংস্কৃতিক প্রতিনিধি জমিদারের পীড়ন-অত্যাচারের বিরুদ্ধে একতারা ফেলে লাঠি নিয়ে রুখে দাঁড়াতেও পিছ-পা হননি। লালনের শিষ্য দুদ্দু শাহও ছিলেন সামাজিক অঙ্গীকারে দৃঢ়-দৃপ্ত মুক্তমনের সাধক-বাউল। সব মিলিয়ে বলা যায়, দূর অতীতের কৃষিসমাজের স্মৃতিবাহী বাউলগান বাংলার লোকসংস্কৃতির এক উজ্জ্বল অধ্যায়।
৭.
বাংলার লোকসংস্কৃতিতে সম্প্রীতি ও সমন্বয়ের যে রূপ প্রতিফলিত তার আভাস আমরা দিয়েছি। এই লোকসংস্কৃতির মূলধারাটি প্রবল জীবনাগ্রহ ও মানবিক চেতনাবোধের ভেতর দিয়ে ইহজাগতিকতায় সমর্পিত। সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় জীবনের সঙ্কট-সমস্যাতেও লোকসংস্কৃতির জনক-ধারকেরা সাহসী ভূমিকা পালন করেছেন। ছড়া-গীতি-গীতিকায় আছে সংগ্রামী ও প্রতিবাদী চেতনার স্বাক্ষর। প্রকৃতপক্ষে জীবনঘনিষ্ঠতা ও সমাজ-সংলগ্নতা বাংলার লোকসংস্কৃতিতে একটি জীবনবাদী ভিন্ন মাত্রা যুক্ত করেছে।
এই লোকসংস্কৃতি চর্চার ভেতর দিয়েই একদিন বাঙালির আত্মানুসন্ধান ও স্বরূপ-অন্বেষার সূচনা হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন তার ঋত্বিক। গুরুসদয় দত্ত এই লোকসংস্কৃতির নানা উপাদান নিয়েই গড়ে তুলেছিলেন তাঁর ব্রতচারী আন্দোলন। বাঙালির জাতিসত্তার স্বরূপ উদঘাটনের জন্য লোকসংস্কৃতিই ছিল অন্যতম অবলম্বন। এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের স্বদেশি যুগের গানের কথা উল্লেখ করতে হয়। সারিগান-ভাটিয়ালি-কীর্তন কিংবা বাউলের সুর বসিয়ে রচনা করা তাঁর সেইসব স্বদেশি গান, কী অবিস্মরনীয় উদ্দীপনা জাগিয়েছিল বাঙালির মনে তা আজ ইতিহাসের অন্তর্গত। ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’— যে গানটি আজ বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত, সেই গানের কথা ও সুরের জন্যেও রবীন্দ্রনাথকে শিলাইদহের গগন হরকরার বাউল গানের কাছে যেতে হয়েছিল। চারণকবি মুকুন্দ দাসের স্বদেশি যাত্রা ও গান বাঙালিকে মুক্তি-পাগল করেছিল। আমাদের দেশের সংগ্রাম-আন্দোলনেও লৌকিক সমাজের কবি ও গায়কদের বিশেষ ভূমিকা আছে। ভাষা আন্দোলনের গান বেঁধে এক বাউল কবি, মহিন শাহ, পুলিশের হাতে লাঞ্ছিত হন।
লোকসংস্কৃতি বাঙালি জীবনের এক স্বতঃস্ফূর্ত প্রেরণা। তবুও কোনও কোনও নগর-সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক সভ্যতাগর্বী শিক্ষাভিমানী পণ্ডিত অবজ্ঞা, তাচ্ছিল্য আর উন্নাসিকতায় লোকসংস্কৃতিকে খারিজ করতে চান। প্রসঙ্গত এখানে প্রখ্যাত লোকবিজ্ঞানী আশুতোষ ভট্টাচার্যের একটি উক্তি উদ্ধৃত করতে চাই:
বাংলার সংস্কৃতি বাংলার পল্লীতেই জন্ম ও পরিপুষ্টি লাভ করিয়াছে। সেইজন্য আজ যে নাগরিক সংস্কৃতি এ দেশের উপর স্পর্ধিত শির উন্নত করিয়া দাঁড়াইতে চাইতেছে, তাহা কিছুতেই জাতির মর্মমূলে নিজের শিকড় প্রবেশ করাইতে পারিতেছে না। উপরের দিকে হইতে ইহাকে যতই শক্তিশালী বলিয়া মনে হইতেছে; ভিতরের দিক হইতে তাহা ততই শক্তিহীন হইয়া পড়িতেছে। অতএব কল্যাণের পথে সমাজকে যাঁহারা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করিতে চাহেন, ধ্বংসোন্মুখ পল্লীজীবনের মধ্যেই এখনও তাঁহাদিগকে বাঙালি সংস্কৃতির মৌলিক উপাদানের সন্ধান করিতে হইবে। [‘বাংলার লোকগীতি’, আশুতোষ ভট্টাচার্য]।
জাতির ক্রান্তিলগ্নে কিংবা জাগৃতি-মুহূর্তে তার ঐতিহ্যলগ্ন আত্মপরিচয় সম্পর্কে কৌতূহল ও সন্ধিৎসা জাগে, যেমন জেগেছিল বাংলাদেশের ভাষা-আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের কালে। গ্রাম এবং তার সংস্কৃতিই আমাদের যথার্থ পরিচয়ের ঠিকুজি। বিশাল বাংলার যে গ্রামকে নিয়ে আমাদের সংস্কৃতি, সভ্যতা, আমাদের স্মৃতি-স্বপ্ন, গৌরব, ঐতিহ্য, আমাদের ইতিহাস— তাকে আবিষ্কারের মাধ্যমেই আমাদের জাতিসত্তার স্বরূপ উন্মোচিত হবে। সেই হবে বিস্মৃত-বিভ্রান্ত বাঙালির সত্যিকারের ‘স্বদেশ প্রত্যাবর্তন’। প্রসঙ্গক্রমে বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের আন্তরিক, গাঢ়, শিকড়-সন্ধানী এক উচ্চারণ দিয়ে বক্তব্য শেষ করি:
…গ্রামের পর গ্রামে নিজেদের আবিষ্কার করেছি, নিজেদের বিদ্রোহের ঐতিহ্য, বিদ্রোহের সংস্কৃতি, যাতে পুনর্বার না হারি। এ বেঁচে থাকার লড়াইতে জিততেই হবে। এখান থেকে তৈরি হবে সভ্যতার বোধ, যে বোধের ভিত্তিতে আছে সমতা, কেন্দ্রে আছে সহমর্মিতা, মূল এবং চতুর্দিকে আছে মানুষ। তাহলেই আমরা সকল আবেগ দিয়ে ভালোবাসব এবং ঘৃণা করব; সকল বৈপরীত্যে সততার সঙ্গে জীবনযাপন করব, সঙ্কল্পে দৃঢ় হয়ে সমাজে পরিবর্তন তৈরি করব উন্মাদক বন্যতা, বর্বরতা, দাসত্ব এবং নির্যাতন শেষ। [‘বাংলাদেশের গ্রাম’, পৃ. ৭৮-৭৯]।
তথ্যসূত্র
- অতুল সুর: ‘বাংলার সামাজিক ইতিহাস’। কলকাতা, কার্তিক ১৩৮৩।
- আবদুল হাফিজ: ‘বাংলাদেশের লৌকিক ঐতিহ্য’। ঢাকা, কার্তিক ১৩৮২।
- আবু জাফর শামসুদ্দীন: ‘লোকায়ত সমাজ ও বাঙালি সংস্কৃতি’। ঢাকা, ভাদ্র ১৩৯৫।
- আবুল আহসান চৌধুরী: ‘লালন শাহ্’। ঢাকা, ১৩৯৬।
- আশরাফ সিদ্দিকী: ‘লোকসাহিত্য’। ঢাকা, ১৯৬৩।
- আশুতোষ ভট্টাচার্য: ‘বাংলার লোকশ্রুতি’। কলকাতা, দ্বি-স, শ্রাবণ ১৩৯২।
- আহমদ শরীফ: ‘বাংলা, বাঙালি ও বাঙালিত্ব’। কলকাতা, জানুয়ারি ১৯৯২।
- ওয়াকিল আহমদ: ‘বাংলার লোকসংস্কৃতি’। ঢাকা, আশ্বিন ১৩৮১।
- গোপাল হালদার: ‘সংস্কৃতির রূপান্তর’। ১ম বাংলাদেশ সংস্করণ, ঢাকা, এপ্রিল ১৯৭৪।
- নীহাররঞ্জন রায়: ‘বাঙালির ইতিহাস – আদিপর্ব’। কলকাতা, পুনর্মুদ্রণ, অগ্রহায়ণ ১৩৮২।
- বিনয় ঘোষ: ‘বাংলার লোকসংস্কৃতির সমাজতত্ত্ব’। কলকাতা, আশ্বিন ১৩৮৬।
- বুলবন ওসমান: ‘সংস্কৃতি ও সংস্কৃতিতত্ত্ব’। ঢাকা, জুলাই ১৯৭৭।
- বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর: ‘বাংলাদেশের গ্রাম’। ঢাকা, মাঘ ১৩৯০।
- শামসুজ্জামান খান সম্পাদিত: ‘বাংলাদেশের লোকঐতিহ্য’। ঢাকা, ভাদ্র ১৩৯২।
এই প্রতিষ্ঠিত সমাজ বর্ণনায় আমরা নেই। নবাবি আমল অবদি চাষী কারিগর এবং হকারদের প্রচেষ্টায় দেশ উদ্বৃত্ত অর্থনীতিতে কেন পরিণত হয়েছিল, সেটা এই ধরণের প্রতিষ্ঠিত সমাজবীক্ষায় ধরা দেয় না বলেই আমাদের মনে হয়েছে। আমরা বিশেষ করে সমাজতাত্ত্বিক আর লোকসংস্কৃতিবিদেরা মূলত পশ্চিমের তত্ত্বে দেশ দেখেছেন। এর বাইরে বেরোনো দরকার। এই ঔপনিওবেশিক বয়ানের একটা ঔপনিবেশিক ঐতিহাসিক প্রেক্ষপট আছে, সেটাও বোঝা জরুরি। এর মধ্যে যে কোনও সত্য নেই বলছি না, কিন্তু নবাবি আমল কারিগর দাদন চুক্তি ছেড়ে বেরিয়ে যেতে পারত, রাষ্ট্র বা ক্ষমতার কোনও অধিকার ছিল না তাকে এই কাজে বাধ্য করে, সুশীল চৌধুরী বা ওম প্রকাশ এ অব নিয়ে বিশদে আলোচনা করেছেন।
সামন্ততন্ত্র বুঝতে আহমেদ ছফা মাস্টারমশাই রেজ্জাক স্যরকে প্রশ্ন করেছিলেন, সেটা তুলে দিলাম
একদিন বিকেলবেলা রজ্জাক স্যারের কাছে গিয়ে বিষয়টি উত্থাপন করলাম। বললাম, স্যার বাংলাদেশেরে বর্তমান সামাজিক অবস্থান কোথায়? এটা আধা-সামন্ততান্ত্রিক সমাজ একথা সত্যি?
…বললেন, ইন দ্য স্ট্রিকটেস্ট সেন্স অভ দ্য টার্ম ইন্ডিয়াতে কোন ফিউডালিজম আছিল না। বেঙ্গলের কথা ত এক্কেবারে আলাদা। বেঙ্গলের কথায় পরে আইতাছি। তার আগে রেস্ট অভ দ্য ইন্ডিয়ার খবর লই।
ফিউডালিজম অইল একটা ক্লোজড সিস্টেম। বংশপরম্পরা একটা পরিবার স্থায়ী অইয়া একটা জায়গায় বাস করব। তার ধোপা, নাপিত, কামার, কুমার সব আলাদা। এক জায়গার মানুষ অন্য যায়গায় যাইবার পারব না। কাঁঠালের যেমন কোয়া, ফিউডাল সিস্টেমের সামন্তের জমির সঙ্গে সকলের তেমন সম্পর্ক। সামন্তরা অইল নিজের জমিদারিতে সমস্ত দণ্ডমুণ্ডের মালিক। রাজসভায় ঠিকমত হাজিরা দিতে পারলে আর যুদ্ধের সময় ঠিকমত সৈন্য পাঠাইবার পারলে এক্কেবারে সাত খুন মাফ। ইন্ডিয়াতে মোগল আমলের কথা ধরেন, জমিদারি এখানে বংশানুক্রমিক আছিল না। সম্রাট ইচ্ছা করলে জমিদারের পোলারে জমিদার নাও বানাইতে পারতেন।
আর যদি বেঙ্গলের কোথায় আইয়েন, তাহলে এক্কেবারে অন্য কথা বলতে অয়। পুরানা বাংলা পুঁথিতে দেখা যায় বাংলার বাণিজ্যবহর জাভা সুমাত্রা এইসকল অঞ্চলে যাওয়া-আসা করছে। যেখানে বাণিজ্য এইরকম সচল থাকে সেই সমাজটারে অন্য যা ইচ্ছা কইবার চান কন, কিন্তু ফিউডালিজম বলবার পারবেন না। ভইটফোগেলের হাইড্রলিক থিয়োরি বেঙ্গলের বেলায় এক্কেবারে খাটে না