সোনালী চক্রবর্তী
আন্তর্জাতিক সাহিত্যের ইতিহাসে যে নক্ষত্র তাঁর বিষাদের দ্যুতিতে চিরব্যাতিক্রমী, তিনি সিলভিয়া প্লাথ। ভাবতে বিস্ময় জাগে, কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটির বিদুষী, ১৯৩২ সালে জন্ম নেওয়া আমেরিকান সুন্দরী সিলভিয়া কী গভীর বিষাদে মাত্র ৩১ বছরের জীবদ্দশায় রচনা করেছিলেন “The Colossus and Other Poems”, “Ariel”, “Lady Lazarus” এবং প্রায় আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস “The Bell Jar” যা তার আত্মহননের সামান্য কিছু আগে প্রকাশিত হয়। প্রায় নিয়মিতভাবে তাঁর বিষাদের উপশমে মনোবিদরা প্রয়োগ করতেন ইলেকট্রিক শক। সবাইকে ব্যর্থ করে জ্বলন্ত ওভেনে মাথা ঢুকিয়ে ফ্রিডা আর নিকোলাসের মা, কবি টেড হিউজের স্ত্রী, ওটো আর অরেলিয়ার সন্তান সিলভিয়া জীবনের মতো মৃত্যুতেও তার শেষ কবিতা খুঁজে নেন। তিনিই সূচনা করেছিলেন ‘Confessional Poetry’ নামের লিটারারি মুভমেন্টের। ১৯৫৫ সালে মাত্র ২৩ বছর বয়সে পেয়েছিলেন ‘Glascock Prize’ আর ১৯৮২ সালে মরণোত্তর ‘Pulitzer Prize for Poetry’।
সিলভিয়া প্লাথের কবিতা
সিন্ডারেলা
আরক্তিম রেকাবের মেয়েটির উপর রাজপুরুষটি ঝুঁকে থাকে,
যখন তালের সম কিছুটা মন্দ হয়ে আসে আর উল্টে যাওয়া বেহালায় ঘূর্ণিরা প্রসারিত হতে থাকে,
মেয়েটির সবুজ চোখ চমকে ওঠে,
রুপোর পাতের মতো চুলগুলো ফ্যানের হাওয়ায় ঝলসায়।
সুউচ্চ কাঁচ প্রাসাদের ঘরটিতে সবকিছুরই যেন অবিরাম পুনরাবৃত্তি,
যেখানে অতিথিরা মসৃণ আলোয় পিছলে যায় মহার্ঘ্য সুরার মতো,
ফুলেল বেগুনি দেওয়ালে গোলাপ সুগন্ধি মোমেরা ঝিকিয়ে প্রতিফলিত করে
লক্ষ লক্ষ বিপুলাকৃতি বোতলের উজ্জ্বলতা।
স্বর্ণখোদিত মিথুনেরা যেন এক ঘূর্ণন সম্মোহনে
অনুসরণ করে চলে সুদূর অতীতে শুরু হওয়া ছুটির দিনের আমোদ প্রমোদ,
যতক্ষণ না কাঁটা বারোটার কাছাকাছি পৌঁছায় আর আজব মেয়েটি হঠাত করে বিরতি নেয় অপরাধের অবদমন রুখতে,
ফ্যাকাশে হয়ে যায়,
আঁকড়ে ধরে তার রাজপুত্তুরকে।
কারণ,
বিভ্রান্তিকর সঙ্গীত আর মন্থিত পানীয়ের ভিতরে মেয়েটি অনিবার্য শুনতে পায়
দেওয়াল ঘড়ির মর্মান্তিক টিকটিকানি।
এক অভ্যুদয় বিশেষ…
রেফ্রিজারেটরদের মৃদু হাসি আমায় সম্পূর্ণ বিনষ্ট করে দেয়,
আমার প্রেমিকাটির শোণিত শিরায় এমনই অশ্লীল বিদ্যুৎপ্রবাহ,
আমি শুনতে পাই তার বিশাল হৃদয়ের গরগর আওয়াজ।
তার ঠোঁট থেকে প্রতি মুহূর্তে আর শতাংশে চুম্বনের মতো সঙ্কেতের নিষ্ক্রমণ হয়,
তার প্রবৃত্তিতে কি সপ্তাহের সূচনা এখন? নীতিশাস্ত্র?
সাফাইয়ের পর ইস্ত্রি করে নিজেদের উপগত করা,
এই স্ববিরোধিতায় আমার করণীয় কি?
আমি পরিধান করি সফেদ হাতকড়া আর নুয়ে পড়ি।
এই কি তাহলে প্রেম? এই রক্তাভ বাস্তব?
ইস্পাতের সূঁচ থেকে উৎসারিত হয়ে যা কানামাছি হয়ে যায়?
এটি তো ছোট্ট ছোট্ট পোষাক আর আচ্ছাদনের নির্মাণকারী।
এটি রক্ষা করে একটি সাম্রাজ্যকে,
কীভাবে তার দেহ আবৃত আর অনাবৃত হয়,
একটি শৌখিন দুর্মূল্য হাতঘড়ি,
প্রতিটি কবজাই রত্নখচিত।
হৃদয় আমার… এ তো অরাজকতা,
নক্ষত্রেরা ঝলসাচ্ছে যেন করাল সংখ্যাসমূহ,
আর তার চোখের পাতারা গতের নামতা পড়ছে।
স্বকামিনীর অন্তর্জগতে…
প্রাণবন্ত, প্যাঁচানো, পরিণত-অতিক্রান্ত দুরত্বের খণ্ডগুলি যেমন,
নাবিকের মোটা খসখসে ওভারকোটের মধ্যে, স্বকামনার অভ্যন্তরে, পার্সি বশ্যতা স্বীকার করে,
ফুসফুসের কিছু থেকে পুরুষটি তখন ক্রমশ আরোগ্যলাভের দিকে।
স্বকামগুলিও অবনত হতে থাকে বৃহৎ কিছুতে,
তারা বিহ্বল করতে থাকে সবুজ উপত্যকার উপর তার নক্ষত্রগুলিকে যেখানে পার্সি সূঁচের ফোড়ের তকলিফকে পরিচর্যা করে আর হাঁটতে থাকে, হাঁটতেই থাকে।
বিষয়টিতে একটি সম্ভ্রম রয়েছে, একটি নিয়মানুগত্য,
ফুলগুলি পটির মতো তীব্র আর পুরুষটি সংস্কারে রত,
তারা আনত হয় আর টিঁকে থাকে,
তারা বরদাস্ত করে আকস্মিক আক্রমণ।
অশীতিপরটি ভালবাসে ক্ষুদ্র যূথগুলিকে,
সে যথেষ্ট অভিজাত,
নিদারুণ হাওয়া তাকে শ্বাসের চেষ্টা দেয়,
স্বকামিনীটি চোখ তুলে তাকায় যেমত শিশু,
রক্তশূন্য দ্রুততায়।
মৃত্যু এবং আসঙ্গ
দুজন, অবশ্যই তারা ‘দুই’জন পুরুষ,
এটা এখন সম্পূর্ণ স্বাভাবিকই ঠেকে,
প্রথমজন কখনও চোখ তুলে তাকায় না,
তার চোখগুলো ঢাকনাওয়ালা, ব্লেকের পাঁচালির মতো,
সে প্রদর্শনীতে বিশ্বাসী।
বণিকী মালিকানার সুপরিচিত সিলের মতো হয়ে গেছে তার জন্মদাগগুলো,
বাষ্প প্রদাহের ক্ষতচিহ্ন,
নগ্নতা,
শকুনির তাম্রমল,
আমি রক্তাভ মাংসখণ্ড, তার খাঁড়ার মতো নাক।
পাশে পড়ে থাকে হাততালির শব্দ,
আমি এখনও তার অধিগত হইনি।
সে আমায় বলে স্থিরচিত্রে আমি কতটা কদাকার,
ভীষণ স্বাভাবিকভাবে সে বলতে থাকে হাসপাতালের বরফ বাক্সে শোয়ানো শিশুগুলি কত মধুর।
ঘাড়ের কাছে ঝালর,
তারপর আদিম উপত্যকার বাঁশি,
মৃত্যুর আলখাল্লারা
আর ছোট্ট দুটো পা
সে হাসে না, ধূমপানও করে না।
অপরজন সেগুলো করে,
তার চুল দীর্ঘ কিন্তু আদতে নকল,
বেজন্মা
একটা ঝলকানিকে নিয়ে স্বমেহনে মেতে থাকে,
তাকে ভালোবাসা হোক, এটা তার চাহিদা।
আমি উত্তেজিত হই না,
ব্যর্থতা একটি ফুলের নির্মাণ করে,
হিম তৈরি করে একটা নক্ষত্র,
মৃত্যু ঘণ্টাটি,
মৃত ঘণ্টাটি,
কেউ তার কাজ শেষ করে ফেলেছে।
আমি শীর্ষদেশীয়
কিন্তু আমার হওয়ার কথা ছিল সমতল,
মাটির গভীরে শিকড় ছড়ানো কোনও বৃক্ষ আমি নই
যে প্রতিনিয়ত খনিজ ও মাতৃপ্রেমের স্তন্য পান করে
যাতে প্রতি বসন্তে আমার সমস্ত রশ্মি পাতায় বিকিরিত হয়।
মুগ্ধতায় নিজের অংশকে প্রলুদ্ধ করা, দর্শনীয়ভাবে চিত্রিত
কোন লাবণীও আমি নই
যে উদ্যান শয্যাকে খোলতাই করে।
জানতে পারার আগেই খুব দ্রুত আমার পাঁপড়িদের ছিঁড়ে ফেলা হবে।
আমার সঙ্গে তুলনায়, একটি বৃক্ষ অবিনশ্বর
আর একটি গর্ভমুণ্ড, নাতিদীর্ঘ কিন্তু অধিক বিস্ময়কর।
আমি একটির পরমায়ু কামনা করি এবং অপরটির স্পর্ধা।
আজ রাতে, নক্ষত্রদের অতি সামান্য আলোয়,
বৃক্ষ আর ফুলেরা তাদের শীতল ঘ্রাণ ছড়িয়ে চলেছে।
আমি তাদের মধ্যে দিয়ে হাঁটছি,
কিন্তু তারা কেউ আমায় লক্ষ করছে না।
কোনও কোনও সময় আমার মনে হয়,
যখন আমি ঘুমিয়ে থাকি,
আমি অবশ্যই সবচেয়ে নিখুঁতভাবে তাদের মতো হয়ে উঠি।
চিন্তাগুলো ক্ষীণ হয়ে আসে।
আমার জন্য সবচেয়ে প্রকৃতিসম্মত হল শুয়ে পড়া,
তখন আমি আর আকাশ মুখোমুখি আসতে পারি মুক্ত সংলাপে।
আর আমি অবশ্যই বেশ ব্যবহার্য হয়ে উঠব যখন চূড়ান্তভাবে শুয়েই পড়ব।
তখন হয়তো বৃক্ষেরা একবারের জন্য হলেও আমায় স্পর্শ করবে,
আর ফুলেদের কাছে সময় থাকবে আমায় দেওয়ার জন্য।