সমন্বয়ের ভারত: ভক্তি ও সুফি আন্দোলন

সৌভিক ঘোষাল

সৌভিক ঘোষাল

 



লেখক প্রাবন্ধিক ও গদ্যকার। পেশায় শিক্ষক।

 

 

 

ভারতের বহুত্ববাদী ও সমন্বয়ী ঐতিহ্যের এক উজ্জ্বল প্রকাশ আমরা দেখতে পাই ভক্তি এবং সুফি আন্দোলনের মধ্যে। এই দুটি আন্দোলনই বেশ কয়েক শতাব্দী জুড়ে সৃষ্টিশীল কবি, চিন্তানায়ক এবং আমজনতাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল এবং উভয়েরই একটি সর্বভারতীয় চরিত্র ছিল।

 

ভক্তি আন্দোলন

ভক্তি আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল তামিলনাড়ুতে। খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ থেকে দশম শতাব্দীর মধ্যে তামিল ভক্তি আন্দোলন দুটি ধারায় অগ্রসর হয়। একটি ছিল নায়ান্মারদের ধারা, যারা ছিলেন শৈব। আরেকটি ছিল আলওয়ারদের ধারা, যারা ছিলেন বৈষ্ণব। এইসময় থেকে তামিল জনজীবনে প্রধান দেবতা হয়ে ওঠেন শিব আর বিষ্ণু এবং তার অন্যান্য দুই অবতার রাম ও কৃষ্ণ। এই সমস্ত দেবতারাই ভারতের অত্যন্ত প্রাচীন দেবতা ছিলেন, কিন্তু বৌদ্ধ ও জৈন যুগে তাদের জনপ্রিয়তা বেশ কমেছিল। নায়ান্মার ও আলওয়ারদের হাত ধরে তা আবার নবরূপে ফিরে আসে। বস্তুতপক্ষে খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীর আগে যে কলাভররা তামিল প্রদেশ শাসন করতেন, তারা ব্রাহ্মণ্যবাদ-বিরোধী বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মর পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন। কলাভর শাসকরা জনগণের মধ্যে জনপ্রিয়তা হারালে ষষ্ঠ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে জনগণের শাসক-বিরোধী প্রতিবাদী মানসিকতা থেকে শৈব ও বৈষ্ণব ধর্ম নতুন চেহারায় জনপ্রিয়ভাবে আত্মপ্রকাশ করে। এই নতুন ভাবধারা নতুন শাসকবর্গ— পাণ্ড, পল্লব ও বাদামীর চালুক্যদের পৃষ্ঠপোষকতা পায়, যারা কলাভর শাসকদের পরাজিত করে রাজনৈতিক ক্ষমতা ও সামাজিক নিয়ন্ত্রণ কায়েম করেন। এই নতুন সময়ে বৈষ্ণব ও শাক্তরা রাষ্ট্রীয় পোষকতা পেলেও বৌদ্ধ এবং জৈনরা কোনও দমনের মুখোমুখি হননি। দক্ষিণ ভারতের প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ নীলকান্ত শাস্ত্রী লিখেছেন যে অনেক ধরনের ধর্মীয় বিশ্বাস এখানে পাশাপাশি শান্তিপূর্ণভাবে প্রবহমান ছিল এবং তারা পারস্পরিক বিবাদে জড়িয়ে পড়েনি। মণিমেকালাই-এর কাহিনিসূত্র তুলে ধরে তিনি দেখিয়েছেন এর নায়িকাকে পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে কাঞ্চিতে গিয়ে বিভিন্ন দার্শনিক ধারা শিক্ষা করতে। এর মধ্যে আছে বৈদিক, শৈব, বৈষ্ণব, আজীবক, জৈন, সাংখ্য, বৈশেষিক এবং লোকায়ত ধারা। এই সময়ে ধর্মপ্রচারক সন্তরা একটি কোনও মন্দিরে আবদ্ধ থাকতেন না। বিভিন্ন ধারার সঙ্গে খোলামেলা বিতর্কে সামিল হতেন। এরই পাশাপাশি নিজ নিজ ভক্তকুলকে সঙ্গে নিয়ে এক এলাকার মন্দির থেকে অন্য এলাকার মন্দিরে পরিক্রমা করতেন। তারা যাত্রাপথে একসঙ্গে নাচতেন এবং গাইতেন। ক্রমশই এর মধ্যে দিয়ে এক নতুন ধরনের গণচরিত্রের বিকাশ ঘটে। ধর্মভিত্তিক এই গণচরিত্রের আন্দোলনের চেহারাটি ক্রমশ তামিলনাড়ুর বাইরে সারা ভারতে ছড়িয়ে যায়। একেই আমরা চিনি ভক্তি আন্দোলন বলে।

ভক্তি আন্দোলনের গণচরিত্র অর্জনের ক্ষেত্রে বিশেষ সহায়ক হয়েছিল সঙ্গীত ও সহায়ক বাদ্যযন্ত্র। ধর্মপ্রচারক সন্তদের অধিকাংশই ছিলেন কবি ও গায়ক। প্রথম যুগের বিখ্যাত নায়ান্মার সন্ত সামবান্ধার ছিলেন একজন অসামান্য গীতিকার ও সুরকার। তার দেওয়া সুরে তালের প্রয়োগ ছিল খুব আকর্ষণীয়। ভক্তি আন্দোলনের গণচরিত্র অর্জনের ক্ষেত্রে নাচেরও বিশেষ প্রভাব ছিল। সমবেত নাচের নির্দিষ্ট আদলটি সন্ত প্রচারকরা নিয়েছিলেন লোকনৃত্যের আঙ্গিক থেকে।

শৈব নায়ান্মাররা সংখ্যায় ছিলেন মোট তেষট্টি জন। তাদের মধ্যে প্রবীণতমা সন্ত ছিলেন একজন মহিলা, নাম কারিক্কল আম্মাইয়ার। ষষ্ঠ শতাব্দীর এই মহিলা সন্ত কবির বিবাহ হয়েছিল এক ধনী পরিবারে। তার স্বামী তাকে নানাভাবে নির্যাতন করতেন। তিনি দ্বিতীয় এক মহিলাকে বিবাহ করেন এবং কারিক্কলকে পরিত্যাগ করেন। এরপরই তিনি গৃহী জীবন ছেড়ে সন্ন্যাসিনীর জীবন শুরু করেন। অন্যান্য বিখ্যাত নায়ান্মার সন্ত কবিদের মধ্যে ছিলেন সম্বন্ধার, আপ্পার ও সুন্দরমূর্তি।

তামিল আলওয়ার সন্তদের মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য হলেন নাম্মালওয়ার, মধুরা কবি, পেরিয়ালওয়ার, আন্দাল, পোকাই আলওয়ার, ভূদাত্তয়ালওয়ার, তোন্দারাদীপ পদী আলওয়ার, কুলশেখর আলওয়ার প্রমুখ। দক্ষিণ ভারতের ভক্তি আন্দোলন থেকে দুটি মহৎ সাহিত্য সঙ্কলন গ্রন্থের জন্ম হয়েছিল। একটি হল শৈব সন্তদের লেখার সঙ্কলন ‘তেভারাম’, একটি আলওয়ার বৈষ্ণবদের লেখার সঙ্কলন ‘নালয়ইরা দিব্য প্রবন্ধম’।

নায়ান্মারদের মধ্যে আমরা যেমন মহিলা কবি কারিক্কল আম্মাইয়ারকে পাই, তেমনি আলওয়ারদের মধ্যে পাই বিষ্ণুচিত্ত আলওয়ার বা পেরিয়া আলওয়ারের পালিতা কন্যা আন্দালকে। আন্দালের বিকাশ প্রতিষ্ঠার সময়টা তামিল সাহিত্যে ভক্তি আন্দোলনের তুঙ্গ মুহূর্তের ঘটনা। সাধারণ মানুষের কাছে ততদিনে প্রথম যুগের আলওয়ার সন্তদের গানগুলি শুধু যে জনপ্রিয়ই হয়ে উঠেছে তা নয়, বেদের মর্যাদাতেই প্রায় সেগুলিকে তারা গ্রহণ করেছে। এই জনপ্রিয়তার একটা কারণ এর কথা ও সুরের মাধুর্য, আরেকটি কারণ সমকালীন বাস্তবতার উপস্থিতি।

দক্ষিণ ভারতের বাইরে ভক্তি আন্দোলনের ধারাটিকে প্রথম লক্ষ করা যায় মহারাষ্ট্রে ত্রয়োদশ শতকের সন্ত কবি জ্ঞানেশ্বরের রচনাবলিতে। দর্শন, কাব্যকলা ও ধর্মীয় প্রজ্ঞার অনবদ্য সমন্বয় ঘটেছিল তাঁর মধ্যে। মনে রাখতে হবে এই সময়টা ভারতে ইসলামিক শাসনের আদি পর্ব। সমকালীন সন্ত কবি নামদেব এবং পরবর্তীকালের তুকারামের ওপরও জ্ঞানেশ্বরের প্রবল প্রভাব ছিল। মহারাষ্ট্রের ভক্তি আন্দোলনের দার্শনিক প্রস্থানটি তিনিই নির্মাণ করে দিয়ে যান। তাঁর প্রথম মান্য জীবনী লিখেছিলেন আর এক প্রভাবশালী সন্ত নামদেব। জ্ঞানেশ্বরের পারিবারিক ঐতিহ্যেই ছিল ভক্তির শিকড়। তাঁর পিতামহ গোবিন্দপন্থ ছিলেন গোরক্ষনাথের ভক্ত। তাঁর বাবা ভিত্তলপন্থ সংস্কৃত শাস্ত্র খুব মন দিয়ে পড়েছিলেন এবং সন্ন্যাসও গ্রহণ করেছিলেন। পরে তিনি গুরুর আদেশে আবার সংসারধর্মে ফিরে আসেন, জন্ম হয় জ্ঞানেশ্বরের। সেটা ১২৭৫ খ্রিস্টাব্দ। মাত্র পনেরো বছর বয়েসেই শ্রীমৎ ভাগবতগীতার যে ভাষ্য জ্ঞানেশ্বর রচনা করেছিলেন, তা জ্ঞানেশ্বরী নামে আজও বিখ্যাত হয়ে আছে। এরপর জ্ঞানদেবের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় নামদেবের এবং তাঁরা উত্তর ভারতের বেনারস, দিল্লি সহ বিস্তীর্ণ অঞ্চল পরিভ্রমণ করেন। এই পরিভ্রমণ সূত্রে তাঁরা এইসব অঞ্চলে জনপ্রিয় করে তোলেন তাঁদের কীর্তনকে। তাঁদের বাসভূমি পান্থারপুরে প্রত্যাবর্তনের পর সন্তদের যে মহা জমায়েত হয় তাতে জাতিগত ভেদাভেদ মুছে যায়। সেই জমায়েতে কুমোর গড়োবা, মালাকার সন্তত, দলিত অস্পৃশ্য চেহ্নবা বা ব্রাহ্মণ পারিসা সকলেই উপস্থিত ছিলেন। হিন্দু ধর্মের ব্রাহ্মণ্যবাদী ধারাটি যে জ্ঞানদেব, নামদেবের ভক্তি আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছিল— এই সন্ত সমাবেশ তার প্রমাণ।

পঞ্চদশ শতাব্দীতে হিন্দুধর্ম ও ইসলামের মধ্যে সঙ্ঘর্ষের পটভূমিকায় সমন্বয়ী বার্তাটি যার মধ্যে দিয়ে সবচেয়ে স্পষ্টভাবে উঠে এসেছিল তিনি হলেন কবীর। দুটি ধর্মেরই অর্থহীন আনুষ্ঠানিক কর্মকাণ্ডগুলিকে তিনি আক্রমণ করেন এবং দুটি ধর্মেরই পরম লক্ষ্য যে এক এবং অভিন্ন তা তিনি বলবার চেষ্টা করেন। একদিকে তিনি যেমন কুসংস্কারমূলক ধর্মবিশ্বাসগুলির বিরুদ্ধে আক্রমণ শানিয়েছিলেন, তেমনি অন্যদিকে আচরণে কঠোর নীতিনিষ্ঠার ওপর জোর দিয়েছেন। কবীর ছিলেন হিন্দুদের জাতিভেদ প্রথার কঠোর সমালোচক। প্রতিমা পূজার বিরুদ্ধে, ঈশ্বরের অবতারবাদের বিরুদ্ধে, পুণ্যসলিলা নদীসমূহে স্নান করলে স্বর্গলাভ হয়— এই সমস্ত ধারণার বিরুদ্ধে তিনি অবিরাম লড়াই করে গেছেন। মসজিদের প্রতি অন্ধ আনুগত্যেরও তিনি সমালোচক ছিলেন। তাঁর মৃতদেহের অধিকার নিয়ে হিন্দু মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের দাবি সংক্রান্ত যে লোককথাটি বিখ্যাত হয়েছে, সেটাই প্রমাণ করে উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যেই পেশায় তাঁতি এই সন্ত কতটা জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন। বস্তুতপক্ষে কবীরের জন্ম বা বেড়ে ওঠা হিন্দু না মুসলিম পরিবারে, তাঁর চিন্তাচেতনার নিয়ন্ত্রক কে— এই নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক আছে। তিনি তাঁতি বৃত্তিজীবী জোলা পরিবারে প্রতিপালিত এই বিষয়ে গবেষকরা একমত হলেও সেই জোলা পরিবার হিন্দু না মুসলিম ধর্মাবলম্বী ছিল তা নির্ণয় করা দুরূহ। কবীরের সহপাঠী রায়দাস এবং পীপা মন্তব্য করেছিলেন কবীর যে তাঁতি পরিবারে বেড়ে ওঠেন, তারা ছিল মুসলিম। আবার অন্যদিকে অনেকে মনে করেছেন যুগী বা কোরি নামক এক নিম্নবর্গীয় হিন্দু পরিবারেই তাঁর বেড়ে ওঠা। এই দুই মতের সমন্বয়ের চেষ্টা করে কেউ কেউ বলেছেন কবীরের পালক পরিবার নিম্নবর্গের হিন্দু থেকে সদ্য ইসলামে রূপান্তরিত হয়েছিল, কিন্ত এই রূপান্তর ছিল নেহাৎই বাহ্যিক। তারা ভেতর থেকে হিন্দু রীতিনীতিই মানত এবং নাথপন্থার অনুসারী ছিল। এই বিতর্কের সমাধান আরও কঠিন কারণ এখনও বিহার উত্তরপ্রদেশে যে জোলাদের দেখা যায়, তাদের মধ্যে হিন্দু ও মুসলিম— দুই ধর্মের মানুষই আছেন। কবীরের আধ্যাত্মিক গুরু কে তা নিয়েও যথেষ্ট বিতর্ক আছে। কেউ কেউ মনে করেন কবীর শেখ তাকিলের শিষ্য ছিলেন। যদিও বেশিরভাগ গবেষকের মতে রামানন্দই ছিলেন কবীরের গুরু। এই সংক্রান্ত কবীরের একটি বচনও উদ্ধৃত করা হয়— ‘ভক্তি দ্রাবিড় উপাজি লায়ে রামানন্দ/ প্রগত কারী কবীর নে সাত দ্বীপ নবখণ্ড’। অর্থাৎ ভক্তি আন্দোলনের জন্ম দক্ষিণ দেশে। উত্তর ভারতে তাকে নিয়ে এলেন রামানন্দ আর সাত দ্বীপ ও নবখণ্ডে তাকে ছড়িয়ে দিলেন কবীর। এটা বলা যায় কবীর এমন এক সমাজে বড় হয়ে উঠেছিলেন যাকে হিন্দু ব্রাহ্মণ্যবাদীরাও ভালো চোখে দেখত না আর মুসলিমদের কাছেও তা পুরোপুরি গ্রহণীয় ছিল না। কবীর তাঁর পদে জানিয়েছেন তিনি অনেকটাই স্বশিক্ষিত এবং সত্রের পুঁথিগত জ্ঞান নয়, আত্মউপলব্ধির মধ্যে দিয়েই তিনি জগৎ জীবনকে জেনেছেন, বুঝেছেন। –মেরে তেরে মনুয়া ক্যয়সে এক হোই রে/ মে কথা হুঁ আঁখি দেখি/ তু কথা হ্যায় কাগজ কী লেখি— অর্থাৎ পণ্ডিতদের সঙ্গে তার চিন্তার মিল হবে কী করে? তাঁদের কথা তাঁদের পবিত্র সব বই থেকে উদ্ধৃত আর তাঁর কথা তাঁর নিজ উপলব্ধিজাত। বস্তুতপক্ষে অভিজ্ঞতা নির্ভর আত্মোপলব্ধিকে ধর্মীয় প্রথার ওপরে স্থান দেওয়া এবং প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের আত্মগরিমার জায়গায় এক উদার মনোভাবকে প্রচার করা কবীরকে এত বিশিষ্ট করে তুলেছে। তাঁর শিষ্যদের মধ্যে হিন্দু মুসলিম উভয়েই ছিলেন, এমনকী এও উল্লেখযোগ্য শিখদের আদিগ্রন্থতেও কবীর রচিত বীজকগুলি স্থান পেয়েছে, যা তাঁর সমন্বয়ী দর্শনের এক বড় প্রমাণ। ‘ভ্রান্ত গরিমা দরজায় তালা দিয়ে দেয়, ভক্তি আর ভালোবাসার চাবি দিয়েই তাকে খুলতে হয়’— এই উচ্চারণ বুঝিয়ে দেয় কবীরের অনন্যতা।

জাতিভেদের বাইরে এক সমন্বয়ী সমাজের পক্ষে বার্তা প্রদান ভক্তি আন্দোলনের এক বিরাট অবদান। চৈতন্যদেব বাংলার বুকে দাঁড়িয়ে ষোড়শ শতাব্দীর গোড়ায় যখন বলেন “চণ্ডালপি দ্বিজশ্রেষ্ঠ হরিভক্তি পরায়ণ”— তখন সেই সামাজিক পটভূমিকায় দাঁড়িয়ে তা এক সমাজ বিপ্লবের বার্তা নিয়ে আসে। জাতপাতের বাধা ও মন্দিরকেন্দ্রিক প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের আচার সর্বস্বতার বেড়াজাল ভেঙে নামগানের যে জোয়ারে তিনি বাংলাকে ভাসিয়ে দিতে পারলেন, বাংলার সমাজ সংস্কৃতি সাহিত্য বেশ কয়েকশো বছর ধরে তাঁকে ঘিরেই আবর্তিত হল। শ্রীচৈতন্যদেবের আবির্ভাব ও তিরোধান— দুইই পাঠানযুগে হয়েছিল। তাঁর দেহাবসানের অর্ধশতাব্দীর মধ্যে বাংলার মুঘল শাসন ক্রমে ক্রমে পাঠান সর্দার ও হিন্দু সামন্তদের ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেয়। কিন্তু সমাজের ভেতরের স্থিতি অনেকটাই রক্ষিত হয়। এর মূল কৃতিত্ব চৈতন্যদেব ও তাঁর প্রচারিত ভক্তি আন্দোলনের। তুর্কি আক্রমণ পরবর্তী পর্যায়ে একদিকে বাইরের দিক থেকে যেমন আঘাত আসছিল, তেমনি অন্যদিকে ব্রাহ্মণ্যমতাবলম্বী জাতপাতে শতধাবিভক্ত হিন্দুসমাজ ভেতর থেকেও ভেঙে পড়ছিল। সমাজের ভেতরে যে বিচ্ছিন্নতা দেখা দিয়েছিল তাকে জোড়ার শক্তি জীমূতবাহন, রঘুনন্দন, রঘুনাথ শিরোমণি, শূলপাণি, রঘুনাথ তর্কবাগীশ, কাশীনাথ বিদ্যানিবাস প্রভৃতি পণ্ডিতদের স্মৃতিসংহিতা ও ন্যায়শাস্ত্রের পক্ষে সম্ভব ছিল না। শ্রীচৈতন্যের আবির্ভাবের মধ্যে দিয়ে সমাজের অন্তেবাসীদের কাছে ভক্তি আন্দোলনের ধারাটি পৌঁছে যায় ও তাদের মন জয় করে নেয়। শুধু হিন্দুসমাজের সমস্ত অংশই যে কেবল ভক্তি আন্দোলনের ধারায় ঐক্যসূত্রে গ্রথিত হয়েছিল তা নয়, বাংলার মুসলিম সমাজের মধ্যেও তার প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছিল। অনেক মুসলমান কবি এই সময়ে চৈতন্যপ্রভাবে রাধাকৃষ্ণের গান বেঁধেছিলেন, গৌরচন্দ্রিকার পদ লিখেছিলেন। বাংলায় সামাজিক সাংস্কৃতিক ঐক্য সাধনে চৈতন্যদেব ও তাঁর ভক্তি আন্দোলনের ভূমিকা ছিল অভূতপূর্ব।

একই কাজ অসমের বুকে করেছিলেন চৈতন্যদেবের প্রায় সমসাময়িক সন্ত মহন্ত শঙ্করদেব। সেইসময় বহুবিভক্ত অসম তথা উত্তর পূর্ব ভারতের বিস্তীর্ণ প্রান্তরে তিনি ছড়িয়ে দেন তাঁর নিজস্ব ভক্তিবাদী ঘরানা— একশরণ নামধর্ম; এবং এর মধ্যে দিয়ে একধরনের সামাজিক সংহতি তৈরি করেন। সেই সময় ব্যাপক পশুবলি সহ নানা ধরনের অজাচারকেন্দ্রিক যে সমস্ত ধর্মীয় অনুশীলন তান্ত্রিক শৈব মতবাদের নামে জনপ্রিয় ছিল, শঙ্করদেবের ভক্তি আন্দোলন তার সামনে দাঁড়ায় এবং আচারসর্বস্ব ধর্মভিত্তিক কুপ্রথাগুলির জায়গায় একমাত্র কীর্তনগানকেই প্রধান ধর্মীয় অনুশীলন হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে। তাঁর প্রতিষ্ঠিত সত্রগুলিতে যে নামগান হত, সেখানে জাতপাতের কোনও ভেদাভেদ ছিল না। ভক্তি আন্দোলনের গুরুরাও জাতনিরপেক্ষভাবে সমাজের যে কোনও বর্ণের মানুষ হতে পারতেন। শঙ্করদেব ও তাঁর অনুগামীরা এই সময় যে বিপুল পরিমাণ সাহিত্য সৃজন করেন তা এক নতুন যুগের সূচনা করে অসমীয়া সাহিত্যে। সঙ্গীত ও নৃত্যকলার বিকাশেও তাঁর ভূমিকা ছিল অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য। এই বৈষ্ণবীয় ভক্তিবাদ অসমীয়া চিত্রকলাতেও এক নতুন ধারার জন্ম দিয়েছিল।

মধ্যযুগের ধর্মীয় সামাজিক আন্দোলনের এই নবতরঙ্গের মধ্যেও অতি বিশিষ্ট ছিলেন গুরু নানক। তিনি শুধু জাতপাতের বেড়াই ভাঙেননি, হিন্দু ক্ষত্রিয় পরিবার ও সমাজের মধ্যে বড় হয়েও বাইরের নানা পরিচয়ের মানুষজনের সঙ্গে তাঁর মতবাদের সংযোগ গড়ে তুলেছেন। ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চল ছাড়াও তিনি ঘুরেছিলেন সিংহল, তিব্বত, লাদাখ, আফগানিস্তান, সৌদি আরব, ইরাক। দেখেছিলেন হিন্দু, বৌদ্ধ ও মুসলিম ধর্মসংস্কৃতির মুখ্য কেন্দ্রগুলি এবং এই অভিজ্ঞতা তাঁর উপলব্ধি ও চিন্তার জগৎকে প্রসারিত করেছিল। তিন দশক ব্যাপী এই পরিভ্রমণ পর্বে নানক বিভিন্ন চিন্তাধারার মানুষের সঙ্গে অনেক বিতর্কে অবতীর্ণ হন। নানকের চিন্তাভাবনা ও মতবাদের একটি বিশেষ দিক হল তিনি আধ্যাত্মিক জগতের নতুন উপলব্ধির সূত্রে মোক্ষলাভের কথাতে আবদ্ধ থাকেননি, পার্থিব আশা আকাঙ্ক্ষা, সমস্যা ও সমস্যা মুক্তির কথা খুব গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনা করেছেন। বস্তুতপক্ষে মধ্যযুগের আর কোনও ধর্মীয় বা সামাজিক নেতৃত্বের কথায় পার্থিব জগতের প্রতি এই পরিমাণ গুরুত্বপ্রদান আমরা বোধহয় খুঁজে পাব না। দৈনন্দিন জীবনের বহুমাত্রিক দ্বন্দ্বের কথা তিনি উল্লেখ করেছেন এবং সেগুলির মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার উপদেশ দিয়েছেন। এই দ্বন্দ্বগুলির মধ্যে রয়েছে রোজকার জীবনের আত্ম এবং অপর, বিচ্ছিন্নতা ও সংযোগ, কাজ এবং নিষ্ক্রিয়তার মত ক্ষেত্রগুলি। সক্রিয়, সৃজনশীল এবং বাস্তবঘনিষ্ঠ জীবনযাপনের উপদেশ দান নানকের শিক্ষার অন্যতম বড় দিক। বাস্তবঘনিষ্ঠ জীবনযাপনের জন্য নানক ত্রিমুখী ধারার কথা বলেছেন। বন্দচাক্কো— যার মূল কথা অন্যের সঙ্গে সম্পদ ভাগ করে নেওয়া, যার বেশি প্রয়োজন তাকে সাহায্য করা, কিরাৎ করো— যার মূল কথা কোনওরকম দুর্নীতি বা শোষণ না করে উপার্জন ও জীবন যাপন করা এবং নামজপ— যার মূল লক্ষ্য কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ এবং অহঙ্কার এই পাঁচটি দোষ থেকে মুক্ত হবার চেষ্টা করা।

 

সুফি আন্দোলন

মূলত হিন্দুধর্মের ভেতর থেকে ভক্তি আন্দোলন যেমন সমাজের মধ্যেকার ঐক্যের সন্ধান করেছিল, তেমনি ইসলামধর্মের ভেতর থেকে এই কাজ করেছিল সুফি আন্দোলন। সুফি মতবাদের উদ্ভব আরবে। কিন্তু এই মতবাদের উদ্ভবের সময় বিভিন্ন ভারতীয় দার্শনিক প্রস্তাবের গভীর প্রভাব তার ওপর পড়েছিল। সুফি মতবাদের ওপর ইসলামের পাশাপাশি যোগদর্শন, উপনিষদ ও বৌদ্ধ মতাদর্শের প্রভাবের কথা এর আলোচকেরা বিস্তারিতভাবে বলেছেন। সেই নিরিখে জন্মমুহূর্ত থেকেই ভারত ভূখণ্ডের সঙ্গে এই ভাবধারার একটি আত্মিক সংযোগ আছে।

সুলতানি সাম্রাজ্য স্থাপনের ফলে মুসলমানদের মধ্যে ভোগবিলাস ও ঐশ্বর্যের উন্মাদনা দেখা যায়। অনেকেই মনে করতে থাকেন ইসলাম তার মূল শিক্ষা থেকে সরে যাচ্ছে। ইসলামের নৈতিক অবক্ষয় ও অধঃপতন লক্ষ করে কয়েকজন ধর্মপ্রাণ মুসলমান মর্মাহত হন। তাঁরা রাষ্ট্রের সঙ্গে সর্বপ্রকার সম্পর্ক ছিন্ন করতে মনস্থ করেন। এঁদের অনেকেই ঈশ্বরের সঙ্গে মানুষের ভালোবাসার বন্ধনের উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। এঁদের চিন্তাধারাই সুফি মতাদর্শ হিসেবে জনপ্রিয়তা প্রায়। খ্রিস্টীয় নবম দশম শতক ছিল এই মতবাদের উদ্ভব ও বিকাশের প্রথম পর্ব। ভারতে ইসলামের রণনৈতিক বিজয়ের আগে থেকেই সুফিরা এদেশে চলে আসেন।

সুফিদের মতবাদ ও ইসলামের আদর্শ থেকে চলতি ইসলামিক সংস্কৃতির সরে যাওয়া বিষয়ক সমালোচনা গোঁড়া মুসলমানদের মনঃপূত হয়নি। তাঁরা সুফিদের ইসলাম-বিরোধী বলে মনে করেন এবং তাদের ওপর বেশকিছু আক্রমণও নেমে আসে। ফলে সুফিরা ক্রমশ নির্জনে ধর্মচর্চা করতে শুরু করেন। এঁরা একজন পীর বা শেখের অধীনে এক একটি ধর্ম সংগঠন গড়ে তোলেন। সংগঠনের সদস্যদের বলা হত ফকির বা দরবেশ।

ভারতের বিখ্যাত সুফি সাধকদের মধ্যে প্রথমদিকে অর্থাৎ একাদশ শতকে যারা এসেছিলেন তাঁদের মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য ছিলেন শাহ রুমি, নথর শা, গনজ বকশ প্রমুখ। গনজ বকশকে অনেকে ভারতের সর্বপ্রথম সুফি সাধক বলে মনে করেন। শাহ রুমি ১০৫৩ সালে বাংলায় এসেছিলেন। ময়মনসিংহের নেত্রকোণায় তাঁর সমাধি রয়েছে। নথর শাহ দাক্ষিণাত্যে সুফি মতবাদ নিয়ে যান। মাদ্রাজের ত্রিচিনপল্লীতে তাঁর সমাধিক্ষেত্র তীর্থস্থানে পরিণত হয়েছে। এই যুগে বাংলায় আগত সুফি সাধকদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত ছিলেন বাংলাদেশের সিলেটের শাহজালাল ইয়ামেনি। তিনি ১২২৭ খ্রিস্টাব্দে বাংলায় আসেন। মরক্কোর তাঞ্জানিয়াবাসী বিখ্যাত পরিব্রাজক ইবন বতুতা ১৩৪৫ খ্রিস্টাব্দে বাংলা পরিভ্রমণে এসে শাহজালালের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তার মতে, শাহজালাল ইয়ামেনি ছিলেন তার সময়ের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষদের একজন।

দ্বাদশ শতাব্দী থেকে ভারতে সুফি সাধকদের ঢেউ আছড়ে পড়ে। আসমুদ্র হিমাচলে সুফি সাধকরা ছড়িয়ে পড়েন৷ যারা এই সময় ভারতে এসেছিলেন তাদের মধ্যে প্রধান ছিলেন চিশতি ও সুরাবর্দি সম্প্রদায়। ভারতে অন্য যে দুটি প্রধান সুফি সম্প্রদায়ের ধারাটির বিকাশ পরবর্তীকালে হয় সে দুটি হল মদানি ধারা ও ফিরদৌসি ধারা।

ভারতবর্ষে সুফিদের ধারাগুলির অঞ্চলভিত্তিক প্রভাব ছিল। যেমন দিল্লি ও দোয়াব অঞ্চলে চিশতি; সিন্ধু, পাঞ্জাব ও মুলতানে সুরাবর্দি এবং বিহারে ফিরদৌসি ধারার প্রভাব ছিল উল্লেখযোগ্য।

চিশতি সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন খাজা মইনউদ্দিন চিশতি। তিনি মহম্মদ ঘুরির সময়ে মধ্য এশিয়া থেকে ভারতবর্ষে আসেন ও আজমিরে বসবাস করতেন। চিশতি সাধকদের মধ্যে নিজামউদ্দিন আউলিয়ার নাম সর্বপেক্ষা উল্লেখযোগ্য। বিখ্যাত কবি আমির খসরু ও ঐতিহাসিক জিয়াউদ্দিন বরানি তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিলেন। হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মানুষই তাঁকে শ্রদ্ধা করতেন।

সুরাবর্দি সম্প্রদায়ের সুফিরা পাঞ্জাব, মুলতান ও বাংলায় প্রভাবশালী ছিলেন। এই সম্প্রদায়ের সাধকদের মধ্যে শেখ শিহাবউদ্দিন সুরাবর্দি ও হামিদউদ্দিন নাগরি ছিলেন প্রধান। এই সম্প্রদায়ের সাধকেরা চিশতিদের মতো দারিদ্র ও কৃচ্ছ্বতাসাধনের জীবনাদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন না। সন্ন্যাসীর জীবনও এদের লক্ষ্য ছিল না। এঁরা রাষ্ট্রের অধীনে ধর্মীয় উচ্চপদ গ্রহণ করতেন।

ওই সময়ে একটি নতুন সম্প্রদায় ভারতবর্ষে বিকাশ লাভ করে। এই সম্প্রদায়ের নাম কাদেরিয়া। এই নতুন সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন সৈয়দ আবদুল কাদির। ইনি ১০৭৮ খ্রিস্টাব্দে বাগদাদের জীলান নামক স্থানে জন্মগ্রহন করেন। এই কারণে এই সাধক আবদুল কাদির জীলানী নামে পরিচিত। আবদুল কাদির জীলানী ছিলেন পণ্ডিত, সুবক্তা এবং একজন জগদ্বিখ্যাত সাধক; ইনি ১১৬৬ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে মৃত্যুবরণ করেন। আবদুল কাদির জীলানী ভারতীয় উপমহাদেশে অত্যন্ত সুপরিচিত হলেও কখনও ইনি ভারতবর্ষে আসেননি। তাঁর এক বংশধর সৈয়দ মুহাম্মদ ঘৌথ গীলানী ১৪৮২ খ্রিস্টাব্দে ভারতে আসেন ও কাদেরিয়া সম্প্রদারের ভিত স্থাপন করেন। সৈয়দ মুহাম্মদ ঘৌথ গীলানী উত্তর ভারতে রাজপুতনার উছ নগরে সুফিকেন্দ্র গড়ে তুলেছিলেন। ইনি ১৫১৭ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন। পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষভাগে ভারতবর্ষে আরও একটি সুফি সম্প্রদায় প্রবেশ করে। এই সম্প্রদায় নকশাবন্দি সম্প্রদায় নামে পরিচিত। এই সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন তুর্কিস্তানের খাজা বাহাউদ্দীন নক্বশ বনদ। ইনি ১৩৮৯ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন। ভারতবর্ষে নকশাবন্দি সম্প্রদায়ের আদিগুরুর নাম: খাজা মুহাম্মদ বাক্বী বিল্লাহ। তিনিই তুর্কিস্তান থেকে নকশাবন্দি সম্প্রদায়ের মতবাদ ভারতবর্ষে নিয়ে আসেন। খাজা মুহাম্মদ বাক্বী বিল্লাহ ১৬০৩ খ্রিস্টাব্দে দিল্লিতে মৃত্যুবরণ করেন।

এর আগেই অবশ্য চতুর্দশ শতাব্দীতে ভারতে আরেকটি সুফি সম্প্রদায়ের উদ্ভব হয়। বদিউদ্দিন শাহ মদার এই ধারাকে জনপ্রিয় করে তোলেন এবং তাঁর নামানুসারেই এই ধারা মদারী সম্প্রদায় নামে পরিচিত হয়।

সুফিরা মনে করতেন প্রেম ও ভক্তিই ঈশ্বরপ্রাপ্তির একমাত্র পথ। আচার অনুষ্ঠান ও ধর্মীয় অনুশাসনের পরিবর্তে ত্যাগ ও বৈরাগ্যর ওপরেই তাঁরা তাদের মতবাদে জোর দিয়েছেন। ত্যাগ ও বৈরাগ্যই তাঁদের মতে প্রকৃত মুক্তির পথ। সর্বধর্মসমন্বয়, জীবে প্রেম ও সম্প্রীতি ছিল সুফিদের আদর্শ। ভারতবর্ষে সুফিরা ইসলামের গোঁড়ামির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন। সুফিরা বারবার বলেছেন অনেক উলেমাই কোরানের ভুল ও বিকৃত ব্যাখ্যা করছেন এবং ইসলামের গণতান্ত্রিক আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়ে যাছেন।

সুফিদের ধার্মিক ও অনাড়ম্বর জীবন, ঈশ্বরভক্তি এবং নির্জনে সন্ন্যাসীর জীবনাদর্শ হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে এদেশের অনেক মানুষের শ্রদ্ধা আকর্ষণ করেছিল। ভক্তি আন্দোলনের কবীর, নানক প্রমুখদের মতোই সুফি প্রচারকেরাও হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে ধর্মগত ব্যবধান কিছুটা লুপ্ত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ইসলামের সাম্যের আদর্শে উলেমাদের চেয়ে সুফিরা বেশি জোর দিতেন বলে সমাজের নিম্নবর্গের মানুষ বিশেষত কৃষক ও কারিগরেরা সুফিদের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল।

 

সুফি মতবাদ ও ভক্তিবাদের মধ্যে অনেক বিষয়েই মিল ছিল। ঈশ্বরের কাছে আত্মনিবেদন ও ঈশ্বরের সঙ্গে মিলন উভয় আদর্শেই স্বীকৃত ছিল। উভয় সম্প্রদায়ই বিশ্বাস করত যে গুরু অথবা পিরের সাহচর্য আত্মার মুক্তির পক্ষে বিশেষভাবে সহায়ক। মধ্যযুগের ভারতে তুর্কি আক্রমণ পরবর্তী সময়ে ধর্মের ভেদাভেদ ও জাতপাতের ভেদাভেদের ওপরে উঠে সমন্বয়ের ভারতীয় ঐতিহ্যটি মজবুত করার পেছনে এই দুই সাংস্কৃতিক আন্দোলনের বিরাট ভূমিকা ছিল। আজকের ভারতবর্ষে বিভেদকামী শক্তির অপচেষ্টার বিরুদ্ধে সমন্বয়ের ভাবধারার প্রয়োজন যখন নতুন চেহারায় আত্মপ্রকাশ করছে, তখন ভারতীয় ঐতিহ্যের অন্যতম ভিত্তি এই সাংস্কৃতিক আন্দোলনগুলিকে ফিরে দেখা, তা থেকে প্রয়োজনীয় শিক্ষা গ্রহণ করা একটি জরুরি কাজ।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4879 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...