প্রশান্ত ভট্টাচার্য
লেখক কবি ও সাংবাদিক।
এ তুমি কেমন তুমি, নেতা ছাড়াই লড়াই করো… এইরকম একটা লাইন কদিন ধরেই শুধু মাথায় ঘুরছে।
পাঠক, আপনার কাছে যদি জানতে চাওয়া হয় যে, সিএএ, এনআরসি, এনপিআর-বিরোধী আন্দোলনের নেতা কে? আমি নিশ্চিত, আপনিও আমার মতো আকাশপাতাল ভাবতে শুরু করবেন। হয়তো, ওরকম একটা লাইন আওড়াবেন। নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে যে ভারত জেগে উঠেছে ও উঠছে, সে কারও আঁচলে বা কাছায় যেমন বাঁধা নেই তেমন থাকবেও না বলেই আমার বিশ্বাস। হাতে তাদের একটাই পতাকা— ভারতের ত্রিবর্ণ নিশান, মুখে তাদের একটাই স্লোগান— আজ়াদি! মাচাবাঁধা প্রতিবাদ-সভায়, খোলা আকাশের নীচে ধরনাতেও একই স্লোগান, একই পতাকা।
সংবিধান থেকে গড়গড়িয়ে পড়ে যাচ্ছে বাঁধ না-মানা আঠেরোর কোনও তরুণ। সংবিধান উঁচু করে ধরে অধিকারের বয়ান পাঠ করছে কোনও উনিশে পা তরুণী। ভারতীয় লোকতন্ত্র ৭০ বছর পার হয়ে এসে এই প্রথম দেখল কোনও রাজনৈতিক দল, বিশিষ্ট কোনও রাজনৈতিক নেতা বা সাংস্কৃতিক নেতা ছাড়া গোটা দেশের সাধারণ মানুষ, ছাত্র-ছাত্রী পথের দখল নিয়েছে।
প্রায় ছ মাস ধরে কাশ্মিরকে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে, পৃথুল সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে অনায়াস মসৃণতায় দেশের সংবিধানকে ছিন্নভিন্ন করা হল সংসদীয় ঘেরাটোপে। অথচ ভোটকুশলী রাজনৈতিক দলগুলো কোনওরকম চাপে ফেলতে পারল না মোদি-শাহ যুগলবন্দিকে। রাজনৈতিক দলগুলোর এই লবেজান অবস্থাই বোধহয় নাগরিকত্ব প্রশ্নে দেশবাসীকে নাড়া দিয়ে গিয়েছে। মানুষ বুঝে গিয়েছে, নিজেদের হক নিজেদের মতো করেই প্রতিষ্ঠা করতে হবে। শাহিনবাগ থেকে পার্ক সার্কাস সেই বার্তাই দিচ্ছে। শাহিনবাগ যেন আজ সিএএ-বিরোধী দেশজোড়া আন্দোলনের সমস্ত শক্তির কেন্দ্র। ওই রাজপথে ধর্মীয় বিভেদ ভুলে সততা ও অদম্য সাহসকে সঙ্গী করে, ‘আজাদি’-র স্বপ্নকে বুকে নিয়ে মাটি আঁকড়ে পড়ে রয়েছেন সদ্যোজাত শিশু থেকে নবতিপর বৃদ্ধারাও।
জানি, গেরুয়া শিবির থেকে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে, স্বাধীন দেশে আবার নতুন করে কিসের আজাদি? আমরা তো জানি শাহিনবাগিদের কাছে এই আজাদি আসলে হিন্দু ফ্যাসিস্টদের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াই। এক অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ থেকে মানবিক সমাজের কোলে আশ্রয় নিশ্চিত করার খোঁজ। সেই খোঁজেই দিল্লির হাড়কাপানো ঠান্ডা ও প্রবল শৈত্যপ্রবাহ যেন হার মেনে যায় এদের লড়াইয়ের উত্তাপে, মানসিক দৃঢ়তার ওমে। কোনও নেতাহীন, কোনও রাজনৈতিক দলের পৃষ্ঠপোষণা ছাড়া শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের এমন প্রতিবাদের ছবি মাসাধিককাল অতিক্রম করে আজও সমানভাবে সতেজ ও আত্মবিশ্বাসী। শাহিনবাগের অহিংস বিক্ষোভ আজ সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে কারণ এটি একটি খণ্ডিত সমাজের মহিলাদের নেতৃত্বাধীন ঐক্যবদ্ধ সমাবেশে পরিণত হয়েছে। দিন-রাতে ২৪ ঘণ্টা ধর্না-বিক্ষোভ চলছে। নিহত দলিত ছাত্র রোহিত ভেমুলার মা এসে রাত জাগছেন শাহিনবাগের মায়েদের সঙ্গে। সারা ভারতে ২১টি জায়গায় ছড়িয়ে গেছে শাহিনবাগ। কলকাতার পার্ক সার্কাস, নওয়াব আলি পার্ক ইকবালপুর, এসএন ব্যানার্জি রোড়, হাওড়ার পিলখানা, জাকারিয়া স্ট্রিট, দিল্লির তিন জায়গায়, রাজস্থানের কোটার তিনটি এলাকায়, পুনের তিনটি জায়গায়, পটনার তিনটি জায়গায়, রাঁচির দুটি এলাকা-সহ নাগপুর, লখনউ, প্রয়াগরাজ, কানপুর— সবই আজ শাহিনবাগ। প্রতিদিনই নতুন নতুন শাহিনবাগ গজিয়ে উঠছে। এর পাশাপাশি বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ুয়ারা পথে নেমে আসছে। উৎকর্ষে এগিয়ে থাকা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো আরও বেশি বেশি অগ্রণী ভূমিকা নিচ্ছে। কে বলেছিল ইন্ডিয়ান স্ট্যটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউটের ছাত্রদের কনভোকেশনের দিন শংসাপত্র হাতে পিছন দিক করে ধরে ফটো সেশন করতে, যা স্পষ্ট বুঝিয়ে দেয়, ‘কাগজ নাহি দেখায়েঙ্গে’। এই মেধাবী পড়ুয়াদের কোনও নেতা নেই। ওঁরা নিজেরাই অ্যাট দ্য কল অফ কনসাইনস নাগরিকত্ব নিয়ে ভারত সরকারের নষ্টামির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জারি রাখল।
২৬ জানুয়ারি জাতীয় পতাকা কাঁধে বয়ে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ কলকাতার দক্ষিণে গোলপার্ক থেকে উত্তরে শ্যামবাজার পাঁচ মাথার মোড় পর্যন্ত ১১ কিলোমিটার দূরত্ব মানবশৃঙ্খলে বেঁধে ফেলল। অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ছিলেন বহু মহিলা। ছিল শিশু, কিশোরকিশোরীরাও। এই ১১ কিলোমিটার পথে ১৫টি মোড় ছিল। প্রতিটি মোড়ে সংবিধান পাঠ করা হয় ইংরেজি, বাংলা ও হিন্দিতে। এই গণ আন্দোলনে কোনও নেতা বা নেত্রী নেই।
ইতিহাসের সন্ধিক্ষণে এইরকম নেতাহীন আন্দোলন মাথা চাড়া দেয়। আমরা যদি গত শতাব্দীর ছয়ের দশকে ইউরোপ ও আমেরিকার ছাত্র আন্দোলনের কথা মনে করি, তবে দেখতে পাব, সেখানেও তেমন করে কোনও নেতা ছিলেন না। তবে সেইসময়টা ছিল মার্কিন আগ্রাসী যুদ্ধের বিরুদ্ধে অজেয় ভিয়েতনাম, তার প্রেরণা। এছাড়াও তখন বিশ্বজুড়ে তরুণ সমাজকে নাড়া দেওয়ার মতো ছিলেন দুই ব্যক্তিত্ব, মাও জেদং ও চে গুয়েভারা। পরবর্তীকালে, এই শতাব্দীর প্রথম দশকের শেষ ধাপে, ২০১০ সালে আমরা দেখলাম মার্কিন দেশে নেতাহীন এক আন্দোলন— ‘অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট’। ‘ওয়াল স্ট্রিট দখল করো’ আন্দোলন আমেরিকা থেকে আস্তে আস্তে দুনিয়ার নানান প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে। লন্ডন, রোম, মাদ্রিদ, বার্লিন-সহ শত শত শহরে ‘অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট’ আন্দোলনের দাবির সমর্থনে প্রতিবাদ সমাবেশ সংগঠিত হয়। মজার যে এই আন্দোলনে কোনও নেতা নেই। কানাডার ‘অ্যাডবাস্টার মিডিয়া ফাউন্ডেশন’ নামে একটি সংস্থা দাবি তোলে, প্রেসিডেন্ট ব্যারাক ওবামাকে প্রেসিডেনশিয়াল কমিশন চালু করে ওয়াশিংটনের জনপ্রতিনিধিদের ওপর কর্পোরেট টাকার প্রভাব রুখতে হবে। এই একটি ‘অরাজনৈতিক’ প্রস্তাব ট্যুইটার, ফেসবুকের মতো সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। ওই আন্দোলন ছিল অহিংস। আন্দোলনকারীরা ওয়াল স্ট্রিটের কাছে জুকোটি পার্কে অবস্থান শুরু করে। এই পার্কটি সরকারি নয় বলে মার্কিন পুলিশ তাদের তুলেও দিতে পারে না। এই অবস্থান আন্দোলনে প্রথম দিকে বেশির ভাগ আন্দোলনকারীই ছিল অল্পবয়সি, পড়ুয়া। আস্তে আস্তে নানান বয়সের মানুষ যোগ দিতে থাকে। অনেক পরিবার তাদের বাচ্চাদের নিয়ে ওই পার্কের অবস্থান বিক্ষোভে যোগ দেয়। আন্দোলনকারীদের কারও কারও হাতে পোস্টার: ‘তোমরা আমার সঙ্গে আছ বলে, আমিও তোমাদের সঙ্গে আছি।’
পাঠক নজর করুন, ১০ বছর আগের জুকোটি পার্কের সঙ্গে আমাদের শাহিনবাগ, পার্ক সার্কাসের কী অদ্ভুত মিল! নাগরিকত্ব নিয়ে মোদি-শাহর ভ্রষ্টাচারের বিরুদ্ধে আমাদের ছাত্ররাই প্রথমে পথে নেমেছে। তারপরেই এগিয়ে এসেছে মহিলারা। মিশরের তহরির স্কোয়ারেও আমরা এরকম নেতাহীন আন্দোলন দেখেছিলাম ২০১১-তে। আজকে আমাদের দেশে যেখানে যেভাবে সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের প্রতিবাদে আন্দোলন হচ্ছে, তাকেও নেতাহীন আন্দোলন বলে বর্ণনা করাটাই সমীচীন। তবে এটাও ঠিক, কোথাও কোথাও রাজনৈতিক দলগুলোর কয়েকটি আন্দোলন সংগঠিত করছে, বিশেষ করে কেরল এবং পশ্চিমবঙ্গে। তবুও বলতে হবে, এই আন্দোলন এমন একটা স্বতঃস্ফূর্ত চরিত্র পাচ্ছে যে মনে হচ্ছে, কোনও রাজনৈতিক দলগঠন বা ভোটে জিতে ক্ষমতায় আসার মতো উদ্দেশ্যে নয়, আজকের প্রতিবাদীরা কতগুলো আদর্শের ভিত্তিতে, সামাজিক ন্যায়ের দাবিতে পথে নেমেছেন। এঁদের নেতা নেই, অগ্রগামীও কেউ নেই। হয়ত, এঁরা সেই রাজনৈতিক ফেব্রিক তৈরি করবে, যেখানে নেতার জন্ম হয় আন্দোলনের কষ্টিপাথরে।