গ্রেটা থুনবার্গ
গত মঙ্গলবার সুইৎজারল্যান্ডের ডাভোসে অনুষ্ঠিত ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের অন্তর্গত একটি ইভেন্টে দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস এবং ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম-এর যৌথ উদ্যোগে গ্রেটা থুনবার্গকে আনা হয়। সতেরো বছরের কিশোরীটি সেখানে ব্যক্ত করে নিজের রাগ এবং অসহায়তা। থুনবার্গের সেই সম্পূর্ণ বক্তব্যটির ভাষান্তর চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম-এর পাঠকদের জন্য। তর্জমা করেছেন সত্যব্রত ঘোষ।
এক বছর আগে আমি ডাভোসে এসে আপনাদের বলেছিলাম আমাদের বাড়িতে আগুন জ্বলছে। আমি চেয়েছিলাম আপনারা ভয় পান। আমাকে সাবধান করা হয়েছিল আবহাওয়া বিপর্যয় নিয়ে কথা বললে বিপদ হবে। না না, চিন্তা করবেন না। কিস্যু হয়নি, বিশ্বাস করুন। আমি আপনাদের নিশ্চিন্ত করছি এর আগে আমি অনেকবার এই নিয়ে বলেছি। কিন্তু তাতে কারও কিছু যায় আসেনি।
পরবর্তীকালে এই দিনগুলিকে ফিরে দেখবার জন্য যে নথি থাকবে, তার স্বার্থে একটা কথা বলি। যখন আমরা ছোটরা বড়দের বলি, তোমরা ভয় পাও, তার মানে কিন্তু এই নয় যে আপনারা যা করে চলেছেন, তাই করে যাবেন। আমরা বলছি না, প্রযুক্তির উপর আপনারা সম্পূর্ণ নির্ভর হন। কারণ, ব্যাপকভাবে ব্যবহার করবার জন্য আজও তা বানানোই হয়নি। হতে পারে, বিজ্ঞান কখনও তা বানাবেই না।
আপনাদের আমরা বলছি না যে ‘নেট জিরো এমিশন’-এর লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য আপনারা আলোচনা চালিয়ে যান। অথবা ‘কার্বন নিউট্রালিটি’ প্রমাণ করবার জন্য সংখ্যাগত কারচুপি করতে থাকুন। আমরা বলছি না এমিশন কমানোর জন্য আফ্রিকায় এবং অন্যান্য জায়গায় গাছ পোঁতার জন্য কাউকে পয়সা দিয়ে নিযুক্ত করুন যখন অ্যামাজনের জঙ্গলের মতো জায়গাগুলিকে অত্যন্ত দ্রুত হারে ধ্বংস করে দেওয়া হচ্ছে।
গাছ পোঁতা নিশ্চয়ই খুব ভালো কাজ, কিন্তু তা কোনওভাবেই সেই পরিমাণের কাছাকাছি পৌঁছাতে পারবে না, যা আমাদের প্রয়োজন। এবং তা দিয়ে প্রকৃতির বিপর্যয়কে প্রশমিত করা যাবে না বা পুনরুদ্ধার করা যাবে না।
একটা কথা আপনাদের স্পষ্ট জানিয়ে দিই। আমরা ‘লো কার্বন ইকোনমি’ চাইছি না। আমরা ‘লোয়ার এমিশন’ চাইছি না। আমরা যদি উষ্ণায়নের ১.৫ ডিগ্রির নীচে থাকতে চাই তাহলে আমাদের এমিশন একেবারে বন্ধ করতে হবে। এবং যতদিন না আমাদের হাতে সেই প্রযুক্তি আসবে যাতে এমিশনের মাত্রাকে আমরা মাইনাসের ঘরে নিয়ে যেতে পারছি, ততদিন নেট জিরো-র কথা আমাদের ভুলে থাকতে হবে। আমরা সত্যিকারের ‘জিরো’ দেখতে চাই।
কারণ নেট জিরো এমিশনের সুদূর লক্ষ্যটি সম্পূর্ণ অর্থহীন হয়ে যায় যখন আমরা কার্বন ডাই অক্সাইডের বাজেটকেই অগ্রাহ্য করে চলেছি— যা শুধু আজকের জন্য প্রযোজ্য, সুদূর ভবিষ্যতের কোনও তারিখের জন্য নয়। যদি এমিশনের মাত্রা এখনকার মতো আগামী আর কয়েক বছর ধরে এতটা উঁচুই রয়ে যায়, তাহলে বাজেটের বাকিটুকু তাতেই খরচ হয়ে যাবে।
অ্যামেরিকা যে প্যারিস অ্যাকর্ড ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে, এই সত্যিটা আমাদের সবাইকে রাগাচ্ছে এবং চিন্তায় ফেলছে। রাগ আর চিন্তা হওয়াই উচিত। কিন্তু প্যারিস এগ্রিমেন্টে আপনারা যে প্রতিশ্রুতিগুলিতে স্বাক্ষর করেছিলেন তা মানতে প্রায় ব্যর্থ হচ্ছেন, সেই সত্যিটা নিয়ে কিন্তু ক্ষমতাধারী ব্যক্তিদের এতটুকুও মাথাব্যাথা নেই।
আপনারা আজ যে পরিকল্পনা বা নীতিগুলি বানাচ্ছেন, তাতে যদি উৎসতেই র্যাডিক্যাল এমিশন কাট আজ এখন থেকে অন্তর্গত না হয়, তাহলে কিন্তু প্যারিস এগ্রিমেন্টে নেওয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী উষ্ণায়নকে ১.৫ ডিগ্রি বা ২ ডিগ্রির যথেষ্ট নীচে রাখবার মাত্রায় পৌঁছানোর লক্ষ্যের দিক থেকে সম্পূর্ণভাবে বিপথে চলে যাবে।
আবার পরিষ্কার করে বলি, কথাটা ডানপন্থী বা বামপন্থী নিয়ে নয়। আপনাদের রাজনীতি নিয়ে আমাদের বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। সাসটেনিবিলিটি (স্থিরতা)-র দিক থেকে দেখলে দেখা যাবে ডানপন্থী, বামপন্থী সহ মধ্যপন্থী সবাই ব্যর্থ। কোনও রাজনৈতিক আদর্শ অথবা অর্থনৈতিক কাঠামোর মধ্যে আবহাওয়া এবং পরিবেশগত জরুরি অবস্থা সামলে একটা সুসমঞ্জস পৃথিবী নির্মাণের ক্ষমতা নেই। কারণ, সেই পৃথিবীটা, যদি খেয়াল করে থাকেন, এখন জ্বলছে।
আপনারা বলবেন, তোমরা বাচ্চারা ভয় পেও না। বলবেন, “আমাদের হাতে ব্যাপারটা ছেড়ে দাও, দেখবে তোমাদের আমরা হতাশ করব না। তোমরা নিরাশ হোয়ো না।”
তারপর, কিছুই হবে না। সবাই চুপ। অথবা স্তব্ধতার চেয়েও ভয়ঙ্কর কিছু। শূন্যগর্ভ কথা আর প্রতিশ্রুতি দিয়ে এমনটা বোঝানো হবে যে এই বিষয়ে যথেষ্ট পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
আজকের এই সমাজের কাছে যে সব সমস্যার সমাধান নেই, সেটা জানি আমরা। এবং এমিশনকে একেবারে কমিয়ে ফেলবার মতো প্রযুক্তিগত নতুন সমাধানগুলির জন্য অপেক্ষা করবার সময়ও আমাদের নেই। তাই এই রূপান্তর পর্বটি যথেষ্ট কঠিন হবে। এবং যদি না আমরা এখন একসঙ্গে টেবিলে হাতের সব তাস ফেলে সমস্যাগুলির সম্মুখীন না হই, তাহলে আর কিন্তু আমরা এর সমাধান করতে পারব না।
ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের পঞ্চাশ বছর পূর্তির দিনগুলিতে আমি এক দল ক্লাইমেট অ্যাক্টিভিস্টদের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করে দাবি তুলে বলি, পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাশালী এবং প্রভাবশালী ব্যবসাদার এবং রাজনীতিবিদ— আপনারা এবার এই নিয়ে কাজ শুরু করুন।
এই বছরের ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামে বিভিন্ন সংস্থা, ব্যাঙ্ক, প্রতিষ্ঠান এবং সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে যারা উপস্থিত আছেন, তাঁদের কাছে আমরা দাবি করছি:
- জৈব জ্বালানি সন্ধান এবং নিষ্কাশনের জন্য করা আপনাদের বিনিয়োগগুলি এখনই বন্ধ করুন;
- জৈব জ্বালানির জন্য যে সাবসিডিগুলি আপনারা দিয়ে এসেছে, তা এখনই বন্ধ করুন;
- জৈব জ্বালানির ক্ষেত্রগুলি থেকে নিজেদের এখনই সরিয়ে নিন।
২০৫০ সালে নয়, ২০৩০ বা ২০২১-এও নয়, আমরা চাই আপনারা এখনই এই কাজগুলি করুন।
আপনাদের মনে হতে পারে আমরা মাত্রাতিরিক্ত দাবি করছি। এবং আপনারা নিশ্চয়ই ভাবছেন এসব জটিল ব্যপারস্যাপার আমরা কিছুই বুঝি না। কিন্তু স্থিরতার জন্য যে রূপান্তরটা শুরু হওয়া একান্ত প্রয়োজন, তার স্বার্থে এই ন্যূনতম চেষ্টাটুকু আপনাদের করতেই হবে।
হয় এগুলি শুরু করুন, নাহলে আপনাদের সন্তানদের বোঝান কেন আপনারা ১.৫ ডিগ্রির লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছানো অসম্ভব ধরে নিয়ে এই কাজগুলি থেকে নিজেদের সরিয়ে নিচ্ছেন। চেষ্টা না করেই হাল ছেড়ে দিচ্ছেন। তবে আমি একটা কথা বলে যাই, আমার প্রজন্ম কিন্তু লড়াই না করে হার মানবে না।
সত্যিগুলি চোখের সামনে স্পষ্ট। কিন্তু সেগুলি দেখে, তাতে সাড়া দেওয়াটা আপনাদের পক্ষে অস্বস্তিকর। আপনারা সরে যাচ্ছেন এই ভেবে যে বিষয়টি এতটাই বিষাদজনক, যে মানুষরা এর থেকে সরে যাবে। কিন্তু মানুষরা হাল ছাড়বে না, ছাড়বেন আপনারা।
গত সপ্তাহে পোল্যান্ডের কয়লাখনি শ্রমিকদের সঙ্গে আমি কথা বলি, কয়লাখনি বন্ধ হওয়ার কারণে যাদের হাতে আর কাজ নেই। রুজিরোজগার না থাকলেও ওনারা হাল ছাড়েননি। বরং ওনারা এই বাস্তবটা খানিক বুঝতে পারছেন যে আপনাদের চেয়েও বেশি করে আমরা বদলটা চাইছি।
জানি না, আপনারা আপনাদের সন্তানদের কাছে নিজেদের ব্যর্থতাগুলির কী কারণ জানাবেন। কেন জেনেশুনে আপনারা তাদের এই ঘোর আবহাওয়া সঙ্কটের মধ্যে ফেলে পালাচ্ছেন, তার উত্তর কী দেবেন আপনারা? বলবেন, যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাগুলি অর্থনীতির দিক থেকে এতটাই খারাপ পরিস্থিতি তৈরি করত, যে তা বুঝে আপনারা ভবিষ্যতে বেঁচে থাকাটাকে সুরক্ষিত করবার ভাবনা ত্যাগ করছেন চেষ্টাটুকুও না করে?
আমাদের বাড়ি এখনও জ্বলছে। আপনাদের অকর্মণ্যতা প্রতি ঘণ্টায় এই আগুনে ইন্ধন যোগাচ্ছে। এবং আমরা আপনাদের এখনই কাজে নামতে বলছি এই ভেবে যে আপনারা আপনাদের সন্তানদের সব কিছুর চেয়ে বেশি ভালোবাসেন।
ধন্যবাদ।