সুভাষচন্দ্র বসু
আরও একটি ২৩ শে জানুয়ারি চলে গেল। দেশনায়কদের জন্মদিন পালনের যাথার্থ্য তাঁদের চিন্তাভাবনার আলোচনায় ও পুনর্মূল্যায়নে। পুনায় ৩ মে, ১৯২৮ সালে মহারাষ্ট্র প্রাদেশিক সম্মেলনে সভাপতি হিসেবে প্রদত্ত সুভাষচন্দ্রের ভাষণটির একটি নির্বাচিত ছোট অংশই এবারে চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম-এর স্টিম ইঞ্জিন। বক্তৃতাটি আনন্দ পাবলিশার্স প্রকাশিত সুভাষচন্দ্র বসুর 'জরুরি কিছু লেখা' (১৯৯৭) গ্রন্থ থেকে গৃহীত।
স্বাধীনতা অর্জনের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবার সময় স্বাধীনতার সমস্ত নিহিতার্থের কথা আমাদের মনে রাখা উচিত। নিজের আত্মার অর্ধাংশকে মুক্ত করে অপর অর্ধাংশকে আপনি দাসত্বশৃঙ্খলে আবদ্ধ রাখতে পারেন না। কোনও ঘরে আলো প্রবেশ করিয়ে একই সঙ্গে এমন আশা করতে পারেন না যে, সেই ঘরের একাংশ অন্ধকারবৃত থাকবে। রাজনৈতিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে একই সঙ্গে সমাজের গণতন্ত্রীকরণ প্রতিরোধ করবেন তা হয় না। না, বন্ধুগণ, আমরা যেন রাজনৈতিক গণতন্ত্রী এবং সামাজিক রক্ষণশীলের কিম্ভূত মিশ্রণ না হই। জনগণের সামাজিক জীবনের ভিতর দিয়ে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে এবং তাকে রূপ দেয় জনগণের ভাবনা এবং আদর্শ। আমরা যদি ভারতবর্ষকে প্রকৃতই মহান করতে চাই তাহলে অবশ্যই আমাদের এক গণতান্ত্রিক সমাজের বেদির উপরে একটি রাজনৈতিক গণতন্ত্র গড়ে তুলতে হবে৷ জন্ম, বর্ণ অথবা ধর্মমতভিত্তিক সুবিধার অবসান ঘটাতে হবে এবং জাতিধর্মনির্বিশেষে সকলের জন্য সমান সু্যোগের দ্বার উন্মুক্ত করে দিতে হবে। নারীর মর্যাদাও উন্নীত করতে হবে এবং জনসাধারণের ব্যাপারে ব্যাপকতর এবং বিচক্ষণতার ভাবে আগ্রহী করে তুলতে তাঁদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে।
সাম্প্রদায়িক ক্ষত আরোগ্যের জন্য প্রয়োজন হলে জোড়াতালি ব্যবস্থার নিন্দা না করেও আমাদের সাম্প্রদায়িক গোলযোগের জন্য গভীরতর কোনও প্রতিকার আবিষ্কারের প্রয়োজনীয়তার উপর আমি গুরুত্ব আরোপ করতে চাই। বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী সম্প্রদায়ের পরস্পরের রীতি, আদর্শ এবং ইতিহাসের সঙ্গে পরিচিত হওয়া প্রয়োজন, কারণ সাংস্কৃতিক ঘনিষ্ঠতা সাম্প্রদায়িক শান্তি এবং ঐক্যের পথ প্রস্তুত করবে। আমি মনে করি যে, বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে রাজনৈতিক ঐক্যের মূল ভিত্তি হল সাংস্কৃতিক পুনর্মিলন। বর্তমানে যা অবস্থা তাতে ভারতবর্ষের অধিবাসী বিভিন্ন সম্প্রদায় অত্যন্ত গণ্ডিবদ্ধ।
সাংস্কৃতিক সৌহার্দ্যের পুনঃপ্রতিষ্ঠা সহজ করতে খানিকটা ধর্মনিরপেক্ষ এবং বৈজ্ঞানিক প্রশিক্ষণের প্রয়োজন। সাংস্কৃতিক অন্তরঙ্গতার পথে সর্বাপেক্ষা বড় বাধা ধর্মোন্মত্ততা এবং ধর্মোন্মত্ততার প্রতিকার হিসাবে ধর্মনিরপেক্ষ ও বৈজ্ঞানিক শিক্ষার চেয়ে উৎকৃষ্টতর আর কিছু নেই। এই ধরনের শিক্ষা অন্য একটি দিক থেকেও প্রয়োজনীয়, কারণ এই শিক্ষা আমাদের অর্থনৈতিক চেতনা জাগ্রত করে। অর্থনৈতিক চেতনার উন্মেষ ধর্মোন্মত্ততার মৃত্যু ডেকে আনে। একজন মুসলমান কৃষক এবং একজন মুসলমান জমিদারের মধ্যে যতটা মিল তার চেয়ে ঢের বেশি মিল একজন মুসলমান কৃষক এবং একজন হিন্দু কৃষকের মধ্যে। তাদের অর্থনৈতিক স্বার্থ কোথায় নিহিত আছে জনসাধারণকে শুধু সেই শিক্ষা দিতে হবে, এবং একবার এই কথাটা বুঝতে পারলে তারা আর সাম্প্রদায়িক বিবাদে নিজেদের ঘুঁটি হিসাবে ব্যবহার করতে দিতে রাজি হবে না। সাংস্কৃতিক, শিক্ষামূলক এবং অর্থনৈতিক দিক থেকে কাজ শুরু করে ধর্মোন্মত্ততাকে ক্রমশ ধ্বংস করতে পারি এবং এইভাবে দেশে সুস্থ জাতীয়তাবোধ বিকাশ সম্ভব করে তুলতে পারি।
বর্তমান সময়ের সর্বাপেক্ষা আশাব্যঞ্জক লক্ষণগুলির মধ্যে অন্যতম হল এই দেশের তরুণদের জাগরণ। আমি যতদূর জানি, দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত আন্দোলন ছড়িয়ে গেছে এবং শুধু তরুণদেরই নয়, তরুণীদেরও আকর্ষণ করেছে। বর্তমান যুগের তরুণেরা আত্মসচেতন হয়েছে; তারা একটি আদর্শের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছে এবং নিজেদের অন্তরের আহবানে সাড়া দিতে এবং নিয়তিনির্ধারিত কর্ম সম্পাদন করতে ব্যগ্র হয়ে উঠেছে। এই আন্দোলন জাতীয় আত্মার স্বতঃস্ফূর্ত আত্মপ্রকাশ এবং এই আন্দোলনের ধারার উপর নির্ভর করছে জাতির ভবিষ্যৎ। সুতরাং এই নবজাত উদ্দীপনাকে ধ্বংস করার চেষ্টা না করে তাকে সমর্থন করা এবং ঠিক পথে পরিচালনা করা আমাদের কর্তব্য।
বন্ধুগণ, তরুণদের জাগরণে এবং যুব-আন্দোলনে সাহায্যের জন্যে আমি আপনাদের কাছে মিনতি করছি। আত্মসচেতন তরুণরা শুধু কাজই করবে না, স্বপ্নও দেখবে; শুধু ধ্বংসই করবে না, সৃষ্টিও করবে৷ এমন কি আপনারাও যেখানে ব্যর্থ হতে পারেন ওরা সেখানে সফল হবে; অতীতের ব্যর্থতা, পরীক্ষা এবং অভিজ্ঞতার ভিতর থেকে ওরা আপনাদের জন্য এক নতুন ভারতবর্ষ – এক স্বাধীন ভারতবর্ষ সৃষ্টি করবে৷ এবং, আমার কথা বিশ্বাস করুন, আমরা যদি ভারতবর্ষকে চিরকালের মতো সাম্প্রদায়িকতা এবং ধর্মান্ধতার দূষিত ক্ষত থেকে মুক্ত করতে চাই তবে তরুণদের মধ্যে আমাদের কাজ করতে হবে।
আমাদের আন্দোলনের আর একটি দিক আছে যা এদেশে কিছুটা অবহেলিত- এটি হল নারী আন্দোলন। এক অর্ধাংশের সক্রিয় সহানুভূতি এবং সমর্থন লাভ না করলে জাতির অপর অর্ধাংশের পক্ষে স্বাধীনতা অর্জন সম্ভব নয়৷ সকল দেশে- এমন কি ইংল্যান্ডের শ্রমিক দলের মধ্যে বিভিন্ন রকমের অরাজনৈতিক সংগঠন আছে, কিন্তু আমি মনে করি এদের মধ্যে একটি দেশব্যাপী রাজনৈতিক সংগঠনের অবকাশ রয়েছে। কেবল মহিলা পরিচালিত এই সংগঠনের প্রাথমিক লক্ষ্য হওয়া উচিত মহিলাদের মধ্যে রাজনৈতিক প্রচার চালানো এবং ভারতের জাতীয় মহাসভার কাজে সাহায্য করা।
বানান অপরিবর্তিত