দেবব্রত শ্যামরায়
লেখক রাজনৈতিক ভাষ্যকার, কবি এবং গদ্যকার।
১
Abolish alienation.
Obidence begins with consciousness;
consciousness begins with disobedience.
First, disobey; then write on the walls.[Laws of May 10, 1968. Paris.]
১৫ই ডিসেম্বর, ২০১৯, আজ থেকে প্রায় পঞ্চাশ রাত আগে, দক্ষিণ দিল্লির জামিয়া নগরের বাসিন্দা শ’পাঁচেক মুসলিম মহিলা যখন স্থির করলেন রাষ্ট্রপতির সদ্য-স্বাক্ষরিত নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের প্রতিবাদে এলাকার শাহিনবাগে ধরনায় বসবেন, তাঁরা নিজেরাই জানতেন না তাঁদের এই সিদ্ধান্ত ভারতবর্ষকে সেই মুহূর্তে থেকে চিরদিনের জন্য বদলে দেবে। ‘রাত’ শব্দটি এখানে দিনের চেয়েও বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ, কারণ যখন লড়াইটা শুরু হয়েছিল, সেই মধ্য ডিসেম্বরে দিল্লির রাতগুলি পাকা ছাদের তলায় কাটানোও সুখকর ছিল না, তখন যমুনা-তীরবর্তী শাহিনবাগে খোলা আকাশের নীচে রাত জাগতে শুরু করলেন নানা বয়সি মুসলিম মহিলারা, এমনকি তাঁদের মধ্যে কারও কোলে কয়েক মাসের শিশুসন্তান। ‘কয়েক মাসের শিশুসন্তান’— এই শব্দ তিনটি লিখতে গিয়ে কেঁপে উঠছি। মাত্র চার মাসের শিশু জাহান মায়ের কোলে চেপে শাহিনবাগে আসত রোজ, খেলে বেড়াত, এর ওর কাছে আদর পেত, প্রবল ঠান্ডায় ও ফুসফুসের সংক্রমণে মাত্র চার-পাঁচদিন আগে ঘুমের মধ্যেই চলে গেছে সে। শোকস্তব্ধ মা নাজিয়া, তাও শোক চোয়ালে চেপে জানাচ্ছেন, তিনি শিগগির ফিরবেন প্রতিবাদমঞ্চে, নিজের ও এখানে উপস্থিত অন্য সকলের সন্তানদের ভবিষ্যতের জন্যই তাঁকে সকলের সঙ্গে শাহিনবাগে থাকতেই হবে৷ নাজিয়ার যন্ত্রণাকে সম্মিলিত জেদে বদলে দিচ্ছে শাহিনবাগ।
এই জেদের জন্যেই শাহিনবাগ মনে করাচ্ছে কায়রোর তাহরির স্কোয়ার, ইস্তানবুলের ট্যাক্সিম স্কোয়ার, এবং নিউ ইয়র্কের ওয়াল স্ট্রিট, অথবা ঢাকার শাহবাগের নাম। সাম্প্রতিক ইতিহাসে civil disobedience-এর সবকটি আঁতুড়ঘরের সঙ্গে সাদৃশ্য ছাড়াও শাহিনবাগের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট এখানে আন্দোলনের পুরোভাগে নেতৃত্ব দিচ্ছেন শুধুমাত্র মহিলারা, আরও নির্দিষ্টভাবে বললে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মহিলারা। আলিয়া-নাজিরা অথবা বর্ষীয়ান ফতেমা বেগম অবস্থান শুরুর মাত্র এক সপ্তাহ আগে পর্যন্তও ভাবতে পারেননি তাঁদের জীবনের এই আসন্ন বাঁকবদলের কথা। এঁদের মধ্যে কেউ হয়তো কলেজ ছাত্রী, কেউ বা সামান্য গৃহবধু, অনেকেই বাড়ির লোকের সঙ্গ ছাড়া বাড়ির বাইরে পা বাড়াননি কোনওদিন। আজ বাইরে বেরিয়ে নিজের ও নিজের সন্তানের অস্তিত্বরক্ষার লড়াই লড়তে এসে বাইরের পৃথিবীর সামনে তাঁদের অস্তিত্বের প্রথাসিদ্ধ ছাঁচটা ভেঙে ফেললেন তাঁরা। ঘর থেকে বেরিয়ে যে সব মহিলা শাহিনবাগে এসেছেন, তাঁরা যখন শাহিনবাগ শেষে আবার ঘরে ফিরবেন, তাঁদের ঘরটা আর, সদর্থে, আগের মতো থাকবে না। এইভাবেই একজন ভারতবাসী হিসেবে নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে মুসলিম মেয়েদের আত্ম-আবিষ্কারের লড়াইয়ে।
মূলত এনআরসি-সিএএ-র বিরোধিতায় এই প্রতিবাদ শুরু হলেও, বিজেপি সরকারের প্রতিটি অগণতান্ত্রিক পদক্ষেপ, তা জেএনইউ-তে হামলার নিষ্পত্তিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের নিষ্ক্রিয়তাই হোক অথবা সরকারের নতুন শ্রম-নীতি, তার প্রধান বিরোধী মুখ হয়ে উঠেছে শাহিনবাগ৷ একটি একটি করে রাত জেগেছে শাহিনবাগ, আর একটি করে নূতন আন্দোলন জ্বলে উঠেছে দেশের কোনও না কোনও প্রান্তে। বিগত পঞ্চাশ দিন দেশের পঞ্চাশটিরও বেশি জায়গায় জন্ম নিয়েছে একেকটি শাহিনবাগ— কলকাতার পার্ক সার্কাসে, (এনআরসি-সিএএ-বিরোধী আন্দোলনের সমস্ত উপাদান, বিশেষ করে জেএনইউ-জামিয়া মিলিয়াতে হামলা এবং পার্ক সার্কাস ময়দানের প্রতিবাদ মঞ্চকে কেন্দ্রে রেখে চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম সম্প্রতি প্রকাশ করেছে এক দীর্ঘ সিরিজ— লেখো ক্রোধ, লেখো ঘৃণা…), বেঙ্গালুরুর মসজিদ রোডে, দেওবন্দের ঈদগাহ-র মাঠে, লখনৌ-এর ঘণ্টাঘরে, বারানসীতে। গত সাধারণতন্ত্র দিবসে কেরলে তৈরি হয়েছিল দেশের অন্যতম দীর্ঘ মানববন্ধন, প্রায় ৭০ লক্ষ মানুষের অংশগ্রহণে যা ছিল উত্তরের কাসরাগোড থেকে দক্ষিণের কালিয়াক্কাভিলাই পর্যন্ত প্রায় ৬২০ কিলোমিটার বিস্তৃত। এনআরসি-সিএএ-র বিরুদ্ধে প্রতিবাদের তালিকায় সর্বকনিষ্ঠ নামটি মুম্বইয়ের। মুম্বইয়ের নাগাপাড়া-মদনপুরা এলাকার মর্টল্যান্ড রোডের সিএএ-বিরোধী অবস্থান আজ অষ্টম দিনে পড়ল। আন্দোলনকারীরা শাহিনবাগের অনুপ্রেরণায় এই মঞ্চের নাম দিয়েছেন মুম্বই বাগ। ১১ জন মুসলিম মহিলা এক সকালে রাস্তার একপাশে একটা বিছানার চাদর বিছিয়ে তার ওপর বসে শুরু করেছিলেন আন্দোলন, অবস্থানকারীর সংখ্যা ইতিমধ্যে ২০০০ ছাড়িয়েছে। সেদিন অবস্থানে বসে গল্প করছিলেন কামরুন্নেসা ও খয়রুন্নেসা, তাঁদের বয়স যথাক্রমে ৮৫ ও ৭০। না, তাঁরা রক্তসম্পর্কে সহোদরা নন, এখানে আসার আগে কেউ কাউকে চিনতেন না, আজ তাঁরাই অভিন্নহৃদয়। এখানে এসে দুজনে ঠিক করেছেন, মহারাষ্ট্র সরকার অন্যান্য রাজ্যের মতো বিধানসভায় সিএএ-বিরোধী অবস্থান নিলে তবেই তাঁরা ঘরে ফিরবেন। মর্টল্যান্ড রোডের দুপাশে দোকানিরা আন্দোলনকারী মহিলাদের সুরক্ষা ও সুবিধা-অসুবিধার দিকে নজর রাখছেন, নিয়মিত প্যাক-করা খাবার ও পানীয় জলের যোগান দিচ্ছেন আন্দোলনকারীদের, যদিও রাস্তার একাংশ গত একসপ্তাহ ধরে বন্ধ থাকায় তাদের নিজেদের ব্যবসার ক্ষতি হচ্ছে। পুলিশ এলাকায় প্রবেশকারী প্রতিটি মানুষকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে, আশেপাশের অ্যাপার্টমেন্টে বাসিন্দাদের পুলিশি ঘেরাটোপ পেরিয়ে ঢুকতে-বেরোতে সমস্যা হচ্ছে। আন্দোলনকারীদের মত, পুলিশ চাইছে এই অবস্থান উঠে যাক তাই পরিকল্পিতভাবে এসব করছে যাতে এলাকার সাধারণ মানুষের মনে এই আন্দোলন-বিরোধী জনমত গড়ে ওঠে৷ অবশ্য আন্দোলনকারীরা অনড়, তারা ‘রোটেশন’ ভিত্তিতে প্রতিবাদ মঞ্চে আসছেন, বাড়ি ফিরছেন, আবার আসছেন। খেয়াল রাখছেন কর্পোরেশনের কলে জল আসার সময়টা, বাচ্চাদের স্কুল, বাড়ির রান্না— সমস্ত দায়িত্ব সামলেও সুনিশ্চিত করছেন মুম্বই বাগে দিনে-রাতে সবসময় যেন অন্তত চার-পাঁচশো মহিলা উপস্থিত থাকেন। ৮০ বছরের কুলসুম বেগম রোজ বেশ দূর থেকে পায়ে হেঁটে মুম্বই বাগে আসেন, সারাদিন কাটান, রাত দশটায় আবার হেঁটে বাড়ি ফেরেন। পরদিনও একই রুটিন। এই বয়সে অনভ্যাসের হাঁটাহাঁটিতে তাঁর দুই পা-ই ফুলে উঠেছে। “এখানে রোজ আসছেন কেন?” প্রশ্নের উত্তরে কুলসুম জানাচ্ছেন, “আমি এই নতুন আইন চাই না, বাবাসাহেব আম্বেদকরের আইন-ই ফেরত চাই। আমি চাই আমাদের পরের প্রজন্ম আমার দেশে নিশ্চিন্তে বাঁচুক।”
দেশজুড়ে মাথা-তোলা এতগুলি দুঃসাহসী শাহিনবাগ অক্সিজেন দিচ্ছে সংসদীয় রাজনীতিকেও। সংসদে বিজেপির পাহাড়প্রমাণ সংখ্যাগরিষ্ঠতার চাপে কোণঠাসা হয়ে যাওয়া দুর্বল বিরোধীদের সাহস জোগাচ্ছে শাহিন বাগ৷ ইতিমধ্যে দেশের ১১টি রাজ্য সরকার অবস্থান নিয়েছেন যে তাদের রাজ্যে এনআরসি প্রক্রিয়া কার্যকর হতে দেবেন না। পশ্চিমবঙ্গ, কেরল, পঞ্জাব, রাজস্থানের পর ফেব্রুয়ারির ৫ তারিখ মধ্যপ্রদেশ বিধানসভাও পঞ্চম রাজ্য হিসেবে সিএএ-বিরোধী অবস্থান নিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় কেন্দ্র সরকারের কার্যকর করা আইন কোনও রাজ্য অমান্য করতে পারে কিনা তা তাত্ত্বিক প্রশ্ন, কিন্তু দেশজুড়ে সিএএ-বিরোধী আন্দোলনের ভরবেগ যে ক্রমশ বাড়ছে, তা বলাই বাহুল্য। আন্দোলনকারীদের প্রতিবাদ শান্তিপূর্ণ অতএব আইনসঙ্গত, দিল্লি ভোটের আগে প্রশাসনিক তরফে কোনও হঠকারী সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না, তাছাড়া সারা দুনিয়ার নজর এখন শাহিনবাগে, অতএব এক অসহায় আস্ফালনে হাঁসফাঁস করছে কেন্দ্রের শাসক। এই আন্দোলন নিয়ে শাসক দল এতটাই বিরক্ত, বিব্রত যে আসন্ন দিল্লি নির্বাচনেও সব ছেড়ে বিজেপি-র মূল অ্যাজেন্ডা এই শাহিনবাগই। রোজ সকালে ঘুম ভেঙে চায়ের কাপে তেতো স্বাদের সঙ্গে শাহিনবাগকে স্মরণ করেন অমিত শাহ। এই নির্বাচনে তাঁর প্রচার, ‘এত জোরে এত রেগে ইভিএম-এর বোতাম টিপুন, যে শাহিনবাগে ইলেকট্রিক শক পৌঁছে যায়।’ ‘গোলি মারো শালোঁকো’, বিজেপি নেতাদের উসকানিমূলক ভাষণে উদ্বুদ্ধ হয়ে দিল্লির দুই তরুণ সত্যিই এসে ‘দেশদ্রোহী’দের লক্ষ করে গুলি চালিয়েছে শাহিনবাগে-জামিয়া মিলিয়ার মিছিলে। আন্তর্জাতিক মহলও সিএএ নিয়ে কেন্দ্র সরকারের সমালোচনা করেছে। অবশেষে পরিস্থিতি সামলাতে এ মাসের চার তারিখ সরকার সংসদে দাঁড়িয়ে স্বীকার করে নিল আপাতত দেশে এনআরসি কার্যকর করা হচ্ছে না। ‘আপাতত’ শব্দের অস্বস্তি থাকলেও এই ঘোষণা শাহিনবাগ সহ সারা দেশে সরকার-বিরোধী আন্দোলনের নৈতিক জয় নিঃসন্দেহে। তবু পিছু হঠার লক্ষণ দেখাচ্ছেন না আন্দোলনকারীরা। সিএএ ‘রোল ব্যাক’ না করা পর্যন্ত ঘরে ফিরবেন না কুলসুম-খয়রুন্নিসারা। এনআরসি নিয়ে সরকারি ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে দেওবন্দের মৌলবীরা আন্দোলনকারীদের অনুরোধ করেছিলেন আপাতত ঘরে ফিরে যেতে, সে অনুরোধ পত্রপাঠ প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। একটা দীর্ঘ ‘অরাজনৈতিক’ জীবন কাটিয়ে শীত ও সূর্যের আলোর নিচে প্রথমবার বেরিয়ে এসেছেন যাঁরা, যুদ্ধে পুরোপুরি না জিতে মাঝপথে ঘরে ফেরার কোনও ইচ্ছে নেই তাঁদের।
দুই
জিনহে নাজ হ্যায় হিন্দ পর, ওহ কাঁহা হ্যায়?
ওহ ইঁহা হ্যায়… ইঁহা হ্যায়… ইঁহা হ্যায়![স্লোগান, শাহিনবাগ]
এরপরেও বেশ কিছু কথা বলা বাকি থেকে যায়।
শাহিনবাগ ও তার সহোদরাগুলি স্বাধীনতা-উত্তর ভারতবর্ষে একটি প্যারাডাইম শিফট-এর সূচনা করেছে একথা বলা যেতে পারে। মোদির রাজত্বে ছয় বছর অবিচার ও বৈষম্য সহ্য করে চুপ থাকার পর ভারতীয় মুসলিমরা সম্ভবত এই প্রথম মুসলিম হিসেবে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই নিজেরাই শুরু করেছেন। তারও আগে অর্থাৎ স্বাধীনতার পর থেকে এতদিন পর্যন্ত দেশীয় রাজনীতির ময়দানে অন্যেরাই মুসলিমদের হয়ে কথা বলার দায়িত্ব নিয়েছিল, ভারতীয় মুসলিমদের প্রতিনিধিত্ব তথাকথিত সেকুলার দলগুলিকে ‘আউটসোর্স’ করা ছিল। একটা সম্ভাব্য কারণ, দেশভাগের পর এদেশে থেকে যাওয়া মুসলিমরা নিজেদের প্রতিনিধিত্ব নিয়ে দ্বিধান্বিত ছিলেন, কারণ ১৯৪৭-পূর্ব ভারতে মুসলিমদের একমাত্র সর্বভারতীয় প্রতিনিধিত্বমূলক দলটির নাম ছিল ‘মুসলিম লিগ’, যার গায়ে দেশভাগের কলঙ্ক লেগে আছে। পাশাপাশি তারা হয়তো আশা করেছিলেন, ধর্মের ভিত্তিতে কাউকে কোনও সুবিধে দেওয়া হবে না, কারও অধিকার হরণ করাও হবে না— এমন আদর্শে বিশ্বাসী একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আলাদা করে ধর্মভিত্তিক দল থাকার প্রয়োজন হবে না। কিন্তু ওই ‘সেকুলার’ দলগুলির মধ্যে খুব কম সংখ্যকই সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষার প্রতি আন্তরিক ছিল। উদাহরণস্বরূপ, জওহরলাল নেহেরুর সময় জাতীয় কংগ্রেস এবং সাধারণভাবে বামদলগুলি সেকুলারিজমের প্রতি প্রকৃত আনুগত্য দেখিয়েছে, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভারতীয় মুসলিমরা ভোটব্যাঙ্ক রাজনীতির বোড়ে হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছেন। দক্ষিণপন্থী হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি দীর্ঘদিন যাবৎ সেকুলার দলগুলির বিরুদ্ধে সংখ্যালঘু তোষণের অভিযোগ এনেছে, কিন্তু এই তথাকথিত তোষণ আদতে কতিপয় মধ্যসত্ত্বভোগী দালালের শ্রীবৃদ্ধি ঘটিয়েছে মাত্র। গত অর্ধশতকেরও বেশি সময় ধরে সাধারণ মুসলিম জনগোষ্ঠীর আর্থসামাজিক অবস্থা যে আসলে তলানিতেই ঠেকে আছে; শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জীবনযাত্রার মান কোনও ক্ষেত্রেই তাদের উল্লেখযোগ্য কোনও উন্নতি হয়নি— রাজেন্দ্র সাচারের রিপোর্ট আমাদের তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল।
আজ এত বছর পর, ৪৭-এ এদেশে থেকে যাওয়া মুসলিমরা মনে করতেই পারেন, এ দেশে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্তটা হয়তোবা ভুল ছিল। অন্তত, এটা নিশ্চিত যে মোদি সরকার এই মুহূর্তে তাদের এটা মনে করতে বাধ্য করছেন। তবে মুসলিমরা আত্মকরুণায় ভুগছেন না। দেওয়ালে পিঠ ঠেকতে শুরু করা একটা ধর্ম-সম্প্রদায় হিসেবে তারা পথে নেমেছেন। যে তথাকথিত সেকুলার দলগুলিকে তারা নিজেদের স্বার্থরক্ষার দায়িত্ব দিয়েছিলেন, সেই দলগুলির ক্ষমতা ও সদিচ্ছার ওপর আর ভরসা রাখতে পারছেন না তারা। মুসলিম পারসোনাল ল বোর্ড এ দেশে মুসলিমদের স্বঘোষিত অভিভাবক, কিন্তু সংসদীয় রাজনীতিতে তারা অবান্তর, তাছাড়া নানা প্রশ্নে ল বোর্ডের কট্টর অবস্থান এই প্রজন্মের মুসলিম ছেলেমেয়েদের কাছে বোর্ডকে অপ্রাসঙ্গিক করেছে। যেমন, তিন তালাকের মতো তর্কাতীতভাবে একটি লিঙ্গসাম্যবিরোধী কুপ্রথা (এ প্রথার প্রয়োগ ভারতের মুসলিম সমাজে যত বিরলই হোক না কেন) প্রসঙ্গে ল বোর্ড-এর অবস্থান প্রথম থেকেই অস্বচ্ছ ছিল। প্রসঙ্গত, তিন তালাক রদ করার জন্য ভারতের মুসলিমদের যে তাদের ‘নেমেসিস’ বিজেপির সরকারের ক্ষমতায় আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হল, এই ঘটনা এদেশে মুসলিমদের উন্নয়নে সেকুলার দলগুলির প্রকৃত সদিচ্ছার অভাব ও ভোটব্যাঙ্ক রাজনীতির স্বরূপ স্পষ্ট করে তোলে। সব মিলিয়ে, নাগরিকত্বের প্রশ্নে মুসলিম সমাজের সরাসরি পথে নামা ভারতবর্ষের রাজনীতিতে তাদের এক সৎ, আন্তরিক ও গ্রহণযোগ্য প্রতিনিধির অভাব তুলে ধরছে। বস্তুত, মৌলানা আবুল কালাম আজাদের পর সর্বভারতীয় স্তরে আর কোনও মুসলিম রাজনীতিবিদ আসেননি যিনি সম্প্রদায়ের মধ্যে ও সম্প্রদায়ের বাইরে সমানভাবে গ্রহণযোগ্য হতে পারেন। বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে মুসলিম সমাজের প্রতিনিধিত্বের এই শূন্যতা পূরণ করার চেষ্টা করছে দেশের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা প্রত্যেকটি শাহিনবাগ। অদূর ভবিষ্যতে আপাত-সংসদীয় আসাদউদ্দিন ওয়াইসি ও কট্টরপন্থী মৌলবাদী আকবরউদ্দিনের দল এআইএমএম এই রাজনৈতিক স্পেসটি অধিকার করে নেবে কিনা তা সময়ই বলবে, তবে আপাতত তার কোনও আশু লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
প্রতিরোধের পাশাপাশি শাহিনবাগ কিছু অস্বস্তিরও জন্ম দিচ্ছে। ফেজ টুপি, হিজাব-পরিহিত মাথার সারি সাম্প্রদায়িক হিন্দু মনে ভয়ের উদ্রেক ঘটাচ্ছে। বিজেপি-র কেন্দ্রীয় মন্ত্রী গিরিরাজ সিংহ সম্প্রতি বলেছেন শাহিনবাগে নাকি ‘সুইসাইড বম্বার’দের লালন করা হচ্ছে। তিনি জনগণের কাছে আবেদন করেছেন, দিল্লি যাতে একটি ইসলামি রাজ্য না হয়ে ওঠে তা সুনিশ্চিত করতে বিজেপিকে ভোট দিন। অন্যদিকে, এমন মানুষও আছেন, যারা বিজেপির রাজনীতির উগ্র সমর্থক নন এবং নিজেকে অসাম্প্রদায়িক মনে করেন, অথচ তারাও টুপি ও দাড়ির আধিক্য দেখলে কেমন যেন গুটিয়ে যান। দীর্ঘদিন পাশাপাশি কাটালেও অন্য সম্প্রদায়কে ঘনিষ্ঠভাবে চেনার ক্ষেত্রে অনীহা একজন মুসলিম সহনাগরিককে সহজভাবে বোঝার ক্ষেত্রে বাধা তৈরি করে। আমরা ভুলে যাই, দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু যেমন বেদ, গীতা পাঠ করে তারপর হিন্দু হননি, ঠিক তেমনি মুসলিম সাধারণ মানুষও কোরানের অর্থ জেনেবুঝে তারপর মুসলিম হয়ে ওঠেননি। একজন খেটেখাওয়া সামান্য মুসলমানের সঙ্গে কোরানের আয়াতের দূরত্ব ঠিক ততটাই, যতটা একজন সাধারণ হিন্দুর বেদের সূক্ত-র সঙ্গে। নিতান্ত সংস্কার ও সমষ্টিগত অভ্যাসে প্রত্যেকে তাদের ধর্মচিহ্ন ধারণ করছেন মাত্র। ঠিক যেমনভাবে হিন্দু ব্রাহ্মণ পৈতে ধারণ করেন, কেউ বা কপালে তিলক কাটেন। এটাও আমাদের আজন্মলালিত, হিন্দু সমাজের অংশ হিসেবে বেড়ে ওঠার অভ্যাস যে হিন্দুর ধর্মপালন বা ধর্মচিহ্ন আলাদা করে আমাদের চোখে লাগে না। একজন মুসলিম মেয়ের হিজাব, তার ক্রমপ্রসরমান প্রগতিশীল চেতনার চাপে একদিন ঠিকই খসে যাবে, কিন্তু যতদিন না তা হচ্ছে, তাকে আমাদের ‘অপর’ মনে করে দূরে সরিয়ে রাখার কোনও কারণ নেই। কথায় কথায় নিজের ভারতীয়ত্বের প্রমাণ দেওয়ার দরকার নেই, ভারতের সংবিধান যেহেতু প্রত্যেকের ধর্মপালনের (এবং না পালন করার) অধিকার সুরক্ষিত রেখেছে, শুধুমাত্র মুসলমান হিসেবেই তারা তাদের অধিকার দাবি করতে পারেন। তাছাড়া সিএএ আইন যখন ধর্মের ভিত্তিতেই বৈষম্য সৃষ্টি করেছে, হিন্দুরাষ্ট্রে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হয়ে পড়ার খাঁড়া প্রতিটি মুসলমানের কাঁধে ঝুলছে, তাহলে শুধুমাত্র মুসলমান হিসেবেই একজন মুসলমান নাগরিক তার প্রতিবাদ করতে পারবেন না কেন? তাই শাহিনবাগ নিয়ে হিন্দু ভারতীয়ের অস্বস্তি আসলে তার চেতনায় বিদ্বেষ অথবা অবচেতনে অপরিচয়ের সঙ্কট, তা আদতে ধর্মনিরপেক্ষ ভারতবর্ষের সমস্যা নয়।
অস্বস্তি শার্জিল ইমামকে নিয়েও। অসম নিয়ে শার্জিলের অতিবিপ্লবী কথাবার্তার রেকর্ড শাসকের হাতে হাতিয়ার তুলে দিয়েছে। বলার চেষ্টা হচ্ছে, শাহিনবাগের চরিত্র আসলে এটাই— দেশদ্রোহিতার। শাহিনবাগ আন্দোলনের পরিচালকমণ্ডলী শার্জিলকে কমিটি থেকে বিতাড়িত করেছেন। কিন্তু ভেবে দেখার, একটা স্বতঃস্ফূর্ত গণআন্দোলনে বিভিন্ন মত ও পথের মানুষ এসে মিলতে পারেন, আগে থেকে তা আদৌ নিয়ন্ত্রণ করা যায় কি? আর দেশের নির্বাচিত ‘গণতান্ত্রিক’ শাসক যখন বিরুদ্ধ মতকে দমন করতে বারবার গণতন্ত্র-বহির্ভূত পন্থা নিচ্ছেন, সেখানে সাধারণ মানুষের গণআন্দোলনের বহিঃপ্রকাশ সবসময় কপিবুক গণতন্ত্র নির্ধারিত পথেই হবে, এতটা আশা করা কি অন্যায় নয়? শার্জিল ইমাম যদি অ্যান্টি-ন্যাশনাল হন(তাঁর নামটি ‘শার্জিল ইমাম’ বলেই কি অপরাধ গুরুতর?), তাহলে যে ব্যক্তি গৌরী লঙ্কেশের হত্যায় উচ্ছ্বসিত উগ্র হিন্দু মৌলবাদীকে অথবা শাহিনবাগে বোরখা পরে ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ স্লোগান দিয়ে আন্দোলনকে বদনাম করতে চাওয়া গুঞ্জা কাপুরকে টুইটারে ‘ফলো’ করেন, তাঁর ভাবমূর্তি নিষ্কলুষ থাকে কী করে? শুধুমাত্র তিনি দেশের প্রধানমন্ত্রী বলে?
শাসকের কাজের সামান্যতম বিরোধিতা করলে যেকোনও সময় নেমে আসতে পারে চূড়ান্ত আঘাত— এই ভয়টাই ভেঙে দিয়েছে শাহিনবাগ৷ সাহস যোগাচ্ছে বেঙ্গালুরুর মসজিদ রোড, কলকাতার পার্ক সার্কাস। গত বছর ঠিক এইরকম সময়ে যে ফ্যাসিস্ট শাসককে অপরাজেয় মনে হচ্ছিল, আজ রাজ্যে রাজ্যে ক্ষমতা থেকে তাদের প্রস্থানের ছবি দেখা যাচ্ছে। গানে-কবিতায়-নাটকে-স্লোগানে, তারুণ্যে সৃষ্টিশীলতায় গণতন্ত্রের এক নতুন পরিসরের নির্মাণ শুরু হয়েছে শাহিনবাগে। নতুনভাবে সজ্জিত হচ্ছে আমাদের চিরচেনা শ্রেণিসমীকরণগুলি। মুম্বই নগরীতে কৃষক লং মার্চের সময় আমরা দেখে শিহরিত হয়েছিলাম, মুম্বইয়ের ডাব্বাওয়ালারা রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে নিজেদের তৈরি খাবার তুলে দিচ্ছিলেন কিলোমিটারের পর কিলোমিটার হেঁটে আসা ক্লান্ত চাষিভাইদের মুখে। শাহিনবাগে দেখছি দিল্লির সিংহহৃদয় শিখ সম্প্রদায়ের বর্ষীয়ান মানুষদের, তাঁরা লঙ্গর লাগিয়ে খাবার তৈরি করছেন অবস্থানরত মুসলিম বোনভাইদের জন্য। লঙ্গরের খরচ চালাতে গিয়ে দিল্লির এক শিখ আইনজীবী নিজের একটি ফ্ল্যাট বিক্রি করে দিয়েছেন, আরও কিছুদিন তিনি তাঁর মুসলিম বোনেদের খাবার রেঁধে খাওয়াতে চান। হরিয়ানা থেকে এসে শাহিনবাগের পাশে দাঁড়িয়ে সহমর্মিতার বার্তা দিচ্ছেন কৃষকের দল। আমরা অনেকেই নূতন প্রজন্মদের ছেলেমেয়েদের ভাবতাম— স্বার্থপর, কেরিয়ারসর্বস্ব, শ্রেণি-অচেতন এক ভারচুয়াল পৃথিবীর বাসিন্দা। অবাক হয়ে দেখছি, এই প্রজন্মই কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে এসে দলে দলে পথে নামছে, ভুল প্রমাণিত করছে নিরাপদ দূরত্বে থাকা চশমা-আঁটা বিজ্ঞদের। ছাত্র-যুবরা এসে দাঁড়িয়েছে শাহিনবাগের আন্দোলনের পাশে। গলা মিলিয়েছে স্লোগানে-গানে। সত্তর বছর আগে যে সাধারণতন্ত্র আমাদের দেশে কার্যকর হয়েছিল, আজ ফ্যাসিবাদের সঙ্কটের মুখে দাঁড়িয়ে সেই সাধারণতন্ত্রের অগ্নিপরীক্ষা হচ্ছে। এই আগুনে পুড়ে কি ছাই হয়ে যাবে আমাদের দেশের বহুত্ববাদের ধারণা? নাকি আগুনে পুড়ে আরও শক্ত হবে এর ভিত্তি, তার রং হবে আরও পাকা? ধর্মনিরপেক্ষতা ধারণা কি এদেশের মানুষের কাছে ওপর থেকেই চাপিয়ে দেওয়া একটা শুষ্ক শব্দ মাত্র, নাকি এদেশের বৈচিত্র্য ও বৈপরীত্য বাঁচিয়ে রাখার মৌলিক চাবিকাঠি? এ হেন নির্ণায়ক লড়াইয়ে আমাদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন মুসলিম নারীরা। যাঁদের আমরা চিরকাল দুর্বল, পর্দানসীন, পুরুষতন্ত্রের নির্যাতনের শিকার ধরে নিয়ে করুণা করে এসেছি, আজ তাঁরাই প্রকাশ্য রাজপথে বেরিয়ে এসে শাসকের ঘুম কেড়ে নিয়েছেন। সংবিধান হাতে নিয়েই তাঁরা সংবিধান বাঁচানোর লড়াইয়ে নেমেছেন। জাতীয় পতাকা, জাতীয় সঙ্গীত, যেগুলিকে আমরা তামাদি হয়ে যাওয়া রাষ্ট্রীয় প্রতীক ভেবে ভুল করেছিলাম, সেগুলিকে আবার জনগণের মাঝে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছেন তাঁরা।
মুসলিম মায়েদের গর্ভে এক নতুন ভারতবর্ষ জন্ম নিচ্ছে। আমরা যারা এখনও ধর্ম পেরিয়ে বিশ্বব্যাপী মানুষের শ্রম, ঘাম ও সমানাধিকারে বিশ্বাস রাখি, কুলসুম-খয়রুন্নিসা-ফতেমার হাতে হাত রেখে আমাদের আজ শুধু এই গর্ভযন্ত্রণার সময়টুকু পেরিয়ে যেতে হবে।
‘আমরা ভুলে যাই, দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু যেমন বেদ, গীতা পাঠ করে তারপর হিন্দু হননি, ঠিক তেমনি মুসলিম সাধারণ মানুষও কোরানের অর্থ জেনেবুঝে তারপর মুসলিম হয়ে ওঠেননি। একজন খেটেখাওয়া সামান্য মুসলমানের সঙ্গে কোরানের আয়াতের দূরত্ব ঠিক ততটাই, যতটা একজন সাধারণ হিন্দুর বেদের সূক্ত-র সঙ্গে।’ — খুবই মনে রাখার মতো কথা। শিক্ষিত প্রগতিশীল হিন্দুরাও নিজেদের মধ্যে আলোচনায় মুসলিমদের প্রতি একেবারে অজ্ঞতাপ্রসূত যে ক্ষোভ প্রকাশ করেন, তার কারণ এটাই। শাহিনবাগ নিয়ে আলোচনাটি অবশ্যই ভাল , কিন্তু প্রসঙ্গত বলা মন্তব্যটি খুবই প্রয়োজনীয়।