একগুচ্ছ গদ্য-আলেখ্য

মাসুদ খান

 

বিশ্বব্যাপার

লোকালয়হীন, জলজঙ্গলভরা বিস্তীর্ণ ভূভাগ। তার ভেতর দিয়ে ভূমিতে সাঁটানো কালো স্কচ টেপের মতো চলে গেছে নির্জন পিচঢালা পথ। আঁকাবাঁকা। যেন এক অতিকায় রিল থেকে হঠাৎ ছাড়া পেয়ে ছড়িয়ে পড়েছে শতশত মাইল ফিল্ম-ফুটেজ, রাশপ্রিন্ট।

সড়ক ধরে ছুটে চলেছে এক নিঃসঙ্গ যন্ত্রযান। মাঝে মাঝে তার পথ আগলে দাঁড়াচ্ছে দুর্বিনীত গ্রিজলি ভালুক, বাচ্চাকাচ্চাসহ। কখনও কখনও মাথাভর্তি শিঙের জটিল জঙ্গল-অলা মুজ-বাহিনী। মাইল কয়েক পরপর মূল সড়ক থেকে বেরিয়ে কোথায়-না-কোথায় উধাও হয়ে চলে গেছে সরু-সরু সব প্রশাখাসড়ক।

এদিকে পথ হারিয়ে বাহন ছুটছে উন্মাদের মতো এলোমেলো দিশাহারা। জিপিএস-এর ধীরস্থির স্পষ্টবাক মেয়েটিও মাথাখারাপের মতো ক্রমাগত বলেই চলেছে ‘টার্ন রাইট’, ‘টার্ন লেফট’, ‘ক্যালকুলেটিং রাউট’। এই এখনই ‘রাইট’ তো পরক্ষণেই ‘লেফট’, আবার এখনই ‘ক্যালকুলেটিং…’। অনেকক্ষণ এরকম করতে করতে একসময় হাল ছেড়ে দিয়ে নিশ্চুপ হয়ে গেছে সে… সেও বেশ আগে। ক্রমেই ফুরিয়ে আসছে জ্বালানি, ফুরিয়ে আসছে আশা ও আলোক। আশপাশ, পরিবেশ সব ভয়াবহরকম নির্জন। জনমানুষের চিহ্নমাত্র নাই। হঠাৎ স্পষ্ট শোনা গেল এক ঢেউ-খেলানো লোকগানের কলি “বহুদিনের পিরিত গো বন্ধু, একই দিনে ভেঙো না”, পরিষ্কার বাংলা ভাষায়। আলাস্কায় বাংলা গানের কলি! তা-ও এই হিম-হিম নিঃঝুম জলাজংলা পথে!

ঝোপের ভেতর থেকে ভেসে আসছে খালি গলার ওই গান। ইতস্তত ফুটে উঠছে আরও অনেক গানের কলি। পাপড়ি-ব্যাদান-করে-থাকা, পতঙ্গ-ধরে-ধরে-খাওয়া ভেনাস ফ্লাই ট্র্যাপ, দুধশাদা-আলোবিচ্ছুরণী ড্যানডেলিয়ন, আর্কটিক স্প্রুসের মঞ্জরী… একে-একে সবকিছুতে চটপট ফুটতে থাকল বিচিত্র সব গীতকলি, এলোপাথাড়ি দৈবচয়নে– “ওলো সই, আমার ইচ্ছা করে তোদের মতো মনের কথা কই”, “আমার কাঙ্খের কলসি, গিয়াছে ভাসি, মাঝি রে তোর নৌকার ঢেউ লাগিয়া”, “যেজন প্রেমের ভাব জানে না, তার সাথে নাই লেনা-দেনা”, “দেখেছি রূপসাগরে মনের মানুষ কাঁচা সোনা”, “দ্যাখ-না মন ঝকমারি এই দুনিয়াদারি”, “কান পেতে রই, ও আমার আপন হৃদয়…”, “নদীর নাম সই অঞ্জনা, নাচে তীরে খঞ্জনা সই…”, “গৌর বলে বাহির হব, গৃহেতে আর রব না গো”, “শাওনও রাতে যদি স্মরণে আসে মোরে”, “আমি বাংলায় গান গাই…” “অমরত্বের প্রত্যাশা নেই, নেই কোনও দাবিদাওয়া/এই নশ্বর জীবনের মানে শুধু তোমাকেই চাওয়া”…

দুর্জ্ঞেয়, দুর্বোধ্য, রোমহর্ষক সব বিশ্বব্যাপার।

এক প্রহেলিকাপূর্ণ পটভূমি-সংগীতে বেজে চলল গোলার্ধপ্রতিম দূরের নির্জন নিঝুম আর্কটিক বনপথ– বাংলা ভাষায়, বাংলা সুরে।

 

সনেট

বিন্দু শূন্যমাত্রিক। রেখা একমাত্রিক। ক্ষেত্র দ্বিমাত্রিক। ঘনবস্তু ত্রিমাত্রিক। দেশকাল চতুর্মাত্রিক…

বহু ও বিচিত্র মাত্রা নিয়ে অনেককাল ধরে ভেবে আসছে মানুষ, মাত্রাতিরিক্তভাবে।

মানুষের মন অন্তত আঠারোমাত্রিক। ভাবনানন্দ সনেট।

 

যোগসূত্র

এও এক জটিল জালিকাবিন্যাস।

এই যে হারান মণ্ডল মাঝে-মধ্যেই বউ পেটায়

সার্কাসের অতিপ্রশিক্ষিত জোকারও মাঝে-মাঝে ভুল তামাশা দেখায়

এসবের জন্য নাকি কোনও-না-কোনওভাবে দায়ী থেকে যায়

বহু-দূরে-থাকা বিশ্বব্যাংকের চেয়ারম্যানও!

 

অহিংসা, শান্তি ও প্রেম

আমরা অহিংসায় বিশ্বাসী—

আমাদের এ-কথায় বিশ্বাস না গেলে একটু তো সহিংস হতেই হয়!

সহিংস হয়েই বোঝাতে হয় অহিংসার মর্ম।

আমরা শান্তির ধারক, বাহক ও নিষ্ঠ সেবক—

আমাদের এই এত সুন্দর শান্তিবাগে না এলে, শান্তিসেবা না নিলে

কিছুটা তো অশান্তি করতেই হয়!

অশান্তি করেই বোঝাতে হয় শান্তির মাজেজা।

আমরা প্রেমের পূজারি—

আমাদের প্রেম– ক্ষারকের মতো খর।

 

প্রেম

এই এক উদ্ভ্রান্ত বিদ্যুৎ যা মানুষকে মুহূর্তে পরিণত করে শক্তিশালী চুম্বকে।

আর সেই চুম্বক যা আবার বানায় বিদ্যুৎ আর তা চমকিয়ে চলে মানুষে মানুষীতে।

 

উপলব্ধি

এক আর এক মিলে দুই হয়। বেশিও হয়, আবার কমও হয়। এমনকি শূন্যও হতে পারে।

নির্ভর করছে কোন দিক থেকে কোন বেগে কোন দৃষ্টিকোণে এসে তারা মিলছে পরস্পরে।

 

অচিকিৎস্য

বহুবক্র কাষ্ঠখণ্ডে গড়া মানব, মানবতা—

যা থেকে হয় না সরল কোনও কিছু।

                          –ইমানুয়েল কান্ট

সুস্থ স্বাভাবিক হয়ে উঠবে মানুষ একদিন—

বিশ্বাসযোগ্যতার সূচকে এই আশাতথ্য যেন

জাতকের সমুদ্রশোষণ…

পঙ্গুর অলঙ্ঘ্য অট্টালিকা-লঙ্ঘন…

সুখী সুদর্শন সংসারীজনের গাভিগমন…

জিরাফের অশ্বারোহণ…

 

শুভেচ্ছাশক্তি

মহাবিস্ফোরণের পর ব্রহ্মাণ্ড যখন ছড়িয়ে জুড়িয়ে যাচ্ছিল একটু একটু করে, তখন ওই ছোট্ট শিশুবিশ্বজুড়ে কেবলই বিকিরণ আর বিকিরণ। আর সেই বিকিরণ থেকে মুহুর্মুহু তৈরি হচ্ছিল কণিকা ও প্রতিকণিকা। ছুটছিল দিগ্বিদিক। আবার তারা যেই মুখোমুখি, অমনি সংঘর্ষ। অমনি পরস্পরে বিলীন হয়ে গিয়ে ফের ফিরে যাওয়া শক্তিতে, বিকিরণে।

বিশ্ব আরও প্রসারিত হতে থাকল ক্রমে। কমে এল উত্তাপ উষ্ণতা। থেমে গেল শক্তি থেকে কণিকা-প্রতিকণিকা তৈরির যজ্ঞলীলা। তবে কী এক দুর্জ্ঞেয় কারণে, সমান-সমান না হয়ে প্রতিকণিকার চেয়ে কণিকা তৈরি হয়েছিল অনেক বেশি। প্রকৃতি দেখিয়েছিল এক স্পষ্ট প্রগাঢ় পক্ষপাত, কণিকার প্রতি।

ভাগ্যিস দেখিয়েছিল! ভাগ্যিস প্রকৃতি নিজেই ভেঙেছিল তার স্বরচিত প্রতিসাম্যের নিয়ম! তা না হলে এ-বিশ্ব এখন ভরা থাকত শুধুই বিকিরণে।

সে-কোন বিধান-ভাঙা বিধি, সে-কোন পক্ষপাতদুষ্ট একরোখা শুভেচ্ছাশক্তি প্রকৃতির, যার আবেশে বিশ্ব আজ এমন বস্তূজ্জ্বল, প্রাণ-থইথই?

 

অভিব্যক্তি

গাছপালা সব ব্রোঞ্জের, পাখিরা অ্যালুমিনিয়ামের, ঘাসপাতা লতাগুল্ম সব প্লাস্টিকের। আগাগোড়া ধাতু ও কংক্রিটে মোড়ানো সব নিরেট নির্বিকার উল্লম্ব স্তূপরাশি। মানুষেরা সব পণ্যপর্বত আর ভোগপাহাড়ের মধ্যে আটকা-পড়া, অসুস্থ উদ্ভ্রান্ত গিনিপিগের মতো ক্রমাগত ছুটতে-থাকা।

হাঁপিয়ে-ওঠা, হাসফাঁস-করা মানুষেরা কোথায় গেলে পাবে একটু নিরাময়, একটু সবুজ, একটু গা-ছমছমে ভাব, কোথায় গিয়ে উগরে দেবে তাদের দিনগত জহরিলা, ঘোচাবে বিভ্রম বিভ্রাট, লঘু পাপেচ্ছা… তা-ও একটু ভেবে রেখেছিলেন মা প্রকৃতি।

দৃষ্টি-ও-শ্রুতিকঠোর এই ধাতুনগরীর মাঝখান দিয়ে বক্ষসন্ধি বরাবর আগে থেকেই বইয়ে রেখেছেন এক চিলতে ধারালো নদী– জংলি ও খরশান। ছোট্ট নদীর দুই ধারে বিচিত্র-প্রাণীপতঙ্গ-অধ্যুষিত জঙ্গলে-ভরা পাহাড়ি অববাহিকা। ঢালের একবার নিচে ওই কৃশকায়া বন্যতোয়ার পাড়ে এসে দাঁড়ালে ঘন জঙ্গলজালের আড়ালে সম্পূর্ণ ঢাকা পড়ে যায় ওই নিষ্করুণ নগরী। কিছুই আর দেখা যায় না তখন ওই স্তূপ-স্তূপ কংক্রিটরাশির।

কোটি কোটি টন ধাতুকংক্রিটের এই দুর্ধর্ষ নগরত্বের বিপরীতে এই এক টুকরো দুর্দান্ত প্রাকৃতিকতা। এক ভয়াল কালাপাহাড়ি জড়ত্বের বিরুদ্ধে প্রাণপণ লড়াইরত এক ফালি সবুজ সজল জৈবিকতা।

 

বন্ধুতা

সেই এক সম্পর্কশক্তি যা পরস্পরের মধ্যকার উত্তম ও উর্বর উপাদানগুলিকে করে তোলে বহুগুণিত আর অনুত্তমগুলিকে করে খণ্ড-খণ্ড, ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র।

এক মানবীয় সম্পর্কশক্তি, নাম যার বন্ধুত্ব। জীবনে এমন কেউ-কেউ থাকে, থাকার প্রয়োজন হয়, যে কখনও হাঁটে না পথপ্রদর্শকের মতো আগে-আগে, আবার থাকে না পিছে-পিছেও, বরং পথ চলে হাত ধরে পাশাপাশি। সেই বিশেষ ‘কেউ-কেউ’ হতে পারে রক্তসম্পর্কের কিংবা রক্তসম্পর্কবহির্ভূত, অন্য।

বন্ধুত্ব সেই শর্ত ও অবস্থা, যেখানে রক্তের সম্পর্কের চেয়ে রক্তসঞ্চালনযন্ত্রের সম্পর্ক হয়ে ওঠে প্রবলতর, যা পরিস্ফুট হয়ে ওঠে জীবনের বিশেষ বিশেষ ক্রান্তিমুহূর্তে।

বন্ধু তাই ‘পর’ হয়েও ‘স্ব’– এক স্পষ্ট পরস্বপ্রকৃতি, কিংবা এক স্বপর-স্বভাব। আর বন্ধুতা?

–সারাদিন ধরে চলা এক উচ্ছল উৎসব, যে উৎসব বেশি জমে ওঠে দিনের প্রথম আর হয়তো পড়ন্ত বেলায়।

 

 

ছবিঋণ – ইন্টারনেট

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4879 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Comment

আপনার মতামত...