অভিজিৎ কুণ্ডু
লেখক দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক।
শীতের এক প্রলম্বিত অপরাহ্ণে দীনদয়াল মার্গে স্থিত ভারতের সবচেয়ে ধনী রাজনৈতিক দলের প্রধান দপ্তর যখন মুহ্যমান, দিল্লি তখন গণতন্ত্রের তালে নাচছে। সবাইকে নিয়ে এগিয়ে চলার রাজনীতি আরও একবার দেশের ধর্মান্ধ রাজনীতির রণহুঙ্কারকে পরোয়া না পরাজিত করল। জিতল সবাইকে মেলানোর রাজনীতি। জীবন ও সামাজিক সুরক্ষার রাজনীতি স্তব্ধ করল ঘৃণাভরা অশুভ কণ্ঠস্বর। প্রায় হারিয়ে যাওয়া এক সময়ের ছন্দে মেতে উঠল দিল্লির রাস্তা আর মহল্লাগুলি। দীনদয়াল মার্গে কোটি কোটি টাকায় নির্মিত প্রাসাদ তখন ভারতীয় ফ্যাসিস্তদের পদযাত্রার ম্লান ছবি।
হ্যাঁ, আম আদমি পার্টির স্বেচ্ছাসেবকদের ‘নতুন রাজনীতি’ সর্বজয়ী বিজেপির ভারী রথটাকে চোখ রাঙিয়ে থামিয়ে দিয়েছে দিল্লির বিধানসভা নির্বাচনে। হ্যাঁ, এটাও ঠিক এই নির্বাচন গৌরবান্বিত এক পুরনির্বাচন বটে। হ্যাঁ, অরবিন্দ কেজরিওয়ালের নেতৃত্বে আআপ সব সন্দেহের অবসান ঘটিয়ে ২০১৯-এ জিতে নবশক্তিতে চনমনে মোদিময় ভারতের অপরাজেয়তার বেলুনটিকে ফুটো করে দিয়েছে।
কেউ হয়তো এখনও বলতে পারেন, এবং বিজেপির কিছু প্রবক্তারাও নাচছেন এই বলে যে গত বিধানসভার নির্বাচনের তুলনায় তাদের দলের ফলে উন্নতি ঘটেছে। তাঁরা সত্তরটির মধ্যে আটটি আসনে জিতেছেন। ২০১৫-র চেয়ে দ্বিগুণ আসন লাভ হয়েছে তাঁদের। এবং ভোট ভাগাভাগি এবং শতকরা হিসেবের খুঁটিনাটি তুলে ধরে ধ্বসে পড়া আত্মবিশ্বাস আবার চাঙ্গা করা যাবে। কিন্তু সংখ্যার বিচার নিয়ে সেই বিষয়মুখীরাই কল্পজগতে বাস করেন যারা সেই সংখ্যার বিভিন্ন স্তরের অর্থ অগ্রাহ্য করে এসেছেন। যদি সংখ্যা দিয়েই মাপতে হয়, তাহলে বলা দরকার আআপ প্রকৃত অর্থে দিল্লিতে কংগ্রেসের পরিসরটি সুবিন্যস্ত এক উপায়ে গত দশ বছরে দখল করেছে। বিজেপি যখন তার ভোটের শতকরার হিসেব কষছে, কংগ্রেস তখন ধরাশায়ী। আআপ-র স্থায়িত্ব আরেক দিকে দিল্লিতে কংগ্রেসের শূন্যগর্ভতা প্রমাণ করে। তাই জাতীয় এক দল হিসেবে বিজেপি ভোট-এর ভিতগুলি আঁকড়ে থাকবে এবং দেশ জুড়ে তা নাড়ানোর সম্ভাবনা এই মুহূর্তে ক্ষীণ। আআপ এখন অন্য বিরোধী/আঞ্চলিক দলগুলিকে লড়াই থেকে হঠিয়ে দিতে পারে। পাটিগণিতের হিসেব আর চুলচেরা বিশ্লেষণে যুক্তিটি খাপে খাপে বসবে বটে। তবে ব্যাখাগত দিক থেকে বললে আংশিক এই সত্যিটা কিন্তু সামগ্রিক ছবি তুলে ধরে না। সামগ্রিক ছবিটিকেও ভেঙে তার টুকরোগুলির সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া যায় না।
বাস্তব আমাদের শুধু বলে, এই সামগ্রিক ছবিটির নেপথ্যে তথ্যপ্রযুক্তি সহায়তায় গেরুয়া বাহিনীর প্রচারের যে বিশাল ধাক্কাটা দেওয়া হয়েছিল, তা এবারের শীতে দিল্লিতে কাজে এল না। সর্বজয়ী স্বয়ং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, দলের সভাপতি এবং দু-দুবারের প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে যে ধ্বংসাত্মক প্রচার চালানো হয়েছিল, তাতেও দিল্লির সর্বভারতীয় চরিত্র পাল্টানো গেল না। তৈলাক্ত পার্টি মেশিন, বিপুল অর্থ এবং প্রশাসনিক ক্ষমতা— সব কিছু কাজে লাগিয়ে এমন একটি দলের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হয়, যার জন্ম এই সেদিন— ২০১২ সালে। তবুও স্থিতধী ভোটাররা হাতে হাত জুড়ে ‘ভারতীয়ত্ব’ টিকিয়ে রাখল। রণহুঙ্কার তুলে বলা হয়েছিল, “ইভিএম-এর বোতাম এত জোরে টিপুন যাতে শাহিনবাগ বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়।” মেরুকরণ প্রকল্পে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এটাই ছিল শেষ হাতিয়ার। প্রয়োগ করার পরে ডিভাইড অ্যান্ড রুল-এর কারবারিদের ফিউজ উড়ে যে শর্ট সার্কিট ঘটেছে, তার ঝটকা সহজে যাবার নয়।
দিল্লির ভোটারদের কাছে সত্যিই এবারকার নির্বাচনটি ছিল বড় এক চ্যালেঞ্জ। ‘জাতীয়তাবোধ’-এর প্রত্যেকটি পরীক্ষার ক্ষেত্রে তো আর পুলওয়ামা আর বালাকোট ঘটতে পারে না। ঘটনাগুলি এমন সময়ে সামনে আসছে, যখন নাগরিক সংশোধন আইনকে কাজে লাগিয়ে আদিম প্রবৃত্তি উসকে দেওয়ার কাজ চলছে। সংসদীয় যত প্রতিশ্রুতি আর সাংবিধানিক শপথকে হাওয়ায় উড়িয়ে দাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে, আইনটির বিরুদ্ধে যারা দাঁড়িয়ে আছেন, তাঁরা শত্রু— ‘অ্যান্টি-ন্যাশনাল’। সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকাগুলিতে, বিশেষ করে আন্দোলনের পথিকৃৎ শাহিনবাগ তখন ছিল চরম ঘৃণার অন্যতম লক্ষ্যস্থল। সাংবিধানিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য প্রতিবাদ সভা এবং লাগাতার ধর্নার মঞ্চগুলির উপর আক্ষরিক অর্থে আক্রমণ হানা হয়েছে এবং শারীরিক লাঞ্ছনার শিকার করা হয়েছে। শাহিনবাগের নাম করে গেরুয়াধারীদের নতুন মানিকজোড় নির্বাচকমণ্ডলীকে সাম্প্রদায়িক দিক থেকে মেরুকরণের কাজ চালিয়েছে। ঘৃণাভরা মেসেজগুলিকে এমন উৎফুল্লতার সঙ্গে অনবরত চালাচালি হয় যে তাতে দিল্লিবাসী প্রমাদ গুনতে শুরু করে। দিল্লিতে বিজেপি-র দুর্দশা ঘনিয়ে আনবার জন্য আআপ-র সূক্ষ্ম বুদ্ধি কাজে দিয়েছে। দলটি শুধুমাত্র নিজেকেই বাঁচায়নি, দিল্লির জনসাধারণকেও সাম্প্রদায়িকতার ফাঁদ থেকে রক্ষা করেছে। গত পাঁচ বছরে যে কাজগুলি করা গেছে, শুধু তা নিয়েই প্রচারে জোর দিয়েছে। এতে বোঝা গেছে এই দল ফাঁকা প্রতিশ্রুতি নয়, কাজের কাজে বিশ্বাসী। তা প্রান্তবাসীরা ‘সমাজ’-এর অংশ হয়ে ওঠবার স্বপ্নটিকে সত্যি করবার চেষ্টার সঙ্গে মিলে গেছে। এবং তা ফল দিয়েছে সেই মানুষগুলির জন্য যারা বোতাম টিপে এই বার্তাটি পাঠিয়েছেন যে হিন্দু-মুসলমান বিভেদে এখন ভারতীয় রাজনীতি পরিপৃক্ত হয়ে উঠেছে।
নির্বাচনের শেষ পর্যায়ে পৌঁছানোর সময়টিতে অনেকে নির্বাচকমণ্ডলীর সঙ্গে আআপ-র লেন-দেন বিষয়টি নিয়ে মাথা ঘামিয়েছেন। সংসদ এবং বিধানসভার ক্ষেত্রে ভোটপ্রদানের যে আলাদা মানসিকতা কাজ করে, তা তুলে ধরে আআপ-র অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির সমালোচনা করা হয়েছিল। আপাতদৃষ্টিতে এই ধরনের আলোচনাগুলিকে বাস্তববোধহীন অনুমান বলাটা ঠিক নয়। এটা সত্যি বিনামূল্যে পরিষেবা প্রদান নিয়ে আআপ-র প্রচার কাজে দিয়েছে। আবার এটাকে নতুন যুগের রাজনৈতিক দর্শন হিসেবেও দেখা যায়, যা আদর্শগত বা কাঠামোগত দিক থেকে সুগ্রন্থিত নয়। এটাও ঠিক, আআপ নেতা ‘ভারত মাতা কি জয়’ ধ্বনি (নাড়া) তোলে, প্রচারসভাগুলিতে যা গেরুয়া বাহিনীর বাঁধাধরা বুলি ছিল। তাছারা আআপ নেতা একই নিঃশ্বাসে ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ শ্লোগান দিয়ে বাম সমাজবাদীদেরও আহ্বান জানায়। প্রচারে ডান ও বামের এই মিশ্রণ আআপ-র সপক্ষে যায়। এটাও ঠিক, আআপ-এর বিজয়মিছিল হনুমান মন্দিরের দিকে যাওয়াটাকেও জনগণের সঙ্গে মিশে কাজ করবার মানসিকতার চিহ্ন হিসেবে দেখেছে মানুষ। দিল্লিবাসী তা নিয়ে চিন্তিত নয় যতক্ষণ না মিছিল ফতেহপুর মসজিদ ধ্বংসের উদ্যেশ্যে এগিয়ে যায়।
সাম্প্রতিক কালে যে তেরঙ্গা পতাকা নিয়ে উদযাপন, স্বতঃস্ফূর্তভাবে জনগণের জাতীয় সঙ্গীত গেয়ে ওঠা, অবিভক্ত ভারতে মহান কবিদের তৎকালীন অশান্ত সময়কে নিয়ে রচিত কবিতার আবৃত্তির জোয়ার উঠেছে, তা সমকালীন ভারতের রাজনীতিতে অশুভ শক্তিদের দানবিক কবল থেকে রাষ্ট্রকে উদ্ধার করা এবং দৈনন্দিন জীবনে ঐক্যবোধ ফিরিয়ে আনবার স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশের সঙ্গে এক সুরে মিশে গেছে।
যতই নেতিবাচক কথা বলা হোক, গণতান্ত্রিক কণ্ঠস্বরগুলিকে এমন পাশবিকভাবে চেপে ধরার মাঝে, যুবসমাজ এবং ছাত্রদের উপর প্রাণঘাতী আঘাত হানার মাঝে এই বিপুল নির্বাচনী জয়ের মূল্য একটি প্রতীক হিসেবে বিশাল। নির্বাচনী অঙ্ক এবং রাজনৈতিক সম্ভাবনার ব্যাখাগুলি অতিক্রম করে আমরা যে বার্তাটিকে খুঁজছি তা হল, আমরা কি সংখ্যালঘুদের রক্ষা করবার জন্য ঐক্যবদ্ধ হতে পারি? প্রচারের সময়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী সোচ্চারে দাবি করেছিলেন, “দিল্লি নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশ হলে ‘টুকরা টুকরা গ্যাং’-এর প্রকৃত চেহারা বার হয়ে যাবে।” হ্যাঁ, স্বরূপ প্রকাশ হয়ে গেছে। দিল্লি জিতেছে। অন্তত এক দিনের জন্য দিল্লি এবং তার জনগণ ‘অন্তর্ভুক্তি’ উদযাপন করছেন এবং শহরের মাঝে অবস্থিত বিশাল গেরুয়া প্রাসাদ তার আত্মম্ভরী উচ্চতা নিয়ে নিঃশব্দ এক ম্লান ভৌতিক মহলে রূপান্তরিত হয়েছে।
……