সুজন ভট্টাচার্য
লেখক সামাজিক-রাজনৈতিক বিশ্লেষক, কবি এবং অনুবাদক।
গতকাল দিল্লিতে আচমকাই বিক্ষিপ্ত আকারে হলেও লাগাতার সংঘর্ষ ঘটে গেল। নিহত হলেন কয়েকজন, আহত অসংখ্য। শাহিনবাগের শান্তিপূর্ণ সমাবেশ চলছে দু মাসের উপর। অজস্র প্ররোচনা সত্ত্বেও অবস্থানকারীরা নিজেদের নিয়ন্ত্রিত রেখে এসেছেন। তাহলে হঠাৎ করে কী হল? আচমকাই দিল্লির পরিবেশ এমন ভয়ঙ্কর হয়ে উঠল কেন?
অপরাধ বিজ্ঞানে মোটিভ শব্দটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। অপরাধীর সন্ধানে গোয়েন্দারা মোটিভের উপর গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। সামাজিক কর্মকাণ্ডের আলোচনার ক্ষেত্রেও তেমনটা হওয়া উচিত ছিল। ঘটনার ফায়দা যাবে কার কোলে, সেটা ভাবলেই অনেক কিছু পরিষ্কার হয়ে যায়। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে এদেশে গুজবের যে নির্ভরযোগ্যতা আছে, মোটিভ নির্ধারণের সেই কদর নেই।
যদি থাকত, তাহলে যাবতীয় গল্পের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠত। কী প্রশ্ন? সামান্য মগজ খাটালেই বোঝা যাবে। তাহলে দেখা যাক।
১/ শাহিনবাগের গণ-অবস্থান এত দিন ধরে শান্তিপূর্ণ রইল। বরং প্রায় এক শতাব্দী পরে ভারতের মাটিতে অসহযোগ আন্দোলনের বার্তা ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে দিগবিদিকে। তার কৃতিত্ব অবশ্যই শাহিনবাগের।
২/ কেন্দ্রীয় সরকার এবং তার তাঁবেদাররা দিনের পর দিন অবস্থানকারীদের দেশদ্রোহী বলে ছাপ্পা লাগানো সত্ত্বেও পাল্টা কিছু হয়নি। তারা মুখে প্রতিবাদ করেছেন, পাল্টা প্রশ্ন তুলেছেন। হিংসাত্মক কিছুই করেননি।
৩/ অবস্থানকারীদের হেনস্থা করতে দিল্লি পুলিশ নানাভাবে চেষ্টা করেছে। এমনকি যারা খাবার যুগিয়েছেন, জল সরবরাহ করেছেন, তাদেরও। কিন্তু তাতেও ফল দেয়নি। দিল্লি পুলিশেরই মুখ পুড়েছে।
৪/ অবস্থানকারীদের পাল্টা চাপে ফেলার জন্য দিল্লি পুলিশ নিজেই বেশ কিছু রাস্তা আটকে দিয়েছে। অবস্থান তোলার জন্য সুপ্রিম কোর্টে মামলাও হয়েছে। তাতেও অবস্থানকারীদের দমানো যায়নি।
৫/ জামিয়া মিলিয়াতে ঢুকে দিল্লি পুলিশ নির্বিচারে তাণ্ডব চালিয়ে ভেবেছিল বীরের মালা পাবে। সুপ্রিম কোর্ট উল্টে জরিমানা চাপানোয় পুলিশের মুখরক্ষা করার জন্য কোনও কাহিনি অবশ্যই দরকার ছিল।
স্পষ্টতই দিল্লি পুলিশের একটা অজুহাত দরকার ছিল। আন্দোলনকারীরা যদি সেই অজুহাত জোগান দিতে অপারগ হয়, তাহলে ভাড়া করেই আনতে হবে বৈকি। সেই ভাড়াটে দুর্বৃত্তরাও তো তৈরি। কারণ শাহিনবাগ পদ্মফুলের মধু-র মধ্যে লুকিয়ে থাকা বিষ সম্পর্কে সচেতন করে তুলেছে গোটা দেশকে।
শাহিনবাগের আন্দোলন সবথেকে জবরদস্ত থাপ্পড় মেরেছে গেরুয়া কোম্পানির মুখে। মোদ্দা প্ল্যান ছিল সিএএ-র নামে হিন্দুদের এককাট্টা করে ফেলা যাবে। সেই আশা ছাই করে দিয়েছে শাহিনবাগ। দলে দলে হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ আর খ্রিস্টান (যারা নাকি সিএএ-র সুবিধা পাবেন) পাশে দাঁড়িয়েছেন শাহিনবাগের। সবশেষে দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনের বিপর্যয় প্রমাণ করে দিয়েছে রাশ চলে যাচ্ছে হাতের বাইরে।
অতএব লোচ্চামি-ই একমাত্র ভরসা। এমনিতেই এদেশে দাঙ্গা আর যুদ্ধের হাওয়া যে নির্বাচনী বৈতরণী পার হবার সবথেকে বড় সাহারা, সে তো দু বছর আগেই প্রমাণিত। অতএব পাল্টা আন্দোলনের নামে সংগঠিত করে ফেলা হল গুন্ডামি। ট্রাম্পের আসার সময়টাকে বেছে নেওয়া হল কেন, তার উত্তরটা লুকিয়ে আছে গেরুয়া কোম্পানির প্রচারের মধ্যেই।
ঘটনায় উশকানি দেবার অভিযোগ উঠেছে কপিল মিশ্রের বিরুদ্ধে। দলবদল করেও নির্বাচনে হাল না মেলায় তার ব্যক্তিগত রোষ থাকতেই পারে। আবার নির্বাচনের ফলে সর্বোচ্চ নেতৃত্বের বিরাগভাজন হয়ে পড়ার একটা চটজলদি সমাধানের রাস্তাও হতে পারে। কিন্তু এই তদন্ত আসলে উপরি-উপরি। ট্রাম্পের যাত্রার সময়টা বেছে নেওয়া হয়েছে যাতে মিডিয়ার নজর না থাকে। কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদের মন্তব্য খেয়াল করুন। সময়টাকে নাকি বেছে নেওয়া হয়েছে বিদেশি অতিথির সামনে ভারতের মুখ পোড়ানোর জন্য। অভিযোগের সুর থেকেই বোঝা যায় অজুহাতের তত্ত্বের প্রাসঙ্গিকতা। মোদ্দা কথা হল, ফ্যাসিবাদী শক্তি এখন চরম আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছে। দিল্লির অশান্তি আর গুজরাটে ছাত্রীদের উলঙ্গ করে যোনি পরীক্ষা, সব এক সূত্রে বাঁধা। সেই সুতোটাই হল আসল, ফ্যাসিবাদী মাকড়সার জাল।