স্যমন্তক ঘোষ
লেখক সাংবাদিক।
আমরা যারা নিজেদের সাংবাদিক বলি, যে কোনও ঘটনায় তাঁদের নিউজ পয়েন্ট খোঁজার একটা দায় থাকে। সেটাই নিউজ পয়েন্ট, যা বিক্রি হয়। শেষ সিনে পাঠকের হৃদয়ে গিয়ে আঘাত করে।
খবরের গুরুত্ব আছে। এই ভয়াবহ সময়ে, এই ভয়ঙ্কর বিভেদের আবহে খবরই তো দেখাচ্ছে, কীভাবে একে অপরের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে শান্তির বার্তা হাওয়ায় মিশিয়ে দিচ্ছেন দুই ধর্মের মানুষ। দাঙ্গাবিধ্বস্ত উত্তর-পূর্ব দিল্লিতে হাজার হাজার সাংবাদিক ‘ভাইচারা’ খুঁজে চলেছেন সারাক্ষণ।
জন্মসূত্রে আমি তৃতীয় প্রজন্মের রিফিউজি। উদ্বাস্তু। বড় হয়েছি কলকাতায়। বাবা মায়ের দয়ায় থেকেছি নিজের বাড়িতে। আমি ছেচল্লিশের দাঙ্গা দেখিনি। তবু বাবা-জেঠুদের গল্প, দমদমের কলোনি, ইস্টবেঙ্গল টেন্ট, এ দেশের বন্ধুদের ভিটেযাপনের কাহিনি এখনও প্রতি মুহূর্তে আমাকে বুঝিয়ে দেয়, আমি উদ্বাস্তু। হিংসা আমায় ভিটেহীন করেছে। না, আমার কোনও দেশ নেই। আমাদের ইতিহাস, আমাদের পরিচয় ‘ঠেলা খাওয়া’। সেই কাল্পনিক ঠেলায় অদ্ভুত এক অবিশ্বাস আছে। তৃতীয় প্রজন্মে পৌঁছে ভয় হয়তো আর নেই, কিন্তু অবিশ্বাস থেকেই গিয়েছে। ভাঙা আয়নার মতো, বিশ্বাস জুড়তে চায় না।
রাজধানীর চিত্রপটে চোখের সামনে যে ভূতের সেট দেখতে পাচ্ছি, সেখানে কেবল অবিশ্বাস নেই, ভয়ও আছে। প্রবল ভয়। এ কথা ঠিক, দিল্লি দাঙ্গায় বাইরে থেকে লোক ঢুকেছিল। পাশাপাশি এও সত্য, প্রতিবেশীর রূপও বদলেছিল। পাশাপাশি বাস করা, চা খাওয়া, গলি ক্রিকেট খেলা বন্ধু পাশের বাড়িতে আগুন না দিক, আগুন ধরে যাওয়ার পরে বাঁচাতে যায়নি। একের পর এক দোকান যারা লুঠ করেছে, ঘরের পর ঘর যারা ফাঁকা করে দিয়েছে, পাথরে পাথরে বিধ্বস্ত করেছে যারা বিস্তীর্ণ এলাকা, সেখানে কোনও চেনা মুখ নেই, এটা হতে পারে না। এটাই দাঙ্গা। পাশের বাড়ির অতি প্রিয় ছেলেটাও আগুন হাতে নিয়ে ফেলে। উন্মাদ হয়ে বেরিয়ে পড়ে রাস্তায়।
শুধু ভাইচারা নয়, দিল্লির রাস্তায় যে শব্দ এখন আরও বেশি প্রকট, তা হল নফরত। নফরত না থাকলে এ কাণ্ড ঘটে না। দিনের পর দিন ধরে রাজনীতি ওই নফরতের সলতে পাকিয়েছে প্রত্যেকের মনে। আমরাও পাকাতে দিয়েছি। আগুনের স্ফুলিঙ্গেই তাই দাবানল তৈরি হয়েছে। সম্প্রীতি এখনও আছে, ভাইচারা আছে বলেই এখনও বেঁচে আছে বহু মহল্লা। মৃতের সংখ্যা হাজার হাজার হয়নি। মনুষ্যত্বের উচ্ছিষ্ট বেঁচে আছে বলেই সাংবাদিকরা করার মতো স্টোরি পাচ্ছেন। কিন্তু অবিশ্বাস তৈরি হয়ে গিয়েছে। শুধু দাঙ্গাবিধ্বস্ত এলাকায় নয়, তার বাইরেও। গোটা দিল্লি জুড়ে সকলে সকলকে সন্দেহ করছেন। প্রকাশ্যে, ভিতরে ভিতরে। গুজব ছড়াচ্ছে প্রতিদিন। ছোট ছোট আলোচনায় উঠে আসছে, কার ঘর কাকে দিয়ে ঘেরা। এক ধর্ম ঘিরে ধরলে অন্য ধর্মের পালানোর রাস্তা কী? এগজিট রুট খুঁজে রাখছেন সবাই। আমিও।
দাঙ্গা রোজ হয় না। দাঙ্গার গুমোট থেকে যায়। হয়তো সারা জীবন। প্রজন্মের পর প্রজন্ম। খবরের কাগজে একটি শিশুর ছবি ভাইরাল হয়েছে, হাপুশ নয়নে কাঁদছে বাবার মৃতদেহের সামনে দাঁড়িয়ে। পড়েছি আরেকটি খবর, জঞ্জাল ঘাঁটা বাবার জঞ্জাল ঘাঁটা ছেলেকে ঘুম থেকে তুলে একদল লোক একটা মৃতপ্রায় শরীর উপহার দিয়ে গিয়েছিল। জঞ্জালের গাড়িতে বাবার সেই নিস্তেজ শরীর নিয়ে ছেলে পৌঁছল স্থানীয় নার্সিংহোমে। প্রাথমিক চিকিৎসার পর নার্সিংহোম বলল, সরকারি হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। বেসরকারি চিকিৎসার দৈনিক খরচ পাঁচ হাজার টাকা। এ দিকে বাবার শরীর থেকে রক্ত বেরিয়েই যাচ্ছে। মিলল না অ্যাম্বুল্যান্স। হাত জোড় করে পুলিশের কাছে ভিক্ষে করেও গাড়ি পাওয়া গেল না। শেষ পর্যন্ত একটা অটোয় যখন শরীরটা তোলা হল, তাতে আর জান নেই তখন। অথবা ওই ছেলেটি, গোটা শরীরে ব্যান্ডেজ বেঁধে বসে আছে যে, রয়টার্স যাকে ঘিরে ধরে মার দেওয়ার ছবি গোটা পৃথিবীকে দেখিয়ে দিয়েছে, গলগল করে মুখ থেকে যখন রক্ত ঝরছে, ওকে গাইতে হয়েছিল জাতীয় সঙ্গীত।
আচ্ছা ওই বাচ্চাটা, এই পিতৃহারা জঞ্জাল ঘাঁটা ছেলে, জাতীয় সঙ্গীত গেয়ে প্রাণভিক্ষা পাওয়া তরুণ ভবিষ্যতে কাকে বিশ্বাস করবে? যাঁদের গেছে, তাঁদের গেছে। সবটা গেছে। যাঁদের আছে, অবিশ্বাস, ভয় সরিয়ে রেখে তাঁদের কেউ কেউ মনুষ্যত্ব বাঁচিয়ে রাখার মরিয়া চেষ্টা করছেন। সেটা জরুরি। ভীষণ জরুরি। কিন্তু এভাবেই সব বিশ্বাস ফিরে আসবে ম্যাজিকের মতো? সবাই আবার গলায় গলায় মেলায় যাবেন, এ ভাবনা নেহাতই অবোধ। প্রজন্ম কেটে যাবে, নফরত ঘুচবে না…
আমাদের স্টোরি, স্টোরিই। নিউজ পয়েন্ট মাত্র। বাস্তবের পাশের রাস্তা…