বিলাল হোসেন
জল গড়ানোর গল্প
নদীটা প্রকৃতির দান, নদীটির দান এর ভেতরের মাছ। গল্পটি এই নদী ও মাছকে ঘিরে শুরু হলে নদীভাঙ্গা স্বভাবের মতই গল্পেরও নানা ভাঙন প্রক্রিয়া লক্ষ্য করবার মত। নদী তার দুপাশ কখনও ভাঙে না, কিন্তু গল্পভাঙার যে গল্প আমরা প্রত্যক্ষ করি তাতে শুধু দুপাশ নয়— গল্পের পাশ থেকে পাশে, পাশের ভেতরে যে রন্ধ্রের সৃষ্টি হয় নতুন করে ভাঙার আগে, তার ভেতরেও ভাঙনশব্দ শোনা যায়।
নদী ভাঙে। আমাদের এই গল্পও। ভাঙনের শুরু হয় জাল নিয়ে।
জালপাতা নিয়ে বাকবিতণ্ডা শুরু হয় গল্পের মধ্যে, নদীর মধ্যে। স্পষ্ট ঘুর্ণিতে ভরাকটাল উথলে ওঠে নদীর পেটের ভেতর থেকে। আর সেই কটালের ভেতরে শব্দের মত জলের তোড়ে ভাঙনের প্রাথমিক পর্যায়ের গলাজোয়ারি শুরু দুজনের মধ্যে। তারা কারা?
দুই প্রতিবেশী। আক্কাস। সিরাজ। প্রাথমিক পর্যায় কেটে দ্বিতীয় পর্যায়ে নেমে যেতে খুব দেরি হয় না।
সেই নামা দিয়ে দ্রুত জল গড়াতে থাকে নিচের দিকে। সম্পর্কের ভাঙনের শব্দ শোনা গেল নদী ও নদীকূলবর্তী জুড়ে। ঘটনা এই— সিরাজ নদীর মধ্যেখানে জাল পাতে। যেখানে আগে থেকেই জাল পেতে রেখেছে আক্কাস। ধমকে ওঠে সিরাজ— জাল গুটা।
আক্কাস অবাক— কও কি সিরাজ! আমি তো সবসময় এজাগায় জাল পাতি।
–এহন থেকে আমি পাতুম। জাল গুটা।
আক্কাসের ভেতর জল বাড়তে থাকে। ফুঁসতে থাকে। ঝামেলা করতে চাও সিরাজ?
–ঝামেলার তো কিছু নাই। এই জাগা আমার। নদী ভাঙতে ভাঙতে আমার জাগা খাইছে। আমার জাগায় আমি জাল পাতুম। তুই জাল গুটা।
সম্পর্কের পাড় ভেঙে পড়ে ঝপ করে। বেলে মাটির পাড় ততটা নরম নয়, যতটা নরম হওয়ার কথা। কারণ বেলের ভেতরে ছিল দোআঁশের সংমিশ্রণ। তবু পাড় ভাঙে গল্পের। সম্পর্কের।
সিরাজ মিয়া অপেক্ষাকৃত বয়সে বড় আক্কাস আলিকে বেধরক পেটাতে শুরু করে। একটু দুরে দাঁড়িয়ে দেখছিল তারই ছেলে রাজা মিয়া। নিজের বাপকে এভাবে মার খেতে দেখে আর সহ্য করতে পারল না। সে একটা বাঁশ নিয়ে এমনভাবে বাড়ি দিল, মাথা গেল ফেটে।
নদীর জল লাল রঙে ছয়লাপ হয়ে গেল। গল্প নতুন বাঁক নিয়ে ছুটে যায় কোর্টকাছারির দিকে।
কেস হল।
থানাওলারা ধরে নিয়ে গেল। অ্যাটেম্পট টু মার্ডার ইস্যুতে জেল হয়ে গেল রাজা মিয়ার।
দিন যায়। মাস যায়। নদীর জল গড়ায়। গড়াতে গড়াতে জল কমজোরি হয়। সিরাজ বলে— আক্কাস ভাই মাফ কইরে দেও।
ততদিনে আক্কাসের ভেতরেও ভাটা পড়েছে রাগের— যাও মাফ কইরা দিসি।
সিরাজ জর্দা নিয়ে পান দেয়। আক্কাস নেয়।
আক্কাস নলেন গুড়ের সঙ্গে একবাটি মুড়ি দেয়। সিরাজ খায়। তারা একসঙ্গে হাটে যায়। মাছ মারে। তারা গ্রামবাসীর বিয়েতে যায়। মুসলমানিতে যায়। একসঙ্গে বসে খায়। হাসাহাসি হয়। গল্পগুজব। রঙ চা। পান বিড়ি লেগেই আছে।
নদী শুকিয়ে আসে। নদীর চরে বাদাম লাগাতে লাগাতে আক্কাস দেখে নদীটা একটা খালের মত হয়ে গেছে। তখন তার মনে পড়ে রাজা মিয়ার আজ জেল থেকে বের হওয়ার কথা।
জেল গেটে অপেক্ষা করে দুজন। রাজা মিয়া বের হয়। দূর থেকে সে দেখে আক্কাস-সিরাজ একটি মোহনা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সিরাজের মনের ভেতরে ফুঁসে ওঠে একটি জলজ জানোয়ার।
নদীর জল বাড়তে থাকে, নতুন করে গড়াবে বলে।
চর পিয়ালের বনে
বেতুয়া লঞ্চঘাটে এসে সুফিয়ার মাথা নষ্ট হয়ে গেল।
লঞ্চ ছেড়ে দিয়েছে ১০ মিনিট আগেই। ঢেউয়ের বাড়ি খেতে খেতে লঞ্চ চলে যাচ্ছে নদীর গভীরে। দুঃখে সুফিয়ার চোখে পানি চলে এল।
–মা, এহন কী হইব?
আঁচলধরা ছিল ৩ বছরের রাবেয়া। তার চোখেও পানি। মার চোখে পানি এলে তার চোখেও আসে। মা হাসলে রাবেয়াও হাসে। সুফিয়া লঞ্চটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বলল— রাবু রে এহন উপায় কী হইব? মনপুরায় তোর বাপ অপেক্ষা করে আছে।
রাবেয়া কিছু বলবে, এমন না। কিন্তু কাছে এল একজন। বলল— আর লঞ্চ নাই। স্পীডবোডে উঠো। পৌঁছাইয়া দেই। লঞ্চের আগেই পৌঁছাইবা। যাইবানি?
ধন্ধে পড়ে গেল সুফিয়া। স্পীডবোট? এ যে অনেক টাকার ব্যাপার।
মনের কথা যেন শুনতে পেল লোকটি।
–টাকা নিয়া চিন্তা করিও না। দিনপড়া শেষ খেপ। আমারও যাওন দরকার। যা দেওয়ার যুক্তি মত দিও। নেও উঠো।
সুফিয়ারা উঠে বসল।
স্পীডবোটে আরও দুজন, সামনের সারিতে বসে কচ কচ করে পান খাচ্ছে। স্টার্ট দেয়ার পর বোট বাতাসের উপরে উঠে গেল। জনতার খালপাড়ে এসে আরও দুজন ওঠার পর ব্যালেন্স এলে পানি কামড়ে বোটটি তীরের মত ছুটতে লাগল।
বেলা
পড়ে
আসছে।
নদীর জলে সূর্যের তেজ ঝিকমিক করতে করতে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে স্রোতের টানে আবার জলেই মিশে যায়। দু একটি জলবাহিত খড়, পানা, আর পাখিদের ভেসে থাকায় তেমন আশ্চর্যের কিছু নেই যতটা আশ্চর্য হল বোটটি চর পিয়ালে এসে ভিড়ল দেখে।
সুফিয়া তাকাল চালক সিরাজের দিকে। চোখেমুখে প্রশ্ন।
দুজন নামার কথা এই চরে। নামল চারজন। সঙ্গে সুফিয়াও।
রাবেয়া নামল না, নামানো হল। দু হাত ধরে হ্যাঁচকা টান এমনভাবে দিল মনে হল তার হাতদুটি ছিঁড়ে যাবে।
সুফিয়া ‘অই মাঝি, অই মাঝি’ বলে চেঁচাতে লাগল।
মাঝি সিরাজ নিজে হতভম্ব হয়ে গেল। সে এগিয়ে এল বাঁচাতে কিন্তু এমন এক চড় দেয়া হল তাকে, পদ্মানদীটা চোখের সামনে দুলে উঠল। ধপাস করে পড়ল চিত হয়ে, পাটাতনে।
সুফিয়াকে তুলে নেয়া হল ডাঙায়। একটা ঘন পেয়ারাবন, সেখানে ঢুকে গেল তারা।
সুফিয়া রাবেয়া রাবেয়া বলে অনেক কাঁদল। পা ধরে ক্ষমা চাইল। কিন্তু কান্নাটি বাতাসে মিলিয়ে সে পেয়ারাবনের দিকেই গেল।
সিরাজ দ্রুত কোমর থেকে মোবাইল বাইর করে— হ্যালো, নজরুল ভাই, ভাই ভাই … মাইয়াডারে বাঁচান ভাই।
সমস্ত ঘটনা খুলে বলল।
নজরুল, স্পীডবোটের মালিক, আরেকটি বোট নিয়ে নিমিষেই চলে এল। এসেই আরেকটা থাপ্পড়— হারামজাদা, যারে-তারে বোটে উঠাস ক্যা?
নজরুল দ্রুত পেয়ারাবনের দিকে দৌড়াল।
থাপ্পর খেয়েও সিরাজের ভালো লাগতে লাগল। যাক! ভাই এখন বইনডারে বাঁচাইতে পারব।
হাতেনাতে ধরা হল চারজনকে। পেয়ারার ডাল দিয়ে পেটানো হল বেধরক। এত পেটানোর পরও নজরুলের হাতের নিসপিশানি কমে না। সে সুফিয়াকে বাঁচাতে পারেনি। চারজন মিলে সর্বনাশটা করেই ফেলেছে।
একটুকরো জঙ্গলে মুখ লুকিয়ে সুফিয়া কাঁদে— রাবেয়া রাবেয়া।
তিনহাজার টাকা ধার্য করে নজরুল চারজনকে ছেঁড়ে দিল। কী আর করা!
গুঁজে দিল সুফিয়ার হাতে।
সুফিয়া একবার তাকাল। দেখে, চারজনের ছেড়ে যাওয়া শরীরটার দিকে অপলকে আরেকজন।
জঙ্গলের মধ্যে ছোট যে-জঙ্গলে সুফিয়া নিজেকে লুকিয়েছিল সেটি আর রইল না। বড় হয়ে গেল।
জলজ
জায়গাটা জঙ্গলে ভরা আর জলা জলা একটা ভাব আছে। বেশ কিছু নতুন পুরাতন জলে ভরা খাদও আছে। খাদটি নিশ্চিত একদিন খাল ছিল। এখন ভরাট হয়ে গেছে। জলপুর্ণ এইসব খাদ, নিচুভূমি হওয়াতে আর প্রাকৃতিক কিছু খানাখন্দের সৃষ্টি হওয়াতে বৃষ্টির জল সারা বছরভর এখানে জমে থাকে। আর এসবের কারণেই কি না কে জানে, ঘাস লতাগুল্ম শন উলুখড় আর বাবলা গাছে পরিবেষ্টিত থাকা এই অংশে কই মাগুর শিং এইসব মাছের বেশ প্রাদুর্ভাব লক্ষ করার মত।
কলিম রব্বানি এই মাছ মারতেই বের হয় প্রায় সন্ধ্যায়।
তার হাতে একটা ট্যাটা। ছয়মুখি। গঞ্জ থেকে বানানো। হাতলটি আবলুস কাঠের। তীক্ষ্ণ ট্যাট্যার ফলায় ঝিকমিক করে তীক্ষ্মতা।
কলিম রব্বানি ট্যাটা ছাড়া খালি হাতে মাছ ধরে না। মাছ ধরা ছাড়া এই সন্ধায় রব্বানির কোন কাজও থাকে না। ফলে সন্ধ্যার পথ ধরে জলা জলা জঙ্গলে বেরিয়ে পড়লে থমথমে প্রকৃতিও তাকে আহ্বান করে— আয় আয়। রব্বানি শুনতে পায়।
জলায় নেমে পড়ল রব্বানি প্রশান্ত পায়ে। হাঁটু ডুবে গেল জলে, গিঁরা ডুবল কাদায়। পলির সর পড়া এমন কাদায় পা স্পর্শ করলে আনন্দ লাগে। রব্বানিও আনন্দে শিউরে উঠল।
আজ অবশ্য কোনও মাছ পাওয়া গেল না। যেমন পাওয়া যায়নি গতকাল কিংবা তার আগের দিন। গেল সপ্তাহে পেয়েছিল কি না তাও মনে পড়ে না। মাছগুলি কই থাকে, কাদার কোন প্রকোষ্ঠে, ধঞ্চে গাছের গোড়ায় নাকি পানা কচুরির পাতার আড়ালে, নাকি… কোথায় থাকে মাছেরা!
রব্বানির মন খারাপ হয়, হয় না।
সে দুচোখ মেলে ট্যাটা হাতে খুঁজতে থাকে তবু। পলকবিহীন। ট্যাটারও কী চোখ আছে! ছয়চোখ মেলে খুঁজতে থাকে সে-ও, পলকহীন?
ছপ ছপ করে পা দিয়ে একটু তরঙ্গ ওঠাতে জলের ভেতরে যে জল থাকে— শান্ত ঠান্ডা— তারা খলবলিয়ে উঠল।
তারা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল, ধাক্কা দিল। আর সে ছড়িয়ে পড়া আর ধাক্কা দেয়ার মধ্যবর্তী স্থানে রব্বানি দেখতে পেল একটি ছোট্ট প্রাণ ভাসছে। ডুবছে।
তার ছোট্ট লেজ। পুতির মত চোখ। ছোট্ট আলোর মত।
একটি পোনা মাছ!
রব্বানি খুব অবাক অবাক ভাব নিয়ে পোনামাছটির দিকে তাকাল। সে ভেবে পাচ্ছিল না, এই নিরাক পড়া সন্ধ্যায় সবাই যখন লুকিয়ে সে জলের ভাঁজে কী করছে?
রব্বানির কৌতূহল হল, ছেলেবেলা লাফিয়ে উঠল মনে। সেই কারণেই কি না, কাদামাটি দিয়ে একটা বলয় তৈরি করে পোনামাছটিকে আটকে দিল।
সে লালন পালন করবে।
লালন পালন শেষে পোনামাছটিকে বড় করে তুলবে।
বড় হলে ট্যাটায় গেঁথে ফেলবে।
এই পরিকল্পনার রাস্তা ধরে রব্বানি প্রতিদিন জলায় আসে। টর্চের আলো ফেলে দেখে পোনামাছ নড়ে চড়ে সাঁতরায়। আলোর রশ্মিতে চমকায়।
রব্বানির কৌতূহল বাড়ে, সঙ্গে বাড়ে রঙ্গও। সে কথা বলে একা একা—
কি রে পোনা?
একলা কেন?
মনটা খারাপ?
বাপ কই তোর?
মা কই তোর?
পোনামাছ ফুটকিতোলা লেজ তুলে সামান্য শব্দ তুললে নিটোল জলে সাড়া পড়ে। রব্বানির ভালো লাগে। তার সঙ্গে একধরনের সখ্যতা গড়ে ওঠে। সে আর অন্য মাছের খোঁজে বের হয় না। সময় পেলেই সে পোনার সঙ্গে গপসপ করে।
অরে পোনা তুই
কার ঘরের মানিক সোনা
গজার নাকি রুই?
দিন
চলে
যায়।
মাছটি বড় হয়ে ওঠে, রব্বানি লক্ষ করে। প্রায় হাতখানেক লম্বা হয়েছে। মোটা তাজাও। রব্বানি ভাবে, এবার ট্যাটায় গেঁথে নিতে অসুবিধা হবার কথা নয়। ট্যাটা হাতে সে স্থির হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু সে ভেতরে ভেতরে কেমন ভেঙে পড়ে। এত সুন্দর মাছটা সে মেরে ফেলবে? সে বরং মাছটিকে খালুইতে ভরে বাড়ির পথ ধরে।
দিলশাদ মাছ দেখে অবাক— এত সুন্দর মাছ সে জীবনেও দেখেনি। তার বুকের ভেতরে মেঘ ডাকার মত গুর গুর করে ডাকতে লাগল। কিন্তু রব্বানি ট্যাটাকে আবার তাক করল। আর কী অদ্ভুত! মাছটি এক লাফ দিয়ে দিলশাদের বুকে গিয়ে উঠল।
স্তন যেন ভারী হয়ে গেল দিলশাদের। আঁতুড় ঘরে সন্তান মারা যাওয়ার পর আবার যেন এমন হল। রব্বানি বিস্ফারিত চোখে ঘটনা দেখতে লাগল। ট্যাটাও।