হিংসা এখন রাজার ধর্ম গান্ধিবুড়োর খাসজমিতে

প্রশান্ত ভট্টাচার্য

 



লেখক কবি, প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক।

 

 

‘ওরা কাগজ দেখানোর কথা বলছে। কিন্তু এখন আর দেখানোর মতো থাকলটা কী? সকলের আধার, ভোটার কার্ড, টাকা জ্বালিয়ে দিয়ে গেল ওরা।’ দিল্লির মুরাদনগরের দাঙ্গা বিধ্বস্ত মহম্মদ রশিদের আর্তনাদ।

সর্বস্ব হারিয়ে রশিদ ঠিক সেই কথাটাই বলে দিয়েছেন, যা মোদি-শাহর মনের কথা। অসমে এনআরসি করতে গিয়ে বিজেপির চরম শিক্ষা হয়েছে। ভেবেছিল, যা খেদানো হবে, সবই ‘মোছলমান’। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে দেখা গেল বেশিরভাগটাই হিন্দু, যারা কাগজ দেখাতে পারছে না। বিদেশি, অনুপ্রবেশকারী বলে জাতীয় নাগরিকপঞ্জিতে নাম ওঠেনি। ফলে এবার পদক্ষেপ, সিএএ আগে পরে এনআরসি। সেখানেও গেরো! বিজেপি খোঁজখবর নিয়ে দেখেছে, সিএএ নিয়ে বিক্ষোভ দেখাচ্ছে বটে, কিন্তু দিল্লি বা তার আশপাশের অঞ্চলে ‘মোছালমান’দের কাছে যথাযথ কাগজপত্তর আছে। ওরা ‘উইপোকা’ নয়। ওদের শিকড় কারও পাঁচশো বছরের, কারও সাতশো বছরের। ফলে ওদের তো তাড়ানো যাচ্ছে না। অথচ আরএসএস ও তার রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপির যে টার্গেট মোছলমানহীন হিন্দু রাষ্ট্র, তা তো করা যাচ্ছে না।

অতএব মোদি-শাহ তাঁদের পুরনো লাইন, ‘গুজরাট মডেল’-এর প্র্যাকটিস করতে বললেন কপিল মিশ্রদের। সেই মোতাবেক কাজ। আর সেটা ধরে ফেলতেই কোপ পড়ল বিচারপতির ওপর। দিল্লি হাইকোর্টের বিচারপতি মুরলীধর, যিনি উত্তর-পূর্ব দিল্লির বর্তমান হিংসায় দিল্লি পুলিশ, মানে অমিত শাহর পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন ও কপিল মিশ্র সহ তিন বিজেপি নেতার বিরুদ্ধে এখুনি এফআইআরের হুকুম দেন। আমাদের মোগাম্বো চোখ পাকিয়ে বলে ওঠেন, ‘খামোশ! আমার বাছা কপিলের বিরুদ্ধে এফআইআর করতে বলে? পাঠাও ওকে নির্বাসনে।’ তাই দিল্লি পুলিশকে ভর্ৎসনা করার মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই বিচারপতি মুরলীধরকে পঞ্জাব ও হরিয়ানা হাইকোর্টে বদলি করা হল। করা হল সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির সঙ্গে পরামর্শ করে। সরকারি গেজেটে তা প্রকাশিত। বিচারপতি মুরলীধরের বদলি এ সরকারের চেহারা নগ্ন করে দিল। প্রমাণ করে দিল, এটা স্পনসর্ড গণহত্যা। এরপরও এই দেশদ্রোহীদের সমর্থন করবেন? এরপরেও বলতে হবে দেশে গণতন্ত্র চলছে? বিচারবিভাগ স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে? এরপরেও বলা হবে না, দেশ চালাচ্ছে গণতান্ত্রিক উপায়ে জিতে আসা ফ্যাসিস্টরা! অথচ কদিন আগেই জনৈক হাকিম, মোদির প্রতিভার প্রশংসায় গদগদ। বোধহয় আর মাস তিনেক বাদে অবসর নিয়ে কোনও রাজ্যের রাজ্যপাল হতে চান হাকিমমশাই।

আসলে দিল্লির বিজেপি নেতা কপিল মিশ্র কথা রেখেছেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও তাঁর তৃতীয় পক্ষ মেরালিন দিল্লিতে আসার আগেই উত্তরপূর্ব দিল্লিতে হিংসা লাগিয়ে দিয়েছেন। বা আরও নির্দিষ্ট করে বললে, গণহত্যা শুরু করে দিয়েছেন। রবিবার জাফরাবাদ ও চাঁদবাগ রোড অঞ্চল থেকে সিএএ-বিরোধী আন্দোলকারীদের হটাতে পুলিশের ওপর  রীতিমতো রাজনৈতিক চাপ দেন কপিল মিশ্র। আরেকটি শাহিনবাগ হতে দেওয়া যাবে না বলে তিনি শান্তিপূর্ণভাবে চলতে থাকা ওই আন্দোলনকে হটাতে জাফরাবাদ অঞ্চলে মিছিল করেন এবং সঙ্গে পুলিশকে ‘সময়সীমা’ বেঁধে দেন আন্দোলনকারীদের হটাতে। একটি ভিডিওতে কপিল মিশ্রকে পুলিশকে উদ্দেশ্য করে বলতে শোনা যায়, ‘মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যতক্ষণ ভারতে আছেন ততক্ষণ আমরা শান্তিপূর্ণ রয়েছি। এরপর আমরা আপনাদের (পুলিশ) কথা শুনব না।’ এরপরেই লরিবোঝাই পাথর এসে পৌঁছয় জাফরাবাদে। আর তা এসেছে দিল্লির প্রতিবেশী রাজ্য থেকে। সঙ্গে লরিবোঝাই ভিন রাজ্যের লোক। দিল্লির উপমুখ্যমন্ত্রী মণীশ শিসোদিয়া যে সম্পর্কে বলেছেন, ‘একদল দৈত্য দিল্লিতে ঢুকে পড়েছে। এরা দিল্লির সাধারণ মানুষ হতেই পারে না।‘

সেই দৈত্যের তাণ্ডব চলল গত ২৩ ফেব্রুয়ারি রবিবার রাত থেকে টানা চারদিন। উত্তরপূর্ব দিল্লির বিস্তীর্ণ এলাকায় নেমে এল গণহত্যা। শুরু হল বিভিন্ন মসজিদে ভাঙচুর। বাড়ি-গাড়িতে আগুন। প্রধানত, এই হামলার দায় পড়ছে বেশ কয়েকটি উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের ওপর। এছাড়াও বিজেপি নেতা কপিল মিশ্রর নেতৃত্বেও গেরুয়া বাহিনীর গুন্ডারা হামলা চালিয়েছে সিএএ-বিরোধী আন্দোলনকারীদের ওপর। আর পরোক্ষে তার মদত এসেছে নর্থ ব্লক থেকে। ইন্দিরা গান্ধির জরুরি অবস্থার সময়ে আমরা পরিচিত হয়েছিলাম কমিটেড আমলাতন্ত্রের সঙ্গে। আজ আমারা পেয়ে গেলাম কমিটেড পুলিশতন্ত্রও। তবে এর প্রাকটিস শুরু হয়েছিল গুজরাটে ২০০২ সালে। গোধরা ও গোধরা পরবর্তী কাণ্ডের মধ্য দিয়ে। যাকে বলা হয় দাঙ্গার বা সাম্প্রদায়িক হিংসার ‘গুজরাট মডেল’। যে মডেলের রূপকাররা আজ দিল্লিতে ক্ষমতায়। কী অদ্ভুত সমাপতন, উত্তরপূর্ব দিল্লিতে সেই গুজরাট মডেলের দাঙ্গা সঙ্ঘটিত হল সেই ফেব্রুয়ারি মাসেই। এবং এই কুকর্মের কারিগর যে বিজেপি তা আরও স্পষ্ট হয় বুধবার সুপ্রিম কোর্ট ও দিল্লি হাইকোর্টের প্রতিক্রিয়ায়।

উস্কানিমূলক মন্তব্যের জন্য এবার বিজেপি নেতা কপিল মিশ্র-সহ অন্যান্যদের বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করার নির্দেশ দিল দিল্লি হাইকোর্ট। এবং এই এফআইআর দায়ের করার ক্ষেত্রে কোনওরকম দেরি করা চলবে না। এফআইআর দায়েরের আর্জি নিয়ে জরুরি ভিত্তিতে আদালতে আবেদন জানিয়েছিলেন মানবাধিকার কর্মী হর্ষ মান্দার। সেই হর্ষ মান্দার, সেই আইএএস, যিনি ২০০২-এ গুজরাট দাঙ্গার সময় নিয়ে বই লিখেছিলেন এবং সেই বইয়ে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে তখনকার গুজরাট সরকার যে পক্ষপাতিত্বমূলক কাজ করেছিল, তা তুলে ধরেছিলেন। মান্দারের আর্জির ওপর শুনানিতে দিল্লি পুলিশকে রীতিমতো ভর্ৎসনা করে বিচারপতি এস মুরলীধর ও বিচারপতি তলবন্ত সিংয়ের ডিভিশন বেঞ্চ।

বিচারপতি মুরলীধর বলেন, ‘সরকারি সম্পত্তি নয়ছয় এবং অগ্নিসংযোগ নিয়ে এফআইআর দায়ের করতে উদগ্রীব আপনারা। অথচ উস্কানিমূলক মন্তব্যের জন্য এফআইআর দায়ের করছেন না কেন? নাকি এর মধ্যে কোনও অপরাধ আছে বলে মনে করেন না আপনারা?’ যদিও, এত কিছুর পরেও, এতগুলো প্রাণ বলি হওয়ার পরেও কোনও সন্তাপ নেই বিজেপি নেতা কপিল মিশ্র বা অমিত শাহ বা তাঁর শাগরেদদের মধ্যে। কেন্দ্রীয় মন্ত্রীপ্রকাশ জাভড়েকর সাংবাদিক বৈঠকে পালটা বলেন, ‘কংগ্রেসের হাতে শিখ নিধনের রক্ত রয়েছে। তারা প্রশ্ন করার কে?’ ঠিক বলেছেন। কংগ্রেসের হাতে আলবাত রক্ত লেগে আছে। যেমন আছে মোদি-শাহর হাতে। যেমন আছে কপিল মিশ্রর হাতে। যেমন আছে অনুরাগ ঠাকুরের হাতে।

শিখ দাঙ্গায় যেমন, জগদীশ টাইটলার, সজ্জন কুমারদের রক্ষা করতে নেমে পড়েছিলেন কংগ্রেস নেতারা ঠিক সেভাবেই এখন কপিল মিশ্রদের রক্ষা করতে নেমে পড়েছেন মোদি-শাহরা। বিচারপতি মুরলীধরকে বদলি করেই মামলা নিয়ে যাওয়া হল সেই ঘরে, যেখানে অক্লেশে খাইয়ে দেওয়া গেল, এখনকার পরিস্থিতি কপিল মিশ্রদের বিরুদ্ধে এফআইআর করার পক্ষে সহায়ক নয়। দিল্লি হাইকোর্টে নতুন করে বেঞ্চ গঠন করে শুনানি হয় বৃহস্পতিবার। নতুন ডিভিশন বেঞ্চে দিল্লি পুলিশ জানায়, এখনও পর্যন্ত চারদিনে মোট ৪৮ জনের বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করা হয়েছে। উস্কানিমূলক মন্তব্য করা বিজেপি নেতাদের বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করা এখনই সম্ভব নয়। সেজন্য সময় লাগবে। এরপরই মামলার শুনানির দিন ১৩ এপ্রিল ঠিক করেন বিচারপতিরা। যাকে বাংলায় বললে বলতে হয়, ঠান্ডা ঘরে পাঠিয়ে দেওয়া হল। আর ততক্ষণে মোদি-শাহর ছা’রা যত পারে মোছলমান নিধন ও তাদের সম্পত্তি লুট করে নিক। ধিক এই বিচারব্যবস্থাকে! অথচ, তার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে আইবি অফিসার অঙ্কিত শর্মা খুনের ঘটনায় আম আদমি পার্টির কাউন্সিলর তাহির হুসেনের বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করল দিল্লি পুলিশ। এই এফআইআরের ভিত্তিও একটি ভিডিও। কপিল মিশ্রর ভিডিও ওই পুলিশ দেখে ওঠেনি আর এই ভিডিও দেখে এফআইআরও হয়ে গেল! আসলে তাহির হুসেন মুসলমান তো! যেমনটা বলেছেন জাভেদ আখতার। এরপরেও বলতে হবে, ‘সব ঠিক হ্যায়।’

গুজরাট দাঙ্গার সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন, মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে নরেন্দ্র মোদি রাজধর্ম পালন করেননি বলে। এমনকী, তাঁকে বরখাস্ত করতেও চেয়েছিলেন। পারেননি, সেইসময় মোদির মেন্টর লালকৃষ্ণ আদবানির জন্য। আবার ১৮ বছর বাদে সেই একই অভিযোগ উঠছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর বিরুদ্ধে। প্রশাসনকে যে নাগরিকের জাতি-বর্ণ-ধর্ম-ভাষা বিচার করে পদক্ষেপ করতে হয় না, সেই গুরুকর্তব্যটি বেমালুম অবহেলা করল দিল্লি পুলিশ, যে দিল্লি পুলিশ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর দফতরের সরাসরি অধীন। যে কোনও ধর্মের নাগরিকমাত্রই যে প্রশাসনের কাছে সমান নিরাপত্তা পাওয়ার অধিকারী, দিল্লির ঘটনা দেখিয়ে দিচ্ছে, সুশাসনের এই প্রাথমিক পাঠটিকে অমিত শাহর পুলিশ প্রশাসন সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করছে। ফলে রাজধর্মে ব্যর্থ অমিত শাহকেই এই ভয়াবহ হিংসার দায় নিতে হবে। আর সেই দায় না নিয়ে শাহরা যে ‘গুজরাট মডেল’ই চালাবে তা আবার প্রমাণ হয়ে গেল বিচারপতি মুরলীধরের বদলির মধ্য দিয়ে। অবিরত মৃতমুখের মধ্য দিয়ে দিল্লি ও অন্যান্য জায়গায় মুসলমানদের ও সমব্যথী হিন্দু বা অন্য ধর্মের লোকদের ত্রাসে রাখার এটিই শাহি কৌশল। ‘হিন্দুয়োঁ কা হিন্দুস্তান’, ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি দিয়ে যারা মুসলিম মহল্লার পর মহল্লা আগুনে ছারখার করছে, এখন সরাসরি তাদের বিরোধিতা করতে না পারলে, স্রেফ চুপ করে গেলে, জমে উঠবে প্রশ্রয় এবং সমর্থন। যার গর্ভে জন্ম নেবে দেশজুড়ে ‘গুজরাট মডেল’-এর দাঙ্গা। হিটলার ও মুসোলিনির হিন্দু মডেল/ দাঁড়িয়ে আছে নর্থ ব্লকের ব্যালকনিতে/ হিংসা এখন রাজধর্ম গান্ধিবুড়োর খাসজমিতে।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4647 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...