সৌম্যদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়
একেকটা দিন যেন কেমন হয়। একটা মন খারাপ জাপটে ধরে থাকে খাটের পায়ার কাঠামো। নীচ থেকে যেন তুরতুরে কুকুর ছানার মতো হাঁটু বেয়ে উঠতে থাকে দুঃখ। গায়ে তার রোমশ মাথা ঘষতে থাকে। সকালের নিশ্বাস শুকনো হাওয়ার স্নায়ুতে স্নায়ুতে সাইকেলের ঘণ্টি বাজিয়ে রাস্তা এদিক ওদিক করে, নরম রোদ কাঠবেড়ালী হয়ে পাঁচিলে লেজ ফোলায়। আর এরম সময়ে শুধু ঘরে বসে থাকতে ইচ্ছে হয় সুমনের। সামনের দুটো বাড়ীর পরের নীল রঙ্গা ঘরের ভিতর থেকে যে দুটো গোলাকার হাত বেড়িয়ে তারের বাঁধনে ভেজা কাপড় জড়িয়ে দেয় তাকে আরও একটু বেশিক্ষণ ধরে দেখার সুযোগ পাওয়া যায়। সামনের মজা জমিতে নেহাৎ অযত্নে বেড়ে ওঠা ফুলকাঁটা ঝোপের মাথা দোলানো, তার মাঝেই চকচকে মৌটুসির পালকে উপছে ওঠা রোদ্দুর বা অন্য কোনও কিছুই না, শুধুই জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকার সুনীল অবকাশ নিয়ে আসে এইসব হঠাৎ পড়ে পাওয়া ছুটির দিন। এইসব কত হাজার হাজার আপাত উদ্দেশ্যহীন মুহূর্তদের জীবন থেকে ঝরে যাওয়া, ভোরের আকাশে স্ট্রিট লাইটগুলোর মতো একে একে নিভে যাওয়া… মন দিয়ে বোঝার চেষ্টা করে দার্শনিক সুমন।
সুমন নজর করে দেখেছে, এরপর তিন কাঁটায় বিঁধেও সময় নিয়ন্ত্রণ করতে না পারার দুঃখ ভুলে ঘড়িও যেন একটু স্লথ হয়ে যায়! তার ভাবখানা, ঠিক আছে মজা করে নাও, কাল থেকে তো আবার আমিই বস। এইসব ভাবতে ভাবতে একটা একলা ফিচিক হাসি খেলে যায় সুমনের মুখে। রান্নাঘরে টুংটাং চুড়ি আর বাসন কোসনের ঝঙ্কার ততক্ষণে সুতপার উপস্থিতি জানান দিচ্ছিল। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ে সুমনের ঘুম থেকে ওঠার স্তিমিত তরঙ্গ ধরে ফেলেছিল তার স্বাভাবিক নারী সংবেদন গ্রন্থী। সকালে নিজের আর সুমনের খাবার বানিয়ে চা করে অফিসে বেরিয়ে যায় করিৎকর্মা সুতপা। পিকুর মা কোনওদিন অত সকালে এসে পৌছালে সাহায্য করে, কিন্তু তাকে এত কমবার দেখেছে সুমন যে রাস্তায় দেখা হলে চিনতে পারবে না নিশ্চয়ই। শুধু সুতপার উত্তাপের তারতম্য তাকে জানিয়ে দেয় পিকুর মায়ের উপস্থিতি আর অনুপস্থিতির ফারাক।
এই মুহূর্তে ঘরে চায়ের কাপ হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে ভিজে চুলে সুতপা ভ্রূ কুঁচকে দেখছিল, গুটিয়ে যাওয়া স্বামীকে। আর যখন তখন ফ্রেঞ্চ লিভ নেওয়া উচ্চাশাহীন সুমন প্রাণপণে আশা করছিল অবশেষে সুতপা মুখ খুলবে এবং বিয়ের দশ বছর পরেও একটা বাচ্চার জন্ম না দিতে পারা, হয়তো ঈষৎ পুরুষত্বহীন সুমনকে অত্যন্ত পেশাদারী নৈপুণ্যে তার জায়গাটা বুঝিয়ে দেবে ফিটফাট, চটপটে এবং ছোটখাটো একটা এম এনসির ট্রেনিং সেন্টার হেড, সুতপা বসু। নিজেদের শরীরের প্রতিটা তিল, জরুলের ঘ্রাণময় গলিপথ, বেনোজলসিক্ত ত্বকভূমি, কোথাও অসতর্ক ব্যথার হোঁচট অন্ধকারেও নিজের পকেটের রুমালের মতো পরিচিত, তবুও কি অচেনা থাকে না কোনও আকস্মিক বাঁকের প্রলোভন। তাই সুতপা প্রত্যাশামতো কিছুই বলে না। কেবল, আজও অফিস যাবে না, না? বেশ ভালই আছ, বলে চাটা বিছানার পাশে রেখে দিয়ে যায়। কোনও শ্লেষ হয়তো ছিল না কথাটার মধ্যে, শুধুই কিছুটা নির্দোষ পাটানা তবু সেইটুকুও নিজের অক্ষমতা ঢাকতেই বোধহয় সুমন অগ্রাহ্য করে। লক্ষ করে চায়ের কাপ রেখে রেখে টেবিলে একটা গেরুয়া গোল দাগ হয়ে গেছে। বাসী মুখে একটু দুর্গন্ধ হাসি ফোটানোর চেষ্টা করে সুমন। তারপর মনে হয় নিজের উদ্দেশেই বলে আজ আর অফিসে যাব না বুঝলে সুতো, একটু মন দিয়ে বাজার করে আনি। সেই প্রাকযৌবনের ডাকনাম শুনে একটু দ্রব হয় কি সুতপা? নাকি অন্য কোনও ধাতব নারীকণ্ঠ বলে ওঠে–- ঠিক আছে এসে মনে করে ফ্রিজে ঢুকিয়ে দিও আগের বারের মত ভুলে যেও না। অফিসের খাবারটাই ডাইনিং টেবলে রেখে গেলাম খিদে পেলে খেয়ে নিও। রাতে একটু কিছু বাইরে থেকে অর্ডার করে নিও প্লিজ, আমার দেরি হবে অফিস থেকে ফিরতে। খেয়েও আসব। বসে থাকবে না কিন্তু না খেয়ে। বলতে বলতে তার পায়ের শব্দ ঢুকে গেল পাশের ঘরে। ছিটকিনির আওয়াজ এল। তারপর মনে পড়ল, ওই ঘরটায় আগে ছিটকিনি লাগাত না সুতপা। তখন বাবা বেঁচে, নতুন খেলনায় ব্যস্ত দুজনেই খেয়াল করেনি দরজাটা হাঁ হয়ে গেছিল কখন।
চটকা ভেঙ্গে সুমন যেন শুনল, সুতপা বলছে আজ অফিস ডেটে যাব আবীরের সাথে। নিজের স্বাভাবিক ঔদাসীন্যে এসব প্রশ্রয় দিল না সুমন। শুধু চায়ে চুমুক দিয়ে হাসিটা আরও চওড়া করে বলল, মাইরি চাটা কিন্তু আজ হেব্বি হয়েছে।
যদিও এসব ছেঁদো প্রশংসাতরলে সংসার চিঁড়ে ভেজে না অনেকদিনই, তবুও সুমন এসব বলে আনন্দ পায় আর সুতপাও এই বহুব্যবহৃত লব্জে অন্তত দৃশ্য়কৌতুক অনুভব করে বলে তার দৃঢ় ধারণা। এর পরে সুতপার যথাযথ অঙ্গুলী ওরফে মুঠোফোন হেলনে দরজায় এসে ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে যায়। এলাম, শব্দের সাথে আস্তে আস্তে সুতপার শাড়ি মোড়ানো সুগন্ধী শরীরটা চৌকাঠ পেরিয়ে বাইরের দিকে এগিয়ে যায়। এবার ফিরতে অন্তত ১৪ ঘণ্টা!
সুতপা বেরনোর সাথে সাথেই বাইরেটা কেমন চুপচাপ হয়ে গেছে। কয়েক পরত আলসে চাদর যেন নেমে আসছে ঘরের মধ্যে। নাহ এখন ঘুমোবে না সে, তাই আড়মোড়া ভেঙ্গে বিছানার নীচে লুকোনো বিড়ির প্যাকেটটা বের করে এবার সুমন। সিস্টেমটা ক্লিয়ার করতে হবে।
বাইরের ঘরে এসে লুঙ্গি পরতে পরতে কি কি বাজার করবে ভাবছিল সুমন। দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে তার যেন নতুন করে মনে পড়ল বাড়িটা কতটা বদলে গেছে। ছবিতে দেওয়াল ঘিরে রাখা তাদের পরিবারের পছন্দসই গৃহসজ্জা। সে দেখছিল সার সার ঘিয়ে খয়েরী থেকে সাদা কালো হয়ে রঙিন ছবির শোভাযাত্রা। একটা ঝাপসা নারীর কোলে কাজলপরা শিশু ঠাকুরদা ধীরে ধীরে চন্দনচর্চিত ফ্রেমের ভার নিয়ে পেরেক সম্বল। তাদের দুজনের যুগল ফ্রেমের পাশাপাশি বছর তিরিশ আগের মা বাবার সাথে ভ্রূ কুঁচকে ছোট্ট সে। আর এসব পারিবারিক ভিড়ভাট্টা থেকে উলটোমুখে আলখাল্লা পড়ে গম্ভীর রবি ঠাকুরের মাথা ঝুঁকিয়ে অন্য কোনও দিকে হেঁটে চলে যাবার পোজ। আর সেটা থেকে একটু এগিয়েই কোণের দিকে আংটায় কয়েকটা মোটা নাইলনের ব্যাগ ঝোলানো। বাজারের ব্যাগ। বাবার। অনেক ঝড়ঝাপটা পেরিয়ে তাপ্পির আস্তরণ নিয়েও দস্তুরমতো টিকে আছে বাজারের ব্যাগগুলো। বাবার বাজারশৈলীর জ্ঞান উত্তরাধিকারে না পেলেও ব্যাগগুলো সুমনকে হারিয়ে যাওয়া বাবার স্পর্শ দিয়ে যায়। ওকে দেখে একটু যেন দুলে উঠল ব্যাগগুলো, আমাকে নিয়ে চলো বাইরে এরম আবদার করছে বলে মনে হল সুমনের। বাইরে তালা দিয়ে বেরিয়ে পরে সুমন। বাঁ চোখটা কেমন তিরতির করে কাঁপছে তার।
রাস্তায় বেরিয়ে সেই নিয়মমাফিক দৃশ্য, দত্তদাদু কানাগলির সামনে নিজের যন্ত্র বের করে হালকা হচ্ছেন ওপরে ঘোষেদের জানলা অগ্রাহ্য করে। সামনের টাইমকলে বউমেয়েদের গ্যাঞ্জাম। এর মধ্যে দক্ষিণী ফিরিওয়ালার ইডলি ধোসা বড়া চেঁচানিতে খিদে ছড়িয়ে যাচ্ছে বাতাসে। নারান্দার চায়ের গুমটিতে ধোঁয়া আর আড্ডার কুণ্ডলী ফণা পাকাচ্ছে। পিঠেতে ব্যাগের ভারে ঝুঁকে ঝুঁকে চলছে শিশু আর আইটি যুবা। মন্দিরের সামনে বিষ্যুদবারের জনসমাগম। সেই সুযোগ নিতে পাড়ার পেশাদার ভিখিরি ল্যাংচা নিজের পোষ্য ও পোষক ঘাটাকে চুলকে বসে পড়েছে রাস্তার সাথে একটা অদ্ভুত জ্যামিতি সৃষ্টি করে। মাঝে মাঝে ওকে বিড়ি টিড়ি দেয় সুমন, তাই ওকে দেখে একটু ব্যস্ত হাসি হাসল ল্যাংচা। ভালই তো আছিস ব্যাটা, মনে মনে বলে কার্নিক মেরে বাজারের রাস্তায় ঢুকে গেল তারপর।
সেনকাকু ওরই মতো একটা ব্যাগ ঝুলিয়ে ঘেমেনেয়ে ফিরছেন বাজার থেকে, ব্যাগের গহ্বর থেকে কয়েকটা ডাটা, শাকপাতা গোছের বেরিয়ে রয়েছে। দেখেই ও মোটামুটি কোণ ঘেঁষে বেরিয়ে যেতে চাচ্ছিল, কিন্তু সেনকাকুকে এড়ানো সম্ভব নয়। দেখতে পেয়েছেন ঠিক। ওনার ছেলে জয় স্কুলে সুমনের সাথে এক ক্লাসে পড়ত সে হিসেবেই যেটুকু চেনাপরিচিতি। হাঁড়িহেঁশেলের বন্ধু তো নয় বটেই, বরঞ্চ মাঝারি গোত্রের ছাত্র সুমনকে জয়রাজ সেন বা তার বাবা কেউই বিশেষ পাত্তা দিত না। ওদের গন্ডি ছিল আলাদা, পড়াশোনায় উচ্চ কুলীনদের সাথে। তা সেই জয় আজ আমেরিকা না ইংল্যান্ড কোথাও একটা থাকে। সে ভালই আছে নিশ্চয়। না থাকলেও কিছু যায় আসে না সুমনের, কিন্তু এখনও ওখানে যাবার সুযোগ না ঘটলেও দেখা হলেই সেই বৈদেশিক স্বর্গের স্বপ্নপোলাওয়ের বিবরণ যথাবিহিত ঘি সহযোগে পাড়ার লোকজন বিশেষত নিজের বা ছেলের বন্ধুস্থানীয়দের কাছে ফলাও না করলে পিত্ত বায়ু ইত্যাদি শারীরিক পীড়ায় ভুগতে থাকেন উত্পল সেন। তবে আজ বাজারের নোটিস বোর্ডে ঝুলতে থাকা জাগো বাংলার পাতার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকা সুমনকে রেহাই দিলেন তিনি, শুধু বলে গেলেন ভালো কই উঠেছে হে। দাঁও মেরে নাও, অবশ্য ৪৫০ টাকা কেজি বলে এমন একটা ক্লিষ্ট হাসলেন যে কাছাকাছি কেউ থাকলে তারা হয়ত আন্দাজ করত, কই অধরা থেকে গেছে তার আয়ত্তের।
কিন্তু সুমন তখন ঝাঁকের কইদের থেকে একটু দূরে চলে গেছিল। এক শতাব্দী প্রাচীন মিটার গেজ রেলপথ বন্ধ হয়ে যাবে সামনের সপ্তাহে তাই নিয়ে ছবি, লোকের স্মৃতিচারণ ইত্যাদি নিয়ে দু পাতার প্রতিবেদন তাকে ভাবাচ্ছিল। তারপর তার মনে পড়ল, লোকাল ট্রেনে তার খুব একটা ওঠা হয় না। ছোটবেলায় বাবার সাথে চক্ররেল চড়া ছাড়া সেরম কোনও স্মৃতি নেই। তার আর সুতপার তামাম আত্মীয়স্বজনের পরিধি কলকাতার ১০ কিমির মধ্যেই শেষ হয়ে যায়, মেট্রো ছাড়া আর ট্রেনের দরকার পড়েওনি তাই তার। পথের পাঁচালীতে রোগশীর্ণা দুর্গার অপুকে একবার রেলগাড়ি চড়ানোর বলা কথাটা মনে পড়ে যায়-– ছোটবেলায় খুব কান্না পেত তার যে জায়গাটা পড়ে। ধুর কী সব আজেবাজে ভাবছে। বাজারটা সেরে আসা যাক ভেবে তরুণদার সেলুনটা ছেড়ে এগোল সে। নানা বয়সীদের ভিড়ে জমজমাট সেলুন। বয়স্কদের কাছে টাকা অথচ স্টাইলোপোযোগী চুলের অভাব আর অল্পবয়সীদের কাছে চুলের সাম্রাজ্য থাকলেও টাকার অভাব এই দুই মিলিয়ে সেলুন বেশ স্থিতিশীল। এখান থেকেই বাজারের চেনা আঁশটে গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। থাক আজ একটু অচেনা মফস্বলী বাজারই করে আসি, ভেবে ডানদিকে হল্ট স্টেশনের রাস্তা ধরল সুমন।
অফিস টাইম শেষ হয়ে গেছে অনেকক্ষণ তাই স্টেশন প্রায় ফাঁকা। সামনের বেওয়ারিশ রেল কলে খলবলিয়ে চান করছে কয়েকটা ন্যাংটা বাচ্চা। পাতার জাল চুইয়ে আলো এসে পড়েছে তাদের ওপর| গাছ থেকে লুকিয়ে চিক চিক করে শব্দ করে যাচ্ছে একটা পাখি, এছাড়া আর কোনও শব্দ নেই চারপাশে। বেঞ্চিগুলো যেন অবাধ ঘুমের হাতছানি দিচ্ছে পথিককে। এমন সময় ট্রেন এল দুলকি চালে। কামরা খালি প্রায়, লোকের বগলের ভিড়মুক্ত। এতক্ষণে নিজের কেত দেখানোর সুযোগ নিচ্ছে ঈষৎ ভারী হাওয়া। সুমন, কিছু শহরফেরত গেঁয়ো লোক, ছুটকোছাটকা প্রেমিক প্রেমিকা, এবং কিছু অত্যুত্সাহী ফিরিওয়ালাকে পেটে নিয়ে মাঠ, জনবসতি, জলাজমির বুকে পড়ে থাকা বহুতলের ছায়া এসব সটাসট ফেলে রেখে দৌড়াচ্ছিল ট্রেন। এই দিকে বিশেষ আসেনি সে। স্টেশনের নামগুলো কি অদ্ভুত। অচেনা অজানা অথচ যেন আবার কত কাছের। অবাক হয়ে দেখছিল সুমন।
মাত্র আধঘণ্টা হয়েছে, এর মধ্যেই বাইরেটা পুরো পাল্টে গেছে। ফসলে স্রোত কাটছে হাওয়া, নির্জন কৃষ্ণবর্ণ জলে মাছ ধরছে একাকী বৃদ্ধ… মন কেমন করা মলাট যেন কেউ মুড়িয়ে দিচ্ছে ছোটবেলার বইতে। কতগুলো স্টেশন পেরিয়ে এল সে তার অভ্যস্ত ঘরসংসার থেকে?
এবার একটা স্টেশন এল, তার নাম পিয়ালী। চারদিকে সবুজ পাতা আর নীলাভ জলের আদরকাজল পরা দ্বীপের মতো একটা নির্জন স্টেশন। এখান থেকে কেউ কোনওদিন কোথাও যায় না, সেই দুঃখে একটা স্টেশনরুম শ্যাওলা গায়ে নিজের মধ্যে গুটিয়ে রয়েছে। একটা নরম আলো আর মেঘের ছায়ায় যেন ভেসে রয়েছে উদাস গম্ভীর প্ল্যাটফর্ম। সুমন নেমে পড়ল ব্যাগ নিয়ে।
নেমেই মনে পড়ল কলেজে এই নামে তার এক বান্ধবী ছিল। অনেকের কাছেই তাদের সম্পর্ক বেশ মাখোমাখো মনে হয়েছিল কিন্তু সুমন বুঝেছিল বাস্তবে ঠিক তা ছিল না। অনেক ঝড়ঝাপটা থেকে প্রায় মায়ের মতো মমতায় তাকে পাখার আড়াল দিয়েছে পিয়ালী, নোটস যুগিয়েছে সময়মতো পরীক্ষা বৈতরণী পেরোনোর জন্য। দুজনের শরীরে ঠোকাঠুকি হয়নি তা নয়, কিন্তু তাতে প্রত্যাশিত আগুনের সন্ধান ছিল না। প্রায় পনেরো বছর কেটে গেছে শেষ কথা বলার পর। যোগাযোগ নেই অনেকদিনই কিন্তু পুরনো কুঠুরী হাতড়ালে হয়তো কিছু ধুলোর পরাগ মেখে শুয়ে থাকা চিঠিপত্র, টুকরো কাগজ ভরা হিজিবিজি খুঁজে পাওয়া যাবেই। সেসব আর না ঝাড়াই উচিত সংসারীদের। সামনে ওর অপেক্ষাতেই যেন একটা হাতলভাঙ্গা বেঞ্চ। একটা বিড়ি ধরাল সুমন। বাতাসে মিশিয়ে দিল ধোঁয়ার বলয়। আর তখনই দেখতে পেল মেয়েটাকে।
একটা সাধারণ তাঁতের শাড়ি পরে ওকেই দেখছে ঘাড় হেলিয়ে। খুব আকর্ষণীয়া নয়, কিন্তু চোখদুটো মারাত্মক! এর আগে কোথাও দেখেছে সে! খুব খুব চেনা এই চকমকিযুগল। কোথায় দেখেছে? কোথায়?
মেয়েটা এগিয়ে আসছে ওর বেঞ্চেরই দিকে। এবার সামনে এসে দাঁড়াল, একটা দুষ্টু গজদাঁত আছে মেয়েটার লক্ষ করল সুমন। এর পর স্থাণু সুমনের হাতটা আচমকা অসংকোচে ধরল সে। বলল, কি হল চলো। কতক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছি যে তোমার জন্যে, আর তুমি এত দেরি করলে! আমি চলে গেলে কী করতে? একটা আলতো অধৈর্য টানও পড়ল এবার আঙ্গুলে। আর তখনই, একটা বিদ্যুত তরঙ্গ যেন খেলে গেল তার মস্তিষ্কে। মনে পড়েছে তার, এই চোখ! সব কিছু! কিন্তু, কী করে সম্ভব! কী করে?
অনেক ছোটবেলায় বাবার সাথে একবার মালদায় নদীর ভাঙ্গন দেখেছিল সে। উঁচু থেকে সে দেখছিল নিজের ছায়া আর দেখছিল জলের আলতো আদুরে অথচ দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ঠোকায় বাধের চাঙ্গর খসছে, মিশে যাচ্ছে ঘোলা জলের অতলস্পর্শী ঘূর্ণিতে। তাকে সাক্ষী রেখে সেই ছলকানি ঢেউ অল্পে অল্পে পিছু হটিয়ে দিচ্ছে শতাব্দীপ্রাচীন বিশ্বাসসৌধ, ধ্বসিয়ে দিচ্ছে আড্ডাঘন বটতলা, সযত্ন লালিত ঠিকানা। পার ভাঙ্গছে, নিরন্তর|ঝুপ ঝুপ করে সে আওয়াজ কানে যেন ধাঁধা ধরিয়ে দেয়। আজ আবার সেই নদীটাকে দেখতে পেল সুমন। ছোটবেলার মতো স্পষ্ট, সফেন তার পুঞ্জিত দেহ আর তার সামনে দ্বিধা বিভক্ত অপেক্ষা ক্লান্ত এক বিশীর্ণ তটরেখা।
অতঃপর একটা গভীর শ্বাস ফেলে বেঞ্চ ছেড়ে উঠে দাঁড়াল সে, মেয়েটার হাত ধরে এগিয়ে গেল স্টেশনের প্রান্তসীমায়। সেখান থেকে রাস্তা মিশে গেছে অন্য কোথাও, অন্য কোনও সময়ের সীমা ছাড়িয়ে সে কোথায় গেছে তার খোঁজ কে জানে? আর সেই মুহূর্তটাকে স্মরণীয় রাখার জন্যই হয়ত শুধু একটা ফক্কড় হাওয়ার ঘূর্ণি উঠল কোথা থেকে। সেই দমকায় বেঞ্চ থেকে উড়ে বেরিয়ে ঘুরপাক খেতে লাগল, বাবার প্রিয় বাজারের ব্যাগটা।
ছবিঋণ – ইন্টারনেট