অসঙ্গতির সঙ্গত — ১০ম পর্ব

হিন্দোল ভট্টাচার্য

 

পূর্ব প্রকাশিতের পর

বাইরের অস্থিরতা যেন তোমায় স্পর্শ না করতে পারে। ভিতরে যেন তুমি থাকতে পার স্থির। বাতাস তো বয়ে যাবে, ঝড় বয়ে যাবে। চারিদিকে ধ্বংসস্তূপ তৈরি হয়ে যাবে। কিন্তু তুমি যেন মনের মধ্যে থাকতে পারে দ্য পিয়ানিস্ট ছবির সেই পিয়ানোবাদকের মতো স্থির। ভেবে দ্যাখো, চারিদিকে ধ্বংসস্তূপ। কিন্তু সে যখন পিয়ানোতে বসছে, তখন কী সুন্দর লাগছে সব! কিন্তু হে শিল্প, আমি তো পারছি না, পারছি না নিজেকে শান্ত রাখতে। আমার অবস্থা মুংক-এর চিৎকার ছবিটার মতো। কিন্তু জানি, এই অবস্থা কোনও বড় মাপের ভাবনার কাছে নিয়ে যেতে পারে না। অন্ধকারের মধ্যে দাঁড়িয়ে অন্ধকার হয়ে যাওয়ার চেয়ে ভালো একটা ছোট্ট মোমবাতি জ্বালানো। যতই সে মোমবাতি ক্ষুদ্র হোক না কেন, তার আলো অন্তত এটি প্রমাণ করে দেবে যে, তার চারপাশে ঘন অন্ধকার। তবে, কী করব আমরা এখন? লোকজনকে ধরে ধরে বলব, ভাই, শেষের সেদিন সমাগত। লড়াই কর, বিরুদ্ধে দাঁড়াও, তাহলে অন্তত মরার সম্মানটুকু নিজের কাছে থাকবে। একবার আউসউৎজ-এ এক কুখ্যাত জার্মান অফিসারের খেয়াল চাপল, তিনি বন্দী ইহুদীদের দিয়ে জার্মান সঙ্গীত গাওয়াবেন এবং বাজানো প্র্যাকটিস করাবেন। স্যাক্সোফন, ট্রাম্পেট, ভায়োলিন এবং বাঁশি নিয়ে তাঁর চারপাশে বন্দী ইহুদীরা সেই সুর বাজাতে লাগল। আর সুরে বিচ্যুতি হলেই গর্জে উঠছিল সেই জার্মান্ অফিসারের হাতের বন্দুক। তো, এরকম কিছুক্ষণ চলতে চলতে যখন গোটা ব্যাপারটাই সহ্যের সীমায় চলে গেছে, তখন ইহুদীরা এটুকু বুঝে গেলেন, যে, তাদের মৃত্যু আসন্ন। তাই সম্মান বাঁচানোর কাজটাই করা দরকার। তাঁরা সমস্ত বাদ্যযন্ত্রে শুরু করলেন জার্মান সঙ্গীতের বদলে ইহুদী গান। আর সেই গান শুনে পাশে লাইন দিয়ে গ্যাস চেম্বারের দিকে যাওয়া ইহুদীরাও গেয়ে উঠলেন। ফল ভালো হল না। প্রায় সমস্ত জার্মান নাজির বন্দুক কথা বলল। শোনা গেল শূধু বুলেটের শব্দ। পড়ে থাকল কিছু বাদ্যযন্ত্র এবং অসংখ্য ইহুদী মৃতদেহ। তো, যখন আপনার হাত থেকে বেরিয়ে গেছে সব, তখন অন্তত নিজের সম্মানটুকু বজায় রাখার চেষ্টা করুন। আমরা ইতিহাসটুকু ধরে রাখার কাজটা করে যাওয়া ছাড়া আর কিছুই কি করতে পারি?

ক্ষুদ্র রাজনীতির সঙ্গে শিল্পের সম্পর্ক খুব একটা থাকে না। যেটাকে সম্পর্ক আছে বলে ভাবি, সেটা আসলে কিছুই নয়। টুসকি মেরে ফেলে দেওয়া যায়। কিন্তু রাজনীতি যখন অস্তিত্ব রক্ষার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়, তখন তার সঙ্গে শিল্পের সম্পর্ক গভীর ভাবে আছে। আজকের ভারতবর্ষ এমন এক নরককুন্ড, এমন এক কসাইখানা, যেখানে দাঁড়িয়ে আমাদের শিল্পের ভিতরে স্বভাবতই কাজ করে এক দ্বিধা। কী বলব। যদি বলিও, সেই সব কথা কীভাবেই বা বলব। আর বললেও সে কথা কেউ এখন শুনবে কিনা। আমাদের সমস্ত লেখালেখি এখন হয়ে দাঁড়াচ্ছে কেবল নিজেদের জন্য লেখালেখি। এই ধরুন আমরা প্রবল প্রতিবাদ করলাম। কিন্তু তা সীমাবদ্ধ থাকল আমাদের ২০০ জনের মধ্যে, যারা কখনওই উগ্র জাতীয়তাবাদের লোক নয়, সাম্প্রদাইয়িক তো নয়-ই। তাহলে নিজেদের মধ্যে এই ইতিহাসের সংরক্ষণ। নিজেদের মধ্যে এই প্রতিবাদ। কিন্তু জানি না আমরা ‘পাগলা ষাঁড়ে করলে তাড়া কেমন ভাবে ঠেকাব তায়’?

এখানেই অসঙ্গতির চূড়ান্ত। কমিউনিস্ট আন্দোলন এভাবেই ভাষাগত কারণেও অনেকটা কখনওই সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছতে পারেনি। ভারতের ১৩০ কোটি মানুষের মধ্যে ১২৯ কোটি মানুষের কাছেই ফ্যাসিবাদ শব্দের কোনও মানে নেই। তেমন-ই কমিউনিস্ট শব্দের মানেও আছে কি? তার সঙ্গে নেই হাজারো পলিটিকাল জার্গনের। অথচ দাঙ্গা হলে বেশিরভাগ যে সমস্ত মানুষ দাঙ্গা করে বা দাঙ্গায় বিধ্বস্ত হয়, তারা এই শ্রেণির মানুষ-ই।

আমরা ভাষাটাকেই চিনতে পারছি না। গড়ে তুলতেও পারছি না। এমনকী নিজেদের কাছেই এখন ব্যবহৃত শব্দগুলি বড় বেশি একঘেয়ে বলে মনে হচ্ছে। শব্দের মধ্যে রক্তপ্রবাহ বা স্পন্দন টের পাচ্ছি না। আমাদের ব্যবহৃত শব্দ কি মৃত হয়ে গেছে? যদি সেই শব্দগুলি নিজেদের কাছেই মৃত হয়ে যায়, তাহলে আমরা সেই সব শব্দগুলি দিয়ে কীভাবে অন্য মানুষের কাছে পৌঁছব?

এটি একটি চূড়ান্ত অসঙ্গতি আমাদের ইচ্ছা আর আমাদের সেই ইচ্ছাকে বাস্তবায়িত করার জন্য যে মাধ্যম, সেগুলির মধ্যে। আজ যে ফ্যাসিবাদী হিন্দুরাষ্ট্রে আমরা বসবাস করছি আগুনের মধ্যেই, যখন যে কোনও সময়ে আমাদের দরজা ভেঙে ফ্যাসিবাদী নরপিশাচেরা আমাদের ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়তে পারে, – এর আরেকটা কারণ কিন্তু প্রগতিশীলতার সঙ্গে এই পিছিয়ে পড়া ফ্যাসিবাদী মানসিকতার দূরত্ব তৈরি হওয়া। আমাদের কথাবার্তার সঙ্গেই দূরত্ব রয়েছে সাধারণ ভারতবাসীর। কীভাবে আমরা ভারতবাসীর কাছে গিয়ে বোঝাব ধর্ম এক নিষিদ্ধ বিষ আর দর্শন এখন ব্যক্তিগত অনুসন্ধান। ধর্মীয় সাহিত্যগুলি ইতিহাসকে খোঁজার একটি সূত্র। কিন্তু কীভাবে আমরা এই যুক্তিগুলি দিয়ে ধর্মীয় ফ্যাসিবাদী যে আগুন হাওয়া বইছে, তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াব?

চেনা কথায় আর হবে না। মানুষের জীবনের পাশে চলতে চলতে, তার সঙ্গে কথা বলতে হবে সাধারণ ভাবে। কিন্তু কে এই কাজটি করবে কোনও উদ্দেশ্য ছাড়া? যখন আজ শিক্ষা, চেতনা – এগুলির বড়বেশি প্রয়োজন আজ।

 

ক্রমশ

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4658 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...