মৃণাল চক্রবর্তী
পূর্ব প্রকাশিতের পর
৮
খুব ভোরে হোটেল থেকে পালালাম। নাহলে ভুতো ঠিক ওদের সঙ্গে নিয়ে যেত। সেই না-হওয়া ট্রিপের কথা ভেবে কাল রাতে আমার ঘুম পেয়ে গিয়েছিল। কিছু খোলামেলা মানুষের ভালবাসায় সাপ্টে আছি মনে হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল যেন আমরা সবাই ভোরবেলা চোখ খুললেই দেখতে পাব মাউন্ট পান্দিম। সারারাত আমি ঘুমের মধ্যে কেঁদেছি।
বন্ধুরা, আপনারা অবগত আছেন যে বৃদ্ধের কান্না দেখতে খুব বাজে লাগে। অপরিসীম ভেতো অভিজ্ঞতার আকর অথচ পুরোপুরি ঘেঁটে যাওয়া বুড়োর কান্নার ছবি আমি দেখেছি। আয়নায়। আবার সেই আয়না। খাটে আধশোয়া হয়ে কাঁদতে কাঁদতে নিজেকে অতর্কিতে দেখলাম। বিচ্ছিরি। তবে এটাও লক্ষ করার মত যে বেদনায় আমি কেঁদেছিলাম পরে ভেবে দেখেছি সেই ঘটনায় জড়িয়ে না পড়ে খুব ভাল হয়েছে। যেমন এবার। আজ সকালে না হলেও হয়ত কাল আমি ভুতোদের সঙ্গে মুগ্ধ হয়ে পাহাড় দেখতাম, কিন্তু এটাও নিশ্চিত কোনও একটা সময় আমার পালাতে ইচ্ছে করত। ওদের মজার পরিবারে ভূতগ্রস্ত হয়ে থাকলে দম চৌপাট হয়ে যেত। তাই এখন গাড়ি চড়ে যাচ্ছি ডুয়ার্সের দিকে। কিন্তু ওখানে আমার কেউ কোনওদিন ছিল না।
পুল্টুশ একেবারেই চুপচাপ। সকালে একবার শাসানি দিয়েছে: সুতো কাঁচা আছে, এখন মদ খেও না। আমি সব ভুলে যাই মাঝেমাঝেই। পুল্টুশ আমার স্মৃতির নানা রঙের সুতো সেলাই করে দেয়। আমি নিশ্চই বেশ ঘেঁটে আছি, তাই ওকে খুব খাটতে হচ্ছে। এমনকি যখন হুট করে সকালে বেরোলাম, গা করল না। স্মৃতি সেলাই করা নাকি খুব কঠিন।
ভুতোর ফোন এল। রাতে কখন যে নম্বর নিয়েছে কে জানে?
–হ্যাঁরে, আসলে আমাকে একটা জরুরি খবর পেয়ে…
–লায়ার।– ভুতো খচে আছে।
–আমার এক মাসি খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছে। জলপাইগুড়িতে…
–সালা হারামি! তোর কোনও মাসি কোথাও নেই।
এই ধরনের মাসি-পিসেদের অসুস্থতার গল্প বলে অনেক সময় ছাড় পেয়েছি। অনেকেই বিশ্বাস করেনি, কিন্তু মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে। অসুস্থতার খবর, তার ঠিক পরেই হসপিটালাইজেশনের কথা সমবেদনা জাগিয়ে তোলে। ভুতো সেদিকে গেল না।
–মাসি ছিল আমার। দীপামাসি। নৈহাটিতে থাকত।
–তুই আমাকে বলেছিলি তোর কোনও মাসি নেই।– কঠিন গলায় ভুতো যোগ করল— ইয়ু আর আ বাস্টার্ড!
–কিন্তু আমার বাবা ছিল। একবার আমার জন্মদিনে তোর সঙ্গে গলা মিলিয়ে গান করেছিল।
–কথার খেলা খেলিস না! ইস, তুই কেন চলে গেলি? এখন আর আমার একটুও ভাল লাগছে না।
এই কথা সত্যি একটা টোকা দিয়ে গেল। কোথায় টোকা দিল বুঝলাম না। ছোটবেলার পর কেউ আর এমন করে বন্ধুকে চায়? ওভাবে বলে?
ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় আমার একটা আঁটোসাটো বন্ধু ছিল। আমরা সব রকম সময়ে, সব ঋতুতে, একে-অন্যের কাছে থেকেছি। মুগ্ধতা, বিরোধ, ঝগড়া, হিংসে, দমফাটা ভালবাসা এই সব নিয়ে কাটিয়েছি। ওর বাবা-মা থাকতেন দার্জিলিং-এ। অনেক দিন দেখা হত না আমাদের। আমার কিচ্ছু ভাল লাগত না। ভাবতাম, ও আসলে যায়নি, টুক করে জানলার ধারে এসে কোনও নাটক করবে।
চিঠি আসত-চিঠি যেত। দীর্ঘ চিঠি। দার্জিলিং-এর বিষণ্ণ মেঘ দিয়ে লেখা ওর দীর্ঘ চিঠি। ঠান্ডা একদম সহ্য করতে পারত না। এদিকে তখন ওকে ছাড়া আমার কলকাতা আধখানা।
–চলে গেলি কেন বল তো? আমার এত ভাল লাগছিল তোকে পেয়ে। আর একটাও বন্ধু নেই রে দুনিয়ায়। এ সালা মরে গেল, ও গান্ডু বিদেশে ঠেসে বসেছে। এতদিন পরে তোর সঙ্গে দেখা হল। ভাবলাম… তুই ঢ্যামনা চলে গেলি!
ভুতো কাঁদছে। এবার আমার মনখারাপ শুরু। নিশ্চই অনেকটা মদ খেয়েছে ভুতো। কিন্তু ও কাঁদছে। এখন খোলাখুলি কাঁদছে। হাত-পা ছুঁড়ে কাঁদছে আমাদের যৌবনের রাইট ব্যাক…
মোবাইল হাতবদল হল। দীপ্তি।
–আগে কখনও এভাবে ওকে কাঁদতে দেখিনি, তারপর সকাল থেকে ড্রিঙ্ক করছে। আমরা সামলে নেব ইন্দ্রদা, তুমি ভেবো না।
কাল রাতে হাসাহাসির মধ্যে কখন যে দীপ্তি আমাকে তুমি বলে ডাকছে আমার মনে নেই। কিন্তু কাল যে আমি ওকে অনেকবার তুই বলে ডেকেছি, আমার মনে পড়ল।
–শোন, ওকে বল মদ খাওয়া থামাতে। আমি আসছি।
–তুমি সত্যি আসবে! ঠিক বলছ! কোনও অসুবিধে…
–চেপে যা না। ভুতোকে বল মদ না খেতে।
–আমি তোমাকে যে কী বলব…
–আগে ওকে বল। আসছি।
ভুতো জানেই না ও কেমন মায়ার চাদরে ঢাকা। তবু মন শুধু বন্ধু বন্ধু করে। আমারও করে। কিন্তু আমার কোনও প্রত্যাশা নেই। আজ ভুতোর কান্না আমাকে বিপথগামী করল। মালবাজার আসার আগেই গাড়ি ঘোরাতে বললাম। মিষ্টি মুখের দাজু অবাক হল, কিন্তু আগে মন দিয়ে গাড়িটা ঘোরাল। হেসে বলল—
–কোই এমারজেন্সি আ পড়া, সাব?
–নেহি, উধার আপনা দোস্ত রো রহা হ্যায়।
এই কথাটা খুব মনে ধরল দাজুর। ও এক বন্ধুর গল্প শুরু করল যে কাঠমান্ডু গেছে বলে ওর কিছু ভাল লাগছে না। আজ কি সারা দুনিয়া এই কথাগুলো শোনাবে তোমাকে ইন্দ্রজিৎ? একটু পরেই আমি খুব লজ্জা পেয়ে গেলাম। কারণ আমার বলা কথাগুলো একদম হিন্দি সিনেমা থেকে টোকা মনে হল। একটা ফোন এল। অচেনা নম্বর। দীপ্তি কথা বলছে।
–গাড়ি নিয়ে ড্রাইভার চলে এসেছে। এখন কী করি বলো তো?
–ভুতো কোথায়?
–তুমি আসছ খবর পেয়ে বলল, এক্ষুনি তৈরি হতে হবে। শেভ করতে হবে। এ-মুখ আমি ইন্দ্রকে দেখাব কী করে!
–শেষ কথাটা বলেনি।
দীপ্তি হাসল। আমিও।
–লোকটাকে কাটিয়ে দে কিছু টাকা দিয়ে। আমরা অন্য গাড়ি ধরে নেব।
–ও ঝামেলা করবে না তো?
–করলে ভুতো আছে। আমার আর ঘণ্টাখানেক লাগবে।
হঠাৎ পুল্টুশ জেগে উঠল।
–এত দায়িত্ব নিতে যেও না। শেষে টানতে পারবে না। তুমি আলাভোলা লোক।
‘আলাভোলা’ শব্দটা শুনতে ভাল লাগল না। দীপ্তির সঙ্গে কথা শেষ করে পুল্টুশকে বললাম।
–আমি আলাভোলা নই। বরং তুমিই একটা কেলানে। সব সময় একটা গুটিয়ে-থাকা কেঁচো। আমি কোনও ডিসিশন নিলেই তোমার পিসিপনা শুরু হয়ে যায়!
কথাগুলো বলে ভুল করলাম। ড্রাইভার দেখল-শুনল আমি একা একা বকছি। আয়নার চোখ দিয়ে আমাকে দেখছে। আমি আন্তরিক হাসলাম।
–নিজেকে বকলাম। আমি মাঝেমধ্যেই নিজেকে বকি। কারণ আমার করা ভুলের কঙ্কালগুলো ইটিখিটি করে দাঁত দেখায়। তুমিও বড় হলে করবে। অথবা অন্যদের ভুল আর অন্যায় নিয়ে ভেবে জীবন বরবাদ করবে।
ও একটু বিভ্রান্ত চোখে আমাকে দেখে ঘাড় নাড়ল। একটু পরে হাসতেও পারল। এই সময়ের মধ্যে ছেলেটি আমাকে খোপে ফেলতে পেরেছে, ক্যাটিগরাইজ করে ফেলেছে। আমরা খাবার খেতে নামলাম তিস্তা পেরিয়ে।
মোমোর স্বাদ কমতে আরম্ভ করেছে। সমতলের মশলা মিশে গেছে খাবারে। পাইনের গন্ধ নেই, নেই দেবদারু। কিছু শাল লাগানো হয়েছে। একেবারেই কিশোর। মাঠে জড়ো হয়েছে। এবার ফুটবল খেলতে যাবে।
এরপর থেকে আমি দাজুর সঙ্গে বাংলাতেই কথা বলেছি। ও একটু সতর্ক হয়ে নেপালি-ঘেঁষা হিন্দিতে উত্তর দিয়েছে। সেই একই টুকটুকে মিষ্টি হাসি মুখে নিয়ে।
হোটেলে ফিরে দেখি পরিস্থিতি চমৎকার। ভুতো তাড়াহুড়োয় বাজে শেভ করেছে। নাকের নিচে একটা রক্তের পোঁটা ঝুলছে। স্নান করেছে, গুচ্ছের পারফিউম লাগিয়েছে, কিন্তু মদের গন্ধ বেরোচ্ছে দেদার। আমাকে দেখে খুব স্মার্টলি বলল, সব ও-কে বস। ড্রাইভারটাকে পটিয়ে নিয়েছি। এবার বেরোব। আমি উত্তরে ওকে চুতিয়া বললাম। দীপ্তি আর মিতলি হাসতে হাসতে বেরিয়ে এল লাগেজ নিয়ে। ভুতো দু-চারটে লাগেজ ঘাড়ে মাথায় নিয়ে নামতে লাগল। আমার কথায় ওর কোনও প্রতিক্রিয়া দেখলাম না।
আমরা শেষে বেরোলাম বারোটায়। সামনের সিটে মিতলি, পেছনে আমি আর ভুতো পাশাপাশি, কোণায় দীপ্তি। গাড়ি যখন সেবক পেরোচ্ছে, তখন তুমুল শব্দ করে ভুতো নাক ডাকতে লাগল। আমারও চোখের সামনে সব ঝাপসা। ঝাপসা মিতলি দু-কানে হেডফোন গুঁজে আমাকে দুটো ছিপি দিল। আমি কানে ঢুকিয়ে দিলাম। একটা আলগা ছিল। দেখলাম দীপ্তি লাগিয়ে দিল। ওর দু-কানেও দুটো ছিপি। এসব ঝাপসা হয়ে যেতে ভুতোর সঙ্গে আমিও ঘুমিয়ে পড়লাম।
জোড়থাং হয়ে গেজিং পৌঁছতে প্রায় সাত ঘণ্টা লাগল। এর মধ্যে বেশ কয়েকবার থামতে হয়েছে প্রধানত ভুতোকে হিসু করানোর জন্যে। সেই ফাঁকে মিতলি অনেক সেলফি তুলে নিয়েছে। তার মধ্যে একটায় হিসুরত ভুতো ফ্রেমে ঢুকে পড়েছিল। রাস্তায় আর মদ খায়নি। কিন্তু ভাঁড়ামো করেছে অনেক। আমাকে একবার চুমো খাবার চেষ্টা করেছিল।
এখন আমরা গেজিং-এর একটা পাহাড়খোঁড়া রেজর্টে আছি। বাইরে অনেক নিচে তাকালে দিনের বেলা দেখা যাবে গাড়ির রাস্তা চলে গেছে পেলিং হয়ে ইয়াকসাম। তবে এ-রাস্তায় বেশি গাড়ি যায় না। বাজারের পাশে অন্য রাস্তা ধরে যায়। তাই নিরিবিলি রাস্তার উল্টোদিকে শুধু পাহাড় আর পাহাড়। এখন রাত আটটায় শুধু চাকচাক অন্ধকার সেখানে।
আমার রুমের ব্যালকনিতে আমরা বসে ছিলাম। আমরা মানে মিতলি বাদে বাকি তিনজন। মিতলি এখানে ঢুকেই কয়েকটা ছেলেমেয়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে নিয়েছে। এখন ওদেরই সঙ্গে এই বিশাল রেজর্টের অন্য কোথাও আছে। ব্যাপারটা ভুতোর ভালো লাগেনি। আমার আর দীপ্তির চাপে মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে। এখন বিয়ার খেতে খেতে ঘুমিয়ে পড়েছে ভুতো। আমাদের মুখোমুখি, পাহাড়ি রাস্তার দিকে পেছন ফিরে ভুতো ঢুলছে। তেমন কনকনে ঠান্ডা নেই আজ। কিন্তু রাত হচ্ছে, আমাদের খাবার আসছে।
–তুমি আসলে কোথায় যাচ্ছিলে ইন্দ্রদা?- দীপ্তি ওর মোবাইল ফোনে ছবি তুলছিল। সেটা রেখে বলল।
–কোচবিহার যাব ভেবেছিলাম।
–ভেবেছিলে। যাচ্ছিলে না তো।
–কী করে যাব? তার আগেই তো আমায় একটা অন্য জায়গায় যেতে হবে। একটা পুরনো দিনের হাটে।
দীপ্তি কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। কিছু বলার আগেই বেয়ারা খাবার নিয়ে চলে এল। দীপ্তি মিতলিকে ফোন করতে লাগল আমার দিকে তাকিয়ে।
এখন আমার একটু একটু ক্লান্ত লাগছে। আমার পাশের খাটে ভুতো ঘুমিয়ে পড়েছে। অনেক কথা হল এর মধ্যে। ও-ই বলল। ছোটবেলার অন্য বন্ধুদের কথা। ওর ভবিষ্যৎ, ওদের ভবিষ্যতের কথা। আর এর মধ্যে গানের স্থায়ীর মত ‘তুই এবার একটা বিয়ে কর মাইরি’। তারপর আবার ছোটবেলা, ওদের ভবিষ্যৎ ইত্যাদি। শেষ দিকে খুব মাতাল হয়ে গিয়েছিল, এবং সেন্টিমেন্টাল। আমাকে জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করছিল। এই ব্যাপারটায় আমি খুব অস্বস্তিতে পড়ে যাই। আমার শরীরভাষা একটু গোটানো, আর ভুতোর উলটো। ইচ্ছে করলে সেই মুহূর্তেই ও জড়িয়ে ধরবে, তাতে ওর প্যান্ট খুলে গেলেও গ্রাহ্য করবে না। পড়ে গেলেও না। পড়ে গিয়ে ব্যথা পেলে বলবে, এসসালা, খুব লাগল রে!
এখন ভুতো নিশ্চই দুনিয়া কাঁপিয়ে নাক ডাকাচ্ছে। আমি তার অল্প আভাস পাচ্ছি। আমার দু-কানে ছিপি। ঘুম আসছে না। এখন আমার ক্লান্ত লাগছে।
পুল্টুশ একটা শ্বাস ছাড়ল।
–এসব তুমি পারবে না। এবার ফিরে চলো।
–হ্যাঁ, খুব ভার-ভার লাগছে।
–সংসার না করলে এমন হয়।
–এইখানে এসে আমি অণুর সঙ্গে ছিলাম। কত বছর আগে। তখন এই হোটেল হয়নি।
–কেন ফালতু গল্প বানিয়ে যাও বলো তো? আমার ওপর খুব চাপ পড়ে যায়। কোনটা সত্যি সুতো আর কোনটা তোমার নিজের বানানো, বুঝতে পারি না।
–অণুর আর আমার এখানে আসার গল্প ফালতু?
–গল্প কেমন আমি জানি না। কিন্তু এটা কখনও হয়নি। কালচে সবুজ সুতো। এবার ফেলে দেব। আর কিচ্ছু মনে পড়বে না।
–থাক না পুল্টুশ। কদিনের মধ্যেই তো আরও কালচে সবুজ সুতো পেয়ে যাবে। একবারে ফেলে দিও।
আমাকে বিশ্বাস করতেই হবে যে পুল্টুশ ঠিক বলছে। আমি কখনও অণুর সঙ্গে গেজিং-এ আসিনি। যে-অণুর সঙ্গে তার বিয়ের পরে দেখা করতে গিয়েছিলাম, সে কোনওদিন উত্তরবঙ্গে আসেনি। সে ছিল কড়েয়া রোডের একটা মেয়ে। তার নামও অণু ছিল না। সে অনেক আগে ছোটবেলায় আমাদের খেলা শেষ হয়ে যাওয়ার পরে আমার খুব কাছে এসে বলেছিল, আমরা কাল এখান থেকে চলে যাচ্ছি।
আমার তখন দশ-এগারো বছর বয়েস, ওরও তাই। পাশাপাশি বাড়ি ছিল আমাদের, ওদের একতলা ছোট বাড়ির বাগানে আমরা খেলছিলাম। দুপুরে অল্প বৃষ্টি হওয়ায় অনেকে খেলতে আসেনি। আমরা সব এলোমেলো দুজনের খেলা খেলছিলাম। হুট করে সন্ধে হয়ে এল। তখন আশা মালহোত্রা কথাটা বলেছিল। আমি বললাম, কোথায় যাবি?
–জয়পুর।
আমাদের ছোটবেলায় জয়পুর ছিল একটা মরুভূমি আর কেল্লা আর জহরব্রত আর সব মিলিয়ে রাজকাহিনি।
–বাঃ! তাহলে তো খুব মজা হবে। উটের পিঠে চড়ে ঘুরবি।
আশা ভাঙা বাংলা বলত। কেমন করে যেন বলল, আমাকে ভুলে যাবি?
বাগানে অল্প আলো জ্বলছিল। রাস্তায় কেউ ছিল না। একটু পরেই ওর বা আমার মা ডাকবে। সময় বুঝেই যেন একটা ঠান্ডা হাওয়া বয়ে গেল। আর একটা অদ্ভুত কাণ্ড করল আশা। আমার গালে একটা চুমো খেল। নিচু গলায় বলল, দেখবি, আর ভুলতে পারবি না।
ও দৌড়ে বাড়ির মধ্যে ঢুকে গিয়েছিল। পরদিন থেকে ওদের আর দেখিনি। ওরা নাকি খুব ভোরে বেরিয়ে গিয়েছিল। আমি ওকে স্বপ্ন দেখেছিলাম। অনেক দিন।
–এই ঘটনাটা আমার মনে নেই। তখন তুমি আমার কাছে আসোনি।
–এজন্যেই আমি নর্থ বেঙ্গলে ঘুরে বেড়াই পুল্টুশ। স্মৃতির হুড়ো খেয়ে আমি সন্তোষ পালের হাত ধরে স্মৃতির গ্রামে যেতে চেয়েছিলাম। পারলাম না। আমার দেরি হয়ে গেল।
একটু সময় নিল পুল্টুশ। আমাকে আক্রমণ করার আগে ও এভাবেই সময় নেয়। প্রথমে চেষ্টা করে কথাগুলো গুছিয়ে নিতে। আমার তাতে কিছুই এসে যায় না। আমি গায়ের কম্বল জড়িয়ে দরজা খুলে ব্যালকনিতে এলাম। কান থেকে ছিপি খুললাম। ভুতোর নাক ডাকছে, মুখ দিয়েও নানান আওয়াজ বেরোচ্ছে। দরজাটা বাইরে থেকে টেনে আমি দূরের পাথুরে অন্ধকারের মুখোমুখি হলাম। ওখান থেকে ঠান্ডা হাওয়ার ঝাঁক আসছে রাতচর পতঙ্গের মতো। কম্বলে মাথা মুখ ঢেকেও আটকানো যাচ্ছে না।
–এভাবে থাকলে নিউমোনিয়া হয়ে যাবে।– পুল্টুশ বিড়বিড় করে উঠল।
–শাট আপ। আমার ব্যাপারে কিছু বলার থাকলে বলো।
–তুমি আসলে নিজেকে নিয়ে এত গল্প বানিয়ে বসে আছ যে আমার কোনও কথাই তোমার ঠিক মনে হবে না। তুমি ওসব গল্পে এর মধ্যে বিশ্বাসও করতে শুরু করেছ।
–তুমি আমাকে কী করতে বলো? আমি সন্তোষ পালের সঙ্গে যোগাযোগ করতে চাইছি। তুমি কি চাইছ আমাকে নিয়ে? তোমার স্টিংকিং লোয়ার মিডল ক্লাস মরালিস্ট ছত্রাকের মতো মন কী চায়?- ঠান্ডায় আমি অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছিলাম, এমনকি আমার ভালো লাগছিল।
–এই ফ্যামিলিটার সঙ্গেই থাকো। এরা তোমাকে মাঝবয়েসি এক মহিলা জুটিয়ে দিতে পারবে। সন্তোষ পালটাল করতে যেও না। ওতে বিপদ হবে।
–ইডিয়েট! সন্তোষ পাল কোনও ক্রিয়াপদ নয়। তাছাড়া পাল-এর সঙ্গে টাল অ্যাড করে তুমি একটা রহস্যময় জার্নিকে তাচ্ছিল্য করার চেষ্টা করছ। চলে যাও! অভন্ট!
খুক খুক করে হাসল পুল্টুশ।
–তাহলে যা ইচ্ছে করো। কিন্তু একটা কথা আবার বলছি। ভুল সুতো বানিও না। তোমার গল্পের সুতোগুলো আমি সারাতে পারছি না। এর পর থেকে তোমার মেমরির কন্টিনিউইটি রাখা শক্ত হয়ে যাবে। সব গুলিয়ে যাবে। গুড মর্নিং।
পুল্টুশ সরে গেল। গুড মর্নিং কেন বলল আমি জানি না। গেজিং পাহাড়ে তখন অনেক রাত। আমি গুহামানবের মতো হেঁটে ঘরে ফিরে এলাম।
ঘরে মেঘ ডাকছে তখন। ভুতোর আধখানা শরীর মাথাসহ মেঝের দিকে। আমি গ্রাহ্য করলাম না। কানে ছিপি গুঁজে টয়লেটে চলে গেলাম।
ফিরে এসে দেখি ভুতোর মাথা মেঝেতে পড়ে। বাকি শরীরটা খাটে। এর ফলে ওর নাকে একটা অন্য সুর বাজছে। আমি সাহায্য না করে দেখতে লাগলাম ব্যাপারটা কোন দিক নেয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই হড়বড় করে জেগে উঠল ভুতো। আমি চোখ বন্ধ করে রইলাম। বোঝা যাচ্ছিল এই পড়া-ওঠায় ও অভ্যস্ত। বেশ কয়েকবার সসালা বলে আবার শুয়ে পড়ল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই নাক ডাকতে আরম্ভ করল। কোনও ছিপি দিয়ে ওই শব্দ আটকানো যাবে না। কারণ শব্দের স্মৃতি রয়ে গেছে। কানকে চোখ মারছে স্মৃতিগত শব্দ।
ভুতোর ঘুম কখন ভাঙল আমি জানি না। এক সময় অবসাদে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। উঠে দেখি ভুতো হাফপ্যান্ট পরে টেরাসে বসে আছে। বেশ ভালো মুড।
–গুড মর্নিং!
–চুপ কর! কাল সারাটা রাত ঘুমোতে দিসনি।– আমি জ্যাকেটের মধ্যে ঢুকে যেতে যেতে দেখলাম ভুতো কাল রাতের হালকা টি-শার্টটা পরেই বসে আছে।
–এটা আমার একটা প্রবলেম। ধীরে ধীরে সয়ে যায়। আজ রাতে দেখবি আর অসুবিধে হচ্ছে না।
–আমি এবার যাই, ভুতো?
ভুতো বুঝল আমি যাওয়া বলে কী বোঝাতে চাইছি। একটু পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে রইল। ওকে খুব নিঃসঙ্গ শিশুর মতো দেখাচ্ছিল।
–কী যে ঘুরিস একা একা। এখানে তো ভালই ছিলি। বেশ একসঙ্গে…
আমি তাকিয়ে রইলাম। ভুতোর গলা একটু যেন দূর থেকে ভেসে এল।
–কোথায় যাবি?
–এক ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা করতে হবে। সন্তোষ পাল। শিলিগুড়িতে থাকেন।
–ফোন করে বল বন্ধুদের সঙ্গে আছিস, দুদিন পরে যাবি।
–সেটা সম্ভব নয়। উনি আমায় খুঁজে নেবেন ঠিক। কিন্তু আমাকে শিলিগুড়ি অঞ্চলে থাকতে হবে।
দীপ্তি এসে বসল। অদ্ভুতভাবে সেই মুহূর্তেই একজন হোটেলকর্মী এসে ড্রাগন-আঁকা ট্রেতে চা নিয়ে এল। আমরা যে-যার মতো করে হাসলাম। আমি জ্যাকেটের মধ্যে দিয়ে কুঁই কুঁই করে হাসলাম, দীপ্তি অপরূপ কান-মাথা ঢাকা হাসি হাসল। কিন্তু ভুতো একটা হাই-মেশানো হাসি হেসে আবার দূরে চলে গেল।
–এর কী হয়েছে?- ভুতোকে দেখিয়ে দীপ্তি জিগ্যেস করল।
–ইন্দ্র চলে যাবে বলছে।
ভুতো আমাদের চা দিতে দিতে বলল। আমার কাপে চিনি মেশাতে দেখে আমি বীরের মতো জ্যাকেট থেকে বের হয়ে কাপটা নিয়ে নিলাম। বাইরে এখন আর অত ঠান্ডা নেই। রোদ উঠেছে।
–কোথায় যাবে ইন্দ্রদা?– দীপ্তি জিগ্যেস করল।
–এক ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা করার ছিল। এক জায়গায় যাবার ছিল। তোদের বলেছিলাম তো, সেই যে বাস মিস করলাম…
–সে খুব কেউকেটা লোক, বুঝলে দীপ্তি, তার কোনও ফোন নম্বর নেই। সে তার দরকারমতো লোকজনকে খুঁজে নেয়। যাবি তো চলে যা না। এত ভাটানোর কী আছে?
ভুতো বড্ড অভিমানী। দীপ্তি আমার দিকে তাকাল। আমি নিচু গলায় বললাম।
–উনি আমাকে পুরনো কালের এক রাতের বাজারে নিয়ে যাবেন। আমি জানি কথাটা অদ্ভুত শোনাবে। কিন্তু এখন আমার আর কিছু করার নেই। আমি শিলিগুড়িতে আসলে এসেছিলাম ওই হাটে যাবার জন্যেই। একবার বাস মিস করেছি। সন্তোষ পাল নিশ্চই খুব আহত হয়েছেন।
গেজিং পাহাড়ের রোদ পড়েছে ওদের দুজনের মুখ। আমার মুখে ছায়া। দীপ্তি ভুতোর দিকে খুব মায়াভরা চোখে তাকাল। ভুতো চোখ সরিয়ে নিল। চাপা গলায় ‘একটু আসছি’ বলে ভেতরে চলে গেল।
আবার আগামী সংখ্যায়