শশী তারুর
মূল নিবন্ধটি প্রোজেক্ট সিন্ডিকেট-এ প্রকাশিত। গুরুত্ব বিবেচনা করে আমরা বাংলায় তর্জমা করে প্রকাশ করলাম। -- স্টেশন মাস্টার
এই প্রশ্নটা আজকাল ঘুরেফিরে শুনতে পাই। কাশ্মিরের দমনপীড়ন, উগ্র হিন্দুত্ববাদের রমরমা, নতুন আইনের বিরুদ্ধে ছড়িয়ে-পড়া প্রতিবাদের ঢেউ, মহিলাদের ওপর অত্যাচার, আরও অনেক মন্দ নিয়ে আজ পশ্চিমের সংবাদমাধ্যমে আলোচনা। যে ভারতকে বিশ্ব একদিন শ্রদ্ধার চোখে দেখত— পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা দ্রুতহারে বাড়তে থাকা মুক্ত বাজার আর উদার গণতন্ত্রের ভারত— সেই ভারত যেন ক্রমশ হিংসা, অসহিষ্ণুতা আর সঙ্কীর্ণ স্বৈরাচারকে জায়গা ছেড়ে দিচ্ছে।
এই খবরগুলো মিথ্যে নয়, আর যে ছবি তাঁরা আকছেন তা-ও মনোরম নয়। তবু যাঁরা ভারতের প্রকৃত হিতৈষী, হতোদ্যম হওয়া তাঁদের উচিত নয়। গণতান্ত্রিক বিরোধীরা লড়াই করছেন, তাঁদের বুকে ভরসা যোগাচ্ছে দেশের তরুণদের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ। কোনও রাজনৈতিক দলের হয়ে নয়, এই তরুণদের যুদ্ধঘোষণা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও তাঁর দল ভারতীয় জনতা পার্টির সরকারের বাড়াবাড়ির বিরুদ্ধে। আমাদের দেশে গণতন্ত্রের শিকড় গভীরে প্রোথিত, এবং দেশের বহু স্বাধীন প্রতিষ্ঠান ও রাজনীতি-সচেতন মানুষের লড়াই-ব্যতিরেকে তাকে উপড়ে ফেলা সম্ভব হবে না।
ভারতের বর্তমান দুর্দশা বিগত তিন দশকে দেশীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে কয়েকটি প্রবণতার ক্রমবিকাশের শীর্ষবিন্দু। আটটি চোখে পড়ার মত প্রবণতার কথা বলব।
প্রথম, গণতন্ত্রের গভীরীকরণের সামাজিক ফলশ্রুতি। ১৯৪৭-এ অনেক পর্যবেক্ষকের কাছে যা ছিল ক্ষণভঙ্গুর প্রতিস্থাপনের সামিল, সেই গণতন্ত্র আজ অনেক গভীরে প্রোথিত, অতীতের অবহেলিত জাতি ও সম্প্রদায়ের ক্ষমতায়নের মাধ্যম। ১৯৮৯ সালে সরকারদ্বারা মণ্ডল কমিশনের “সংরক্ষণ”-এর প্রস্তাবগ্রহণের সুবাদে সরকারি চাকরিক্ষেত্রে ও বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদিতে “অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণি”-র (অনগ্রসর শ্রেণি হিসাবে একদা সমাজচ্যূত দলিত ও ভারতের আদিম বাসিন্দা উপজাতীয় মানুষেরা আগে থেকেই চিহ্নিত ছিলেন) মানুষেরা সুযোগ পেয়ে এক ক্ষমতাবান রাজনৈতিক শক্তি হিসাবে প্রতিপন্ন হলেন। এই জনগোষ্ঠীর— যার অন্তর্গত মানুষদের মধ্যে রইলেন কিছু স্বল্পশিক্ষিত, হিন্দিভাষী এবং ছোট শহরের মানুষও— তিন দশকের রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন শহুরে, ইংরাজিভাষী অভিজাতদের— যারা ছিলেন ভারতের উদারবাদী ধর্মনিরপেক্ষ শাসনপ্রণালীর উদ্গাতা— কর্তৃত্ব অনেকাংশে খর্ব করল। ক্ষমতার অলিন্দে এলেন অন্যতর মানসিকতার মানুষ।
দ্বিতীয়, সাংস্কৃতিক বিশ্বায়নের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া। তুরস্ক ও অ্যামেরিকার মত ভারতের অসাম্প্রদায়িক বিশ্বনাগরিক পশ্চিমী জীবনচর্যায় অভ্যস্ত এলিটদের মধ্যেও দেখা যেতে লাগল ক্রমবর্ধমান অসন্তোষ। ছায়াছবি ও টেলিভিশনের প্রভাবে সামাজিক ও যৌনভাবনার আমূল বদল ভারতের সামাজিক রক্ষণশীলতাকে বিস্রস্ত করে দিল। জিনস ও অন্যান্য অভারতীয় পোষাকে মহিলাদের কর্মক্ষেত্রে যাওয়া, সামাজিক রীতিনীতির পরোয়া না করে পশ্চিমের কাজের সময়ের সঙ্গে মিলিয়ে কল সেন্টারের শিফট শেষে রাত করে বাড়ি ফেরা, এসব দেখে ঐতিহ্যবাদীরা ক্ষেপে উঠল।
তৃতীয়, রাজনীতির তথাকথিত অভ্যন্তরের মানুষদের বিরুদ্ধে যেন বিদ্রোহের সূচনা হল। “লুটিয়েনের দিল্লি”— যা কিনা রাজধানীর প্রাণকেন্দ্রস্থিত সরকারি ভূমিখণ্ডের ডাকনাম— তার উচ্চপদের ক্ষমতাবান বাসিন্দাদের দুর্নীতিগ্রস্ত, আত্মসন্তুষ্ট, অকর্মণ্য আর পরিবর্তনবিরোধী বলে দেখতে লাগল তাঁদের প্রতিদ্বন্দ্বীরা। একুশ শতকের প্রথম দশক জুড়ে এঁরা যা কিছুর প্রতিভূ্রূপে উপনীত হয়েছিলেন, অর্থাৎ উদারবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, রাজনৈতিক “ইনসাইডার ট্রেডিং” বা অন্তরালের কেনাবেচা, আর দরকারের তুলনায় দুর্বল শাসন পরিচালনা, এ সবেরই তুমুল প্রত্যাখ্যান। গান্ধিবাদী আন্না হাজারের ২০১১ সালের প্রতিবাদী ধরনায় জনতার এই মনোভাবই প্রকাশ পায়। নীতিভ্রষ্ট শাসকশ্রেণিকে সরিয়ে দেশকে সাফ করার প্রতিবাদী চাহিদা ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদির বিজয়ের অন্যতম উপাদান।
চতুর্থ, বিশ্ববাজারের বাস্তবতাকে স্বীকার করে ১৯৯১ থেকে ভারতের অর্থনীতি রাষ্ট্রবাদের থেকে উদারবাদের দিকে যাত্রা শুরু করলে ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের ক্ষমতা বেড়ে যায়, এবং তাঁদের ক্ষমতা ও সম্পদবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা তাঁদের ব্যবসাকে আরও বাড়ানোর পথে যতটুকু বাধাবিপত্তি সব উৎখাত করার উদ্দেশ্যে তাঁদের অনুকূল একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা গঠনের জন্য অর্থব্যয় করতে শুরু করেন। পুঁজিবাদী নব্যধনীদের অকাতর অর্থব্যয়ে লাভবান হন মোদি, হয় বিজেপি।
পঞ্চম, গত শতকের শেষ সিকিভাগ সময় জুড়ে ধর্ম নিয়ে দুনিয়াজোড়া বাড়াবাড়ির ছায়া ভারতে হিন্দুত্ববাদের উত্থানের মধ্যে দিয়ে দেখতে পাওয়া গেল। এর কিছুটা সৌদি-অর্থে নির্মিত দীপ্তিমান মসজিদে ওয়াহাবি/সালাফি ধর্মতত্ত্বের প্রচারের ফল। ভারতীয় মুসলমানেরাও নিখিল বিশ্ব ইসলামি উম্মার সঙ্গে সচেতনভাবে নিজেদের অভিন্ন প্রমাণ করতে গিয়ে ইসলামকে এমনভাবে পুনর্সংজ্ঞায়িত করতে শুরু করলেন যে হিন্দুদের থেকে তাঁরা আরও বেশ কিছুটা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লেন।
এর সমান্তরালে টেলিভিশনে রামায়ণ আর মহাভারতের জনপ্রিয়তা হিন্দুচেতনাকে আরও পুষ্ট করল। সুপ্রিম কোর্টের বিনির্দেশ অগ্রাহ্য করে তালাকপ্রাপ্তা মুসলিম মহিলার ভরণপোষণ বন্ধ করার ফলে “মুসলিম তোষণ” নিয়ে বাড়তে থাকা উদ্বেগ, আর ষোড়শ শতকের একটি মসজিদ, বাবরি মসজিদকে— যার প্রতিষ্ঠাস্থলটিকে হিন্দুরা তাঁদের অন্যতম পবিত্রতম তীর্থস্থান রামের জন্মভূমি বলে বিশ্বাস করেন— মুছে ফেলার উদ্দেশ্যে রচিত বিজেপি-পরিচালিত উদ্যোগের জনপ্রিয়তা এই আগুনে আরও ঘৃতাহুতি দিল। এই সমস্ত কারণ উগ্র হিন্দুহিতৈষিতার হাফপ্যান্ট-পরিহিত তত্ত্বসেনা রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ বা আরএসএসের প্রসারে সাহায্য করল। আরএসএস বলল একটা সোজাসাপ্টা ভাবাদর্শের কথা, নিয়ে এল হিন্দু অসন্তোষকে সংগঠিত করার প্রয়োজনীয় সাংগঠনিক শক্তি। এই আরএসএসের লেজুড় হয়েই আশির দশকের মধ্যভাগ থেকে বিজেপির বিকাশের সূত্রপাত।
ষষ্ঠ, হিন্দুচেতনার এই উত্থান এমন একটা সময়ে ঘটল যখন ইসলামি পাকিস্তান পূর্ণোদ্যমে এ-দেশে নানান প্ররোচনামূলক ও সন্ত্রাসের কাজে তাদের অর্থব্যয় করছে। কাশ্মিরে জঙ্গিবাদকে তাদের দেওয়া সমর্থনে সরাসরি সামরিক আগ্রাসনের পথ খুলে গেল, যার একটি পরিণতি ১৯৯৯ সালে কার্গিলের স্বল্পমেয়াদি কিন্তু রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। পাকিস্তানের প্রতি বাড়তে থাকা শত্রুতার মনোভাব, এবং বারংবার শান্তি আলোচনার বিফলতায় হিন্দুরা মনে করলেন আক্রমণের স্বীকার হচ্ছেন তাঁরা।
সপ্তম, বিশ্বের প্রমুখ দেশগুলির মধ্যে ভারত সর্বাপেক্ষা তরুণ। এ-দেশের জনসংখ্যার শতকরা পঁয়ষট্টি ভাগের বয়স পঁয়ত্রিশের কম। ভারতের তরুণ পরিবর্তন ও অগ্রগতির জন্য অধীর, পুরনো ঘরানার রাজনীতি দেখে ক্লান্ত (বিশেষ করে ১৯৮৯ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত জোট সরকারগুলির অগোছালো হাল এবং তাদের রাজনৈতিক দোদুল্যমানতা দেখে)। তাঁরা চান দেশ হোক আত্মবিশ্বাসী, ইতিবাচক ও দৃঢ়, বিশ্বের সঙ্গে টক্কর নিতে প্রস্তুত। মোদির আত্মবিশ্বাসী আচরণে তাঁরা এর উত্তর পেলেন।
শেষত, টুইটার, ফেসবুক ও হোয়াটস্যাপের মত সামাজিক মাধ্যমগুলি এখন সর্বত্রগামী। এই মাধ্যমগুলি একদিকে প্রভাবক, এবং অন্যদিকে অকারণ ঘৃণা ও সন্দেহবিস্তারের মন্থক। যে ঘৃণার কথা আগে উচ্চারণ করতে বাধত, মানুষের জঘন্যতম ধারণাকেও মান্যতা দিয়ে সামাজিক মাধ্যম এই জড়তা কাটিয়ে উঠতে একপ্রকার উৎসাহ দিচ্ছে। হঠাত করে ধর্মান্ধতা হয়ে উঠছে সম্মানের বিষয়, মুসলিমবিদ্বেষ— অতীতে যা ছিল সভ্যতার চাদরে ঢাকা— হয়ে উঠছে নির্বাচনী সম্পদ।
এই সমস্ত কিছু চরমে পৌঁছল, যখন সময় নিজের বার্তাবাহক হিসাবে বেছে নিল মোদিকে। মোদি— বাগ্মিতায় সুদক্ষ, হিন্দুত্বের পরিচয়ে যিনি অপ্রতিদ্বন্দ্বী, গুজরাটের দক্ষ মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে বাজারজাত হয়েছে যাঁর ভাবমূর্তি। আর তাঁর ডান হাত অমিত শাহ, আরও এক দক্ষ প্রশাসক যিনি সুনিশ্চিত করবেন দেশের উন্নয়ন। মোদির বার্তা গ্রহণ করার জন্য ক্ষেত্র প্রস্তুত ছিলই, আর এরই ফলস্বরূপ ভারতের জনগণ বিজেপি সরকারকে বরণ করল পর পর দু-বার, ২০১৪ আর ২০১৯-এ। এরই ফল আমরা ভোগ করছি। এই আটটি কারণের মধ্যেই এই পরিণতির বীজ নিহিত।