সুজন ভট্টাচার্যের ‘কালাপাহাড়’: একটি আলোচনা

সুশান্ত সাহা

বাংলার মধ্যযুগের ইতিহাসে কালাপাহাড় এক চরম ঘৃণিত নাম। জগন্নাথ মন্দির ধ্বংসকারী কালাপাহাড়-কে নিয়ে আলোড়িত হবার কোনও কারণ থাকার কথা নয়। কিন্তু সুজন ভট্টাচার্য আলোড়িত হয়েছেন। ইতিহাসের নানান বিস্মৃত পৃষ্ঠায় উঁকি মেরে তুলে এনেছেন নানান অজানা তথ্য। আর সেই তথ্যকে ভিত্তি করে গড়ে তুলেছেন উপন্যাসের শরীর। নিশ্চিতভাবেই বলা যায় পাঠককেও আলোড়িত হতে বাধ্য করবে কালাপাহাড় উপন্যাস।

নাম থেকে মনে হওয়া স্বাভাবিক এই উপন্যাস কালাপাহাড়ের জীবনী। কিন্তু সেই প্রাথমিক ধারণা খানিক পরেই  ভেঙে পড়বে কাহিনির হাত ধরে। কালাপাহাড় উপন্যাস কালাপাহাড়ের আখ্যানেই থেমে যায়নি। আবার তাকে মাঝপথে ছেড়েও যায়নি। উপন্যাসের সবথেকে বড় বৈশিষ্ট্য হল ব্যক্তিকে ছাপিয়ে গিয়ে তদানীন্তন সময়ের অনুসন্ধান করা। তাই এই উপন্যাস নিছক কালাপাহাড়ের আখ্যান নয়, বরং একটা সময়ের জীবন্ত দলিল। যা কিছু হচ্ছে সবটাই মিশে যাচ্ছে কালাপাহাড় নামক মানুষটার জীবনের স্রোতে। কিন্তু সেই ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে কত জটিলতা! ষোড়শ শতাব্দীর ঘটনাক্রমকে বড় পরিচিত মনে হয় বর্তমান ভারতবর্ষের মাটিতে দাঁড়িয়ে। ইতিহাস হয়তো এভাবেই পুনরাবৃত্ত হয়। তাই কালাপাহাড় ইতিহাস হয়েও হয়ে ওঠে বর্তমান।

উপন্যাসের আখ্যান শুধু গৌড় নয় ঘুরে বেড়িয়েছে বিষ্ণুপুর থেকে কামতাপুর, খড়দহ থেকে ফতেপুর সিক্রি। রাজনৈতিক আখ্যানকে ছুঁয়ে বারবার জেগে উঠেছে এক প্রবল আর্তি— আইডেনটিটির হাহাকার। চিলা রায় আর হাম্বীর মল্ল সেখানে একাকার হয়ে যান। আর ভিন্ন দিক থেকে এসে মুঘল বাদশাহ আকবর আর কালাপাহাড়ও মিশে যায় সেই সন্ধান যাত্রায়। পাঠক-ও হয়তো নিজেকে খুঁজে পাবেন সেই মিছিলে।

ইতিহাস-নির্ভর উপন্যাসে বাস্তব ঐতিহাসিক চরিত্র তো থাকবেই। এবং তাদের প্রায় সকলেরই অজানা, আধজানা অবয়ব স্পষ্ট আকারে ফুটে উঠেছে। সামান্য উপস্থিতিতেই ভাসিয়ে নিয়ে যান বীরচন্দ্র গোস্বামী কিংবা চিলা রায়। সুলতান দাউদ খানকে যেন মনে হয় বর্তমান রাজনীতির মঞ্চে দলবদল করা কোনও নেতা। কোনও প্রসঙ্গই অপ্রয়োজনীয় মনে হয়নি, এমনকি বাউলিয়া আখড়া-ও। কারণ কালাপাহাড়ের ভবিতব্যে তারা প্রত্যেকে নিজস্ব ভূমিকা পালন করেছে।

পাশাপাশি অসংখ্য কাল্পনিক চরিত্র ঘটনার গতিকে ঠেলে নিয়ে গেছে সামনে। প্রতিটি কাল্পনিক চরিত্রই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে কাহিনির বিন্যাসে। রহিমদাস বাউলিয়াই হোক আর কঙ্কাবতী কিংবা রূপমতী কালাপাহাড়ের জীবনকে আন্দোলিত করে গেছে। যার ধাক্কা কালাপাহাড়কে কখনও বিবশ করেছে, কখনও চালিয়ে নিয়ে গেছে সামনে। ফলে একটিও কাল্পনিক চরিত্রকে অপ্রাসঙ্গিক মনে হয় না। লেখকের দক্ষতার পরিচয়কে তাই সাবাশি জানাতেই হয়।

উপন্যাসের সবথেকে বড় চমক হল ভাষা। প্রেক্ষাপট বদলের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যাচ্ছে ভাষা। শুধু চরিত্রদের সংলাপে নয়, কাহিনির ভাষাতেও। তাই পাঠক বড় স্বচ্ছন্দে টের পেয়ে যান ফতেপুর সিক্রি আর কোচবিহারের জল-হাওয়ার পার্থক্য। এমন সচেতন পরিবর্তনশীল ভাষারীতি খুব একটা দেখা যায় না। এই পরীক্ষা উপন্যাসকে অনেকটাই এগিয়ে দিয়েছে। লেখকের কথন অনেকটাই গল্প বলার ধাঁচের। প্রয়োজনমত কথনের গতি ওঠানামা করেছে। ফলে ৬০০ পৃষ্ঠার এই বৃহৎ আখ্যান কখনওই একঘেয়ে হয়ে ওঠে না।

ঐতিহাসিক উপন্যাস বলতে সাধারণত আমরা যা বুঝি কালাপাহাড় তা নয়। কালাপাহাড় আসলে ষোড়শ শতাব্দীর শেষভাগের এক নান্দনিক জীবনপট, যা আজকের সমাজের সঙ্গে অন্তর্লীন হয়ে আছে।

উপন্যাস কালাপাহাড়
সুজন ভট্টাচার্য
পালক পাবলিশার্স

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4661 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...