অদিতি বসু রায়
লেখক কবি, গদ্যকার ও সাংবাদিক।
বসন্তে আমার কোনও নস্ট্যালজিয়া নেই। দোলের দিন, সোনাঝুড়িতে আমি জীবনে রং খেলতে যাব না এবং জেনে রাখা দরকার, আমি হেমন্তের লোক। বছরভর আমি শীতকাল মনে রেখেই কাজল পরি! যদিও নভেম্বরে যে কটা প্রেম হয়েছিল— সব ছেড়ে গেছে। তবু আমি বরাবর হেমন্তের মানুষ!
বসন্ত বলতে সবাই যাকে চেনে, তার সঙ্গে ভাব হয়নি তবু এক গোপন ফাল্গুন প্রায়ই রাত ১১টা ৪০এ উপস্থিত হয় এ বাড়িতে। স্ট্রিট-লাইট ছাড়া সব আলো তখন ঘুমিয়ে— আমাদের ড্রইং-রুমে আলো জ্বলে ওঠে। এই আলোর নাম রাখি, পিচকিরি। কাশ্মিরী গালিচা পাতি পাথরের মেঝেতে। আবির বলে ডাকি একে। কতবার এখানে আমরা জড়ো করেছি জ্যোৎস্না— চাঁদ, এগারোটা চল্লিশে এইসব রাতে একবার উঁকি দেবেই, পূর্ণিমা থাকুক বা নাই থাকুক! রাত বারোটা বাজতে কুড়ি মিনিট আগের এই বসন্তকালে, চাঁদ লাগে চাঁদের গায়ে। ভুবনডাঙ্গা নামের চাদর পেতে বসি জানলার ধারে। খুলে যায় আসন্ন চৈত্রের মানচিত্র। বাতাসে ভেসে ওঠে রেণু রেণু সুখের মতো রং। অনেকদিন পর, আদরের ইচ্ছেগুলো আড়ামোড়া ভেঙে উঠে বসে, আমার পাশে। দূরে ফেলে আসা চড়কের বাজনা, বাজতে থাকে, আমাদের দরজায়-জানলায়! কারা যেন ফাগ ওড়াতে ওড়াতে এসে বসে আমার সঙ্গে। ওমনি— ভুলে যাই আমি আসলে হেমন্তের মেয়ে, ভুলে যাই বসন্তের সঙ্গে বহুদিন আমার মুখ-দেখাদেখি বন্ধ, ভুলে যাই বসন্ত আমার আদি শত্রুর ডাকনাম— আমার ডানারা খুলে যায় এই অনন্য ও পুরনো ম্যাজিকে। এই সময়, এই মধ্যরাতের সামান্য আগে, একটা নিরালা মফঃস্বল— একটা ছিপছিপে ইছামতী— একটা অসুখের দোল কোরাসে রবীন্দ্রনাথের গান গেয়ে ওঠে, জানো? মেমরি লেন থেকে একটা রাস্তা সোজা ঢুকে পড়ে ঘরে। সেখানে প্রিয় ছেলেবেলা রং গুলছে দাদার হাত ধরে। সেখানে জ্বরের ঘোরে শুয়ে থাকে ছোট্ট মেয়ে। সেখানে মায়ের ইস্কুল ছুটিতে আত্মহারা দোল ছুট্টে মাঠে নামে খেলনা বন্দুক হাতে। নদীর ধারের পথে গোলা রং ছড়িয়ে দেয় দস্যিরা। নদীর প্রসঙ্গে মনে পড়ে যায়, আপাতত নৌকার দিন শেষ। এখন ইছামতীর সেতু দিয়ে ওপারে যাতায়াত অনায়াস খুব। সেই সেতুর অপর পারে, পীযূষকান্তির স্বর বাজে নিয়মিত। সে গানের সুর ভাসে— জানলার পাশে। ঘুমের রাত কাছে আসে। গান অসমাপ্ত তখনও— বসন্তে আমার কোনও পাওয়াই শেষ হয় না তবুও তুমি আসো।
‘আবির’-এ বসে রেওয়াজ করো, মাড়োয়া-বেহাগ বেজে ওঠে ঘরে। তোমার মাথা থেকে নেমে যাওয়া ‘দুঃখ’ নামের মুকুট আমার পায়ের কাছে এসে পড়ে থাকে, আনমনে খনিকক্ষণ। তোমার কণ্ঠ অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত থেকে কবীর সুমন হয়ে পরিক্রমা জারি রাখে আর আমি শুনতে থাকি গ্রীষ্মের প্রিলিউড।
সুতরাং, বসন্ত আসলে এক অন্যমনস্ক গানের ইস্কুল। তোমাকে ছাড়া তার রূপ খোলে না কখনও। বসন্তের সঙ্গে আমার দেখাও হয় ইতস্তত! সে তখন নীলচে জিনস আর পাপড়ি-ছড়ানো টি-শার্ট। গাড়ি ব্যাক করে একমনে। রাত এগারোটা চল্লিশে— আমার তাকে মনে পড়ে। এখনও দোলের গল্পে, বসন্ত, আজীবন মেন ক্যারেকটার। ভালবাসার গল্পেও। বসন্ত ছাড়া এমন বিরক্ত আমাকে কেউ করেনি— কেউ তুমুল ডাকেনি ডাক নামে— শোনায়নি বউ, মৃদুল দাশগুপ্ত এবং পরাগ সংযোগের ইতিহাস।
দুঃখের বিষয়টা হল, প্রতিটি বসন্তের শীর্ষে একটি সমাপ্ত বইমেলার কিস্যা থাকে। শীতের হুইশেল বন্ধ করে দেয় সে। বন্ধ করে সোয়েটারের আচ্ছন্ন আরাম। রাত এগারোটা চল্লিশে যখন আমি একা জেগে, কফি না খেয়ে চুমুর জন্যে মনকেমন শুরু হয়— বুঝতে পারি সন্তর্পণে লগ-ইন করার মুহূর্ত উপস্থিত। বুঝতে পারি ইউজার নেম-এর সঙ্গে পাসওয়ার্ড মিলে গেছে— বুঝতে পারি, এবার আর রেহাই নেই— এবার সে আমাকে প্রেম থেকে, স্নান থেকে, আগুন থেকে, শীত থেকে, আলস্য থেকে, ঘুম থেকে উঠিয়ে নিয়ে যাবে পলাশের বনে। সেখানে রাত থেমে থাকে— সেখানে আমার রাগের অভিমুখে জ্যোৎস্না নামে— তখন রাত এগারোটা চল্লিশ। বারোটা বাজতে কুড়ি মিনিট বাকি।
কোথায় একটা ব্যথা, একটা ব্যথা বিঁধে আছে
বিষের নখ যার মুখে
বসন্ত-বিলাসে যা হয় তীব্রতর।।