৮ ফাল্গুন ভ্যান গগের তিনটি ছবি ও একটি ফোন-কল

পার্থজিৎ চন্দ

 





লেখক কবি ও গদ্যকার।

 

 

‘তোমার ব্যক্তিগত বসন্তদিনের চটি হারিয়েছ বাদামপাহাড়ে’, উৎপলকুমার বসুর ‘পুরী সিরিজ-য়ের শেষ কবিতা’র এই লাইনটির ‘তোমার’ শব্দটি কেটে আমি মনে মনে ‘আমার’ করে নিই, ‘হারিয়েছ’ অতি-অবশ্যই হয়ে যায় ‘হারিয়েছি’। তারপর এক বাদামপাহাড়ে আমি বসন্তের দীর্ঘ-দুপুর আর বিকেলবেলা খালি পায়ে ঘুরতে থাকি। 

বাদামপাহাড় মনে পড়লেই আমার কুড়ি-বছর আগের এক হলিডে-হোমের সামনে শুয়ে থাকা চওড়া আঙিনা আর দূরে টিলার ইশারা মনে পড়ে। ধলভূমগড় ঘাটশিলা পেরিয়ে গালুডিহি শহর থেকে বেশ কিছুটা দূরে এক ফাঁকা হলিডে হোম। দোল-পূর্ণিমার আগের দিন এক ভারী গন্ধ চেপে বসেছে সন্ধ্যার বু্কে। এক আশ্চর্য নরম মৃত্যুর মতো সে গন্ধ। অকারণে কান্নার মতো পবিত্রতা আর কিছুতেই নেই; সমস্ত সম্পর্ক থেকে দূরে সরে গিয়ে এক-জীবনে একা একা মাত্র কয়েকবারই কাঁদতে পারে মানুষ। সে দিন হু হু করে কেঁদে উঠেছিলাম আমি। 

প্রতি বছর বসন্ত মানে আমার কাছে সেই ঘ্রাণ। নরম মৃত্যুর মতো একটা ঘ্রাণ অব্যর্থ ভাবে স্নায়ুতে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। সে ঘ্রাণের ভিতর চুপ করে বসে থাকে মুখে রক্ত-তুলে হাহাকার করা কোকিল। হ্যালুসিনেশনের এক পৃথিবীর মধ্যে তখন আমার ব্যক্তিগত বাদামপাহাড় ও বসন্তদিনের ঘনিয়ে ওঠা।

যে দৃশ্য কোনও দিন দেখা হয়নি আমার, অথচ যে-দৃশ্য প্রবলভাবে আমার… যেমন ধরা যাক ফাল্গুনের এক দুপুরে একটা মিহি হাওয়া বইতে শুরু করেছে গড়ভবানীপুর গ্রামের দিকে। পিচ ক্ষয়ে যাওয়া রাস্তা থেকে কয়েক মিলিমিটার পুরু ধুলো উড়িয়ে সে হাওয়া মিলিয়ে গেল নয়ানজুলির ওপারে। শান্ত  ডাহুকের মতো আছে-অথচ-নেই এমন এক ভঙ্গিতে দূরে দাঁড়িয়ে রয়েছে একটি শিবমন্দির; আর তার ভাঙা চাতালে বসে রয়েছেন স্বয়ং ভ্যান গগ। এই কল্পদৃশ্যটি আমি বারবার দেখি ব্যক্তিগত বসন্তদিনে। এবং এই দৃশ্যটি আমার কাছে অবাস্তব, কিন্তু মিথ্যা নয়। 

ঠিক যেমন মিথ্যা নয় ৮ ফাল্গুন ও ভ্যান গগ-এর তিনটি ছবি। 

>ঠিক কিভাবে শুরু হয়েছিল ব্যক্তিগত ৮ ফাল্গুন? 

শুরু হয়েছিল সকালে ঘুম ভাঙার পর সেই মৃত্যুর মতো গন্ধটির বুক চেপে ধরার মধ্য দিয়ে। আমি বুঝে গেছিলাম এক তীব্র বিষাদের হাত থেকে আজ আমার মুক্তি নেই। ঠিক সে সময়ে কেন আমি বারবার গগ-এর ওই তিনটি ছবিই দেখছিলাম, কেন আমি ঘন্টার পর ঘন্টা তাকিয়ে ছিলাম ছবি তিনটির দিকে তার কোনও সদুত্তর নেই আমার কাছে। আমার বসন্তদিনের মধ্যে এসে বসেছিল গগ-এর স্টারি নাইট, দ্য পটেটো ইটারস ও দ্য নাইট ক্যাফে… যে ভাবে অন্ধ বসে থাকে নদীর কাছে বা একজন হুইল-চেয়ারে বসা মানুষ কিন্ডারগার্টেনের সামনে… আমিও সে ভাবে বসে ছিলাম ছবি তিনটির সামনে। জানালা দিয়ে খুব ধীরে ধীরে ঢুকে পড়ছিল মৃত্যুরূপী সেই গন্ধ। গগ-এর তিনটি ছবির উপর এসে বসছিল সে; এক মহাজাগতিক প্রজাপতির মতো। অধিকাংশ বাঙালীর মতো চিত্রকলা বিষয়ে অজ্ঞ আমি। অথচ মাথার ভিতর ছটফট করতে শুরু করেছিল এক সুতীব্র জিজ্ঞাসা – রাত্রি তো অন্ধকার… গগ তারকাখচিত রাত্রির ছবি আঁকছেন অথচ তাঁর সেই রাত্রি নীল। কেন নীল রঙ ব্যবহার করলেন গগ? নিজের মতো বেশ কিছু ব্যাখ্যা করে নিয়ে শান্তি পাচ্ছিলাম না। প্রথম ফোনটি করেছিলাম এক অগ্রজ কবিকে। তিনি কবিতা ও ছবির মানুষ। তিনি সঙ্গত কারণেই কিছুটা সময় নিয়েছিলেন (এবং তিনি পরে জানিয়েও ছিলেন তাঁর মনে হওয়া কারণগুলি)। 

দ্বিতীয় ফোনটি করেছিলাম কবিবন্ধু কুন্তল মুখোপাধ্যায়’কে। সম্ভবত আমার না-ছোড় অবস্থা আন্দাজ করে জরুরী কিছু কাজ সরিয়ে রাখতে বাধ্য হয়েছিল কুন্তল। তারপর শুরু হয়েছিল আমাদের কথা… ব্যক্তিগত বসন্তদিন গগ ‘স্টারি নাইট’ ও পটেটো ইটারস…

৮ ফাল্গুন মধ্যাহ্ণের কিছু আগে আমার আর কুন্তলের সামনে খোলা ছিল স্টারি নাইট। আমি আর কুন্তল ঢুকে পড়ছিলাম ছবিটার মধ্যে। কুন্তল বলছিল, একজন শিল্পীর কাছে, মনের এক বিশেষ অবস্থায় রাত্রির আকাশও আশ্চর্য নীল আর দুপুরের আকাশ অন্ধকার হয়ে যেতে পারে… আর নক্ষত্রগুলি তো থাকেই… 

-নীচে একটা ছোট্ট জনপদ; একটা চার্চ। তুলনামূলকভাবে শান্ত… যেন এক মহারহস্যের নীচে শুয়ে আছে…

-ঠিক, এবার তুমি একবার সেই বিখ্যাত গাছটার দিকে তাকাও… ভালো করে দেখলে তোমার মনে হবেই এটা কোনও গাছ নয়… যেন একটা পুড়ে যাওয়া মানুষের আর্তনাদ লকলক করে আকাশ ফুঁড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে… এবং ওই তারা থেকে তারায় ছড়িয়ে পড়া মহাজাগতিক এক স্রোত… একটা ওয়েভ…ছবিটার সব থেকে বড় গুণ, সে তোমাকে যে দিকে টেনে নিয়ে যেতে চাইবে তোমাকে সে দিকেই ছুটে যেতে হবে…

-দ্য নাইট ক্যাফে ছবিটায় এবড়ো-খেবড়ো ব্রাশিং… মানে মানুষগুলো যেন ঠিক মানুষ নয়, ক্যাফের চেয়ার-টেবিল বাঁকাচোরা… যেন এক ‘শিশু’র ব্রাশিং… অথচ ছবিটায় কী যেন একটা রয়েছে যাকে ব্যাখ্যা করা যায় না… একটা থম মেরে থাকা বিষন্নতা…

-আসলে কী জানো… শিল্পের প্রকরণগুলি আয়ত্ব করবার পর কেউ যদি আবার শিশুর স্তরে ফিরে যেতে পারেন তিনিই সব থেকে বেশী সফল… গগ সেটা পেরেছিলেন… একদম শিশুর মতো একজন যেন…

কুন্তলের সঙ্গে আরও কিছুক্ষণ কথা বলবার পর আমি আবার ফিরে এসেছিলাম স্টারি নাইটের কাছে। তারা থেকে তারায় ছুটে যাওয়া প্রবল ঘূর্ণি ক্রমশ আমার কাছে হয়ে উঠছিল অক্টোপাসের আকর্ষের মতো। আত্মভ্রূণের দিকে পাকিয়ে ওঠা একটি অকল্পিত বিহ্বল ও অসাড় করে দেওয়া অনুভূতি। তারাভরা আকাশের নীচে ছোট্ট জনপদ, আকাশের বিস্তারের সঙ্গে তার বিস্তার তীব্র কন্ট্রাস্ট তৈরি করছে। পাহাড়ের পাদদেশে যে গাছ তার কোনোটিই ঋজু নয়। যেন সমুদ্রের তলদেশে কয়েক-শো বছর কাটিয়ে দিয়েছে সে-সব গাছ, বিন্দুমাত্র সূর্যের আলো পায়নি কোনও দিন। অথচ তারা তীব্র সবুজ। এমনকি এক কোণে জ্বলজ্বল করছে চাঁদ। তার ভিতরেও এক ঘূর্ণি। ক্লকওয়াইজ, প্রতিটি তারার নাভিবিন্দুতে একটি করে চোখ। মহাজাগতিক চোখ। দূরের টিলাটি যেন উপুড় হয়ে শুয়ে থাকা এক নারীর আদল নিয়ে জেগে। ছবিটির দুটি অংশ, একটি আকাশের আর একটি তার নীচে শুয়ে থাকা জনপদের। শান্ত একটি রাত কাটিয়ে দিচ্ছে হয়তো জনপদটি, কিন্তু তার মাথার ওপর ঘটে চলেছে এক মহাজাগতিক ‘যাত্রা’। প্রতি মুহূর্তে ছুটে চলেছে এই ‘ইউনিভার্স’। সেই গতি আর ঘূর্ণন নিয়ে জেগে রয়েছে তারকাখচিত একটা রাত। 

ফিরে এসেছিলাম পটাট ইটারস ছবিটির কাছেও। কী অদ্ভুত এই ছবি, যেন আবহমানকাল ধরে এভাবেই দিনান্তে মানুষেরা এসে বসে তাদের ছোট্ট খাবার টেবিল। তাদের মুখে এসে পড়ে এক হলুদ আলো। তিনজন নারী ও একটি বাচ্চা মেয়ে এবং একটি পুরুষ। পুরুষ ও যে-নারীটি আলুর শরীরে ফর্ক গেঁথে দিয়েছে তাদের আঙুলগুলির দিকে তাকিয়ে সারা শরীর কেঁপে ওঠে। তাদের আঙুলগুলি আমার ব্যক্তিগত বসন্তদিনে রূপান্তরিত হয়ে যেতে দেখি ফর্কের তীক্ষ্ণ কাঁটায়। বাচ্চামেয়েটির মুখ দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু বাকী তিনজন নারী ও পুরুষ কেউ কারো দৃষ্ট অনুসরণ করছে না। সমস্ত ছবিটায় ছেয়ে আছে এক অদ্ভুত ‘দৃষ্টির উদাসীনতা’। পুরুষটির পাশে বসা নারীটি, যে ফর্ক গেঁথে দিয়েছে আলুর শরীরে তার ও পুরুষের দৃষ্টি প্রায় এক সমকোণে একে অপরকে অতিক্রম করে যাচ্ছে। 

যে নারী পাত্রে পানীয় ঢেলে চলেছে তার দিকে পাত্র তুলে তাকিয়ে রয়েছে আরেক প্রৌঢ়া। কিন্তু এখানেও কেউ কারও দিকে তাকিয়ে নেই। 

ছবিটিতে সব থেকে রহস্যময় বাচ্চামেয়েটি। ৮ ফাল্গুন হঠাৎ ছবিটির সামনে বসে মনে হয়েছিল, এই বাচ্চাটি কি সেই ব্লেক কথিত innocence? প্রৌঢ়ত্বের সামনে দাঁড়ানো জীবনের বিপুল-বিস্ময়? তার মুখের উপরেই থিতু হয়ে রয়েছে সব থেকে রহস্যময় ও তীব্র আলো। 

৮ ফাল্গুন ভাঙা শিবমন্দির থেকে নেমে এক ক্যানভাসের কাছে চলে গেছিলেন আমার গগ। একটি ক্যাফে ও ছটি মানুষ। ঘড়িতে বারোটা পনেরো… দরজার ডানদিকে এক যুগল। শুধু তারাই নিজেদের মধ্যে মগ্ন। তিনটি টেবিল ফাঁকা। এই মাত্র যেন শেষ বিষটুকু পান করে উঠে গেছে কেউ। এবং আর দুটি টেবিলে তিনজন বিষন্ন মানুষ; প্রত্যেকের ঝুঁকে যাওয়া মাথা। জীবনের কাছে একটি মাত্র আশা নিয়ে এসেছিল তারা এবং ফিরে যাচ্ছে রক্তমাখা ঠোঁটে। 

বিলিয়ার্ডেসের সামনে এক হতবিহ্বল মানুষ। আর কিছু নেই। 

আর যা আছে তা হল ল্যাম্প থেকে ঝরে পড়া এক অদ্ভুত হলুদ আলোর বিষন্নতা। ব্যক্তিগত বসন্তদিনে যতবার ছবিটার দিকে তাকিয়েছি ততবার প্রকট হয়ে উঠেছে তিনটি প্রাগৈতিহাসিক চোখ, যা আসলে তিনটি ল্যাম্প। যেন একচক্ষু কোনও এক অভিশাপ ও বিষন্নতার দানব তাকিয়ে রয়েছে শহরের সস্তা ক্যাফের মানুষগুলির দিকে। তাদের চোখ ঘিরে আবার সেই রহস্যময় ঘূর্ণি। 

এসো, এই ঘূর্ণির ভিতর এসো… মধ্যরাতের সস্তা ক্যাফের ভিতর ঘনিয়ে থাকা মদের গন্ধ বিলিয়ার্ড-বোর্ড মগ্ন-যুগল পেরিয়ে আরও এক পারাপারহীন দূর্জ্ঞেয় রহস্যময় ঘূর্ণি অপেক্ষা করছে তোমার জন্য। এর হাত থেকে তোমার পরিত্রাণ নেই। 

ছবির ভিতর ‘গন্ধ’ লুকিয়ে থাকতে পারে না। কিন্তু দ্য নাইট ক্যাফে থেকে মৃত্যু ও বিষন্নতার একটা গন্ধ বারবার উঠে এসেছিল, আমাকে ঘিরে পাক খেতে শুরু করেছিল। এমনকি দরজার ডানদিকে মগ্ন হয়ে থাকা যুগল, তাদের কাছ থেকেও উঠে আসছিল গন্ধটি। 

চুম্বন ও শরীরতো আসলে এক দীর্ঘ বিষন্নতার শুরু মাত্র। 

ব্যক্তিগত বাদামপাহাড়ে হাহাকার করা বসন্তদিনের শুরুও সেখান থেকেই। 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4879 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...