বসন্ত-বিলাপ

সৌমিত দেব

 

 

লেখক 

 

 

 

“বসন্ত একটা হোলি সময়, এ সময় প্রেমের বৈদ্যুতিক তরঙ্গেই চলে নিউরোনের আদানপ্রদান”– টেসলা

“হোলি শিট! গুরু পাবলিক করেন, শেয়ার দিব!”– এডিসন

বসন্তকাল নিয়ে আদিখ্যেতা করেনি এমন কবি মেলা ভার! অবশ্য আদিখ্যেতার দোষটাই বা কোথায় এবং করবে নাই বা কেন! বসন্ত মানেই দ্বন্দ্বের সময়। আর দ্বন্দ্ব মানেই কবিতা! এই যে পাখাটা চালাব না চালাব না, আরেকটা জামা পরব না পরব না, ঠান্ডা জলে চান করব না করব না, রাস্তায় ফেলে লাঠির আগায় গান গাওয়ানো হচ্ছে দেখে চোখ ঘুরিয়ে স্ক্রলডাউন করে যাব না যাব না, ইত্যাদি প্রভৃতি ডিলেমায় কোন পাষণ্ডের না ইচ্ছে করবে ছন্দ মিলিয়ে দু চারটে প্রেমময় কাপ্লেট নামাতে? মায় আইনস্টাইন পর্যন্ত বলতে বাধ্য হয়েছিলেন– “রিলেটিভিটির চাইতে রিলেশনশিপ ঢের ভালো জিনিস।” না, একথা ঠিক যে বাংলায় বলেননি, জার্মান ভাষায় বলেছিলেন, কিন্তু সে সব তো ট্রান্সলেট হওয়ার আগেই হিটলার কাগজ ফাগজ ইত্যাদির তোয়াক্কা না করেই খেদিয়ে দিচ্ছে দেখে বাধ্য হয়ে দেশ ছাড়লেন।

তা যাকগে, এসব বাজে কথায় বেশি কাজ নেই, বরং বসন্তের এই মধুর সময়ে চাড্ডি মধুর কথা বলা যাক।

মধুর স্প্রেড তুলসিপাতার ওপর লাগিয়ে রোজ সকালে খেয়ে ফেললেই বসন্তের এই সময়টায় সর্দি হওয়ার সম্ভাবনা ৯৯.৯% কমে যায়। বাকি যে পয়েন্ট এক পার্সেন্ট থেকে যায় সেটা ফেরত এলে অবশ্য নাশকতাকে বক দেখানো যায়৷ ০.১℅ কি, না ০.২℅… কে জানে! আসলে বয়স হচ্ছে তো। এসব নম্বর, নাম, ক্রোনোলজি কিছুই তেমন মনে থাকে না আর আজকাল। খালি ছোটবেলায় ঘাড় ধরে সজনেডাঁটা খাওয়াত বলে মনে আছে যে ওসব খেলে গুটিবসন্ত হয় না। তবে একটা ব্যপার হয়েছে বেশ ভালো জানেন! আজকাল কেউ ‘ছোট’ বললেই রিফ্লেক্সে ‘ইস্যু’ বলে ফেলি। বসন্তকাল তো, ভাসা ভাসা সময়… ভালো লাগে…

ভালো লাগে সকালে উঠেই কোকিলের রব এই থুড়ি ডাক! হ্যাঁ, সে মানে দিন নেই ভোর নেই, কুউউউউ, কুউউউউ! এত ভালো লাগে কী বলব! কুউউউ, কুউউউ! আর জিনিসটা এত ভালো যে নয়েস ক্যানসেল হেডফোনেও আটকাতে পারবে না! না চাইলেও আপনাকে শুনতেই হবে! বাড়ির জানলার সামনে গাছটায় বসে কুউউউ, কুউউউউ! একটা এয়ারগান যদি থাকত…. তাহলে সেটা ভেঙে ওকে একটা পোক্ত বাসা করে দিতাম এই আর কী! ওই আবার শুরু হল… কুউউউ কুউউউ… খুব ভাল্লাগছে! #হাসিরস্মাইলি

তবে বসন্তের ক্ষেত্রে এসব খুবই ছুটকোছাটকা ব্যপার কারণ বসন্তের আসলি দুমদাম বিষয় হল দুটি:

১. দোল/হোলি/বুরা না মানো মোলেস্টেশন হ্যায়!
২. প্রেম, প্রেম, প্রেম…

তা সত্যি বলতে কী মোটের ওপর দোল বিষয়টা বেশ উলালার দিকেই। আমিই তো কতবার বন্ধুবান্ধব বা আপনার লোককে “অ্যাই! ওর নাকের ডগাটা খালি ক্যানো?” মর্মে বাঁদুরে রং দিয়ে ছেনে দিয়েছি। বাচ্চা-কাচ্চারা যেমন তাদের থেকেও লম্বা বালতিকে বেসক্যাম্প করে পিচকিরি নিয়ে পাড়াময় দৌড়ে বেড়ায় রং দেওয়ার জন্য। চিরকালীন সকালে রণবীর সিং-এর জামার আলমারি আর বিকেলে রণবীর কাপুর (রকস্টারের) হয়ে ঘোরার দিন।

এই দোল প্রসঙ্গেই মনে পড়ে যাচ্ছে আমার দুই প্রিয় মানুষের কথা৷ সম্পর্কে ওরা দুই ভাই, অথচ আশ্চর্যের ব্যাপার মিল প্রায় নেই বললেই চলে দুজনের! ওদের দুটো বিখ্যাত উক্তি হুবহু তুলে দিই!

“কিন্তু আপনার যেমন প্রথমে স্বেচ্ছায় রামধনু হয়ে পরে কানের পেছনে দড়াম ছোবড়া ঘষতে ভালো লাগে, তেমনই সামনের লোকটার নাও লাগতে পারে। সে বন্ধুবান্ধব/আপনজন হলে কী করবেন (সেক্ষেত্রেও কনসেন্ট নেওয়া উচিৎ) সেটা আপনার ব্যাপার কিন্তু সে আপনার অচেনা হলে তাকে জোর করবার কোনও অধিকার আপনার নেই…”– সভ্যতা।

“তাহলে দোলের দিন রাস্তায় বেরিয়েছে ক্যানো? রাস্তায় বেরুলে রং দেব্বোই!”– অসভ্যতা।

“তার কাজ আছে, তাই সে বেরিয়েছে! সে যখন তোকে প্লাস্টিকের বোতলে কী পাইল করা আছে জানতে চায়নি তখন তুইও সে ক্যানো রং মাখবে না তা জানতে চাইতে পারিস না! তোকে তো সে হুল্লোড়ে বাধা দেয়নি, তাহলে…” সভ্যতা।

এইসব বলে তর্কটা চালিয়ে যাওয়ার আগেই যদিও অসভ্যতা তাকে গায়ের জোরে ধরে ফেলে, মাটিয়ে শুইয়ে, বাঁদুরে রং দিয়ে দাঁত মাজিয়ে দিয়েছিল! সে যে কী ‘মজা’ কী বলব রে ভাই!

তবে আসলি আসলি মজা অন্য! মেয়ে!

যার সঙ্গে কথা বলতেও ভয় পান, আজ যতটা পারা যায় ছুঁয়ে নেওয়ার চান্স। একেবারে হুড়ুমদুড়ুম ইয়েএএ, ধধধর! কারণ কিচ্ছু বলবার কোনও স্কোপ নেই। উলটে ভিকটিম ব্লেমিং করে দিলেও চাপ নেই।– “আমি তো সরল মনে রং দিচ্ছিলাম!” এমনও বসন্ত দিনে, জোরাজুরি কনসেন্ট বিনে! এইবার! যে সমস্ত সুন্দরী পাঠিকার কথা ভেবে আমি এসব লিখি, তিনি নিশ্চয়ই মনে মনে প্যাঁ কষছেন আমায় ইচ্ছে করে ফাঁদে ফেলবার! কী? তাই তো? বেশ আনুন তবে প্রশ্নবাণ! চ্যালেঞ্জ অ্যাকসেপটেড!

“তো! ছেলেদেরও তো এভাবে রং দেওয়া হয়! তার বেলা?”– ওটা ভুল৷ ওটা অসভ্যতা!

“মুখেই যত সমান সমান নাকি! মেয়েরাও তো করে এমন, তখন?”– ভুল করে। যেই করুক, ভুল করে।

“তাহলে তো রং খেলাই যাবে না ভাই।”– কেন যাবে না! জিজ্ঞাসা করুন! হ্যাঁ বললে দিন না রং!

“মানে?”– মানে মোরাল অফ দা স্টোরি হল কনসেন্ট ছাড়া নিজের বউ/বরকেও আপনি জোর করে রং মাখাতে পারেন না। দুষ্টুমি, খুনসুটি আর জোরাজুরি এক জিনিস নয়। আর শান্তিনিকেতনে ফি বছর ছেলে ছোকরাদের দোলের সময়কার এই মোচ্ছবহিস্টিরিয়ার কারণ যে শুধু রবিঠাকুরের প্রতি ভালোবাসা নয়, তা বোধহয় আমরা সকলেই কমবেশি জেনে গেছি! তাই, না?!

যাকগে দোলের এই প্রসঙ্গ শেষ করব সভ্যতা ভাইয়েরই একটা কথা দিয়ে৷ দাঁতে রং নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলেছিল– কোনও লৌন্ডা, ভাইয়াজি, ভাই, দাদা, কাকু, পাপ্পন, লাল্লান, যেই হোক না কেন তারা যদি দোলের দিন রং দেওয়ার নামে কোনওরকম বদামো করে তবে, তার দু-পায়ের মাঝে সপাটে হাঁটু চালিয়ে দিয়ে বলুন বুরা না মানো হোলি হ্যায়।

নিজে করেওছিল তারপর একই কাজ।

অবশ্য বসন্তে একটাই কাজের কাজ যা করা যায় তা হল প্রেম।

আহা… তা প্রেমের মতো তুরীয় ব্যপার আর বোধহয় নেই। রোমিও-জুলিয়েট, লায়লা-মজনু রক্তাক্ত হয়েছে একে অপরের প্রেমে… এই বসন্তেই আবার রাজধানীর রাজপথও রক্তাক্ত হল প্রেমেই… অ্যাজেন্ডা প্রেমে… ওরা বলে দিল, তারা খারাপ, আমরা মেরে এলাম… প্রেম প্রেম…. এত প্রেম দেখে কখনও কখনও মনে হয় বনমালী তুমি, পরজনমে হইও বজরং দল…

বাকিটা, ব্যক্তিগত।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4661 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...