ঈশিতা দে সরকার
লেখক কবি ও গদ্যকার
…তারপর অপেক্ষা আর অপেক্ষার পর ঘণ্টাতলার চিরনবীন বটগাছের দিকে তাকিয়ে বলেছিল, “বকুলশাখা পিয়ালশাখা তাকাও কেন আমার দিকে/মিথ্যা জীবন কাটল আমার ছাই লিখে আর ভস্ম লিখে/…কেমন করে রঙ দেবো তোমার ঐ বান্ধবীকে”।
রঙে রঙে আবির হয়ে উঠেছে শান্তিনিকেতন। তরুণ কবি, কবিতাপ্রেমিক কবিতায় ছুঁয়ে দিচ্ছে প্রেমিকার নরম গাল; ঠোঁট প্রান্ত…।
এই দৃশ্যকাব্য প্রতিবারের আবির দিনের সূচনা করে। এই মুহূর্তে আরম্ভ করল বসন্ত লেখার। গাঢ় জঙ্গলের ভেতর দাঁড়িয়ে গাছের অভিমান টুকে ডায়েরি লেখা যেন….
ডায়েরি কিছুটা জানে।
‘স্থলে জলে বনতলে’ দোলের যে রটনা, তাকে জোরালো করে আয়না আয়নায় মাটির কানের দুল, কলাপাতায় আবির, নৃত্যনাট্য ঝাপ্টা মারছে কবির উড়ো চুলে। এসব স্মৃতিফুলের বীজ আমার বসন্ত ধারণ করে আছে। লিখতে গিয়ে বাসরুট হারিয়ে পথিকের পথ হারানোর সম্ভাবনা প্রবল।
কোথায় শেষ স্টপেজের প্রাণভ্রমরা: জানা নেই। জানা নেই কিভাবে ট্রেনে শান্তিনিকেতন যাওয়ার সময় রবীন্দ্রভারতীর ছেলেমেয়েগুলোর সাথে কলকাতায় পড়তে আসা উত্তরবঙ্গের মেয়েটা “আনন্দ বসন্ত সমাগমে” গলা মিলিয়েছিল। সঙ্গী গানপাগল গিটার কাঁধের ঝকঝকে যুবক ও তার বন্ধুরা। এরপর এক যুগ একে অপরের পিছুটান হয়ে গেছি কখন যেন…।
বসন্তে প্রকৃতি পোয়াতি হয়। মনে মনখারাপ মনভালোর দ্বন্দ্ব। বসন্তে একটা ঘরে গাদাগাদি তিরিশ জন শুয়ে শুয়ে আকাশের গায়ে কান পেতেছি কত না দিন! ভোর হতেই অবাধ্য হলুদ কুচি আঁচল সাদা পাঞ্জাবি হলুদ কুর্তা হেঁটেছে আম্রকুঞ্জের গীতবিতানে…।
তখন নিষেধের চোখ জুলজুল করত না, জড়িপেঁচানো লাঠি হাতে মিশে গেছি “ওরে গৃহবাসীর” দলে। লাল কাঁকরের রাস্তা জুড়ে মানুষ আর মানুষের আয়োজন। পাখোয়াজে মৃদঙ্গে যে উতরোল বাজে, তাতে পলাশের সাথে ভাটফুল ধুতরাফুলও নাচে। “নদীও নর্তকী হয়…”। চাতাল জুড়ে চলতেই থাকে বসন্তসেনাদের আনন্দ মন্তাজ। “যা ছিল কালো ধলো, রঙে রঙে রঙিন হল” গানে যে রং আছে, আকাশকে দোল মাখায় ছায়াপথের কিশোরী। আমিও তো সেই আবিরমেয়েদেরই একজন।
মিলনমেলা ভাঙে অবশেষে।
অষ্টম শ্রেণির ছাত্রীদের প্রিয় ঋতু নিয়ে লিখতে বলায় কেউ কেউ বসন্ত নিয়ে এল। বাবা মারা গেছেন সাত বছর বয়সে, মা কাজ করেন মাঠে; শর্বাণী টিগ্যা উপসংহারে লিখছে “আমার বসন্ত কাটে খাদ্যের সারিতে প্রতীক্ষায়…”। চমকে উঠি! যে বয়স তুলতুলে রোদ, আমের মঞ্জরীর মত গন্ধে বিলোল, সেই বয়স আমাকে সপাটে দাঁড় করায় রচনা বইয়ের বাইরে..। বসন্তের ‘ক্ষুধা’ বসন্তের উন্মাদনার মতই তুমুল।
বসন্তের আহ্লাদী আবিরমেয়ের একজন হতে পেরে যে রিনরিন মেখেছিলাম গায়ে, তার কাছে হাঁটু গেড়ে বসে জানাই– ক্ষুধার্ত মেয়ের খালি পেট হতে পারিনি তো… বসন্তের এক পিঠ ভরা অভাবের চুপ দর্শক হতে পেরেছি কেবল…।
কত কিছুই পারি না। বসন্ত আসে। ঘুরে ফিরে শান্তিনিকেতন মনে পড়ে। সুবর্ণরেখার সামনে ধুতি পাঞ্জাবি পড়ে কাঁধে ব্যাগ নিয়ে বসে আছেন ইন্দ্রনাথ মজুমদার। বইয়ের জহুরি। প্রচারের আলো থেকে দূরে থাকা আইকন। ইন্দ্রকাকু বসেন না আর। আবিরের দানা ছড়িয়ে দিতে পারি না মাথায়। কোনও এক রবীন্দ্র-জন্মদিনে চোখে কুর্চিফুল গুঁজে ইন্দ্রকাকু চলে গেলেন পুরনো বইপত্তর খুঁজতে। কাকিমা খোঁজেন রোজকার উপস্থিতি। আমরা খুঁজে বেড়াই বসন্তের গলায় ডোকরার, হাঁসুলির সুবর্ণরেখা।
পারি না ছুঁতে পারি না কত মায়াজল।
মায়া ষড়যন্ত্রকারী। মায়ার পিঞ্জরে বাঁধা পাখি কখন যেন উড়ে যায়। পাখির ভিসা লাগে না। মানুষের লাগে। সীমান্ত টপকাতে পরীক্ষা দিতে হয় ইমিগ্রেশন খাতায়। একদিন সব খাতা উড়িয়ে দেব হাওয়ায়, একদিন কাঁটাতারগুলো দোতারার তার হয়ে যাবে বিশ্বাসে প্রথম বাংলাদেশের মাটি ছুঁই বসন্তে। ৫ই ফাল্গুন, ২০১৭।
ঢাকা বরিশাল যশোর পেরিয়ে বসন্তের বুকছেঁচা জলে ভিজেছিল বিক্রমপুর হাইস্কুলের মাঠ। এই স্কুলের সবটাতে জুড়ে আছে আমার পূর্বপুরুষ-নারীদের নিঃশ্বাস। ব্ল্যাকবোর্ডটায় বাক্য-শব্দ বিন্যাসের রূপকথার চাবিকাঠি। আজন্ম দেশভাগের বেদনায় কাতর কত না পরিজনের অক্ষর পরিচয় লেগে আছে স্কুলের শরীরে।
এক মুঠো মাটি স্কুলের মাঠ থেকে তুলে ভরি কৌটোয়। এ মাটির রং সব রঙের চাইতে রঙিন, নবীন, প্রবীণ, আরও কত কী!
এমন কত না শিহরিত স্মৃতির পৃষ্ঠা! বসন্তে বাংলাদেশে কাটানো অমলিন দিনগুলো খামে ভরা আছে। কোনও একদিন পুরোটা খুলে দিতে হবে গদ্যের উঠোনে।
৮ই ফাল্গুন। ২১শে ফেব্রুয়ারির অলৌকিক প্রভাতফেরিতে আমরা তিনজনও ছিলাম।
শহিদ মিনার ফুলে ফুলে ঢাকা। এত ফুলের ভিড়ে রফিক-বরকত-জব্বারের কপালে খসে পড়ল যে শিমুল, সেও আলো নিবে গেলে, পদযাত্রা মিলিয়ে গেলে কাঁদে?
কাঁদো শিমুল।
ভরা ফাল্গুনে ভরা ভাদ্রের নদীর জোয়ারিতে কাঁদো বাঙালি। ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছে ভাইরা। বসন্ত আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো। বসন্ত আমার তোমার ভাষার মাস। প্রতি বসন্ত বাংলাদেশে জন্ম দিয়েছে ইতিহাস। ২১শে ফেব্রুয়ারি, শাহবাগ আন্দোলন, ৭১-এর লড়াই সব জমা আছে বসন্তের বুকপকেটে। ফাল্গুনের ভরা সন্ধ্যায় মৌলবাদীদের হাতে নিহত মুক্তমনা ব্লগার অভিজিৎ রায়ের রক্তে ভিজেছে মাটি।
রাতজাগা শাহবাগের প্রজন্ম চত্বরের আগুন দেখেছে বিশ্ব। এককোণে পড়ে থাকা আমার রায়গঞ্জে লেগেছিল তার আঁচ। স্লোগানে গানে পথসভায় উদ্দীপিত হয়েছিল মফস্বলি মানুষেরা। মনে পড়ে সেদিন যমুনা ব্রিজের দুধারে পলাশ শিমুলের দৃপ্ত সম্মেলন। আমার রায়গঞ্জের রেললাইনের ধারঘেঁষা একটামাত্র শিমুল একই পরিবারের ঘরকন্না সেরেছে।
কাঁটাতারের ওধারে শাহবাগ তো এধারে শাহিনবাগ গর্জে উঠেছে এই বসন্তেই। নীল দিগন্তে যখন ফুলের আগুন, আমার নানা রঙের দেশ ভারতে বসন্ত ফুল প্রতিবাদের আগুন হয়ে ফুটেছে। শাহিনবাগে হাজার হাজার নারী গর্জে উঠছে এনআরসি এনপিআরের বিরূদ্ধে। বসন্ত প্রকৃতিকে গড়ে পিটে নেয়, ইশারা দেয় অন্যায়ের সামনে মাথা নত না করার। ইতিহাস আর প্রকৃতি যেন এক চলরেখায় চলছে, বসন্ত তার প্রমাণ রাখছে বারবার।
বসন্ত এলে দৃপ্ত লেখনী আর মায়াবী কণ্ঠের উচ্চারণ বুকে কানে কড়া নাড়ে….
“আবার ফেব্রুয়ারি আবার গর্জমান/ দুর্জয় ঘাঁটি বাংলার মাটি শত্রুরা সাবধান” (কথা-সুর-কন্ঠ: শুভপ্রসাদ নন্দী মজুমদার।)
এপার হোক বা ওপার ভরা বসন্তে বিশ্বাস ভাসে বাংলার মাটিতে সাম্প্রদায়িক মৌলবাদীদের ঠাঁই হবে না জেনো। ফাল্গুনকে সাক্ষী রেখে বাংলাদেশ পথ দেখিয়েছিল পশ্চিমবঙ্গে অনুষ্ঠিত মঙ্গল শোভাযাত্রার আলোচনার। রাতের কোপাই জ্যোৎস্নার শাড়ি পরেছে। এক দঙ্গল উজবুক তখন চাঁদের আলোর সওয়ারি। “ও চাঁদ চোখের জলে লাগল জোয়ার.. “, জোয়ারে হাসিও আছে চাঁদের। আলো ঠিকরে পড়ে চরাচরব্যাপী। এ সুখানুভূতি অনেকদিন অক্সিজেন জোগায়। সময় পেরোল অনেকটাই। জীবনপাত্র ভরেছে নানা ব্যঞ্জনে। কোপাই-এর গা ঘেঁষে খুঁটি উঠতে দেখেছিলাম।তারপর ‘জ্যোৎস্নারাতে’ আর যাওয়া হয়নি। জানি না ‘বসন্তের মাতাল সমীরণ’ নিয়ে কেমন আছে কোপাই…
শীত অপছন্দের। উত্তরবঙ্গের জাঁকালো শীতে শামুকের মত গুটিয়ে থাকি। ক্যালেন্ডারের দিকে তাকিয়ে ফেব্রুয়ারির ১ তারিখে নড়েচড়ে বসার আয়োজন করেছি। যেন ফেব্রুয়ারি শীতের শাসন থেকে রক্ষা করবে। তখনও শীত বেজায় ভাবেই থাকে, তবুও ১লা ফেব্রুয়ারি আমার শীতের ঝালাপালা থেকে মানসিক উড়ান দেওয়ার বসন্ত দিন।।
ফুটপাতে তখনো খড়ের আগুন। টবের উনুনে হাত সেঁকা ঘটিপাগলি পরে আছে চট-সেলাই করা সালোয়ার।
পাগলপারা গানের হিম্মত আছে বসন্তের ট্রাঙ্কে। গানের দোহাই দিয়ে সংসারে খেটে খাওয়া বুলিদিকে প্রেমে পড়তে দেখেছি বসন্তে। “শোনো গো দখিন হাওয়া প্রেম করেছি আমি”– সকাল এগারোটায় এই একই গান শুনত বুলিদি। জন বেয়াজের “কার্লাস” অনুবাদ করে সাংবাদিক প্রেম মধ্যরাতের তাজ উপহার দিয়েছে ফাল্গুনের সূচনায়। এক গঞ্জের পাগলা দাশু যে অন্য গঞ্জের “মারহাব্বা”কে নিয়ে প্রেমচরিত লেখে সে বসন্ত ছাড়া অন্য কিছু হতে পারে না।
পারুলডাঙ্গায় সুধীরদাদুর আখড়ায় সহজিয়া সন্ধ্যা নামে গানের নিমজ্জনে। “বসন্ত বাতাসে সই গো বসন্ত বাতাসে/ বন্ধুর বাড়ির ফুলের গন্ধ আমার বাড়ি আসে.. “। শাহ আব্দুল করিম গাইছেন, প্রাণপ্রিয়। সুধীর দাদুর “খ্যাপারে” তান ঘুরছে মর্মরিত পাতায়। এমন সব বসন্ত দিনের স্মৃতি অথই হয়ে আছে।
ফাগুন শেষ। চৈত্র অনেকটা বোনের মত। লেপ্টে থাকে জামায়। চৈত্র দুপুরে স্কুল ছুটি থাকলে ঘর থেকে বেরিয়ে চড়কের “দেল”-এর সাথে। পায়ে ঘুঙুর, মাথায় কাঠের পাঠ ঠাকুর নিয়ে হেঁটে চলেছে নিঝুম দুপুরে। মা ডেকে জল বাতাসা তেল সিঁদুর দেয়। আমি আর দাদা কালিসন্ন্যাসীর কাছে গান শোনার বায়না করি। কালিসন্ন্যাসী গান ধরে… “এপার গঙ্গা ওপার গঙ্গা মধ্যিখানে চর/ তার মাঝে বইসে আছে শিব সদাগর..”
এমন দুপুরে অতীতের গন্ধ পাই। ঘুঙুরের ছলাৎ ছলে বিভূতিভূষণের দুপুর নেমে আসে। আমাদের বাড়ির কাজকর্মে সাহায্য করা লায়লার মা মামি আঁচলের খুঁট থেকে দুটাকার কয়েন রাখে কালিসন্ন্যাসীর সামনে। বাতাসা দিতে বলে। বসন্তের উপুড় করা দুপুরে ভারতবর্ষের সিম্ফনি বেজে ওঠে। রিডে রিডে সম্প্রীতির সিম্ফনি। এই সিম্ফনি কি সিংহাসন অব্ধি পৌছায় না!?
“এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম /এবারের সংগ্রাম স্বাধীন তার সংগ্রাম”
বঙ্গবন্ধু ৭ই মার্চ রেডকোর্স ময়দান থেকে এই আহবান রেখেছিলেন বাঙালির কাছে, যা বাঙালির লড়াইকে উদ্দীপ্ত করে। লড়াই করে বাঙালি পায় এক অখণ্ড ভুবন। জয়গাথার এই পরম লগ্ন গেঁথেছিল বসন্ত ফুল। বসন্ত এলে ৭ ই মার্চ মনে পড়ে আমার। জড়িয়ে থাকে চুয়াচন্দনের মত।
ক্ষয়ে যাওয়া স্মৃতি নিয়ে বাবা বসন্তকে চিনতে পারে না। ইদানিং মা-ও গুলিয়ে ফেলে বসন্তের আচরণ। হঠাৎ বাংলা ক্যালেন্ডারে চোখ গেলে ফাল্গুন মনে পড়ে তাঁর। ফাল্গুনে বৃষ্টি এলে মা বলবেই “যদি বর্ষে ফাগের শেষ/ ধন্যি রাজার পুণ্য দেশ.. “। সমাজতন্ত্রের গণতন্ত্রের স্বপ্ন দেখা মা ‘ধন্য রাজার’ হদিশ পায় না।
বসন্ত ভালো নেই।
মানুষের রক্তে স্নান করতে চায়নি। এই বসন্তে ফুল ফোটার চেয়ে ঝরেছে বেশি। ধান্দাবাজ মৌলবাদীদের অস্ত্রের দামামায় বসন্ত ভয়ের। আশ্রয়হীনতার।
তবুও কোকিল ডাকছে।
হসপিটালের জানালা দিয়ে মা ও তার পাশের বেডের বৃদ্ধা দিদা জানালা দিয়ে যখন কাঁঠালপাতার কচি মুখ দেখে খুশি হয়; বসন্ত জন্মায় বারবার। বারবার পাশের বাড়ির তোর্সা অর্ক নজরুল শ্রিয়া আফসানারা ছোট ছোট হাত পা নেড়ে বসন্ত উৎসবের মহড়া দেয়, পুড়ে যাওয়া বাড়ির অবশিষ্ট ঘেঁটে শিশুরা তুলে নিচ্ছে আধপোড়া বই।
বসন্ত প্রাণখোলা হাসি হাসে
হাসে ঘটিপাগলি।
আমার বিষাদের বসন্ত ‘না পাওয়ার রঙে’ শাড়ি ছাপে।
সব্বার বসন্ত আছে। থাকবেই। না পাওয়া, সর্বস্বান্তের কাছে একটুকরো বসন্ত আছে। কোকিলটা ডেকেই চলেছে। পুকুরের ধারে ঘুরে দাঁড়ানোর শপথ বুনছে বসন্ত। জর্জ বিশ্বাসের কণ্ঠ ভেসে আসছে গলির শেষ বাড়ি থেকে….
“তবু অনন্ত জাগে…. “