বিলাল হোসেন
যখন অণুগল্প নিয়ে বিভিন্ন ধরণের কথা শুরু হয়েছে; অনুশীলন হচ্ছে এর বিষয়আশয় নিয়ে কখনও তাত্ত্বিক কখনও ব্যবহারিকভাবে; পত্রপত্রিকা এবং ছোটকাগজে সাহিত্যের অন্যান্য শাখার মতোই অণুগল্প স্বতন্ত্র শাখা হিসেবেই বিভাগ করে নিচ্ছে; তখনও কেউ কেউ একটি প্রশ্ন তুলে একটা উদ্ভট পরিস্থিতির অবতারণা করে চলেছেন। তাদের প্রশ্নের মধ্যে একটি প্রশ্ন প্রধান হয়ে যাচ্ছে। প্রশ্নটি হল—
অণুগল্প নতুন কিছু না। এর নানা প্রকাশ অনেক আগেই ঘটেছে। রবীন্দ্রনাথের ‘লিপিকা’ একটি অণুগল্পের বই। বনফুল প্রচুর অণুগল্প লিখেছেন। কেউ কেউ বনফুলকে অণুগল্পের ‘জনক’ বলেও একধাপ এগিয়ে কথা বলেছেন। তাছাড়া ৬০ দশকে গল্পের জগতে একটি নতুন ধারা সূচিত হয়েছিল ‘চোঙ্গা গল্প’— কেউ কেউ তাকেও অণুগল্পের ছায়াশরীর মনে করে থাকেন। এছাড়াও ৯০ দশকে ‘যায় যায় দিন’ একটি ভালবাসার সংখ্যা প্রকাশ করত ‘মৌচাকে ঢিল’ নামে। অণুগল্পের ইঙ্গিত হিসেবে সেটিকেও অনেকে মনে করে থাকেন। এইসব বিষয়কে সামনে রেখে এই নিবন্ধটি লিখিত হল। এই লেখাটির মাধ্যমে আমরা চেষ্টা করব বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে প্রকৃতই কি অণুগল্পের অস্তিত্ব ছিল কি না তা দেখার। আলোচনা করা যাক…।
‘ছোটগল্প বিশেষভাবে একালের সৃষ্টি। তাই গল্পের সাথে তার একটি বিশেষ পার্থক্য আছে। এ একটি বিশেষ ‘রূপসৃষ্টি’। শুধু কাহিনি নয়, শুধু আখ্যান রচনা নয়, শধু চরিত্র সৃষ্টিও নয়। এ এক বিশিষ্ট সাহিত্যরূপ।’
গল্প থেকে ছোটগল্পকে এইভাবেই দেখা হয়েছিল জন্ম মুহূর্তে এবং এর পরবর্তীকালে। ছোটগল্পের জন্ম ঐতিহাসিক, কার্যকারণভিত্তিক এবং সুসংবদ্ধ নীতিমালাসমৃদ্ধ। অন্যদিকে গল্প তো গল্পই। গল্পের কোনও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট নেই। নির্দিষ্ট গন্তব্য এবং গতিধারা নেই। কাঠামো অবয়বের ধার ধারে না গল্প। গল্প মুক্ত, স্বাধীন। বাঁধনহারা। গল্পের উৎস কল্পনা। যখন থেকে মানুষ কল্পনা করতে শিখেছে গল্পের জন্ম সেই মুহূর্ত থেকেই হয়েছে। কল্পনা প্রাচীন তাই গল্পও প্রাচীন।
‘কল্পনার আদিমতাই প্রাচীনতার লক্ষণ’
প্রাচীনতার এই লক্ষণসূত্র ধরেই আমরা পাই রূপকথা। রাজা রাণী, রাক্ষস খোক্ষস, ব্যাঙ্গমা ব্যাঙ্গমী, সোনার কাঠি, রূপার কাঠি, ডালিম কুমার, নীল কমল এইসব চরিত্র বা পাত্রমিত্রদের নিয়ে রূপকথার গল্প মুখে মুখে ফিরেছে। জিন পরী, দেওদানো কিংবা মায়া পাহাড়, প্রাণভোমরা সুয়োরাণী দুয়োরাণীর গল্পের বিস্তার ঘটাত সে কালের মানুষেরা। ‘এই রকম পৃথিবীর প্রাচীনতম কাহিনী বলা হচ্ছে মিশরীয় লেখক ‘আন্নানা’র একটি লেখাকে।’
ঠিক রূপকথা নয়, গ্রামবাংলার ঘরে ঘরে আরেক শ্রেণীর গল্পের দেখা মিলত। একেবারে মাটির গল্প। লোকজ গল্প। স্বভাবকবিরা এই কাহিনিগুলি সংগ্রহ করতেন বা লিখতেন ছন্দে। এই ধরণের গল্পগুলিই পূর্ববঙ্গ গীতিকা বলে অধিক পরিচিত। এই গল্প কাহিনির মধ্যে মধুমালা, মদন কুমার, কাজলরেখা, বেহুলা লখিন্দর, মলুয়া উল্লেখ করা যায়। অবশ্য উল্লেখ করার মতো আরও অনেক কাহিনি আছে।
এইসব গল্পগুলি রূপকথা সৃষ্টির অনেক পরে জন্ম নিয়েছে। বলে রাখা ভাল, কোনও পুরাণ বা ধর্মীয় কাহিনি এইগুলিতে স্থান পায়নি।
ধর্মীয় গল্প বা আখ্যান কাব্য আমরা পাই রামায়ণ মহাভারতে। পাই মঙ্গলকাব্যেও। এই কাব্যে ঘটনা বা চরিত্রসৃষ্টি— যা গল্প উপন্যাসের মূল অবলম্বন— প্রবল।
বাংলা গদ্যের বিকাশ ত্বরান্বিত হওয়ার পেছনে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখে ছাপাখানার আত্মপ্রকাশ। এটা অষ্টাদশ শতকের ঘটনা। ছাপাখানার উদ্ভবে বাংলায় প্রচুর পরিমানে পত্রপত্রিকার প্রকাশের ছড়াছড়ি ঘটে। আর বাংলা গদ্যের বিকাশ প্রসারের ক্ষেত্রে ঘটে যায় বিপ্লব।
জন্ম হল উপন্যাসের।
একদিকে দীর্ঘ উপন্যাস, অন্যদিকে এল ছোট ছোট উপন্যাসও। ছোট উপন্যাসগুলিকে বলা হল ইংরেজিতে— নভেলা। তবে উপন্যাস বা নভেলার আগে আরও কিছুটা গুরুত্বপূর্ণ সময় গেছে। এই সময়ে আমরা পেতে শুরু করলাম পত্রিকার কল্যাণে টুকরো টুকরো কাহিনি। এদের বলা যেতে পারে চূর্ণক।
চূর্ণকের বৈশিষ্ট্যটি অসাধারণ। চূর্ণক নিয়ে ভাবার আছে অনেক কিছু। চূর্ণক গল্পগুলি এমন এক সময়ে সংবাদপত্রে প্রকাশিত হতে লাগল যখন— যা বলছিলাম— এর সময়টাই গুরুত্বপূর্ণ। তাছাড়া চূর্ণকের যে রীতিবৈশিষ্ট্য, সেটাও অনেক কৌতূহলের সৃষ্টি করে।
‘একটি ছোট ঘটনা, কিংবা অতি ছোট কথা যেন হঠাত জ্বলে ওঠে। স্ফুলিং জ্বলে, সঙ্গে সঙ্গে আবার নিভে যায়। আগাগোড়া নিটোল এবং পূর্বকল্পিত। যেন শেষটা আগে ভেবে প্রথমটা তৈরি করা হয়েছে।’
দেখে শুনে মনে হয়— সাহিত্যের একেবারে নবীনতর শাখা ‘অণুগল্প’ এই চূর্ণকেরই বংশলতিকার সর্বশেষ প্রজন্ম।
চূর্ণক হল অণুগল্পের আদি মাতা।
চুর্ণকের অনেক বৈশিষ্ট্যের মধ্যে একটি হল এটি কোনও ব্যক্তি বিশেষের রচনা নয়। অর্থাৎ এইগুলি মানুষের মুখে মুখে রচিত হয়ে আসছিল। সমাজের নানা সঙ্কট নৈরাজ্য অসঙ্গতিকে মানুষ তার কল্পনায় মিশ্রণ করে মুখে মুখে বইয়ে নিয়ে এসেছিল যুগ যুগ ধরে।
আধুনিক অণুগল্পের মতোই এর নিঃশ্বাসবায়ু। ‘উপমান স্ফুলিঙ্গ যার পাখায় ক্ষণকালের ছন্দ; উড়ে গিয়ে ফুরিয়ে যাবার মধ্যেই তার আনন্দ।’
চুর্ণকের পরে সাহিত্যে এল আখ্যানক। আধুনিক ছোটগল্প এবং আধুনিক অণুগল্পের ধারাবাহিক আগমনের বন্ধুর পথে এই আখ্যানক বিশেষ জংশন হিসেবে কাজ করেছে। আখ্যানকের আদি উৎস পঞ্চতন্ত্র, হিতোপদেশ, গুণাঢ্য-এর ‘বৃহৎকথা’ ক্ষেমেন্দ্র-এর ‘বৃহৎ কথা মঞ্জরী’ সোমদেবের ‘কথা সরিতসাগর’, তোতা ইতিহাস, বত্রিশ সিংহাসন, বেতাল পঞ্চবিংশতি। কিংবা ইংরেজী বাইবেল এই আখ্যানকের পর্যায়ভুক্ত।
উল্লেখ্য, পুস্তকাকারে বা সংবাদপত্রের মাধ্যমেই এই আখ্যানকগুলি আমরা পাই। ভারতীয় গল্পসম্ভার, সংস্কৃত গল্পসম্ভার, ইংরেজী থেকে অনুদিত গল্পসম্ভার ছাড়াও আরেক শ্রেণির আখ্যানক আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়। সেটি হল আবহমান বাংলার লোকপ্রচলিত গল্পের সম্ভার। ‘এই গল্পগুলির অনেকগুলিই নিতান্ত চূর্ণক অর্থাৎ খুবই অল্প কথায় একটি ঘটনা, দেশলাই কাঠির আলোর মতো কিছুক্ষণ জ্বলেই নিভে যায়।’
দেশীয় চূর্ণকের সেরা উদাহরণ ১৮০৩ সালে প্রকাশিত তারিণীচরণ মিত্র সম্পাদিত ‘ইশপের গল্প’।
এই নিবন্ধের শেষে কয়েকটি চূর্ণকের উদাহরণ দেওয়া হল।
চূর্ণক-আখ্যানকের পর আসল এক নতুন জিনিস। বাঙালি জীবনযাত্রার চিত্র এবং চরিত্র-সংলাপ সংবলিত অন্যরকমের কাঠামো নিয়ে তা সংবাদপত্রে প্রকাশ হতে লাগল। এর নাম— নক্সা।
‘নক্সা কাহিনির কাঠামো মাত্র, তার মধ্যে কাহিনির আভাস আছে। কিন্তু পূর্ণতা নেই। সাহিত্যিক নক্সামাত্রেই প্রধানত দুটি শ্রেণির, একটি চরিত্র নক্সা, আর একটি ঘটনার নক্সা। নক্সাগুলি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হলে-হতে-পারত গল্প।’
১৮৬২ সালে প্রকাশিত হয় একটি নক্সা। এ যাবত কাল লিখিত সেরা নক্সা। নক্সার চরমপরিণতি। নাম— হুতুম প্যাঁচার নক্সা।
মজার বিষয় হল— এই গ্রন্থেও অনেক চূর্ণক আছে। যেমন—
এক বাবু তার জন্মদিনে বন্ধুদের নিমন্ত্রণ করেছেন। কিন্তু সেদিন বর্ষার জন্য কোথাও মাছ পাওয়া যাচ্ছে না। বাবু বহু জায়গায় লোক পাঠিয়েও কিছুতেই মাছ সংগ্রহ করতে পারলেন না। শেষে এক জেলে বিরাট রুই নিয়ে হাজির। বাবু খুশি হয়ে যে কোনও দাম দিতে প্রস্তুত হলেন। কিন্তু জেলে বলল— আমি চাই কুড়ি ঘা জুতো। বাবু ভাবলেন বুঝি বাদলার দিনে একটু মদ খেয়েছে। কিন্তু সে কিছুতেই দাম নিতে রাজি হল না। তার চাই বিশ জুতো। বাবু আর কী করেন, বাধ্য হয়ে রাজি হলেন। তার পিঠে দশ ঘা জুতো পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই সে বলল— থামুন। আমার একজন অংশীদার আছে। তার পিঠে বাকি দশ ঘা পড়বে। সে হল বাবুর বাড়ির দারোয়ান। সে জেলেকে কিছুতেই ঘরে ঢুকতে দিচ্ছিল না। শেষে বলেছে— যদি তোমার দামের অর্ধেক দাও তবেই ঢুকতে দেব। জেলে রাজি হয়েছে। তাই বিশ ঘা জুতো দাম নিয়েছে।
এইভাবেই দেখা যায় আধুনিক অণুগল্পের আদিরূপের সন্ধান পাওয়া যাবে এইসব চূর্ণক-আখ্যানক-নক্সার রন্ধ্রে রন্ধ্রে। প্রকৃত অর্থে, এক শিল্প আরেক শিল্পের জন্মদাত্রী। এক শিল্পের আকার প্রকৃতি আরেক শিল্পের পেটে জন্মলাভ করে। কোনও শিল্প বা শিল্পরীতিই স্বয়ম্ভু নয়।
অণুগল্পও তেমনি। এর জন্ম রহস্য নিহিত আছে অন্য কোথাও। এর লক্ষণরেখা দেখা যাবে পূর্ববর্তী শিল্পের হৃদ কমলের জলে।
এর পরের স্তরটি হল নভেলা। নভেলা হল ছোট উপন্যাস। অণুগল্পের ভিত্তি তৈরিতে নভেলার কী প্রয়োজন— সেটি বিবেচ্য। নভেলা-উপন্যাস-পরবর্তী ছোটগল্পের স্রোতের ফলায় নৃত্য করতে করতে এসে শিল্পের সমতটে পৌছায় আধুনিক অণুগল্প।
আপাতত লিপিকা-র বিষয়টি দেখে আলোচনা এখনকার মতো শেষ করা যাক।
লিপিকাসংক্রান্ত বিভ্রান্তি
একদিন খেতে বসে গদ্য কবিতার কথা তুলতেই মৈত্রেয়ী দেবী বললেন— গদ্য কবিতা আমার ভালো লাগে না।
এই কথার উত্তরে রবীন্দ্রনাথ ভালো না লাগার দুটি কারণ উল্লেখ করলেন। যেমন—
১। গদ্য কবিতায় অভ্যস্ত না হওয়া,
২। সস্তা মিলের মোহতে আক্রান্ত হওয়া।
মৈত্রেয়ী দেবী বাঁধ সাধলেন। পালটা যুক্তি দিলেন— ‘বলাকা’ কবিতার মিল সস্তা নয়। ছবি কবিতার মিল নিশ্চয়ই কবিতাকে নষ্ট করেনি। ক্ষতি করেনি।
রবীন্দ্রনাথ এই প্রশ্নের যে উত্তর দিলেন, সেটি গুরুত্বপূর্ণ।
বললেন— দুটোর মধ্যে তুলনা চলে না। দুটোয় দু’রকম রস; তুমি যদি গদ্যের সঙ্গে কবিতার তুলনা করো সেরকমই হবে। ‘লিপিকা’ তোমার কেমন লাগে?
মৈত্রেয়ী দেবী এই প্রশ্নের উত্তরে বললেন— খুব ভালো!
রবীন্দ্রনাথ বললেন— কেন? সে তো বিশুদ্ধ গদ্যকবিতা। লেখাটা গদ্যের ছাঁদে [মানে পদ্যের পর্বে সাজানো নয়], এই তো তফাত।
এই আলাপটি হয়েছিল মংপু-তে।
এই আলাপচারিতায় এই কথাই ফুটে উঠেছে ‘লিপিকা’ একটি কাব্যগ্রন্থ। যারা বলেন লিপিকা একটি গদ্য গ্রন্থ এবং বর্তমান অণুগল্পের সাদৃশ্যমূলক আশা করছি সবার ভুল ভেঙেছে।
লিপিকা আসলে একটি নিরীক্ষামূলক গ্রন্থ। এটি ছিল গদ্যকবিতায় ফিরে যাওয়ার একটি পদক্ষেপ।
একটি উদাহরণ–
এই তো পায়ে চলার পথ।
এসেছে বনের মধ্যে দিয়ে মাঠে, মাঠের মধ্যে দিয়ে নদীর ধারে, খেয়াঘাটের পাশে বটগাছতলায়। তার পরে ও পারের ভাঙা ঘাট থেকে বেঁকে চলে গেছে গ্রামের মধ্যে; তার পরে তিসির খেতের ধার দিয়ে, আমবাগানের ছায়া দিয়ে, পদ্মদিঘির পাড় দিয়ে, রথতলার পাশ দিয়ে কোন্ গাঁয়ে গিয়ে পৌঁছেছে জানি নে।
এই পথে কত মানুষ কেউ-বা আমার পাশ দিয়ে চলে গেছে, কেউ-বা সঙ্গ নিয়েছে, কাউকে-বা দূর থেকে দেখা গেল; কারও-বা ঘোমটা আছে, কারও-বা নেই; কেউ-বা জল ভরতে চলেছে, কেউ-বা জল নিয়ে ফিরে এল।
—-
এখন দিন গিয়েছে, অন্ধকার হয়ে আসে।
একদিন এই পথকে মনে হয়েছিল আমারই পথ একান্তই আমার; এখন দেখছি, কেবল একটিবার মাত্র এই পথ দিয়ে চলার হুকুম নিয়ে এসেছি, আর নয়।
নেবুতলা উজিয়ে সেই পুকুরপাড়, দ্বাদশ দেউলের ঘাট, নদীর চর, গোয়ালবাড়ি, ধানের গোলা পেরিয়ে— সেই চেনা চাউনি, চেনা কথা, চেনা মুখের মহলে আর একটিবারও ফিরে গিয়ে বলা হবে না, “এই যে!” এ পধ যে চলার পথ, ফেরার পথ নয়।
আজ ধূসর সন্ধ্যায় একবার পিছন ফিরে তাকালুম; দেখলুম, এই পথটি বহুবিস্মৃত পদচিহ্নের পদাবলী, ভৈরবীর সুরে বাঁধা।
যত কাল যত পথিক চলে গেছে তাদের জীবনের সমস্ত কথাকেই এই পথ আপনার একটিমাত্র ধূলিরেখায় সংক্ষিপ্ত করে এঁকেছে; সেই একটি রেখা চলেছে সূর্যোদয়ের দিক থেকে সূর্যাস্তের দিকে, এক সোনার সিংহদ্বার থেকে আর-এক সোনার সিংহদ্বারে।
অবশ্য এই গদ্যকবিতাগুলি কবিতার রীতি অনুযায়ী ভাঙাপঙক্তিতে সাজানো নেই কেন? এই প্রশ্ন করলে গুরুদেব উত্তর দিলেন— বোধকরি ভীরুতাই তার কারণ।
সুতরাং আধুনিক অণুগল্পের নেপথ্য ভিত্তিভূমি হিসেবে লিপিকাকে যেভাবে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হত, প্রকৃত বিচারে তা দেখা যাচ্ছে না। অণুগল্পের আদিরূপ বলে লিপিকার কোনও ভূমিকা নেই। যদি ধরে নেই অণুগল্পের চিহ্নরূপ লিপিকায় আছে, তবে লিপিকার ঐতিহাসিক ভূমিকাকেই বরং বিকৃত এবং খাটো করা হবে। এত বড় হীন কাজ করার দায়িত্ব আমরা কেন নেব?
বনফুল নিয়ে অজ্ঞতার কালোস্রোত
একথা বলার অপেক্ষা রাখে না বাংলা সাহিত্যে ছোটগল্প শাখায় যারা নতুন ফর্মেটে পাঠক রুচিকে অন্য স্বাদের সাহিত্য রসের সন্ধান দিয়েছেন তাদের মধ্যে বনফুল অন্যতম না হলেও একজন। বনফুল তার দীর্ঘজীবনে প্রচুর ছোটগল্প লিখেছেন।
একথা সত্য যে, বনফুল পাঠকপ্রিয় ছিলেন। তার গল্পের সহজ ভাষা, কাহিনির সারল্য বিশেষ করে একটি বিশেষ গঠনশৈলীর কারণে পাঠকের কাছে নতুন কিছু বলেই মনে হল। ফলে বনফুল আলোচিত হলেন।
বনফুল মোট ৫৮৬টি ছোটগল্প লিখেছেন। এই গল্পগুলি আকারে ছোট/বড় বিভিন্ন আয়তনের। অনেকেই কোথাও ধারণা করে এই কথা বলে থাকেন যে, বনফুলের গল্পের আয়তন ছোট। ছোট, তবে সব গল্পের জন্যে এ কথা যেমন খাটে না, তেমনি খাটে না তার বড়গল্প নেই— এই মন্তব্যে।
পেশায় একজন ফিজিশিয়ান হওয়াতে তার কাছে রোগীদের ভিড় ছিল। বনফুল রোগীদের কেস হিস্ট্রি লিখতেন। ভাবতেন— পরে এটাকে বড় করে গল্পে রূপান্তর করবেন। কিন্তু সেটা ভাবনা পর্যন্তই ছিল— হয়ে উঠত না। পাঠকরা পেতেন অপেক্ষাকৃত স্বল্পায়তনের ছোটগল্প।
একালে, যখন অণুগল্পের কাঠামো তৈরি হচ্ছে, লেখনশৈলীর নিজস্ব ভুবন নির্মাণ হচ্ছে অণুগল্পের, বিভিন্ন উপাদানের সংশ্লিষ্টতায় অই ভুবনের আদ্যোপান্ত নিয়ে আলাপ হচ্ছে। সেই আলাপের ভেতর থেকেই প্রশ্ন তুলছেন কেউ কেউ— অণুগল্প নতুন কিছু নয়। বনফুল অণুগল্প লিখেছেন অনেক আগেই।
অনেকেই, বেশিরভাগ এ প্রশ্নটি এ কারণে করেন যেন অণুগল্পের ভিতটি নড়ে ওঠে, স্তম্ভটি ধ্বসে পড়ে, অনেকেই করেন জানার জন্যে; যদি প্রশ্ন করার ফলে নতুন কিছু তথ্য বের হয়ে এল— সেই ইচ্ছায়। অনেকেই আবার অণুগল্প বিষয়ে অজ্ঞতার কারণেও এমনকি বনফুলকে না জানার কারণেও এই প্রশ্নটি করে থাকেন। অর্থাৎ অজ্ঞতাই হল এই প্রশ্নের জনক।
বিদ্বেষ বা অজ্ঞতাপ্রসূত এই প্রশ্নের উত্তর দিতে হলে যে আলোচনাটি করা দরকার, প্রকৃত অর্থেই সে সুযোগটি নেই আপাতত।
শুধু এ কথাটি এখানে বলা যেতে পারে— বনফুল ৫৮৬টি গল্প লিখেছেন, এর মধ্যে সচেতনভাবে একটি অণুগল্পও লেখেননি। ছোট ছোট ছোটগল্প যেমন অণুগল্প নয়, একইভাবে স্বল্পায়তনের অনেক অণুগল্পও ছোটগল্পের মহিমা নিয়ে আলো ছড়ায় যদিও সেগুলো অণুগল্প নামে সম্বোধিত হয় অহরহ।
ফলে দুই শ্রেণির মধ্যেই আছে অজ্ঞতা নামের কালোস্রোত।
যদি এমন হয়— একবিংশ শতকের সাহিত্যের এই অভূতপুর্ব শাখাটির সাথে বনফুল লিখিত গল্পের সাদৃশ্য আছে, অণুগল্পের ফর্মেটের সমস্ত চাহিদা বনফুল লিখিত গল্পটির মধ্যে বিদ্যমান সে ক্ষেত্রে একথাই বলা যাবে অণুগল্পের সাদৃশ্যমূলক ছোটগল্প বনফুল লিখেছেন। কেননা বনফুল কখনওই অণুগল্প লেখেননি।
পরিশিষ্ট : কয়েকটি চূর্ণক
সংবাদ কৌমুদী [১৮২৩] থেকে
গ্রীক দেশে এক পণ্ডিত অবিরোধে কালযাপন করিতেন। একসময় তিনি আপন মিত্রদিগের সহিত পথ ভ্রমণ করিতেছেন, ইত্যবকাশে এক ব্যক্তি গোঁয়ার আসিয়া তাহাকে পদাঘাত করিল। তাহাতে তিনি কিছুই উত্তর করিলেন না। ইহা দেখিয়া তাহার মিত্ররা কহিল, একি আপনি যে ইহাকে কিছু কহিলেন না। পণ্ডিত কহিলেন যে, যদি কোনও ব্যক্তি গর্ধভের নিকট যায় এবং সে গর্ধভ চাইট মারে তবে কি গর্ধভের নামে কেহ নালিশ করিয়া থাকে!
পঞ্চানন্দ থেকে
বাবু আফিসে যাইবার জন্য সেজেগুজে বাহির হইতেছে, এমন সময়ে দুইজন ইয়ার মদের বোতল সঙ্গে আসিয়া উপস্থিত। বাবুকে অনুরোধ, একটু বসিয়া এক গেলাস খাইয়া আফিসে যান, এখনও তত বেলা হয়নি, তাড়াতাড়ি কেন?
বাবু। না ভাই, এখন খেয়ে গেলে মুখ দে গন্ধ বেরুবে, সকলে টের পাবে।
ইয়ার। হ্যাঁ, টের পাবে, না ঘোড়ার ডিম হবে। নেহাত টের পায় বলবে যে আজকার নয়, কাল রাত্তিরে খেয়েছিলে তারই গন্ধ।
তর্ক অকাট্য। বাবু নিরুত্তর।
সমাচার দর্পন থেকে
অতি নিবিড় অন্ধকার রাত্রিতে এক অন্ধ ব্যক্তি কলসি ঘাড়ে করত মশাল লইয়া যাইতেছিল। পরে এক ব্যক্তি দৌড়িতেই তাহার নিকটস্থ হইয়া মশাল দেখিয়া আশ্চর্যবোধে কহিল যে হে অন্ধ মশালেতে তোমার কি উপকার হইতেছে? তোমার নিকটে দিবা রাত্রি তুল্য।
অন্ধ কহিল যে আমি আপনার নিমিত্ত মশাল ধরি নাই কিন্তু তোমার মতো পাগল ব্যক্তিরা আমাকে ধাক্কা মারিয়া কলসিটা না ভাঙ্গে এ নিমিত্ত।
২
একজন সেনাপতি অতি তুমুল যুদ্ধ সময়ে আপনার মোসাহেবের নিকটে একটিপ নস্য প্রার্থনা করাতে মোসাহেব যে ক্ষণে তাঁহাকে নাসদানি দিলেন সেই ক্ষণেই একটি গোলার বেগেতে তিনি কোথায় উড়িয়া গেলেন। তাহাতে সেনাপতি কিছুমাত্র বিকৃত না হইয়া অন্যদিকে ফিরিয়া আর একজন মোসাহেবকে বলিলেন যে আপনার একটিপ নস্য আমাকে দিতে হইবে। নাসদানিটা ইহার সঙ্গে গিয়াছে।
তথ্যসূত্র
শিশিরকুমার দাশ-এর ‘বাংলা ছোটগল্প’; নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়–এর ‘সাহিত্যে ছোটগল্প’; রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘লিপিকা’; আবদুশ শাকুর-এর ‘মহাগদ্যকবি রবীন্দ্রনাথ’; মৈত্রেয়ী দেবীর ‘মংপুতে রবীন্দ্রনাথ’; সুকুমার সেনের ‘বাংলা সাহিত্যের গদ্য’।
সমাচার দর্পণ হল প্রথম বাংলা সংবাদপত্র। পত্রিকাটি ছিল সাপ্তাহিক। ১৮১৮ খ্রীষ্টাব্দের ২৩ মে তারিখে এটি প্রথম প্রকাশিত হয়।
ছবিঋণ – ইন্টারনেট
অনুগল্প নিয়ে এত বড় প্রবন্ধ? অক্সিমোরন নয় কি? একথা নিশ্চিত করে বলতে পারি যারা অনুগল্প ও শুধুই অনুগল্প পড়তে ভালবাসেন, তারা এই গবেষণামূলক কিন্তু এত প্রাঞ্জল লেখাটা পড়বেন না ও বড় জিনিশ মিস করবেন। বাংলা সাহিত্য ছোট আকারের গল্পের দীর্ঘ ঐতিহ্যের কথা লেখাটা না পড়লে অজানা থেকে যেত অনেক কিছুই।
চমৎকার লেখা। কিন্তু কিছু অতৃপ্তি রয়ে গেল। অণুগল্পের সঠিক সংজ্ঞাটা পেলে ভালো লাগত বিলালভাই। তাহলে আমাদের মতো পাঠকদের জন্য চিহ্নিতকরণের কাজটা সহজ হত…