আইন বা ঈশ্বর, কাউকে ভরসা নেই উত্তরপ্রদেশের এই সন্ন্যাসীর

কিরণ মল্লিক

 

লেখক রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক।

সন্ন্যাসী মানে এমন একজন মানুষ যে কপর্দকহীন। যার জীবনের প্রতি কোনও মোহ নেই, যার বডিগার্ড লাগে না। সন্ন্যাসী মানে এমন একজন যে বিশ্বাস করে যে কেউ অপরাধ করলে ঈশ্বরই তাদের শাস্তি দেন, আবার ভালো কাজ করলে ঈশ্বর তাদের পুরস্কৃত করেন। ভারতে এই মুহূর্তে সংবিধান বা আইনের শাসনের রাশ ক্রমাগত কিছু মুষ্টিমেয় ব্যক্তির হাতে চলে যাচ্ছে। একদিকে সংবিধানের অন্তঃসারকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে নিত্যনতুন আইনের সংস্কার তো চলছেই, অন্যদিকে যেটুকুও বাকি আছে সেটুকুর প্রয়োগেও অসুবিধা হচ্ছে। দিল্লিতে শুধু গুন্ডা নামিয়ে মানুষ নিধনযজ্ঞ চালিয়েও তৃপ্তি আসেনি। গুন্ডাদের সহযোগিতায় বহু স্থানে পুলিশকেও সক্রিয় ভূমিকা নিতে দেখা গেছে। সিএএ নিয়ে প্রতিবাদ করায় সব থেকে বেশি মৃত্যু হয়েছে উত্তরপ্রদেশে। পুলিশকে দিয়ে এত মৃত্যুতেও উত্তরপ্রদেশে সরকার সন্তুষ্ট নয়, তারা হয়তো চাইছে গুন্ডাবাহিনীর সাহায্যে আরও বেশি মানুষের মৃত্যুযজ্ঞে নামতে বা নাগরিকদের আতঙ্কিত করে চুপ করিয়া দিতে। আদিত্যনাথ যোগী এমনই এক সন্ন্যাসী যিনি ঈশ্বরের ক্ষমতার উপর বিন্দুমাত্র আস্থা রাখেন না। যিনি ঈশ্বরের কিছু সন্তানের মুখ রাস্তার মোড়ে টাঙিয়ে দিয়েছেন। সিএএ-বিরোধী আন্দোলন ও ঢিল ছোড়ার অপরাধে নাকি যুক্ত এরা। ঈশ্বরই এদের শাস্তি দেবে বলে অপেক্ষা করেননি তিনি। এমনকি আইনের রাস্তায় হেঁটে তাদের শাস্তি হবে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে সেটুকু ভরসাও তার নেই। তার একমাত্র বিশ্বাস কিছু দলীয় গুন্ডাদের উপর, যারা পোস্টার দেখে নামধাম জেনে পাড়ায় পাড়ায় গিয়ে পড়শিদের তাতিয়ে তুলবে এইসব অপরাধীদের শাস্তি দেওয়ার জন্য। অন্যদিকে সাধারণ মানুষের গোপনীয়তা রক্ষার মৌলিক অধিকার কেড়ে নিচ্ছে আইন আদালতের কলঙ্ক কিছু বিচারপতি। তাই অবিলম্বে ব্যানার প্রত্যাহার করার নির্দেশ না দিয়ে সর্বোচ্চ আদালত মুখে যোগীকে ভর্ৎসনা করলেও, ৩ জনের বেঞ্চে বিষয়টাকে পাঠিয়ে দিয়েছে, যার রায় হবে রবিবার। এই কয়েকদিনের মধ্যে যাতে কিছু গুন্ডা এই মুখগুলোকে শাস্তি দিতে উদ্যত না হয় সেই ব্যাপারে যোগীর পুলিশকে সতর্ক ও তৎপর হতে অবশ্য বলা হয়নি।

সংসদের ক্ষমতা আছে বিচারপতিদের অসাংবিধানিক আচরণ নিয়ে প্রশ্ন তোলার। সংবিধানের ১২৪ নং ধারা সর্বোচ্চ আদালতের বিচারপতিদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষমতা জনপ্রতিনিধিদের দিয়েছে। মৌলিক অধিকার নিয়ে ছিনিমিনি খেলার অধিকার কারও নেই, তা জজসাহেবরা ভুলে যাওয়ার আগে ভারতের জনগণকে তাদের খেয়াল করাতেই হবে। ভারতের অর্থনীতি, শিক্ষানীতি, স্বাস্থ্যনীতি কোনওটাই হয়তো এই মুহূর্তে ভালো চলছে না। এগুলো সব ভেঙে পড়ার সঙ্কেত চারিদিকে নানাভাবে দেখা যাচ্ছে। সামগ্রিকতা বিচার করলে দেখা যাবে ভারতের গণতান্ত্রিক প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মূল ভিত্তি সংবিধান নিজেই এই মুহূর্তে সবথেকে বড় সঙ্কটের সম্মুখীন। অর্থনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য বা সমাজের যে মূল ভিত্তিস্তর সংবিধান সেটা ভেঙে পড়লে সেটা যে কী নিদারুণ ক্যাটাস্ট্রফির দিকে দেশকে নিয়ে যাবে, সেটা অনেকেই এখনও অনুধাবন করতে পারছেন না। সিএএ-বিরোধী যে আন্দোলন গোটা দেশজুড়ে ছড়াচ্ছে সেটা আসলে সংবিধান বাঁচানোর লড়াই। যেকোনও একটা ইস্যু থেকেই এই লড়াই শুরু হতে পারে। কিছু মুষ্টিমেয় গোষ্ঠীর মানুষ এই লড়াই শুরু করতেই পারেন। কিন্তু সংবিধান বাঁচানোর এই লড়াইটা শুধু একটি অন্যায় আইনের বিরোধিতার লড়াইয়ে শেষ হবে না। লড়াইয়ের যোদ্ধা মুষ্টিমেয় কিছু গোষ্ঠীর মানুষ হলেও চলবে না। এ লড়াই শুধু মুসলিম বা শুধু আস্তিক অথবা নাস্তিকদের লড়াই নয়। এই লড়াই মুসলিম, হিন্দু, খ্রিস্টান, জৈন, বৌদ্ধ, পার্সী, নাস্তিক, অজ্ঞেয়বাদী সকলের লড়াই। তাই এই লড়াইয়ে আন্দোলনকারীদের প্রাইভেসি নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট কী রায় দেয়, তার হাতে ছেড়ে রাখা যাবে না।

সিএএ বিরোধী আন্দোলনকারীদের নেতৃত্বকে যে কথাটা মাথায় রাখতে হবে তা হল, এই লড়াই মুসলিমদের বাঁচানোর জন্য নয়, সংবিধানকে বাঁচানোর জন্য। সংবিধান বাঁচাতে একা মুসলিমরা পারবে না। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ অর্থাৎ হিন্দুরা ছাড়া কিছুই হবে না। এত অবধি বলার পরেই কিছু নেতা হয়তো বলবেন, হ্যাঁ এই লড়াই দেশের নাগরিকরা লড়বে, ধর্মনির্বিশেষে। এ এক বিচিত্র স্ববিরোধ! মুসলিম সমাজ যখন কাতারে কাতারে নেমেছে, তারা ধর্মীয় পরিচয় নিয়েই নামবেন, অথচ যখনই হিন্দুদের সঙ্গে জোট বাঁধার প্রশ্ন আসছে তখনই ‘নাগরিক’!! ক্যা বিরোধী এই লড়াইয়ে ‘ইনশাহ আল্লাহ’-র স্লোগান থাকবে তেমনই থাকতে পারে ‘জয় শ্রী রাম’ বা ‘রাম রাম’ স্লোগান। অর্থাৎ ‘ইনশাহ আল্লাহ-মোদি মুর্দাবাদ’ যেমন থাকবে তেমনই আমাদের চাই ‘জয় শ্রী রাম-মোদি মুর্দাবাদ’ এই স্লোগানও। দেশের বর্তমান পরিস্থিতি যা, তাতে শুধু মুসলিম বা শুধু নাস্তিক বামপন্থীদের হাতে সমস্ত দায় ছেড়ে দেওয়া যাবে না। গণতন্ত্রপ্রিয় সকল সাধারণ মানুষকে এই লড়াইয়ে সামিল করতে হবে। তাতে কিছু হিন্দু ধার্মিক যেমন থাকবেন, বিভিন্ন সামাজিক কারণে কম বেশি মুসলিমবিদ্বেষ মনের মধ্যে রাখা হিন্দুকেও সামিল করতে হবে। সাত্ত্বিক হিন্দু হয়ে অনেকেই, একটু হলেও মুসলিমবিদ্বেষী। আমাদের কাজ সেই মুসলিমবিদ্বেষকে আগে কাটানো নাকি হিন্দু পরিচয় বহনকারী একজনকে সংবিধান রক্ষার লড়াইতে নামানো? নেতাদের বুঝতে হবে যে মুসলিম নিধনের জন্য সিএএ-র মত আইনের দরকার নেই। দিল্লিতে মাত্র কয়েকটা সিটে জিতেই বিজেপি দাঙ্গা করতে পেরেছে, কয়েকশো মুসলিমকে গৃহহীন করতে পেরেছে। এই সিএএ আসলে এমন এক অ্যাজেন্ডা যা দিয়ে হিন্দু মুসলিম ঐক্যকে সম্পূর্ণ ভেঙে দেওয়া যায়, স্পষ্ট সমীকরণ তৈরি করা যায়। সেই পথে আমরা হাঁটলে তা মোদিদের পাতা ফাঁদেই পা দেওয়া হবে। মুসলিম ধর্মীয় পরিচয়কে জাহির করা একজন মুসলিমের জন্মগত অধিকার হতেই পারে, কিন্তু সেই জন্মগত অধিকারকে পালন করার জন্য সবাই এই আন্দোলনে অংশ নেননি। এমন কিছু করার কথা নয় যাতে একজন মুসলিমবিদ্বেষী হিন্দুরও মোদি-বিরোধী সিএএ-বিরোধী আন্দোলনে নামতে অসুবিধা না হয়। ২০২১ আর ২০২৪ সালে বিজেপিকে যাদের হারানোটাই লক্ষ্য, সেখান থেকে যে কোনও অজুহাতেই তাদের সরে আসা যাবে না। ‘ভোটে কে জিতবে আমাদের মাথাব্যথা নয়’, ‘আপ জিতলেও দাঙ্গা হয়’ জাতীয় অপযুক্তি যেন আমাদের বোধকে সংক্রমিত না করে। সংবিধান রক্ষার লড়াই শুধু আর্টিকেল ২১-কে বাঁচানোর লড়াই নয়। এখন প্রতি মুহূর্তে সংবিধানের নানা ধারাই ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে। রাইট টু লাইভ ও রাইট টু প্রাইভেসির লড়াইকে বিস্তারিত করে সমগ্র সংবিধানকে বাঁচানোর লড়াই এই মুহূর্তে সমাজে চলছে। এই লড়াইয়ের হাত শক্ত করার দায়িত্ব আমাদের সবার।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4880 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...