বানানভুলের আমন্ত্রণ

পবিত্র সরকার

 





লেখক বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও গবেষক।

 

 

 

সকলেই জানেন, এই লেখক বানান বিষয়ে একটি অসুস্থ ও প্রায় বিকারগ্রস্ত আগ্রহ পোষণ করে, তাই এ লেখা নিয়ে বিতর্ক হতেই পারে। আর যে কোনও মতের বিপরীত মত একটা হতেই পারে, যেমন আমি একটি সিদ্ধান্তের বিপরীত মত এখানে পেশ করছি। কোন্‌ সিদ্ধান্ত? না সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গে উচ্চমাধ্যমিক সংসদ পরীক্ষকদের মাধ্যমিক পরীক্ষার খাতায় বানানভুলের নম্বর কাটা সম্বন্ধে যে নির্দেশ দিয়েছেন, সেইটি। তাঁরা বলেছেন, সাহিত্যের পেপারগুলিতে বানানভুলের জন্য নম্বর কাটার নির্দেশ যেমন আছে তেমনই থাকবে, কিন্তু সাহিত্য ভিন্ন অন্যান্য বিষয়ে— ইতিহাস, অঙ্ক, পদার্থবিজ্ঞান (রসায়ন তারই অংশ), জীববিজ্ঞান, ভূগোল ইত্যাদিতে বানানভুল হলে যেন নম্বর না কাটা হয়। এই নির্দেশ, আমার মতে যথেষ্ট বিবেচনাপ্রসূত নয়।

আমি জানি যে, চিন্তা আর ভাষা সমান পদক্ষেপে এগোয় না। আমি একটা বিষয়কে বুঝলাম, কিন্তু তাকে প্রকাশ করার সামর্থ্য আমার নানা পর্যায়ে থাকতে পারে। যদিও আমার বিষয়টা বুঝে ওঠার পিছনেও আমার ব্যবহৃত ভাষার একটা ভূমিকা আছে, অর্থাৎ মনে মনে আমি ভাষা দিয়েই বুঝি। সে ভাষা উচ্চারণ করি বা না করি, লিখে উঠতে পারি বা না পারি, আমার বুঝে ফেলার ব্যাপারটা ভাষাতে আশ্রিত, আমি মনে মনে এই বোঝাটাকে যে উলটে-পালটে দেখব তাও মূলত ভাষারই সাহায্যে। যে ভাষায় আমি শিখি, তারই সাহায্যে।

এখন স্কুলে আমরা ভাষা শিখি দু-ভাবে। এক শিখি আমার নিজের ভাষা, অর্থাৎ নিজের ভাষার যেটা প্রমিত বা স্ট্যান্ডার্ড রূপ সেইটা, কারণ সেটাই আমার শিক্ষার ভাষা। যখন অন্য ভাষার মধ্য দিয়ে শিখি, তখনও শিখি সেই ভাষার প্রমিত রূপ। এই প্রমিত রূপের দুটো চেহারা। একটা তার উচ্চারণের দিক, আর-একটা তার লিখিত রূপ।  স্কুলে বাংলার ক্ষেত্রে প্রমিত উচ্চারণ কতটা শেখানো হয় জানি না, কিন্তু তার লিখিত রূপটি খুব গুরুত্ব দিয়েই শেখানো হয়, কারণ এটাই ধরে নেওয়া হয় যে, সে এই ভাষার মাধ্যমে শুধু ভাষাটা বা ভাষায় লিখিত সাহিত্য শিখবে না, সে সমস্ত জরুরি বিষয় শিখবে, যে বিষয়গুলি তার শেখার জন্য সিলেবাসে রাখা হয়েছে। সে শুধু শিখবে না, ওই ভাষায় সে তার শিক্ষাকে প্রকাশ করবে, যার হিসেব করার একটা উপায় হল পরীক্ষা। অর্থাৎ পরীক্ষার উত্তর সে যে ভাষায় বিষয়গুলি শিখছে, সেই ভাষায় লিখবে। পরে সারা জীবন সে ব্যবহার করবে সেই ভাষা, যথাসম্ভব বানান জেনে নিয়ে।

এখন লেখার একটা অন্যতম শর্ত হল বানান, এই বানান-শিক্ষা লিখিত ভাষাশিক্ষারই অঙ্গ। পৃথিবীতে বর্ণমালায় লেখা হয় এমন ভাষা খুব কম আছে, ইতালীয় আর চেক হয়তো প্রায়-ব্যতিক্রম, যাতে বানান শিখতে হয় না, উচ্চারণ অনুযায়ী লিখে দিলেই চলে। অন্যান্য স্কুলে ভাষা শিক্ষা— সাহিত্যের হোক, অন্য বিষয়ের মাধ্যম হিসেবে হোক— বানান-শিক্ষাকে একটা শর্ত বলেই ধরে নেয়। তুমি লেখার ভাষাটা কতদূর জান, তার একটা অঙ্গী প্রশ্ন হল তুমি বানান কীরকম জান। বানান একটা চ্যালেঞ্জ, ইংরেজি, ফরাসি ভাষার বানান বেশ বড় চ্যালেঞ্জ, কিন্তু ওই চ্যালেঞ্জ যারা লিখতে শেখে তাদের সবাইকে নিতে হয়।

আমি জানি যে, ইদানীং শুধু ভাষা আর সাহিত্যে নয়, অন্য বিষয়েও টানা লেখার গুরুত্ব কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। কেন হয়েছে, কে জানে? এমসিকিউ প্রশ্নে টিক মারা, আর এক শব্দের বা এক লাইনের উত্তর লেখার মধ্যে ভাষার কোনও চ্যালেঞ্জ নেই, আর যে জ্ঞান চাওয়া হয় তা information বা তথ্যের জ্ঞান, তার বেশি কিছু নয়। এ ভাবে ছেলেমেয়েরা হয়তো অনেক বেশি নম্বর পায়, কিন্তু কতটা বিষয় ‘শেখে’ তা আমাদের মতো প্রাচীনপন্থীদের কাছে সন্দেহের বিষয়। আর বেশি নম্বর পেলেই কি বেশি লাভ হবে? সবাই তো বেশি নম্বর পাবে, তখন প্রতিযোগিতায় কার সুযোগ বেশি হবে? যে ক্ষমতাশালীর সুপারিশ নিয়ে এসেছে তার?

বানান থেকে অন্য কথায় চলে যাচ্ছি। ছেলেমেয়েদের বানান জানা শুধু ভাষা আর সাহিত্যের জন্য জরুরি নয়, অন্য বিষয়ের জন্যও জরুরি। অন্য বিষয়গুলিতে প্রচুর পরিভাষা থাকে, সেগুলির বানান কি ভুল লিখলেও চলবে? ‘পাতন’-এ মূর্ধন্য ণ দিলাম, আর ‘পারমাণবিক’-এ দন্ত্য ন? ‘সালোক-সংশ্লেষ’-এ ঢালাও তালব্য শ বা দন্ত্য স চালালাম? আমার তো মনে হয়, বিষয়ের খাতায় বানানের এই উদার শিথিলতার নীতি ছেলেমেয়ের ভাষা-সাহিত্যের বানানকেও প্রভবিত করবে। ছেলেমেয়েরা যদি দাবি করে, ভাষা-সাহিত্য কী দোষ করল, তাদের ক্ষেত্রেও বানান নিয়ে কড়াকড়ি তুলে দিন স্যাররা।

মনে হয় বাংলার ক্ষেত্রে এটা আমরা সম্ভাবনা হিসেবে ভাবতে পারি। কিন্তু ইংরেজির ক্ষেত্রে? এ কী সর্বনেশে কথা!

 

যাই হোক, উচ্চমাধ্যমিক সংসদ এখন শুনছি উপরের নির্দেশ সংশোধন করে নতুন একটি নির্দেশ দিয়েছেন। তা এই যে, বানানের ‘হেরফের’ ঘটলে যেন নম্বর কাটা না হয়। বানানের ‘হেরফের’ কথাটা যথেষ্ট পরিষ্কার নয়। আসল কথাটা হল, নানা সময়ের বানান-সংস্কারের ফলে ‘ভুল’ বানানটা শুধু তৎসম বা সংস্কৃত শব্দের ক্ষেত্রেই সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করা যেতে পারে। অবশ্য অনেক সংস্কৃত শব্দেরও দু-রকমের ‘শুদ্ধ’ বানান আছে, যেমন অবনি-অব‎‎নী, কিশলয়-কিসলয়, ঊষা-উষা, পরিবেশন-পরিবেষণ ইত্যাদি।

আর বাংলারও অন্য শব্দগুলির ক্ষেত্রে এই অবস্থা। একাধিক শুদ্ধ বানান— একটা পুরোনো, আর-একটা নতুন, যেমন বাড়ী-বা‏‏‏‏ড়ি, মাসী-মাসি, মাস্টার-মাষ্টার ইত্যাদি।

এবার শিক্ষকদের দায়িত্ব হল, সংস্কৃতের হোক, বাংলার হোক— শুধু ‘ভুল’ বানান নয়, ‘শুদ্ধ’ বানানের যে একাধিক চেহারা আছে তা মনে রাখা। কজন শিক্ষক সেটা খেয়াল করতে পারবেন, সেটা একটা উদ্বেগের কথা। পর্ষৎ বা সংসদ দুয়েরই উচিত মাঝে মাঝে শিক্ষকদের বানান বিষয়ে কর্মশালা করা। বাজারে প্রাপ্ত বানান অভিধান থেকে বাংলা বানানের নীতিগুলির সঙ্গে তাদের পরিচয় করানো, অভিধান ব্যবহারে অভ্যস্ত করে তোলা।

 

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4885 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...