সুজন ভট্টাচার্য
লেখক প্রাবন্ধিক, ঔপন্যাসিক, অনুবাদক ও কবি।
আজকাল কথা বলতে খুব ভয় হয়। ক্ষণিকের উত্তেজনার বাষ্প বের করে দিয়ে ফের গৃহকোণের সুরম্য প্রতিরক্ষায় লুকিয়ে পড়ার অভ্যাসটা এখনও আয়ত্ত করতে পারিনি। রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বিষয়ে যারা আমার শব্দের বিরুদ্ধতা করতে পারেন, তাদের চেহারার আদলটা জানি। এবং এটাও জানি, আমার শব্দের অসত্যতা কিংবা অপ্রযুক্ততা প্রমাণের ক্ষেত্রে তারা বালখিল্য। হ্যাঁ, কিছু ব্যক্তিগত গালিগালাজ আসে। কিন্তু সেটা ধর্তব্যের মধ্যে নয়।
সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রশ্নে কিন্তু সেই অবসর নেই। এখানে খাপ-পঞ্চায়েত বসানোর বহর অনেক বেশি। এবং যে আক্রমণ সাধারণত আসে, তার মধ্যে যেহেতু বানিয়ে তোলা বিদ্বেষ এবং নিজেকে জাহির করার প্রবণতাই থাকে মূল বিষয়, তাই প্রকাশের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রায়শই থাকে না। তাই এইসব বিষয়ে মুখ খুলতে একটু দ্বিধাই হয়। তবু সংকোচ কাটিয়ে দু-চারটে কথা বলতে বাধ্য হচ্ছি।
না, রোদ্দুর রায়ের কোনও প্যাচাল আমি কোনওদিন শুনিনি। নামটা ফেসবুকেই শুনেছি। শোনার বা আলোচনার উৎসাহ হয়নি। বেচারা খ্যাতির কৃমিরোগে আক্রান্ত। রাস্তায় বে-হেড মাতাল কিংবা উলঙ্গ উন্মাদকে এড়িয়ে চলতেই আমি অভ্যস্ত। সবার সঙ্গে আলোচনা করা যায়। বাদ শুধু মগজহীন এবং বদমায়েশ। রোদ্দুর দুটিরই তুল্য মিশ্রণ। ফলে কিছু বলার প্রশ্নই ওঠে না। সে বেচারা আবার সামনে চলে এল রবীন্দ্রভারতী কিস্যার হাত ধরে। ঘটনাটা সবাই জানেন। ছবিও অনেকেই তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করেছেন নিশ্চিত। ফলে সে রাস্তা আর মারালাম না।
কিন্তু কতগুলো প্রশ্ন উঠেই আসছে। বেলেল্লাপনার প্রকাশ্যতা এখন একটা সামাজিক ব্যাধি হয়ে উঠেছে। তার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ হল, সেই বেলেল্লাপনাকে প্রত্যক্ষত অথবা ঘুরিয়ে সমর্থন করারও লোকের অভাব হচ্ছে না। কেউ দোহাই পারছেন রাজনৈতিক নেতাদের বেহায়াপনার, কেউ বা অন্যান্য খ্যাতিমানদের। মুশকিল হল, এদের ঘরে যদি সেই বেলেল্লাপনা হানা মারে, এদের ছেলে কিংবা মেয়ে যদি বুকেপিঠে বেলেল্লাপনার এমন স্বাক্ষর নিয়ে ঘরে ফেরে, কী করবেন এরা? নেতাদের গালিগালাজ দিয়ে থেমে যাবেন? আমি কিন্তু ঠাঁটিয়ে থাপ্পড় মারব গালে। কেন বলুন তো?
সামাজিক ব্যাধির সংক্রমণ বিষয়টা কি আমার জানা নেই? আছে, অবশ্যই আছে। কিন্তু সংক্রমণের হাত থেকে বাঁচার জন্য ভ্যাকসিন যে নিতে হয়, সেটাও জানা আছে। সাংস্কৃতিক সংক্রমণের ক্ষেত্রে সেটা আরো বেশি জরুরি।
একটা কথা বলুন তো! যে ছেলেমেয়েগুলো বুকেপিঠে অভব্যতার এমন কলাপ মেলে ধরল, তারা কি বাড়িতে কেমন অভ্যর্থনা পাবে, ভাবেনি? হয়তো নয়। হয়তো ভেবেছিল, বেপাড়ায় মস্তি মারিয়ে নিজের পাড়ায় এসে সাধু সাজবে। সোস্যাল মিডিয়া যে বেসামাল করে দেবে, হয়তো মাথায় আসেনি। আবার এমনটাও খুব অসম্ভব নয় যে ভেবেছিল বাড়িতে এমন হিম্মত কার আছে যে প্রশ্ন করবে! ভাবনাটা খুব অসঙ্গত-ও নয়। বাবামায়ের মাথায় যদি এমন আশঙ্কা থাকে শাসন করতে গেলেই ছেলে বা মেয়ে পাল্টা প্রশ্ন করবে, তোমরা কী করো হে, তাহলে তাদেরও মুখে তালা পড়তে বাধ্য। এবং আজকের মূলগত সমস্যা এটাই।
সামাজিক অপরাধ বিশ্বের সবদেশে সবসময়েই হয়ে থাকে। কিন্তু ইদানিং তার প্লাবন ঘটছে। মোদ্দা কারণ হল ছিঁচকে উপভোগবাদ। প্রযুক্তির উন্নতি হচ্ছে, নিত্যনতুন পণ্যসম্ভার আপনার ঘরের দরজায় টোকা দিচ্ছে। আর আপনি সন্ন্যাসী হয়ে থাকবেন, সে কি হয়! কিন্তু তাই বলে নিজেকে পণ্য করে তুলতে হবে? আপনার শরীরটা না হয় তাজমহলের মতই সুন্দর। তাই বলে তাকে সর্বত্র দেখিয়ে বেড়াতে হবে? সেই সৌন্দর্যকে যদি আপনি মহার্ঘ্য-ই মনে করেন, তাহলে তাকে এমন সস্তা করে দিচ্ছেন কেন? কারণ তো আসলে আপনি শিখে গেছেন, আজকের দিনটাই সব। আগামী বলে কিচ্ছু নেই, ফলে তার দায়-ও নেই।
এই সামাজিক দর্শনই আসল ভাইরাস। আপনি-আমি কোরোনা ভাইরাস নিয়ে চিন্তিত। আর করো-করো ভাইরাস প্রতিমুহূর্তে উশকানি দিচ্ছে। তার হাত থেকে প্রতিরক্ষার দায় আমরা ঝেড়ে ফেলেছি। আর তার বাহানা বানাই অমুক নেতা, তমুক সেলিব্রিটির দোহাই পেড়ে। সত্যি কথা বলুন তো, রাজনৈতিক নেতাদের কথা ছাড়ুন, পাড়ার ওয়ার্ড কমিটির মেম্বারের থেকেও আজকাল কি কেউ সৌজন্য, ভদ্রতা, সততা ইত্যাদি আশা করেন? ফ্যাসিবাদের বিকাশের তো আদর্শ পরিস্থিতি সেটাই। ফ্যাসিবাদ মানে স্রেফ গোবর বা চোনাতত্ত্ব নয়। ফ্যাসিবাদের মূল অনেক গভীরে। সেই সাংস্কৃতিক ভিতকে চিনবেন না, তার বিরুদ্ধে কথা বলবেন না, আর রাস্তায় দুটো শ্লোগান দিলেই সব হয়ে যাবে?
ভারতে ফ্যাসিবাদের ভিত প্রতিষ্ঠার সামনে সবথেকে বড় প্রতিবন্ধক ছিল বাঙালির সাংস্কৃতিক চেতনা। সেটাকে প্রায় হাপিস করে দেওয়া গেছে। বাঙালির বাচ্চা বাংলা পড়তে পারে না বললে বং বাপমায়ের লেজে বসন্তের বাতাস খেলে। রণজিৎ রায়ের ‘The Agony of Bengal’ পড়েছিলাম ক্লাস ইলেভেনে। এখন লেখা হচ্ছে ‘The Epitaph of Bengal’। জাতি হিসাবে বাঙালি আর মৃতপ্রায়। তার সাংস্কৃতিক চেতনাও তাই মৃত্যুপথগামী। কিছুদিন পরে তাই অক্লেশে বলতে পারব, ‘Bengal is dead. Long Live Bengal’।
রবীন্দ্রভারতীর ঘটনার হাত ধরে এখন বিতর্কের ঘনঘটা। যারা ‘অসভ্যতা’র বিরুদ্ধে মুখর, তারাও যে সবাই খুব যৌক্তিক, এমনটা কখনওই নয়। কিন্তু বিপরীতে যারা, তাদের যুক্তিবিন্যাস শুনলে মনে পড়ে যাচ্ছে ঢাকাইয়া কুট্টির কথা, আস্তে কয়েন কত্তা, ঘোড়ায় হাসব।
যুক্তিগুলোর মূল ভিত্তি হল স্বাধীনতার প্রসঙ্গ। স্বাধীনতা মানে কী? আমার পরাণ যাহা চায়, তাহাই করিব আমি। এমনটা কদাচ হয়েছে বুঝি? না, মানে ধরুন, রাস্তায় আপনার চটি গেল ছিঁড়ে। ওদিকে বিশ্বসুন্দরীটি (মানে আপনার চোখে) চৈত্রের ভরা রোদে অপেক্ষমানা। অগত্যা আপনি সামনের মুচির দোকানে গিয়ে বললেন, এটা জলদি সারিয়ে দাও দেখি। তো মুচি ভদ্রলোক মুচকি হেসে বললেন, এখন আমার জন লেননের গান শোনার শখ জেগেছে। আপনি রাত্তিরে আসুন। আচ্ছা, আচ্ছা। লেনন বলাতে আপনার সফিস্টিকেশনে আঘাত লেগেছে বুঝতে পারছি। বাদ দিন, ভোজপুরি গান ধরে নিন। কি, সেই স্বাধীনতা আপনি মেনে নেবেন তো?
কিংবা ধরুন, তুমুল বর্ষার রাতে আচমকা অটোচালকরা ভাড়া তিনগুণ হাঁকতে শুরু করল। সেই স্বাধীনতা অম্লাণবদনে মেনে নেবেন তো? মনে মনে তাদের শুয়োরের বাচ্চা বলে গাল পাড়বেন না তো? ফেসবুকে সেই রাতেই গুরুগম্ভীর পোস্ট দেবেন না তো? যদি সেই ‘স্বাধীনতা’ অকাতরে মেনে নেন, একমাত্র তাহলেই আপনার ‘স্বাধীনতা’র তত্ত্ব মান্য। নচেৎ ধ্যাষ্টামি।
স্বাধীনতার প্রসঙ্গ তুললে ধর্ষকের অবাধে ধর্ষণ করার স্বাধীনতাও মেনে নিতে হয়। মেনে নিতে হয় তোলাবাজদের বদমায়েশি। কিংবা গোটা দেশের অর্থনীতিকে উচ্ছন্নে পাঠানোর স্বাধীনতাকেও সম্মান করতে হয়। গোবর বা চোনায় ক্যান্সার সারে কিংবা করোনা ভাইরাস চিনাদের টাইট করতে আল্লা-ই পাঠিয়েছেন জাতীয় বালখিল্যপনাকেও শ্রদ্ধা করতে হয় স্বাধীনতার তাগিদে। কারণ স্বাধীনতা, স্বাধীনতাই সব।
কারও যদি স্বাধীনতা থাকে অন্য কারও শব্দগুচ্ছের মধ্যে আপন বাঁড়া ঢুকিয়ে দেবার, তাহলে তৃতীয় কারও স্বাধীনতাও থাকতে পারে সেই প্রবিষ্টকের বাপের নামের মধ্যে একই বস্তু গুঁজে দেবার। শিল্পীর স্বাধীনতার দোহাই পারলে চলবে? তাহলে ভারভারা রাওয়ের মত প্রথম সারির তেলেগু কবির দীর্ঘ কারাবাস নিয়ে একটি শব্দও উচ্চারণ করছেন না কেন? মনে ভয় আছে প্রত্যাঘাতের, তাই? হ্যাঁ, জানি, আপনি বলবেন কোন বিষয়ে কথা বলব, সেটা আমার স্বাধীনতা। রাইট স্যার। আপনাদের স্বাধীনতার সার তো হল যৌনাঙ্গের অবাধচরনের স্বাধীনতা, উচ্ছৃঙ্খলতার স্বাধীনতা। সেটা স্পষ্ট করে বলে দিলেই হয়!
যে কোনও স্বাধীনতারই আসল বিকাশ তার স্বেচ্ছা এবং পারস্পরিক নিয়ন্ত্রণে। এবং সেটা পারস্পরিক স্বার্থেই। পথচলতি একটি মেয়েকে দেখেই বাই চাগাড় দেবার স্বাধীনতা আপনার আছে। মেয়েটিরও স্বাধীনতা আছে আপনার গালে তার পেন্সিল হিল বুলিয়ে আদর করার। আর আমারও স্বাধীনতা আছে আপনার গা-হাত-পা কিঞ্চিৎ মাসাজ করে রাতে কাঁধের যন্ত্রণায় ছটফট করার। বছরতিনেক আগেই সেই অভিজ্ঞতা হয়ে আছে। এই ত্রিবিধ স্বাধীনতার প্রকোপ থেকে বাঁচতে আপনি কী করেন? নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করেন। এটাই হল মোদ্দা কথা। আপনি বাঁচলে বাপের নাম, সে আপনিও ভালই জানেন। জানেন শ্রীমান রোদ্দুর-ও। ওটি যে তার পিতৃদত্ত বা সার্টিফিকেটের নাম নয়, সেটি বোধহয় আমার আগেই আপনার জানা। নাম ভাড়ানোর স্বাধীনতা বেছে নিতে হল কেন?
আরেকদল পণ্ডিত গালিগালাজের ভাষাতাত্ত্বিক ও সাহিত্যিক নিদর্শনের দোহাই পেড়ে রোদ্দুরকে ছায়াবৃত করার চেষ্টা করছেন। উদাহরণ টানছেন নবারুণের। এমনকি বঙ্কিম কোথায় কোথায় মাগি লিখেছেন এই বয়সে আবার বইপত্তর হাতড়ে সেগুলো তুলে আনছেন। নবারুণ বা বঙ্কিমের উদাহরণ এক্ষেত্রে খাটবে না। কারণ তারা নিজেদের রচনাতেই আলোচ্য শব্দাবলি ব্যবহার করেছেন। অন্য কারও লেখায় নয়। বঙ্কিম অবধি পিছোনোর দরকার কী? ‘কেরি সাহেবের মুন্সী’তে উইলিয়াম কেরি সমবেত জনতাকে সম্ভাষণ করছেন, ‘আমার প্রিয় মাগি ও মিন্সেগণ’ বলে। তো? শাক দিয়ে মাছ তবু হয়তো ঢাকা যায়, মালের বোতল স্বপ্রকাশ।
নিম্নবর্গের মানুষ নিরন্তর গাল পাড়েন বুঝি! কজন ভূমিহীন কৃষকের ঘরের দাওয়ায় রাত কাটিয়েছেন ভাই? কটা শ্রমিক বস্তি স্বচক্ষে দেখেছেন? কটি নিরন্ন দুঃস্থ পরিবারকে দেখেছেন পরস্পরকে নিয়মিত বিশেষায়িত করে সম্বোধন করতে? অন্ত্যজবর্গের কোন গম্ভীরা গান, কোন ঝুমুর পালায়, ইদানিং মৃতপ্রায় কোন আলকাপ পালায় খিস্তির বন্যা শুনেছেন? নিম্নবর্গের ঘর থেকে উঠে আসা কোন বাউলের গানে শুনেছেন ‘ওরে বাঁড়া পরানপাখি/ এই বুঝি রে দিল ফাঁকি/ সাধের শরীর হইল ছাই/ রে বাঁড়া/ সাধের শরীর হইল ছাই’!
হ্যাঁ, করে। নেশাগ্রস্ত অবস্থায় করে। সারাদিনের গ্লানি উজাড় করে দেয়। কিন্তু মাতাল আর পাগলকে টেনে এনে কোনও সামাজিকতার আলোচনা হয় না। গালিগালাজ মানুষ অসহায় ক্রোধ থেকে করে ঠিকই। কিন্তু গালিগালাজ আসলে ক্ষমতার প্রতীক। তাই থানায় পুলিশ স্বচ্ছন্দে কয়েদিদের বাপমা তুলে খিস্তি দেয়। বিপরীতটা কখনওই হয় না। আবার পাড়ার রাজনৈতিক গর্বে স্ফীত দাদাটিও পুলিশকে যখন সুভাষিতাবলী শোনায়, তখন পুলিশও সোনাপানা মুখ করে শোনে। আর মনে মনে বলে, দিনটা বদলাতে দে।
আপনার সাহিত্যে যদি এমন প্রসঙ্গ আসে, গালিগালাজগুলোও আসতেই পারে। যা অনুপ্রযুক্ত নয়, তা অশোভন বা অশ্লীল নয়। কিন্তু প্রসঙ্গাতীতভাবে নিজের কেরদানি দেখানোর জন্য এমন কাজ করা মানে নোংরামি। সে যিনিই করে থাকুন না কেন। নষ্টামি করা আর নষ্টামিকে প্রশ্রয় দেওয়া কারও কারও মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজি হতেই পারে। তারা দালাল হিসাবেই চিহ্নিত থাক।