রায়পুর ডায়রি

সত্যব্রত ঘোষ

 




লেখক চলচ্চিত্রনির্মাতা, চলচ্চিত্রের শিক্ষক।

 

 

 

কলকাতা থেকে ছত্রিশগড়ের রায়পুর যতটা দূরে, মুম্বাই থেকেও প্রায় তাই। মধ্যবর্তী এই প্রাণমুখর শহরটির সঙ্গে মুম্বাইয়ের রাজনৈতিক সচেতন মানুষেরা দীর্ঘ সময় ধরে গভীর সংস্পর্শে রয়েছেন। সেই তুলনায় কলকাতার ‘বুদ্ধিজীবী’-দের সঙ্গে রায়পুরের সম্পর্কটা এতদিনেও দানা বাঁধেনি। গত শতাব্দীর আটের দশকের শেষদিকে শঙ্কর গুহ নিয়োগী যখন তাঁর ‘সংঘর্ষ ঔর নির্মাণ’ আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে গণ আন্দোলনের এক অনন্য দিশা ভারতবাসীকে দেখাচ্ছিলেন, তখন কলকাতার নানা মহলে ছত্রিশগড় মুক্তি মোর্চা-র নাম বিভিন্ন সময়ে উচ্চারিত হতে শুনেছি। কিন্তু নয়ের দশকের গোড়া থেকে ক্রমশ সেই নাম ও চিন্তার রেশ ক্রমশ ক্ষীণ হতে থাকে। হয়তো বা এই কারণে যে, আমাদের বামশাসিত রাজ্যটির পরিচালকেরা অন্য চিন্তাধারার এক শ্রমিক আন্দোলনের নেতা ও তাঁর ভাবাদর্শকে গুরুত্ব দেওয়াটাকে রাজনৈতিক স্থিতাবস্থার পরিপন্থী মনে করেছেন। মানুষের অধিকার অর্জনের লড়াইয়ের চেয়েও নেতাদের ক্ষমতায় টিঁকে থাকার কৌশল যেখানে মুখ্য হয়ে ওঠে, সেখানে কেউই চাইবেন না হত্যাকারীদের নিশানা হতে। তাই ‘সংঘর্ষ’-কে চরমপন্থী বিশেষণ দিয়ে সরিয়ে রাখা হয়েছে আর ধনতন্ত্রের অন্তরঙ্গ সাথীদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে ‘নির্মাণ’-এর যাবতীয় দায়িত্ব।

৫ম রায়পুর আন্তর্জাতিক শর্ট ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে অংশগ্রহণের অভিজ্ঞতার বয়ানে এসব কথা ‘ধান ভাঙতে শিবের গীত’ মনে হতে পারে। তবে আমন্ত্রণ গ্রহণ করবার পর থেকে রায়পুর পোঁছানোর পরেও ক্যালাইডোস্কোপের মতো আবেগভরা সেই সব দিনগুলি চোখের সামনে চলমান রঙিন নক্সা ভাসিয়ে তুলছিল যা প্রায় চল্লিশ বছর আগেও ছিল ঘোর বাস্তব। রায়পুরবাসী অগ্রজ শুভাকাঙ্ক্ষী বোধিসত্ত্ব চ্যাটার্জি-র সান্নিধ্য লাভের তাড়নাও ছিল। কিন্তু কিছুটা ভয়েও ছিলাম। ফেস্টিভ্যাল ডিরেক্টর শেখর নাগ অনুরোধ করেছিলেন ফেস্টিভ্যাল চলাকালীন চলচ্চিত্র নির্মাণ সংক্রান্ত কয়েকটি ‘মাস্টারক্লাস’-এর দায়িত্ব নিতে হবে এবং তা হিন্দি ভাষায়। জিজ্ঞাসা করেছিলাম, কারা থাকবেন ক্লাসে? শেখর জানিয়েছিলেন মূলত চলচিত্রে আগ্রহী তরুণ-তরুণীরা। বাস্তবে যা হল, অবকাশে তা বলা যাবে।

রায়পুরের মহান্ত ঘাসিদাস মেমোরিয়াল মিউজিয়ামের প্রেক্ষাগৃহ এবং সংলগ্ন মুক্ত মঞ্চে গত ২৭শে ফেব্রুয়ারি-১লা মার্চ আয়োজিত এই স্বল্পদৈর্ঘের আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র সমারোহে উদ্বোধনী ছবির একটি ছিল বিলাস দেউস্কর পরিচালিত ‘প্রপোজাল’। সাদাকালোয় বানানো এই ছবিটির বিষয় আগ্রাসী এক তরুণের ‘প্রেমনিবেদন’। মুম্বাই শহরের এক রেস্তোরায় মুখোমুখি বসা বান্ধবীটি সেই প্রস্তাবে ‘না’ বলতেই তরুণটিকে হাতের বোতলটি দেখিয়ে তাকে অ্যাসিড দিয়ে ‘মুখ ধুয়ে দেওয়া’-র হুমকি দেয়। অবিশ্বাসী এক আতঙ্কে মেয়েটি ক্রমশ নরম হতে শুরু করে। তার বিশ্বাস অর্জনের জন্যই ছেলেটি বলে বোতলে জল ছাড়া আর কিছু নেই। প্রতারিত মেয়েটি রাগে এক থাপ্পড় মারে ছেলেটির গালে। প্রত্যুত্তরে কথা না বলে ছেলেটি বোতলটি খুলে তরল পদার্থ উজাড় করে দেয় মেয়েটির মুখে। তা অ্যাসিড কিনা, তা বলা প্রয়োজন মনে করেননি চিত্রপরিচালক। ছবিটি এখানেই শেষ হয়ে যায়। দমচাপা এক নাটকীয়তায় লিঙ্গ অসাম্যের এই ঘোরতর বাস্তবতার চিত্রায়ন বস্তুত ফেস্টিভ্যালের মূল সুরটি বেঁধে দেয়। ফেস্টিভ্যালে প্রতিযোগী চল্লিশটি ছবির চুলচেরা বিশ্লেষনের পর বিচারকেরা একমত হন যে বাসুদেব দেউস্করকে আমরা ‘প্রপোজাল’ ছবির জন্য সেরা পরিচালকের শিরোপা দেবো।

আন্তর্জাতিক তথা ভারতীয় কাহিনীচিত্র এখন এক যুগসন্ধিতে পৌঁছেছে। একদিকে সে যেমন ঐতিহাসিক বিভিন্ন চিত্রশৈলীর অনন্য সৃষ্টিবৈচিত্রে ঋদ্ধ, অন্যদিকে উত্তরোত্তর বানিজ্যিক চাপে তার স্বাধীন শৈল্পিক অভিব্যক্তির পরিসর ক্রমশ সংকীর্ণ। সৌন্দর্যের মাপকাঠি এখন টেলিভিশন। চিত্রনাট্যের সংলাপ থেকে শুরু করে আলোকচিত্রের আঙ্গিকে ছোট আর বড় পর্দা মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে। প্রেক্ষাগৃহে টিকিট কেটে সিনেমা দেখতে বসে অনেক সময়ে ভ্রম হয় টেলিভিশন কোনও একটি ধারাবাহিকের একটি ‘মহাপর্ব’ দেখছি না তো। ডিজিটাল মাধ্যমে রূপান্তরিত হয়ে যাওয়ার পর সিনেমার অধোগতিতে মার্টিন স্করসিসির পর মতো বরেণ্য চিত্রপরিচালক সম্প্রতি বিষন্নচিত্তে বলছেন “They were taking the films away, from everybody’s … The main thing was fighting for control…” এমন ধারণা সারা পৃথিবীর বিভিন্ন চলচ্চিত্রকার এবং দর্শকদের মধ্যে ক্রমশ ছড়াচ্ছে এই কারণে, যে সিনেমা অথবা ‘মুভি’র যে ব্যপ্তি নয়ের দশকের শুরুতেও আমরা পেয়েছি, তা আজ হারিয়েছে। বাসুদেবকে সেরা পরিচালকের স্বীকৃতি দেওয়ার নেপথ্যে জুরিদের মনে হয়েছিল স্বল্প পরিসরেও ‘প্রপোজাল’ দর্শকদেরকে সিনেমার স্বাদ দিয়েছে। এখানে বলা প্রয়োজন, মুম্বাই চিত্রজগতে কলানির্দেশক সুমিত মিশ্রের স্বল্প দৈর্ঘ্যের কাহিনীচিত্র ‘খিড়কি’-কে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রস্তাব উঠেছিল জুরিদের একাংশে। ‘অসুন্দর’ একটি মেয়ের স্বপ্ন বাস্তব হয়ে ওঠবার গল্প বলেছেন সুমিত। নিখুঁত পেশাদারিত্বে তা উপস্থাপন করা সত্ত্বেও ছবিটি বিশেষভাবে ভারতীয় টেলিভিশনে জনপ্রিয় কৃত্রিম শৈলীর দ্বারা প্রভাবগ্রস্ত বলেই সুমিতকে ‘সেরা পরিচালক’-এর সম্মান দেওয়া গেল না।

ফেস্টিভ্যাল ডিরেক্টর শেখর নাগ সাতটি সেশনে ভাগ করে ছবিগুলিকে প্রদর্শনের পরিকল্পনা করেছিলেন। প্রতিটি সেশনের পরে সেই সেশনে প্রদর্শিত ছবিগুলি নিয়ে দর্শকদের সঙ্গে আলোচনা হবে। ফেস্টিভ্যালে উপস্থিত কিছু চিত্রপরিচালক, সমাজকর্মী এবং বিদগ্ধ ব্যাক্তি এই আলোচনায় যোগ দেন। ভাবনার এই আদান-প্রদান যে সাধারণ দর্শকদের মনকে প্রভাবিত করছে, তা বোঝা যায় যে বিভিন্ন বয়সের বেশ কিছু মানুষ ফেস্টিভ্যালের প্রথম থেকে শেষ দিন অবধি উপস্থিত থেকেছেন। অক্সফ্যাম ইণ্ডিয়া-র পক্ষ থেকে আতিথেয়তার ব্যবস্থাপনায় কোনও ত্রুটি হয়নি। বিভিন্ন পর্বের এই আলোচনাগুলিতে ছবিগুলির সঙ্গে জড়িয়ে থাকা নারীদের বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা নিয়েও ভাবনার আদানপ্রদান ঘটে।

‘মাস্টারক্লাস’ নামক সেশনটিতে দেখা গেল শুধু ছাত্রছাত্রীরাই নয়। বিভিন্ন ক্ষেত্র থেকে আগত মধ্যবয়সী এবং  প্রৌঢ় মহিলা ও পুরুষ  পেশাদারেরাও আগ্রহের সঙ্গে বসে আছেন প্রেক্ষাগৃহে। এমন মিশ্রিত বয়স, অভিজ্ঞতা আর মানসিকতার মানুষদের সিনেমা নিয়ে ‘জ্ঞান’ দেওয়ার দুঃসাহস অতি কমজনেরই আছে বলে ধারণা। আমার ভাঙা হিন্দি সম্বল করে প্রথম ক্লাসটিতে শুধু সিনেমার জন্মকথা থেকে আজকের ডিজিটাল ফিল্মের বিবর্তনটুকু আলোকচিত্র এবং ভিডিয়ো ক্লিপের মাধ্যমে তুলে ধরবার প্রয়াসটুকু করা গেল। গলা শুকিয়ে এলেও, বিভিন্ন সময়ে শ্রোতাদের তোলা প্রশ্ন এবং তার উত্তরগুলিতে সন্তুষ্টির চিহ্ন লক্ষ্য করে মনে হল, ভাগ্যিস প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। তবে, আগে বিভিন্ন সময়ে কলকাতার চিত্রবাণী-তে ক্লাসগুলি নেওয়ার সময়ে বারবার দুটি কথা বলতাম, যা এখানেও বলেছি। প্রথমত, সিনেমা মাধ্যমটির যা ডাইনামিক্স, তা একতরফা লেকচারের পরিবর্তে দুইপক্ষের আদানপ্রদানে বেশি অনুভব করা যায়। এবং দ্বিতীয়ত, সিনেমার টেকনিক বিষয়ে তত্ত্বগত জার্গনসর্বস্ব কথা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মাথার উপর দিয়ে চলে যায়। যতক্ষণ না সেগুলিকে ব্যবহারিক অর্থে প্রয়োগের স্তরে নিয়ে আসবার পরিস্থিতি তৈরি করা হবে, সেগুলি নিয়ে আলোচনা করাটা প্রায় মুল্যহীন। ক্লাসটির পর যেভাবে অংশগ্রহণকারীরা যেভাবে বাইরে ভিড় করে আমাকে ঘিরে নিজেদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছিলেন, তাতে আরেকবার মনে হল যে সিনেমার মাধ্যমটিকে যারা অধীত শিক্ষার অন্তর্গত করতে চাইছেন, এই পথে চললে সদর্থক ফল পাবার আশা করতে পারেন।

ফেস্টিভ্যালে ছবি দেখবার বাইরে যে তিক্তমধুর অভিজ্ঞতা মনের মণিকোঠরে চিরকাল রয়ে যাবে, তা হল রায়পুরে বসবাসকারী কবি ও লেখক বিনোদ কুমার শুক্লা-র বাড়িতে তাঁর সান্নিধ্যলাভ। মুম্বাইতে কিছুকাল মণি কাউলের সঙ্গে চিত্রনাট্য রচনার কাজে সহকারী হিসেবে কাজ করবার সময়ে নামটি জেনেছিলাম। পরবর্তীকালে ওনার উপন্যাস ‘নৌকর কে কামিজ’ অবলম্বনে একটি ছবি বানিয়েছিলেন মণি কাউল। যার চিত্রনাট্য রচনা করেছিলেন স্বয়ং বিনোদ কুমার শুক্লা। ঋষিতুল্য এই প্রাজ্ঞ মানুষটিকে জিজ্ঞাসা করলাম, “উপন্যাসটি বাংলা অনুবাদের অনুমতি দেবেন?” জবাবে যে কথাটি তিনি বললেন, তা পশ্চিমবঙ্গের কতজন বাঙালিকে লজ্জা দেবে জানি না, আমাকে অধোমুখ হতে বাধ্য করেছে। তিনি জানালেন “ভারতীয় ভাষা পরিষদ’ নামে এক সংস্থা তো ইতিমধ্যেই অনুবাদ করে বই ছাপিয়ে প্রকাশ করে ফেলেছে। এবং তা বিনা অনুমতিতে। তা জানবার পর যখন তাঁদের বললাম, টাকা পয়সা না দাও দিওনা, কিন্তু বইটির কী গতি হল, তা দয়া করে জানাও। ওরা কুরিয়ারে একশো বইয়ের কপি আমাকে পাঠিয়ে দিয়েছে। যেগুলি নিয়ে আমি যে কী করবো জানিনা। পারলে তুমি কিছু বই নিয়ে যাও।” না, নিয়ে আসিনি। কিন্তু যে বুদ্ধিজীবী বাঙালি সম্প্রদায় ‘সংস্কৃতিবান’ হিসেবে নিজেদের সারাক্ষণ বিজ্ঞাপিত করেন, তাঁদের সঙ্কীর্ণতা, কূটমনস্কতা এবং অভব্যতার সঙ্গে আমার সম্যক পরিচয় আছে, অনুতাপের সুরে সেই চরিত্র যখন রায়পুর ও মুম্বাইয়ের চোখে পরমশ্রদ্ধেয় মানুষটির কণ্ঠেও ধ্বনিত হল, বাঙালি হিসেবে আমার লজ্জা আরেকটুকু  বাড়ল মাত্র।

শেখরের অনুরোধে এবং অনুমতি সাপেক্ষে বাঙলার দুই তরুণের বানানো দুটি সাম্প্রতিক ছবি নিয়ে রায়পুরে গেছিলাম। অনির্বাণ গুহের ‘ফ্লেমস’ এবং দেবরাজ নাইয়া-র ‘ভয়েস অফ সাইলেন্স’। প্রতিযোগী বিভাগে ছবিগুলির মধ্যে এই দুটিই বাংলা ছবি ছিল। ‘ফ্লেমস’-এ অনির্বাণ উত্তর কলকাতার এক তরুণ অটো চালকের স্বপ্নভঙ্গের কথা বলেছেন স্বকীয় এক আন্তরিক ভঙ্গিতে। সাবলীল চিত্ররচনায় চেনা এই শহরটির এক অচেনা রূপ ফুটে উঠেছে তার ছবিতে। রায়পুরের দর্শকরা সেই ছবি দেখে অভিভূত হলেও ছবির শেষে বিশ্বাসঘাতকতার শিকার ছেলেটি যে চরম পদক্ষেপ নিয়েছে, তা নিয়ে দ্বিধাবিভক্ত প্রতিক্রিয়া শোনা গেল। জুরিদের একাংশে সেই বিরুদ্ধ মতামত প্রভাবিত করলেও ওখানকার অনেকের মতো আমিও বিশ্বাস করি সব রাগ গিলে হজম করে নেওয়া যায়না।

দেবরাজের ‘ভয়েস অফ সাইলেন্স’ যে শ্রেষ্ঠ চিত্রচনার স্বীকৃতি পেল এই ফেস্টিভ্যালে, তা আমার পক্ষে তৃপ্তিদায়ক। প্রায় পাঁচবছর ধরে বিভিন্ন প্রতিকুলতার মধ্যে বানানো ছবিটিতে দৃশ্যরচনার মৌলিকতা ও যত্ন লক্ষ্য করে ছবিটি প্রতিযোগী বিভাগে পাঠানোর ব্যবস্থা করি। ইদানিংকালে নারী-ধর্ষণ ও অত্যাচারের সংবাদবাহুল্য ঘটনাগুলিকে প্রায় স্বাভাবিকতার মাত্রা দিয়ে ফেলেছে। কিন্তু দেবরাজ সেই সদ্য-তরুণীর মানসিক যন্ত্রণা এবং অসহায় এক বিষণ্ণতাকে তাঁর ছবির বিষয় বানিয়েছেন, যার চোখের সামনে টিভির পর্দায় নিত্য-নৈমিত্তিক এই বীভৎস সংবাদগুলি আছড়ে পরে। ধর্ষণের শারীরিক ও মানসিক আঘাতে বহু বছর ধরে কোমায় আচ্ছন্ন হওয়ার পর প্রয়াত নার্স অরুণা শানবাগের স্মৃতিতে নির্মিত এই স্বল্পদৈর্ঘের ছবিটিতে ব্যক্তি-সমাজ-রাজনীতির দুর্বৃত্তায়নকে দেবরাজ যে তীক্ষ্ণতার সঙ্গে দৃশ্যায়িত করেছেন, তা রায়পুরের দর্শকের মর্মে বিদ্ধ করেছে। ছবি দেখানোর পর প্রশ্নোত্তর পর্বে, বিভিন্ন দর্শকের ব্যক্তিগত প্রতিক্রিয়ায় তার পরিচয় পাওয়া গেল। ওখানকার লিঙ্গ-সচেতক মহল থেকে অবশ্য অভিযোগ উঠেছিল, নারীদের উপর অত্যাচার দেখানোর সময়েও পুরুষদের ‘লোভী’ নজর নারীশরীরের প্রতি রয়ে যায়। সে নিয়ে তর্কের পরিবেশ তৈরি হলেও ‘ভয়েস অফ সাইলেন্স’-এর উদ্দেশ্য যে ধর্ষণের তীব্র অভিঘাত, তা নিয়ে কারো কোনও সন্দেহ ছিল না।

হরিয়ানা থেকে আসা দীপ্তির সঙ্গে আলাপ হল। চেন্নাইয়ের প্রতিষ্ঠিত তথ্যচিত্রনির্মাতা স্টালিনের উৎসাহে তৈরি ‘ভিডিয়ো ভলান্টিয়ার্স’ এবং ‘চেঞ্জচিত্র’ আন্দোলন থেকে উঠে আসা এক মেধাবী, পরিশ্রমী ফসল। দীপ্তির ছবিটি প্রতিযোগিতার অংশ ছিল না বটে। কিন্তু হরিয়ানা এবং গোবলয়ের অন্যত্র মেয়েরাও যে লম্পটদের উচিৎ শিক্ষা দিয়ে চলেছে, তার যথেষ্ট প্রমাণ তুলে ধরেছে দীপ্তির ছবিটি। এই প্রসঙ্গে মহিন মির্জার ‘অগর উয়ো দেশ বানাতি’ তথ্যচিত্রটি নিয়ে কিছু বলা প্রয়োজন। ছত্রিশগড়ের খনি অঞ্চলগুলি বানিজ্যিক কারণে প্রসারিত হয়ে যাওয়ার ফলে সন্নিহিত গ্রামগুলির অস্তিত্ব এখন বিপন্ন। এই সংকটে স্থানীয় মহিলারা এক অভিনব আন্দোলন সঙ্ঘটিত করেছেন। নতুন রাস্তা বা খনির জন্য আসা মাপজোককারী আমিন এবং কতৃপক্ষদের বাধা দিয়ে সরাসরি ফিরিয়ে দিচ্ছেন এই বলে যে, ‘তোমরা যে উন্নয়ন দিতে এসেছ, তা আমাদের দরকারে আসবে না। যে জমিতে এতবছর আমরা চাষ করেছি পায়ে হেঁটে গিয়ে, সেই জমি আজ কয়লার ধুলোর আড়ালে হারিয়ে গেছে। আমাদের হাঁটবার জন্য পাথুরে সরু রাস্তাই যথেষ্ট। মোটরে করে ঘুরতে আসবার জন্য চওড়া রাস্তা এখানে হবেনা।’ দেওয়ালে পিঠ থেকে যাওয়া এই মহিলাদের বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বরগুলি কানে এখনও বাজছে। যে প্রশ্নটি আমরা বারবার সরকারকে নানাভাবে করে চলেছি, “কার জন্য উন্নয়ন?” ছত্রিশগড়ের মহিলারা এই তথ্যচিত্রে আবার একবার জোরালো ভাষায় তুললেন।

ছত্রিশগড় থেকে কলকাতায় ফিরে  খবর পেলাম রায়পুরের মধ্যভাগে জয়স্তম্ভ মার্গে সিএএ-র প্রতিবাদে যে লাগাতার ধর্না চলছিল, সেই ‘রায়পুর কা শাহিন বাগ’-কে বাঘেলা সরকার নিরাপত্তার কারণে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে তুলে দিয়েছে। প্রতিদিন সন্ধ্যায় ফেস্টিভ্যাল থেকে ফিরে আমরা সবাই কিছুক্ষণের জন্য ওখানে থাকতাম। আজাদ হিন্দ বাহিনীর অবিচ্ছেদ্য অংশ ক্যাপ্টেন লক্ষ্মী সেহগলের আজীবন সাথী রেখা মণ্ডালে-র সঙ্গে আলাপ হয়েছিল ধর্নাস্থলে। তিনি বলেছিলেন এই লড়াই তো শুধু মুসলমান মেয়েদেরই নয়, সবার জন্য – যারা আজও সংবিধান-প্রদত্ত সমানাধিকার থেকে বঞ্চিত। এখন, এই মুহূর্তে করোনা ভাইরাস-এর প্রকোপ সংবাদমাধ্যমগুলিকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে বটে। তবে রাজনৈতিক দাঁও নিতে অভ্যস্থ দলগুলিকে শীঘ্রই এই বঞ্চনা, মিথ্যাচার এবং ক্ষমতার প্রদর্শনের জন্য সাধারণ মানুষের ক্রমবর্ধমান ক্ষোভ এবং ঘৃণার সম্মুখীন হতে হবে। দিল্লীর দাঙ্গাবিধ্বস্ত অঞ্চল থেকে শুরু করে কলকাতার পার্কসার্কাস বা রায়পুরের জয়স্তম্ভ মার্গ – অবদমন, বিশ্বাসঘাতকটা এবং নিপীড়নে মানুষ আজ আর ভীতসন্ত্রস্ত নয়। সবাই এখন অপেক্ষা করছে সেই মুহূর্তটির জন্য, যখন তাঁরা সব অপমান এবং হিংসার জবাব দিতে কুণ্ঠিত হবে না। কারণ, বিনোদ কুমার শুক্লা তাঁর অবিস্মরণীয় কবিতাটিতে তো বলেইছেন:

আমি প্রতিদিন শহরে ঘুরে বেড়াতে চাই
কারফিউতে মরতে চাই না
আমি বেঁচে থাকতে চাই।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4879 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...