কবীর সুমন
লেখক গীতিকার, সঙ্গীতকার, গায়ক, সাংবাদিক, প্রবন্ধকার।
মার্চ মাসের পয়লা তারিখে চলে গেলেন নিকারাগুয়ার প্রবাদপ্রতিম বিপ্লবী, কবি ও ধর্মযাজক ফাদার এর্নেস্তো কার্দেনাল। ফাদার কার্দেনালের সঙ্গে আমার পুরনো পরিচয়ের সূত্রে চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম পত্রিকার তরফ থেকে আমাকে তাঁর বিষয়ে কিছু বলতে অনুরোধ করা হয়েছে। ফাদার কার্দেনালকে নিয়ে কিছু বলার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য এঁদের ধন্যবাদ জানাই।
এইভাবে শুরু করা যেতে পারে— নিকারাগুয়ার ১৯৭৯ সালের রাষ্ট্রবিপ্লব ও তার এক স্থপতি ফাদার এর্নেস্তো কার্দেনাল— হঠাৎ করে এই বিরাট গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাটির মধ্যে আমি ঢুকে পড়লাম কীভাবে! কোথায় ফাদার এর্নেস্তো কার্দেনাল, আর কোথায় কলকাতার এক সামান্য বাঙালি যুবক যার নাম তখন সুমন চট্টোপাধ্যায়! হ্যাঁ যে সময়ের কথা বলব, তখন আমি সদ্য যুবক। বাঙালি মধ্যবিত্ত ঘরে জন্মানো ছেলেপুলে প্রায় প্রত্যেকেই যেমন বিপ্লবের স্বপ্ন দেখে, আমিও দেখতাম। তার মানে কি আমি নিজে খুব বিপ্লবী লোক? তা নয়, কিন্তু হ্যাঁ, স্বপ্নটা দেখতাম। সেইসময় আমার চোখের সামনে নাকের ডগায় ঘটে চলেছে একের পর এক সাড়া-জাগানো অভ্যুত্থান। প্রথমেই মনে আসে কিউবার নাম। কিউবার বিপ্লব যখন হয়েছে, আমার বয়স তখন বারো কি তেরো বছর। কিন্তু কিউবার বিপ্লবের কথা তখন আমাকে কেউ সেভাবে বলেনি। আমার বাবা-মা, আমার শিক্ষকেরা, পাড়ার কেউ, আত্মীয়স্বজন— কেউ কোনওদিনই আমাকে কিউবাতে বিপ্লবের বিষয়ে কিছু জানাননি। কিউবার বিপ্লব সম্বন্ধে তো বটেই, এমনকি ফিদেল কাস্ত্রো নামটাও আমি জানতে পেরেছি অনেক পরে৷ আমার ওই বয়সে চে গেভারার নামও আমি জানতাম না। আমার মা অবশ্য আমাকে ইতিমধ্যে বিশ্ববিখ্যাত টাইম পত্রিকার গ্রাহক করে দিয়েছিলেন। সেটা ছয়ের দশকের কথা। সেই সময় সেই পত্রিকার দাম ছিল সংখ্যাপিছু চার টাকা। যাই হোক, একদিন, সালটা ১৯৬৭, টাইম পত্রিকার প্রচ্ছদেই আমি প্রথম চে গেভারাকে দেখলাম। ছবিতে দেখা যাচ্ছে, চে গেভারা বলিভিয়ায় মার্কিন সৈন্যদের হাতে নিহত, মৃত শুয়ে আছেন। তাঁর চোখদুটি খোলা। এরপর, আমি তখন কলেজে, মারা গেলেন হো চি মিন। এদিকে আবার নকশালবাড়ির বিদ্রোহ হচ্ছে। আমি মানি বা মানি, আমার চারিদিকে এই ঘটনাগুলো তখন ঘটে চলেছে এবং আমাকে প্রভাবিত করতেও শুরু করেছে। ‘তোমাকে আমাকে দিচ্ছে নাড়া/মাও সে তুং-এর চিন্তাধারা’, দেওয়ালে এইসব লেখা দেখতে দেখতে আমরা কলেজে যাচ্ছি। এইসব দেখতে দেখতে আমারও বিপ্লবের স্বপ্ন দেখার সূত্রপাত।
আরও কিছুদিন পরে, ১৯৭৮-৭৯ সালে, নিকারাগুয়ায় সান্দিনিস্তা জাতীয় মুক্তিফ্রন্ট দেশের শাসনক্ষমতা দখল করে নিয়েছে, সে খবরটা পেয়েছি। এর কিছু আগেই, অর্থাৎ ১৯৭৫ সালে, আমি জার্মানিতে পালিয়ে যাই, জরুরি অবস্থায় ধরা পড়ার ভয়ে। কলকাতায় আমার পেছনে ফেউ লেগেছিল। জার্মানিতে যাওয়ার ফলে যেটা ঘটল, পৃথিবীটা যেন হঠাৎ করে আমার আরও বেশি কাছে চলে এল। আমি তখন ভয়েস অফ জার্মানিতে ফ্রিল্যান্স চাকরি করছি। জার্মানির কোলন শহর ছিল ভয়েস অফ জার্মানির সদর দপ্তর। আমি কোলনেই বাসা ভাড়া নিয়ে আছি, আর ওখানে বসেই নানা দেশের মুভমেন্টের খবর পাচ্ছি, সারা বিশ্বে কোথায় কী হচ্ছে সবকিছু খুঁটিনাটি জানতে পারছি। নিকারাগুয়ায় বিপ্লব ও অভ্যুত্থানের খবরে আমাদের মতো তরুণদের মধ্যে একেবারে হইচই পড়ে গেছে। আগেই বলেছি, কিউবা বিপ্লবের সময় আমার বয়স বারো কি তেরো বছর। সেই সময়কার আমি কৈশোর ও যৌবনের বয়ঃসন্ধিতে দাঁড়িয়ে থাকা সদ্য গোঁফ-বেরোনো একটা ছেলে, যার রাত্রিবেলা স্বপ্নদোষ হত। অবশ্য ১৯৭৯ সালে পরিস্থিতি আর সেরকমটি নেই। আমি এখন এক পরিণত যুবক৷ জার্মানি থেকে কিছুদিনের জন্য কলকাতায় এসেছি। দেশে ফিরে মূলত সেইসব মানুষদের সঙ্গেই আমার দেখাসাক্ষাৎ হচ্ছে, সময় কাটছে যারা আমার মতোই বিপ্লবের ভাবে ভাবাপন্ন, সমমনস্ক। তখন আমার তিরিশ বছর বয়স, অর্থাৎ যাকে বলে একেবারে হইহই যৌবন।
ঠিক এইসময় আমার মনের মধ্যে অসম্ভব রকমের একটা লোভ জেগে উঠল। মনে হল, নিকারাগুয়া দেশটাতে একবার যদি যেতে পারতাম। ইতিমধ্যে আমি পরীক্ষা দিয়ে ভয়েস অফ আমেরিকায় চাকরি পেয়ে গেছি। এবার আমার আস্তানা ওয়াশিংটন ডিসি। বলে রাখি, আমেরিকাতে যাওয়ার পেছনে আমার নানা উদ্দেশ্য ছিল। উদ্দেশ্যগুলি যথাক্রমে, নতুন ধরনের নানা বাদ্যযন্ত্র কেনা, ব্লুজ বিষয়টিকে আরেকটু ভালোভাবে শেখা, এবং যে করে হোক নিকারাগুয়া যাওয়া। ওখানে গিয়ে প্রথমেই আমি স্প্যানিশ ভাষা শেখা শুরু করলাম, দক্ষিণ আমেরিকা সংক্রান্ত নানা বিষয় নিয়ে পড়াশুনো করতে লাগলাম, যার মধ্যে সেখানকার রাজনীতি, সাহিত্য, ভূগোল সবই ছিল। বিশেষভাবে এসব চর্চার কারণ, যদি একবার যেতে পারি নিকারাগুয়ায়, তাহলে দেশটাকে নিয়ে আমার মাতৃভাষা বাংলায় একখানা বই লিখব। যাই হোক, আমি তো নিকারাগুয়া যাওয়ার প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি, অথচ কিছুতেই কারও কাছে পাত্তা পাচ্ছি না। ঠিক এই সময় আমি হঠাৎ-ই চেনাজানা আমেরিকার ভেতরে অন্য এক আমেরিকার সংস্পর্শে এলাম। আমরা জানি, আমাদের দেশের বড় বড় সাহিত্যিকরা, যেমন ধরা যাক, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, তাঁরা যখনই ওদেশে গিয়েছেন, তাঁদের ওখানকার বিভিন্ন শহরে আয়োজিত নানা সাহিত্য অনুষ্ঠানে যোগ দিতে হয়েছে। কিন্তু তাঁরা যেসব অনুষ্ঠানে গেছেন বা তারপরেও যান, সেগুলি মূলত বড় বড় প্রতিষ্ঠানের টাকায় চলে, ফলে সেইসব অনুষ্ঠান থেকে সমকালীন আমেরিকায় কী ধরনের প্রতিষ্ঠানবিরোধী লেখালেখি হচ্ছে তার কোনও ধারণা পাওয়া যায় না। কিন্তু আমার অতি সৌভাগ্য হয়েছিল, নিকারাগুয়া যাওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যেতে যেতেই আমার সঙ্গে ক্রমশ সেখানকার প্রতিষ্ঠানবিরোধী ধারার বিভিন্ন মানুষজনের পরিচয় হচ্ছিল। প্রথমেই যাঁর নাম মনে পড়ছে, তিনি নম চমস্কি। পরিচয় হয়েছিল পল সুইজি-র সঙ্গে, যিনি সেই সময় মার্ক্সবাদের একটা নতুন দিক, পোস্ট-ক্যাপিটালিজম যুগে মার্ক্সবাদের চেহারাটা কেমন হয়েছে, তা নিয়ে কাজ করছিলেন। এভাবেই আমি প্রথমবার পরিচয় পেলাম ‘লিবারেশন থিওলজি’র, যেখান থেকে আমি ক্রমে এর্নেস্তো কার্দেনালের কাছে পৌঁছব৷
এই লিবারেশন থিওলজি বিষয়টা নিয়ে কয়েকটা কথা বলে নেওয়া দরকার। এ বিষয়ে আমাদের দেশে তেমনভাবে কোনও চর্চা হয়নি। আমাদের মনে সাধারণ ধারণা এই, যে বিপ্লব মানেই লাল নিশান। সবসময় তা কিন্তু নয়। এই ধারণাটা সোভিয়েত ইউনিয়ন বা চিনের ক্ষেত্রে নিশ্চয়ই সঠিক, কিন্তু আফ্রিকা বা দক্ষিণ আমেরিকার ক্ষেত্রে একেবারেই প্রযোজ্য নয়। বরং নিকারাগুয়ার রাস্তার ধারে দেওয়ালে দেওয়ালে আমি বড় বড় করে গ্রাফিতি দেখেছি— ‘বিপ্লব হ্যাঁ, কমিউনিজম না’। তাছাড়া ধর্ম বা একজন ধর্মযাজকের সঙ্গে যে রাষ্ট্রবিপ্লবের কোনওরকম সম্পর্ক থাকতে পারে, আমাদের দেশে তা কেউ কোনওদিন কল্পনাও করতে পারবেন না। এই প্রসঙ্গে আমার প্রায়শই মনে হয়, স্বামী বিবেকানন্দের কথা। তাঁকে অভিবাদন জানিয়েও বলছি, মাঝে মাঝে আমার মনে হয়, তিনি যদি আরেকটু অন্য ধরনের মানুষ হতেন…। ধরা যাক, তিনি যদি মার্ক্স পড়তেন, তাঁর সময়ে ওসব পড়া অসম্ভব কিছু ছিল না, এবং তিনি যদি আরেকটু বাঁচতেন, কে বলতে পারে হয়তো তাঁকে কেন্দ্র করেই ভারতবর্ষের লিবারেশন থিওলজি দানা বাঁধত। সে যাই হোক, গুস্তাভো গিতিয়েরেজ নামে এক ভদ্রলোক লিবারেশন থিওলজির ওপর একখানা বই লেখেন। সেই বইয়ের মূল বক্তব্যটা হচ্ছে এই রকম, প্রভু যিশু মুৎসুদ্দি বেনিয়াদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন৷ দেবালয়ে বসে সেকালের মুৎসুদ্দিরা ব্যবসা চালাচ্ছিল, যিশু তাদের প্রহার করে সেখান থেকে উৎখাত করে দেন। না, যিশু কারও মাথা ফাটাননি, কোনও রক্তপাত ঘটাননি, কিন্তু তেড়ে গিয়ে ‘তবে রে ব্যাটা, বেরো’ বলে সেইসব সুবিধেভোগী ব্যবসায়ীদের তাড়িয়ে দিয়েছিলেন৷ এই ঘটনা বা এই ধরনের ঘটনাগুলিকে কেন্দ্র করে লিবারেশন থিওলজির তত্ত্বগুলো তৈরি হয়। আরেকটি বিখ্যাত বই, পাওলো ফ্রেইরির ‘পেডাগগি অফ দি অপ্রেসড’ নিয়েও সেইসময় চর্চা হয়েছিল, মার্ক্সবাদীরা এই বইটা নিয়ে প্রভূত চর্চা করেছিলেন, কলকাতায় অবশ্য এই বইটি নিয়ে আলোচনা তেমনভাবে কানে আসেনি। ঠিক সেই সময়, ব্রেজিলে খ্রিস্টান ধর্মযাজকরা মার্ক্সবাদীদের সঙ্গে কাজ করেছিলেন সেখানকার বস্তিতে বস্তিতে। অর্থাৎ এঁদের মধ্যে তখন লিবারেশন থিওলজি ঢুকে গেছে। ছয়ের দশকে ভ্যাটিকানের এক ধর্মযাজক ‘সেকেন্ড ভ্যাটিকান’ নামে এক আন্দোলন শুরু করেছিলেন। তাতে ক্যাথলিক ধর্মমতের সীমানার মধ্যে থেকেও পৃথিবীর দরিদ্র অঞ্চলগুলিতে যেসব বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ড বা সংগ্রাম চলছে, তার সঙ্গে সরাসরি হাত মেলানোর কথা বলা ছিল। অবশ্য ভ্যাটিকানের পরের পোপ এসে এই মতাদর্শকে দমিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু একথা আজ বলাই যায়, ছয় ও সাতের দশক ধরে বিশ্বজুড়ে একটা টালমাটাল অবস্থা চলছিল, যা থেকে লিবারেশন থিওলজি এবং ফাদার এর্নেস্তো কার্দেনালের মতো ব্যক্তিত্বের উদ্ভব হয়।
এর্নেস্তো কার্দেনাল ছিলেন একজন জেসুইট যাজক। আমার সঙ্গে ওঁর কীভাবে আলাপ হয়েছিল, এবার সেই কথাটা বলি। আমি তখন ‘দ্য আদার আমেরিকা’ নামে একটি বই লেখার চেষ্টা করছি। যেসব প্রতিষ্ঠানবিরোধী মানুষদের লেখাপত্র কলকাতায় বসে সংগ্রহ করতে ও পড়তে আমাদের কালঘাম ছুটে যায়, সেরকম একগুচ্ছ প্রতিষ্ঠানবিরোধী মানুষের একটি করে সাক্ষাৎকার যদি একখানি বইয়ে সঙ্কলিত করা যায়, তাহলে এই গ্রন্থ থেকে আমাদের দেশের মানুষ তাঁদের সম্বন্ধে অনেক কিছু জানতে পারবেন— এই অসভ্য অভিসন্ধি থেকে আমি সেই প্রজেক্টটি শুরু করি, নাম দিই – দ্য আদার আমেরিকা। এই প্রজেক্টে কোনওদিন কোনও ভারতীয় যাঁদের সাক্ষাৎকার নেননি, এমন সব মানুষদের ইন্টারভিউ নিয়েছিলাম। চমস্কি থেকে আরম্ভ করে আমিরি বারাকা, অ্যানেট রুবিনস্টাইন— যাঁর লেখা বই মাও সে তুং-ও পড়াতেন অর্থাৎ সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময় চিনের কমিউনিস্ট পার্টি পড়ানোর বন্দোবস্ত করেছিল— এরকম প্রচুর ব্যক্তিত্বের সাক্ষাৎকার সেই বইটিতে ছিল। এঁদের মধ্যে একজন মানুষ ছিলেন পিট সিগার৷ পিট সিগারকে কথায় কথায় আমার নিকারাগুয়া যাওয়ার স্বপ্নের কথা বলেছিলাম। তারপরে উনি কোনও কারণে একবার নিকারাগুয়া গিয়ে এর্নেস্তো কার্দেনালকে আমার কথা বলেন। নিকারাগুয়া মন্ত্রকে একটি চিঠিও দেন। চিঠিতে পিট লিখেছেন, সুমন চ্যাটার্জি নামে এক ভারতীয় সাংবাদিকের সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছে। তাঁর ভারি ইচ্ছে তিনি নিকারাগুয়ায় গিয়ে সবকিছু দেখেশুনে এসে সেখানকার বিপ্লবের গল্প নিজের দেশবাসীকে শোনাবেন। আপনি যদি এ বিষয়ে একটু সাহায্য করেন। বলে রাখি, পিটের এই চিঠি পাঠানোর আগে আমি নিজেই নিকারাগুয়ার সংস্কৃতি মন্ত্রক থেকে শুরু করে চেনা-অচেনা বিভিন্ন মানুষকে প্রায় শ তিনেক চিঠি পাঠিয়ে ফেলেছি, একাধিকবার ফোনও করেছি। অবশ্য তাতে কাজের কাজ কিছু হয়নি। আমি মাঝে মাঝে নিকারাগুয়ার দূতাবাসে ফোন করতাম। ওরা বলতেন, দেখুন, কিছু মনে করবেন না। আপনার আগ্রহের জন্য অনেক ধন্যবাদ, কিন্তু এই মুহূর্তে সেই রকম কোনও সুযোগের অবকাশ নেই। অবশেষে পিট সিগার একটি চিঠি পাঠানোয় ফাদার কার্দেনাল নিজে আমাকে একটি আমন্ত্রণপত্র পাঠালেন, “তুমি এসো আমার দেশে, এসে কাজ করো।” আমিও পত্রপাঠ আমেরিকার চাকরি ছেড়ে নিকারাগুয়ার প্লেনে চড়ে বসলাম।
ভয়েস অফ আমেরিকার পাকা চাকরি ছেড়ে অনিশ্চিতের উদ্দেশ্যে পা বাড়ানো— আমাকে আজ যারা ‘মমতার দালাল’ বলে গালি দেন, তারা আমার এই কাজের মর্মার্থ কতটা উপলব্ধি করতে পারবেন, জানি না। এমনকি আজিজুল হক নামে একজন মহানুভব বিপ্লবী আছেন, আমি যখন লোকসভা ভোটে দাঁড়িয়েছিলাম, আজকালে আমাকে নিয়ে তিনি একখানা চিঠি লিখেছিলেন, যার শিরোনাম ছিল- ‘কেউটে সাপকে গর্তে পুড়ে দিন’। সেখানে তিনি লিখেছেন, আমাকে নাকি সিআইএ চর বানিয়ে নিকারাগুয়া পাঠিয়েছিল, সেখানকার বিপ্লব ধ্বংস করে দেওয়ার জন্য। ভাবতে পারছেন, প্রিয় পাঠক, আমার কতখানি ক্ষমতা! সেই সময় লেখাটা পড়ে নিজেকে প্রায় ফ্যান্টম অথবা জেমস বণ্ড-এর সমতুল্য মনে হচ্ছিল আমার। এই তো হল আমাদের দেশের বিপ্লববাদীদের চিন্তাভাবনার দৌড়!
যাই হোক, আমি তো প্লেনে করে নিকারাগুয়া পৌঁছলাম এবং ঠিক এখান থেকেই ফাদার এর্নেস্তো কার্দেনালের সঙ্গে আমার দীর্ঘ ও আন্তরিক পরিচয়পর্বটি শুরু হল। ফাদার কার্দেনাল একনায়ক সোমোজার আমলে সলেন্তিনামে দ্বীপে একটা আশ্রম তৈরি করেছিলেন। এখানেই তাঁর বিখ্যাত বই ‘গসপেল অফ সলেন্তিনামে’ রচিত হয়েছিল। সেই আশ্রমে ছবি আঁকা হত, নানা ধরনের শিল্পসৃষ্টি হত, এবং পাশাপাশি দরিদ্র নিপীড়িত মানুষের জন্য কল্যাণমূলক কাজকর্ম করা হত। এই উদ্যোগটিকে আমরা শিল্পগ্রাম বা চেতনাগ্রাম বলতে পারি। এই শিল্পগ্রামে আঁকা একটি ছবির কথা এই মুহূর্তে আমার মনে পড়ছে, ঝড়ে বিক্ষুব্ধ সমুদ্রে ভাসমান একটি নৌকো, তাতে আশ্রয় নিয়েছেন শঙ্কিত নিরাশ্রয় মানুষ, এবং স্বয়ং যিশু সেই নৌকোর মাঝি অর্থাৎ পরিত্রাতা। আত্মার দিক থেকে এই আশ্রমটিকে আমরা মহাত্মা গান্ধির সবরমতী আশ্রমের সঙ্গে খানিকটা তুলনা করতে পারি। আমার নিজেকে খুঁজে পাওয়া ও তার মধ্যে দিয়ে সমাজকে খুঁজে পাওয়া, অথবা সমাজকে খুঁজে পাওয়ার মধ্যে দিয়ে নিজেকে খুঁজে পাওয়া— এটাই ছিল সলেন্তিনামের দর্শন৷ কেন এই আশ্রম গড়ে তুলেছিলেন ফাদার কার্দেনাল? আমি তাঁকে প্রশ্ন করেছিলাম, “ফাদার, আপনি কেন প্রিস্ট হলেন?” উত্তরে তিনি আমাকে প্রশ্ন করলেন, “আচ্ছা সুমন, তুমি কখনও প্রেমে পড়েছ?” আমি হেসে বললাম, “সারাক্ষণই।” ফাদার কার্দেনাল তখন আমাকে বললেন, “আমি এত প্রেমে পড়তাম, কী বলব বাবা, আমার তো প্রেমের চোটে পাগল হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। আমি দেখলাম, এভাবে তো চলতে পারে না। তাই আমি একদিন ঈশ্বরকে বললাম, হে ভগবান তুমি আমার সমস্ত প্রেম নিয়ে নাও। সেইদিন থেকে আমার সমস্ত প্রেম আমি ঈশ্বরকে অর্পণ করলাম।” এইরকম একজন ভীষণ মিষ্টি ও মজার লোক ছিলেন ফাদার কার্দেনাল। আমার সঙ্গে দেখা হলে উনি আমার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেন, যেমনভাবে একটি ছোট বাচ্চাকে, একজন অবুঝ শিশুকে তার মা বা বাবা গায়ে হাত বুলিয়ে শান্ত করেন, উনি আমার সঙ্গে ঠিক তেমন ব্যবহার করতেন। আমি অবশ্য অবুঝ বালকের মতোই ছিলাম। মাঝে মাঝে ফাদারকে ভয়ঙ্কর সব প্রশ্ন করে ফেলতাম, সশস্ত্র বিপ্লবের কথা বলতাম। ফাদার আমার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে স্নেহের সুরে বলতেন, সুমন… আস্তে আস্তে… তুমি কী লিখলে দেখাও… কতদূর লিখলে… তোমাকে তো এখানে লিখতে এনেছি, বাবা… এসব কথা বলার জন্য তো নয়…. ওই বিষয়টা কি লেখাতে ধরেছ… তোমার মতে আর কী কী করা দরকার ইত্যাদি ইত্যাদি। ওঁর মাপের একজন মানুষের কাছ থেকে এত সহজ সরল আন্তরিক ব্যবহার, ভাবতেই পারা যায় না।
ইতিমধ্যে ওঁর সঙ্গে লাতিন আমেরিকার অন্যান্য দেশের বিপ্লববাদীদের একটা গভীর যোগাযোগ তৈরি হয়েছে। ফিদেল কাস্ত্রো ওঁকে একাধিকবার হাভানায় নিয়ে গেছেন। সেখানকার কবিতা উৎসবে উনি সভাপতি। প্রসঙ্গত, কিউবাতে একাধিকবার ভ্রমণের ওপর ভিত্তি করে এর্নেস্তো কার্দেনালের লেখা একটি অসামান্য বই রয়েছে— ইন কিউবা। আমি আমার পাঠক বন্ধুদের বলব, বইটা বেশি দামে হলেও সংগ্রহ করে অবশ্যই পড়ুন। এর্নেস্তো কিউবাকে যেভাবে দেখেছেন, সাধারণ মানুষের সঙ্গে সময় কাটিয়েছেন— বিপ্লবোত্তর কিউবার ভালোমন্দ সবকিছু উঠে এসেছে তাঁর সেই লেখায়। এমনকি ফিদেল কাস্ত্রোর ব্যক্তিত্বের নানা দিক ছিল, সেইসব অন্য প্রসঙ্গ, কিন্তু এর্নেস্তো কার্দেনালের লেখা থেকে আমরা জানতে পারছি, কিউবার প্রতিটি শিশুর জন্মদিন পালন করার বন্দোবস্ত করে দিয়েছিলেন ফিদেল কাস্ত্রো সরকার। তাতে সরকারের তরফ থেকে কুড়ি বা তিরিশটা স্যান্ডউইচ দেওয়া হত। এবং লেমোনেড। অর্থাৎ ওই সংখ্যক ছেলেমেয়েকে জন্মদিনে নিমন্ত্রণ করার ব্যবস্থা করে দেওয়া হত। কিউবার প্রতিটি নববিবাহিত দম্পতিকে মধুচন্দ্রিমায় যাওয়ার টাকা দেওয়া হত, বেড়াবার জায়গা ঠিক করে দেওয়া হত, এবং সেখানে গিয়ে হোটেলে থাকার খরচও দেওয়া হত।
যাই হোক, যেটা বোঝাতে চাইছি তা হল এর্নেস্তো কার্দেনাল একটা অদ্ভুত মানুষমুখো লোক। ওঁর ব্যাপারখানা হল এইরকম– অতশত তত্ত্ব বুঝি না, সোজাসাপটা একটাই কথা, আমাদের একটা শোষণমুক্ত সমাজ গড়তে হবে। প্রশ্ন হল, সেই পথে আমরা কীভাবে এগোব? সেই পথে যেতে গেলে যেখানে মার্ক্সবাদ সহায়ক, সেখানে মার্ক্সবাদকে, যেখানে গান্ধিবাদ সহায়ক, সেখানে গান্ধিবাদকে ব্যবহার করতে হবে। এই শোষণমুক্ত সমাজ কিন্তু নাস্তিক সমাজ না-ও হতে পারে৷ যে যার ধর্ম নিয়ে থাকো, ভালো থাকো, তবে মনে রেখো দেশটা কিন্তু সক্কলের। দেশটাকে যেন কোনও ধর্ম না চালায়! অর্থাৎ এই হচ্ছেন পাদ্রে এর্নেস্তো বা ফাদার এর্নেস্তো, যাঁকে গোটা নিকারাগুয়া পাদ্রে বলে ডাকত, এমনকী পিট সিগারও তাঁকে পাদ্রে বলেই ডাকতেন। বিপ্লবের প্রয়োজনে তিনিই আবার কমান্দান্তে এর্নেস্তো বা কম্যান্ডার এর্নেস্তো। এঁর সমতুল্য কোনও ব্যক্তিত্বকে আমরা আমাদের দেশে দেখার সু্যোগ পাইনি। ফাদার কার্দেনাল ছিলেন এমন একজন ধর্মযাজক, যাঁর ধর্ম শোষিতের পাশে দাঁড়ানো। উনি বলতেন, জেসাস লেড মি টু মার্ক্স৷ এর্নেস্তো কার্দেনাল ধর্মযাজক হয়েও কোনওদিন বিপ্লব থেকে মুখ ফিরিয়ে নেননি। প্রথম যৌবনে তিনি তাঁর সমমনস্কদের নিয়ে প্রথমবার রাষ্ট্রবিপ্লবের স্বপ্ন দেখেছিলেন যা এপ্রিল বিপ্লব নামে পরিচিত। এই বিপ্লব ব্যর্থ হয়। সালটা ১৯৫৪। তখনও তিনি যাজক হননি। যাজক হবার পরেও কিন্তু তিনি বিপ্লবের পথ থেকে সরে আসেননি, সান্দিনিস্তা মুক্তিফ্রন্টের পক্ষ নিয়ে আবার শোষিত মানুষদের অধিকার আদায়ের জন্য বিপ্লবের পথে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। আমাদের দেশের অরবিন্দ ঘোষের সঙ্গে এর্নেস্তোর পার্থক্য এখানেই। অরবিন্দ ঘোষ সশস্ত্র বিপ্লব করতে গিয়ে ধরা পড়ার ভয়ে পন্ডিচেরী পালিয়েছিলেন, যদ্দিন বেঁচেছিলেন আর কোনওদিন এমুখো হননি। এর্নেস্তো কার্দেনালরা অবশ্য এইরকম লোক ছিলেন না। শুধু নিকারাগুয়া নয়, লাতিন আমেরিকাতেই অন্য দেশগুলির যেমন এল সালভাদোর বা গুয়াতেমালার দিকে আমরা যদি তাকাই, সেখানেও দেখতে পাব খ্রিস্টান ধর্মযাজকরা মার্ক্সবাদীদের পাশে দাঁড়িয়ে দেশের মুক্তির জন্য একসাথে লড়াই করছেন, আর তাতে কারও কোনও অসুবিধে হচ্ছে না।
আমার সঙ্গে এর্নেস্তো কার্দেনালের যেদিন প্রথম দেখা হল, আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, “আপনি কেমন আছেন, ফাদার?” উনি বলেছিলেন, “খুব খারাপ আছি, সুমন! বড় কবিতা লিখতে পারছি না।” আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কেন?“ উনি বলেছিলেন, “তুমি তো দেখছি কোনও খবরই রাখো না। যুদ্ধ চলছে। আমাকে এদিক ওদিক দৌড়তে হচ্ছে। আমি সংস্কৃতিমন্ত্রী বলে কি এই সময়ে আমার হাত গুটিয়ে বসে থাকলে চলবে? বড় কবিতা লেখার আর সময় কোথায়?” আমি বললাম,”তাহলে কী করছেন?” উত্তর এল, “কী করব আবার! ছোট কবিতা লিখছি!” এই হলেন এর্নেস্তো কার্দেনাল। তাঁর ব্যক্তিত্বের এই দিকটার কথা মানুষ বিশেষ জানেন না। তাঁর কবি পরিচয়টা তার কাছে আলাদা ভারিক্কি ধরনের কোনও পরিচয় ছিল না, বরং তাঁর যাপনের সঙ্গেই অত্যন্ত সহজভাবে জড়িয়ে ছিল। নিকারাগুয়াতেই দেখেছি, যুবকেরা দলে দলে মুক্তিফৌজে যোগ দিচ্ছেন। ট্রাকে করে যুবকদের এক জায়গায় আনা হচ্ছে, অন্য একটি ট্রাকে এম-১৬ বা অন্য নানা ধরনের রাইফেল আসছে। তাদের সামনে দাঁড়িয়ে দেখেছি, একের পর এক যুবক লাইন দিয়ে আসছেন, একটি করে রাইফেল হাতে তুলে নিচ্ছেন, এবং বলছেন, “আমি বিশ্বমানবতা, লাতিন আমেরিকা আর কমান্দান্তে চে গেভারার নামে এই বন্দুকটি নিলাম।” লক্ষণীয়, একবারের জন্যও কমিউনিজম শব্দটি উচ্চারণ করছেন না তারা। আমার ‘মুক্ত নিকারাগুয়া’ বইতে আমি এসব কথা লিখেছি। খুব ভালো লিখতে পারিনি। লিখতে গিয়ে ভীষণ আবেগ এসে গিয়েছিল। আমার আবেগমুক্ত হয়ে লেখা উচিত ছিল। ওই যে আসলে মধ্যবিত্ত বাঙালি তো, একটা আস্ত বিপ্লবকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছি, আর ছাড়ি! আমি কেঁদেকেটে, গান গেয়ে, পদ্য লিখে নৈর্ব্যক্তিকতার একবারে বারোটা বাজিয়ে ফেলেছিলাম আর কী!
মোদ্দা কথাটা হল, এর্নেস্তো কার্দেনাল ছিলেন একজন ধর্মযাজক, যে যাজক বিপ্লবের কথা বলতেন। এই বিপ্লব মানে কিন্তু পরিপূর্ণ ও প্রথাগত অর্থে কোনও মার্ক্সিস্ট বিপ্লব নয়। ঠিক যেমন সান্দিনিস্তা সরকার মার্ক্সবাদী ছিলেন না, তারা মিশ্র অর্থনীতিতে বিশ্বাস করতেন। আর এর্নেস্তো কার্দেনাল ছিলেন সেই সরকারের অর্থাৎ ‘Government of National Reconstruction’ বা জাতীয় পুনর্নির্মাণকামী সরকারের সংস্কৃতি দপ্তরের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী। তারা মার্ক্সবাদী নন, প্রথাগত অর্থে কমিউনিস্ট নন। তাদের কাছে বিপ্লব মানে সমাজটাকে একেবারে একটা পাক ঘুরিয়ে দেওয়া। নিকারাগুয়ার ওপরে আমার একটা ক্যাসেট ছিল— বিপ্লব সম্পর্কিত তথ্য আর গানের অ্যালবাম। তাতে একটা গান ছিল, ‘বিপ্লব মানে সমাজটাকে ঘুরিয়ে দেওয়া নাগরদোলায়/ বুভুক্ষু সব লোকগুলোকে পৌঁছে দেওয়া ধানের গোলায়’। অর্থাৎ বিপ্লব মানে যেন চোখের সামনে একটা রাস্তা তৈরি হয়ে যাচ্ছে, আমরা আগে যেভাবে জিনিসগুলোকে দেখতাম, সেভাবে আর দেখছি না। যেমন, একটা ঘটনার কথা উল্লেখ করি যেটা এর্নেস্তো কার্দেনালের পরিকল্পনা অনুযায়ী হয়েছিল। আমরা নিকারাগুয়ায় একটা গেস্ট হাউসে থাকতাম। আমরা বলতে দুজন ফরাসি কম্পানিয়েরো, চার-পাঁচজন সোভিয়েত কম্পানিয়েরো এবং দুজন আমেরিকান কম্পানিয়েরো, ম্যালকম আর স্টেসি। কম্পানিয়েরো ও কমরেড শব্দদুটির মধ্যে কিঞ্চিৎ তফাত আছে। কম্পানিয়েরো মানে কম্পানিয়ন, সঙ্গী বা ‘ভায়া’, আমাকে যদি কেউ ‘ওহে কবীর ভায়া’ বলে ডাকেন, অনেকটা সেইরকম। নিকারাগুয়ায় গ্রামের চাষিরা একে অপরকে কম্পানিয়েরো বলতেন, সংক্ষেপে কম্পা। তা আমি ও আমার কম্পানিয়েরোরা সবাই মিলে একটি বাড়িতে থাকতাম, বাড়িটা ছিল আমাদের থাকার জন্য প্রদত্ত সরকারি গেস্টহাউজ। ওই বাড়িতে যাঁরা আমাদের দিদি ছিলেন, অর্থাৎ গৃহপরিচারিকা, যাঁরা আমাদের জন্য রান্নাবান্না করতেন, অন্যান্য কাজে সাহায্য করতেন, তাঁরা কেউই পড়াশুনো শেখেননি, বস্তুত সোমোজার আমলে পড়াশুনো করার সুযোগই পাননি। বিপ্লবোত্তর আমলে এখন তাঁরা সবাই লেখাপড়া শিখছেন। সেরকমই ব্যবস্থা করে দিয়েছেন সংস্কৃতি মন্ত্রী ফাদার কার্দেনাল। এখন দিদিদের সবাইকে নিজের ভাষায় ছোট ছোট রচনা লিখতে হত, আমরা মাঝেমধ্যে একটু সাহায্য করতাম। আমি অত ভালো স্প্যানিশ জানতাম না। আমাদের দলের মধ্যে কম্পানিয়েরো স্টেসি সবচেয়ে ভালো স্প্যানিশ জানতেন। তিনি ছিলেন একজন আমেরিকান, ছবির সম্পাদনা করতেন, নিকারাগুয়া এসেছিলেন বিপ্লবের ওপরে বানানো একটা চলচ্চিত্র এডিট করতে। আমি মাঝেমধ্যে নাক গলাতাম, দেখতাম ওঁরা কী লিখছেন। একদিন দেখলাম ওঁদের ছোট একটি রচনা লিখতে দেওয়া হয়েছে। রচনার বিষয়— আমি আর কোনওদিন ভয় পাব না। আমি কোথাও দেখিনি যে লেখা আছে এখনই কমিউনিজম কায়েম করতে হবে। লাল উল্কিতে পরস্পরকে চেনা, অথবা একটা উদার সমাজতান্ত্রিক দেশ গড়তে হবে, এমন কথাও কখনও শুনিনি। কোথাও কোনওকিছু জোর করে গিলিয়ে দেওয়ার প্রয়াস ছিল না। এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কে, না আমি, অর্থাৎ ব্যক্তি আমি এখানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যে ‘আমি’কে বাদ দিয়ে সমাজ নয়, বিপ্লবও নয়।
আমি মানাগুয়ার রাস্তায় একদিন দুপুরে একটা ছোট ছেলেকে দেখেছিলাম। ছেলেটার প্রায় খালি গা৷ একটা স্যান্ডো গেঞ্জি আর হাফপ্যান্ট পরে খালি পায়ে রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাকে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, “এই তোর স্কুল নেই?” সে বলল, “হ্যাঁ, আছে তো।” “কখন?” “সকালে।” “স্কুলে গিয়েছিলি?” “হ্যাঁ।” আমি এদিক ওদিক তাকিয়ে তখন তাকে জিজ্ঞেস করলাম, “আচ্ছা, শোন, তোদের এখানে বিপ্লব হয়েছে, জানিস?” সে খুব বিরক্ত মুখে আমার দিকে তাকিয়ে বললে, “হ্যাঁ।” “বিপ্লব মানে কী রে বাবা?” সে অনেকক্ষণ চুপ করে থাকল, তারপর আমার দিকে তাকিয়ে উত্তর দিল, “আমিই বিপ্লব।” বলেই চলে গেল। অর্থাৎ মানুষের মনের মধ্যে অন্তত একটা জিনিস ঢুকিয়ে দেওয়া গেছে যে আগে যা ছিল, সেটা আর থাকছে না। নতুন দিন এসেছে। এবার এই নতুন দিনটা কেমন হবে সেটা আস্তে আস্তে বোঝা যাবে। সেটা এক্ষুণি বলে দেওয়া যাচ্ছে না।
ফাদার কার্দেনাল দেশের সক্কলের আপনজন ছিলেন। অবশ্য শুধুমাত্র ফাদার কার্দেনালই নন, থমাস বোর্হে, যিনি ছিলেন মূল সান্দিনিস্তা দলটা যারা তৈরি করেছিলেন, সেই দলের মধ্যে একমাত্র জীবিত সদস্য। আমি যখন নিকারাগুয়ায়, তখন তিনি সান্দিনিস্তা সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। বোর্হেও সেদেশের সাধারণ মানুষের অত্যন্ত কাছের লোক ছিলেন। বিপ্লবোত্তর নিকারাগুয়ায় আমি থমাস বোর্হেকে বহুবার দেখেছি, তিনি খোলা রাস্তায় হাঁটছেন, যেখানেই যাচ্ছেন মানুষ এসে ওঁকে জড়িয়ে ধরছে। এবং বিরক্ত করছে, “কী হল, খুব তো বলেছিলে, বিপ্লব হলে এটা দেবে, সেটা দেবে! খাবার পাব। ওষুধ পাব। কিছুই তো পাচ্ছি না। কী হে!” আমি এসব দেখে থমাসের দেহরক্ষীর দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করলাম, “এই দেখো, কীসব হচ্ছে।” সে আমার কথায় পাত্তাই দিল না, “ধুর, এখানে কিস্যু হয় না।” ঠিক তেমনিভাবে, ফাদার এর্নেস্তো কার্দেনাল একদিন রাস্তায় বেরিয়েছেন, আমি দেখেছি, চারদিক থেকে অন্তত তেতাল্লিশটা ছেলে ছুটে এসে তাঁকে জড়িয়ে ধরল। “গুরু, গিটারের তার নেই। গানবাজনাটা উঠে যাবে নাকি? তার কোথায় পাব?” অর্থাৎ মানুষের সঙ্গে ফাদার কার্দেনালের কোনও দূরত্ব তো নেই-ই, বরং দেশের সংস্কৃতিমন্ত্রীকে জাপটে ধরে দুটি ছেলে গিটারের তার চাইছে, আমাদের দেশে আমরা এই দৃশ্য দেখব তা ভাবতেই পারি না। ওঁর দেহরক্ষী তখন একটু দূরে আমার সঙ্গে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছে। এর্নেস্তো আমাকে হেঁকে বললেন, “এই সুমন, একটা সিগারেট দাও না!” আমি এগিয়ে গিয়ে ওঁকে সিগারেট দিলাম। উনি সিগারেট খেতে খেতে বললেন, “আমি তোমাদের গিটারের তার এক্ষুণি কীভাবে এনে দেব?” “ওসব জানি না। দিতেই হবে।” “আচ্ছা, আমি বলে দিচ্ছি, যাও, ওখানে গেলে পেয়ে যাবে।” তারপর এলেন একজন বৃদ্ধা, তিনিও এসে ফাদার কার্দেনালকে জড়িয়ে ধরে বলছেন, “হ্যাঁ রে, তোর লজ্জা করে না? ওষুধ-বিষুধ কিছুই তো পাওয়া যাচ্ছে না রে। এটা কী ঘোড়ার ডিমের বিপ্লব করলি বাপ!” এইভাবে তারা কথা বলছেন দেশের একজন মন্ত্রীর সঙ্গে, এতখানি কাছের মানুষ ছিলেন ফাদার কার্দেনাল। এসব ঘটনা অবিশ্বাস্য মনে হবে, কিন্তু এ সবই আমার নিজের চোখে দেখা।
এখানে প্রশ্ন আসতে পারে, ফাদার কার্দেনালের কোন ব্যক্তিত্বটাকে আমরা এগিয়ে রাখব? তিনি কি প্রথমে একজন ধর্মযাজক? নাকি কবি? নাকি তিনি প্রথমত ও শেষপর্যন্ত একজন বিপ্লবী? শুধু বিপ্লবী নয়, সশস্ত্র বিপ্লবে বিশ্বাসী একজন বিপ্লবী। এর মধ্যে কোন পরিচয়টা আগে? তাঁর জীবনের মধ্যে থেকেই এর উত্তর আমাদের খুঁজতে হবে। হুইম ভেন্ডারস (Wim Wenders) নামে এক অসামান্য জার্মান চলচ্চিত্র পরিচালক নিকারাগুয়ার বিপ্লব-বিরোধীদের ওপর একটা সিনেমা বানিয়েছিলেন। ফাদার কার্দেনাল নিকারাগুয়ার সংস্কৃতি মন্ত্রী হিসেবে সেই গরিব দেশের রাজকোষ থেকে টাকা দিয়ে সেই ডকুমেন্টারিটার আট বা দশ কপি কিনেছিলেন এবং সারা দেশে দেখানোর ব্যবস্থা করেছিলেন। ফাদার আমায় নিজে বলেছিলেন, “সুমন, তোমার এই বইতে আমাদের দেশের বিপ্লববিরোধীদের কথা থাকছে তো? মনে রেখো, ওটা যদি না থাকে, তাহলে আমি বুঝব তুমি বিপ্লবের কিছুই বুঝলে না কোনওদিন।” এটা সারাজীবন ধরে আমি মনে রেখেছি। বিপ্লবের অন্য কোনও দিক নয়, যেকোনও রাষ্ট্রবিপ্লবের এটাই আসল অভিমুখ। এই দিকটা ছিল না বলে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেছে, পূর্ব ইউরোপের দেশগুলি থেকে সমাজতন্ত্র উঠে গেছে, এমনকি এখনকার চিন বস্তুত একটি প্রায় উঠে-যাওয়া দেশ। চিনে এখন যাকে-তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া যায়, তার বিরুদ্ধে কোনও আপিল হয় না, কোর্টের বাইরে নিয়ে গিয়ে একটা গাড়িতে বসিয়ে পাছায় একটা ইঞ্জেকশন দিয়ে মেরে ফেলা হয়। যা ইচ্ছে তাই করা যায়। এই মুহূর্তে মুসলমানদের ওপর কি অকথ্য অত্যাচার হচ্ছে চিনে। অথচ এই চিনে যখন বিপ্লব হয়েছিল, তখন শূকরের মাংস ছিল চিনের একটি প্রধানতম খাদ্য, স্টেপল ফুড। কিন্তু মুসলমানেরা শূকর খান না বলে সেই সময় তাদের গোরুর মাংসের জন্য আলাদা রেশন কার্ড দেওয়া হত। সেই অবস্থা থেকে নামতে নামতে আজ এই জায়গায় এসে পৌঁছেছে চিন।
রোজা লুক্সেমবার্গ-এর একটা তত্ত্ব ছিল যেটা লেনিন মানতে চাইতেন না, যে কারণে লেনিনের সঙ্গে লুক্সেমবার্গ-এর মতবিরোধ হয়েছিল, তত্ত্বটা ছিল— ‘স্বাধীনতা সবসময় তাদের, যারা অন্যরকম ভাবনাচিন্তা করে’। খুবই গুরুত্বপূর্ণ এই কথা। এই দর্শনটাই নিকারাগুয়া চর্চা করেছিল, এবং এর প্রধান স্থপতি ছিলেন থমাস বোর্হে এবং ফাদার এর্নেস্তো কার্দেনাল। বিপ্লবোত্তর নিকারাগুয়াতে বিপ্লব-বিরোধীদের অধিকারের জায়গাটা বুঝতে হলে আমাদের আরেকবার থমাস বোর্হের কাছে যেতে হবে। থমাস বোর্হের ওপর সোমোজার আমলে দীর্ঘদিন ধরে অত্যাচার হয়েছিল। দিনের পর দিন তাঁকে শেকল বেঁধে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছিল। উনি ওইভাবেই পায়খানা-প্রস্রাব করতেন। অর্থাৎ মধ্যযুগে চার্চ ইনকুইজিশনের সময় যে শাস্তি দিত, সেই শাস্তিই থমাস বোর্হেকে দেওয়া হয়েছিল। সোমোজার লোকজন থমাসের স্ত্রীকে ধরে নিয়ে গিয়ে তাঁর ওপর যৌন নির্যাতন চালাত। সেই নির্যাতনের ছবি তোলা হত, রেকর্ডিং করা হত। তারপর ওঁকে কুপিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। পরে সেই সমস্ত ছবি ও রেকর্ডিং বন্দি থমাস বোর্হেকে নিয়মিত দেখানো এবং শোনানো হত। থমাস বোর্হে শুধু বলেছিলেন, “আমরা একদিন কিন্তু জিতবই আর সেদিন আমি এই সবকিছুর শোধ নেব।” ইতিমধ্যে ডোরা মারিয়া টেলেজ নামে এক তরুণী, সান্দিনিস্তা দলের এক গেরিলা যোদ্ধা, তাঁর সঙ্গীদের একটা ছোট্ট দল নিয়ে একবার মানাগুয়ায় মার্কিন রাষ্ট্রদূতের বাড়ি অবরোধ করেন। সেখানে তখন একটি পার্টি চলছিল। অতিথিরা ছিলেন৷ গেরিলারা এই অবরোধ তোলার জন্য কিছু শর্ত দিয়েছিল, যার মধ্যে একটি শর্ত ছিল বিপ্লবীদের নিঃশর্ত মুক্তি। এই ঘটনার ফলে থমাস বোর্হে সেই দীর্ঘ নির্যাতন থেকে মুক্তি পান।
বিপ্লবের পরে যখন রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করা হয়, সোমোজার ওইসব অত্যাচারী লোকজনের রাউন্ড আপ হয়। যারা এই অত্যাচারগুলো করেছিলেন, তাদের ধরে আনা হয়। চারদিকে লক্ষ লক্ষ লোক, সকলে বলছে যে এদের ফাঁসি হোক। থমাস বোর্হে বললেন, “তোমরা আমাদের এতখানি ঘৃণা করতে যে আমাদের ওপর এই ধরনের অত্যাচার করতে পেরেছিলে, তাই না? আজ এসো, আমাকে আলিঙ্গন করো। এটাই তোমাদের শাস্তি৷ তারপর ফিরে যাও, দেশের কাজ করো।” এটা সরাসরি খ্রিস্টধর্মের ক্ষমার জায়গা থেকে আসছে, যার কথা ফাদার কার্দেনালও বারবার বলেছেন। নিকারাগুয়ার বিপ্লব তাই খ্রিস্টধর্মকে বাদ দিয়ে হয়নি। তেমনি কিউবাতেও যে বিপ্লব হয়েছিল তাতেও কিন্তু খ্রিস্টধর্মের কিছু গুণগত বৈশিষ্ট্যকে বাদ দিয়ে বা তাকে গালাগাল করে হয়নি। কোথাও একবারের জন্যেও ধর্ম একটা পাপ বা অভিশাপ, এ কথা বলা হয়নি। কার্ল মার্ক্সের যে উক্তিটা আমরা শুনে থাকি তার শুরুটা ছিল এইরকম— “ধর্ম হল নিপীড়িতের চিৎকার।” “ধর্ম মানবজাতির আফিম”, এই কথাটা বাক্যটির সবচেয়ে শেষে ছিল, আমরা তথাকথিত প্রগতিশীলরা শুধুমাত্র শেষের কথাটুকু মনে রেখে দিয়েছি, প্রথম অংশটিকে স্মরণে রাখিনি। লাতিন আমেরিকা কিন্তু ধর্মকে উৎপীড়িতের আর্তনাদ হিসেবেই দেখেছিল, এবং এটা মনে রেখেই সেখানকার বিপ্লবগুলি সাধিত হয়েছিল, এটা আমাদের মনে রাখতে হবে৷ অতএব ফাদার এর্নেস্তো কার্দিনাল সলেন্তিনামের গসপেলের রচয়িতা বা উদগাতা শুধু নন, সলেন্তিনামে দ্বীপের যে শিল্পমণ্ডপ তার প্রতিষ্ঠাতা শুধু নন, বিপ্লবী নিকারাগুয়ার যেটা ভাব ও দর্শনের জায়গা, তার প্রধান স্থপতি ও ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন এই ফাদার এর্নেস্তো কার্দেনাল।
আর মাত্র দুটি ঘটনার উল্লেখ করব যা থেকে নিকারাগুয়ার বিপ্লবের ভাববিশ্ব ও তাতে ফাদার কার্দেনালের ভূমিকা আরেকটু স্পষ্ট হয়ে উঠবে। মানাগুয়া থেকে তখন একটি পত্রিকা বার হত, এই মুহূর্তে নামটা মনে পড়ছে না, পত্রিকারটির প্রধান ছিলেন সেদেশের একজন কবি। তাঁর নাম ছিল পাবলো আন্তোনিয় কুয়াদ্রা। সেই কাগজের তরফ থেকে নিয়মিত ও প্রচণ্ডভাবে সান্দিনিস্তা সরকারের বিরোধিতা করা হত। এবং সেই পত্রিকার বিরোধিতার জায়গাগুলি উদ্ধৃত করে তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রপতি রনাল্ড রেগন প্রতি সপ্তাহে বক্তৃতা করতেন৷ আমি একবার মানাগুয়ায় ওই ভদ্রলোকের সাক্ষাৎকার নিতে গিয়েছিলাম। ভদ্রলোকটি আমার সামনে বসে অনর্গল বলে যাচ্ছেন, নিকারাগুয়ায় সান্দিনিস্তা সরকার নাকি সাধারণ মানুষকে কোনও স্বাধীনতা দিচ্ছে না। আমি শুনতে শুনতে ভেতরে ভেতরে খেপে যাচ্ছি। ওই সাক্ষাৎকারের সময় আমার সঙ্গী, আমার কম্পান্তিয়েরো ছিলেন নিকারাগুয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের একজন কর্মচারী। তাঁকে পাঠানো হয়েছে আমাকে গাইড করার জন্য, তিনি তখন ঠিক আমার পাশেই বসে ছিলেন৷ আমি কুয়াদ্রার কথা শুনে খেপে উঠছি বুঝতে পেরে, উনি আমার হাতটা ধরে আস্তে করে বললেন, “কম্পানিয়েরো, ভুলে যেও না, ওঁর অধিকার আছে আমাদের বিরুদ্ধে কথা বলার। প্লিজ, ওঁকে বলতে দাও।” তারপরেও তিনি গালাগাল দিয়ে যাচ্ছেন। আমি অবশেষে না থাকতে পেরে বলেই ফেললাম, “আপনি সম্ভবত বেশি বলছেন। আপনার সব অভিযোগ যদি সত্যি হয় তাহলে আমি আপনার কাছে এই ধরনের প্রশ্নগুলো করতে পারছি কী করে? আর আপনিই বা বিনাবাধায় এগুলো বলে যাচ্ছেন কী করে? এ থেকেই কি প্রমাণ হয় না যে আপনি যা বলছেন, নিকারাগুয়া সরকার সেরকমটা নন?” আমার সঙ্গী কিন্তু সমানে আমাকে হাত ধরে শান্ত করার চেষ্টা করছেন– “কম্পানিয়েরো, ওঁকে বলতে দাও।” এই স্পিরিটটাই কিন্তু প্রকৃতপক্ষে নিকারাগুয়ার বিপ্লবের স্পিরিট। আর থমাস বোর্হে ও ফাদার এর্নেস্তো কার্দিনাল ছিলেন এরই প্রবক্তা।
আজ স্বীকার করছি, নিকারাগুয়া যাওয়ার কিছুদিন পর একটি কথা আমার মনে হয়েছিল, এ জিনিস বেশিদিন টিঁকতে পারে না। মানুষ এত ভালো নয়। এঁরা একটা স্বপ্নের ছবি এঁকেছিলেন। একটা আস্ত স্বপ্ন। স্বপ্নটার অস্থিচর্ম, মেদ, মাংস, রক্ত, দেহরস মেলানো অভিব্যক্তিগুলো আমি ওখানকার মানুষজনের মধ্যে দেখার সুযোগ পেয়েছি। পাশাপাশি ভয়ও পেয়েছি, এটা বেশিদিন টিঁকে থাকতে পারবে তো? আমি এর্নেস্তো কার্দেনালের একজন ভক্ত হিসেবে, তাঁর সন্তান হিসেবে, একজন সামান্য মানুষ যে চর্মচক্ষে তাঁকে দেখে চোখ সার্থক করেছে, তাঁর নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করার সুযোগ পেয়েছে, সেরকম একজন মানুষ হিসেবে বলতে পারি যে উনিও একজন আধুনিক প্রফেট। এবং প্রত্যেক প্রফেটের ক্ষেত্রেই যা হয়, সে যা চেয়েছিল তা হয় না। প্রমথ চৌধুরীর প্রবন্ধে একটা অসামান্য উক্তি আছে, বুদ্ধ, যিশু, মহম্মদের মতো মানুষেরা কী বলতে চেয়েছিলেন, তা তাঁদের আশেপাশের কয়েকজন ছাড়া কেউ বুঝতে পারেননি। শুধু বই পড়ে তাঁদের সবটা বোঝা যায় না। লেনিনের ক্ষেত্রেও তাই, এমনকি ফাদার কার্দেনালের ক্ষেত্রেও এ কথাটা প্রযোজ্য। উনি আমাকে সমানে বলতেন, “তুমি আগে সব কিছু ঘুরে দেখো। আগে থেকে আমাদের কোনওকিছুকে ভালো বোলো না। Do not read books. See. আগে নিজে দেখো। অনুভব করো। তোমাকে একটা মোটরগাড়ি দিয়েছি। একটা ভালো ড্রাইভার দিয়েছি। যাও, বেরিয়ে পড়ো। সারা দেশ ঘুরে দেখো। লোকজনের মাঝখানে যাও। সেটাই আসল কাজ।” এই কথাগুলো যিনি বলতে পারেন, তিনি অন্তরের দিক থেকে অবশ্যই একজন ধার্মিক মানুষ।
পিট সিগারের জন্যেই ফাদার কার্দেনালের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল আমার। পিটের প্রসঙ্গ টেনেই শেষ করব। ১৯৯৭ সালে পিট সিগারের সঙ্গে শেষবারের মতো আমার দেখা হল, আমেরিকাতে। আমি গান গাইতে গিয়েছিলাম, তারপর ওঁর বাড়িতে দেখা করতে গেলাম। পিট ও ওঁর স্ত্রী হাডসন নদীর ধারে একখণ্ড জমি কিনে সেখানে লগ কেবিন বানিয়ে দুজনে মিলে থাকতেন। ওঁর স্ত্রী নিজেই রান্নাবান্না করতেন। তা আমি আর পিট একদিন হাডসন নদীর ধারে ওঁর বাড়ির সামনে দুজনে বসে আছি। আমি ওঁকে জিজ্ঞেস করলাম, “পিট, আমাদের কী হবে?”
পিট জিজ্ঞেস করলেন, “মানে?”
আমি আবার বললাম, “আমাদের মানে এই পৃথিবীর কী হবে?”
উনি বললেন, “সুমন, আমার মনে হয়, We have to become deeply religious.” এটা বলেই পরক্ষণেই বললেন, “But you know how I mean it. I dont mean organized religion, but we have to become deeply religous. Otherwise, we cannot feel the agony of our planet.”
তারপর পিট আমাকে জিজ্ঞেস করছেন, “সুমন, তুমি কোনওদিন গাছ কেটেছ? গান কাটতে জানো?” আমি হেসে বললাম, “না, আমি জানি না। কাটিনি কোনওদিন।“
পিট বললেন, “আমাদের গাছ কাটতে হয়। ঝাঁকড়া গাছ হয়ে যায়। আমাদের উপায় থাকে না, তখন কাটতেই হয়। সেটা অবশ্য প্রতিবেশীদেরই কাজে লাগে। পাইনগাছও কাটতে হয়। আমাদের গাছ কাটা শিখতে হয়। আমরা জানি কীভাবে গাছটা পড়বে। গাছটাকে এমনভাবে কাটি যেন ও আস্তে করে পড়ে। এবার যখন একটা গাছ কাটতে হল, গাছটা যখন পড়ল, আমার মনে হল, ওহ লর্ড, আমায় তুমি এইভাবে ফেলো। হে প্রভু… আমায় তুমি এইভাবে ফেলো যাতে এমন আস্তে করে আমি মাটিতে পড়ি। সুমন, তারপর আমি একটা গান লিখতে চেষ্টা করলাম, জানো? কিন্তু লিখতে পারলাম না।“
আমি বললাম, “কেন?”
পিট বললেন, “’প্রভু’ কথাটা আমার মুখ দিয়ে বেরোল না, আমার সংস্কারের কারণে। সুমন, তোমার যেন এটা না হয়। তোমার যদি ভগবানকে ডাকতে ইচ্ছে হয়, ডেকো। আমি পারিনি।”
এ যেন পৃথিবীর সমস্ত প্রবীণ ও বৃদ্ধ মানুষদের কথা। আমার কেন যেন মনে হয়, এই বুড়ো পিট সিগারের মধ্যেও যেন একটা ফাদার এর্নেস্তো কার্দেনাল রয়ে গেছেন। আবার ফাদার এর্নেস্তো কার্দেনালের মধ্যেও রয়ে গেছেন এই বুড়োটা। নিকারাগুয়ার বিপ্লব, সারা পৃথিবীর নিপীড়িত মানুষের শোষণমুক্তির জন্য সংগ্রাম, প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম পেরিয়ে মানুষের ধর্ম, বিরুদ্ধ মতের প্রতি সম্মান ও সহনশীলতা– এই সবকিছুকে ধারণ করে আছেন ফাদার এর্নেস্তো কার্দেনাল। কমান্দান্তে এর্নেস্তো কার্দেনাল, পাদ্রে এর্নেস্তো কার্দেনাল এইভাবেই আমার কাছে বেঁচে আছেন। আমার মধ্যে বেঁচে আছেন। চিরদিন বেঁচে থাকবেন।
সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে অনুলিখিত
এই কলমচির আজ বাহাত্তর! মানতে পারছি না। কণ্ঠ ও কলম সতত সচল থাক।