প্যারাসাইট কি একটি দিগভ্রষ্ট রাজনৈতিক রূপকথা?

সোমেশ ভট্টাচার্য

 

লেখক চলচ্চিত্র সমালোচক, সিনে সোসাইটির কর্মী।

ইংরেজি ছবির প্রধান দুর্গে হানা দিয়ে ভিন্নভাষী কেউ যে অচিরেই অস্কার ছিনিয়ে নিয়ে যাবে, তা গত কয়েক বছর ধরেই কার্যত আঁচ করা যাচ্ছিল। কিন্তু চলচ্চিত্রের সূতিকাগার ইউরোপ নয়, অঘটনটা ঘটাল এশিয়া। কিন্তু সেটাকেও ঠিক অঘটন বলা কঠিন।

গত বছর কান চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা পুরস্কার পাম ডি’অর জেতার পরেই বং জুন-হোর ‘প্যারাসাইট’ নিয়ে ছবির দুনিয়ায় কৌতূহল তৈরি হয়েছিল। বহু আহা-উহু, জল্পনা, বাজি ধরাধরির শেষে তা ৯২ বছরের অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ডসের মঞ্চে ঝড় তুলে নয়া ইতিহাস গড়েছে। সেরা ছবি, সেরা পরিচালক, সেরা মৌলিক চিত্রনাট্য, সেরা আন্তর্জাতিক কাহিনিচিত্র— চার বিভাগে পুরস্কার। তার আগে গোল্ডেন গ্লোব এবং বাফটা-য় সেরা অ-ইংরেজি ছবির শিরোপাও পাওয়া হয়ে গিয়েছে।

ফলে এক কথায়, ‘প্যারাসাইট’-এর শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে সংশয় প্রকাশের জায়গা বিশেষ নেই। কিন্তু সেই সঙ্গে এ-ও বোধহয় সত্যি যে মূলধারার ভারতীয় ছবির দর্শকদের কাছে ব্যাপারটা তত চমকপ্রদ মনে না-ও হতে পারে। তার মানে এই নয় যে ছবির নির্মাণে, চলচ্চিত্র ভাষার প্রয়োগে, বেপরোয়া ইম্যাজিনেশনে যে মুনশিয়ানা ছড়ানো, বলিউডে তার ছড়াছড়ি যাচ্ছে। কিন্তু দুটো জায়গা— এক, যুক্তিসিদ্ধ ‘রিয়্যালিটি’র তোয়াক্কা না করে গল্পের নিজের অভীষ্ট পথে পাগলপারা ধেয়ে চলা আর দুই, তত সিরিয়াস মুখ না করেও মগজ চিরে চলে যাওয়া কথা আন্ডারটোনে গুঁজে দেওয়া, কমিকের ঢঙে তেতো জীবনের কথা আলগোছে বলে যাওয়া— ভারতীয় মেনস্ট্রিম, বিশেষত বলিউডি ছবির এই সব তরিকা বহু পুরনো। সত্যি বলতে, ‘প্যারাসাইট’ তার চিত্রনাট্যে এবং দৃশ্যনির্মাণে বলিউডকে মনে পড়ায় বহুবার। কিন্তু সেটাই এই ছবি সম্পর্কে শেষ কথা নয়।

কথা আরও বাড়ানোর আগে মূল আখ্যানের মোড়কটা এক বার ছুঁয়ে যেতে হবে। যদিও তাতে, যাঁরা ছবিটি দেখেননি তাঁদের দেখার মজা নষ্ট হবে, কেননা ছবিটি চমকে ঠাসা থ্রিলারও বটে, গল্প বলে দিলে দেখার মজাই নষ্ট (যাঁরা ছবিটি দেখবেন বলে গোঁ ধরে আছেন কিন্তু দেখা হয়ে ওঠেনি এখনও, তাঁরা এখানে পড়া বন্ধ করে আগে দেখে নিন)। কিন্তু ছবি নিয়ে কথা বলার অন্য উপায়ও কিছু নেই।

মোদ্দা গল্পটা এরকম: দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সিওলে নীচের পাড়ায় এঁদো রাস্তার ধারে অর্ধেক জেগে থাকা বেসমেন্টের ঘরে চারটি প্রাণীর বাস— বাবা-মা আর দুই ছেলেমেয়ে। প্যাকিং বাক্স মুড়ে তাদের পেট চলে বা চলে না। এক চিলতে কোণে বসানো কমোড ঘরের মেঝের তুলনায় ঢের উঁচুতে। শুধু সেখানে উঠেই উপরতলার পড়শির ওয়াইফাই নাগালে পাওয়া যায়, ভাইবোন হোয়াটসঅ্যাপ সারে।

এমন এক পরিবারের স্কুল পাশ না-করা অথচ খানিক ইংরেজি জানা তরুণ কিম কি-উ ওরফে কেভিনের সামনে আসমান উজিয়ে এসে পড়ে এক বড়লোক ব্যবসায়ীর মেয়ের প্রাইভেট টিউটর হওয়ার সুযোগ। তার কম্পিউটার-দক্ষ বোন কিম কি-জাং ওরফে জেসিকা তার জন্য জাল সার্টিফিকেট বানিয়ে দেয় আর সিঁড়ি বেয়ে উঠে ছেলেটি ঢুকে পড়ে স্বপ্নের অন্দরমহলে। আশপাশের জগৎ থেকে আলগা হয়ে সরে থাকা স্থাপত্যস্নিগ্ধ অট্টালিকার সামনে ছড়ানো সবুজ লন। দেওয়ালে-সিঁড়িতে শীলিত বৈভবের মুগ্ধবোধ।

তার পর শুরু হয় আশ্চর্য এক খেলা। কেভিনের সুপারিশে সেই বড়লোক বাড়ির খামখেয়ালি ছোট ছেলের ‘আর্ট থেরাপিস্ট’ হয়ে ঢোকে জেসিকা। এবং প্রথম সুযোগেই মালিকের গাড়িতে প্যান্টি ফেলে রেখে ড্রাইভারকে ফাঁসিয়ে তাড়ানোর ব্যবস্থা পাকা করে ফেলে সে। সেই রন্ধ্র দিয়ে ড্রাইভার হয়ে ঢোকেন তাদের বাবা কিম কি-তেক। এর পর বাড়ির দীর্ঘদিনের ‘ডোমেস্টিক হেল্প’, যাঁর হাতে গোটা বাড়ির ভার, তাঁকে টিবি রোগী তকমা দিয়ে তাড়ানোর ব্যবস্থাও হয়ে যায়। তাঁর জায়গায় নতুন ‘কাজের মাসি’ হয়ে আসেন কেভিনের মা পার্ক চুং-সুক। বৃত্ত সম্পূর্ণ। যদিও এই চার পরজীবী যে একই সাপের চারটে মুখ, তার আঁচ পর্যন্ত পায় না কেউ।

এই পর্যন্ত গল্পটা কি খুব অচেনা? নয় সম্ভবত। একটা পর্যায় পর্যন্ত চরিত্রগুলোকেও মোটামুটি চেনাই লাগে। অট্টালিকার মালিক পার্ক ডং-ইক ও তাঁর স্ত্রী তো প্রায় ছকে বাঁধা। লোকটি ঝকঝকে, কেজো রকমের চালাক, ফোকাসড এবং সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রায় নিরাবেগ— দ্রুতধাবী পুঁজিবিশ্বে সাফল্য যেমনটা দাবি করে, ঠিক তা-ই। এবং অবধারিতভাবেই তাঁর স্ত্রী নেহাত সোজাসাপটা, এতটাই যে প্রায় বোকাসোকাও বলা চলে, সংসার অন্তপ্রাণ কিন্তু কাজে-কম্মে তেমন দড় নয়, ফলে অন্য লোকের সেবা-নির্ভর— পরজীবী বস্তুত! তাঁদের কিশোরী মেয়ে প্রাইভেট টিউটরের প্রেমে মরিয়া আর ছটফটে ছোট ছেলে একটু স্পয়েল্ট— যাকে ‘ডিজ়অর্ডার’ বলে ঠাউরে নেন তার মা।

এর পরে হয় কী, কয়েক দিনের জন্য ভেকেশনে যায় পার্ক পরিবার। আর সেই রাতে কিমেরা চার জন লিভিং রুমে পানাহার সাজিয়ে বসে। এবং চকিতে ভোল পাল্টাতে শুরু করে ছবিটা। চার জনের ঈষৎ মত্ত সংলাপে মন্থনজলে হালকা ননীর মতো ভেসে উঠতে থাকে গোপন লোভ, ঘৃণা, উচ্চাশা, ভীতি। এবং সর্বোপরি অসহায়তা। বৃষ্টিতে তখন ভেসে যাচ্ছে বাইরের পৃথিবী। দর্শকেরা কেউ-কেউ যখন মৃদু আশঙ্কায় ভুগছেন যে বলিউডি ঢঙে এখন পার্কেরা ফিরে না আসে, বেল বাজিয়ে আবির্ভূত হন আগের কাজের মাসি গুক মুন-ওয়াং। এবং উন্মোচিত হয় আর একটা নীচের মহল— অট্টালিকার তলায় গোপন বাঙ্কার, যেখানে চার বছর ধরে মুন-ওয়াং লুকিয়ে রেখেছেন তাঁর ব্যবসায় দেউলিয়া হয়ে যাওয়া স্বামীকে। এক ইটালীয় স্থপতির থেকে বাড়িটি কিনেছিলেন পার্কেরা, তাঁরা এই বাঙ্কারের অস্তিত্ব জানেন না।

এই জায়গা থেকে অবিশ্বাস্য গতিতে অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলতে থাকেন বং। এক পক্ষের অন্যকে ব্ল্যাকমেল, অনুনয়-বিনয় ও শারীরিক আক্রমণ, সবই ঘটতে থাকে ক্রমপর্যায়ে। এবং এরই মধ্যে আশঙ্কা সত্যি প্রমাণ করে পার্কেরা বাড়ি ফিরে আসে। চকিতে মুন-ওয়াং আর তাঁর স্বামীকে গোপন বাঙ্কারে বন্দি করে কিম আর তার দুই ছেলেমেয়ে লুকিয়ে পড়ে সোফার নীচে। টানটান সাসপেন্স, যার শেষ হবে পরের দিন তুমুল খুনোখুনিতে।

‘প্যারাসাইট’ এমন এক ডার্ক কমেডি, এক আধুনিক শহুরে রূপকথা যাকে ‘মাস্টারপিস’ হিসেবেই বন্দনা করছে পশ্চিমি দুনিয়া। এই অভিধা অত্যুক্তি কি না, তা অবশ্যই বিচার্য। কিন্তু এ কথা মানতেই হবে যে, পরের পর দৃশ্যনির্মাণে দর্শকদের কার্যত ছিটকে দিয়েছেন বং। গোটা ছবিতে একের পর এক সিঁড়ির অসাধারণ ব্যবহারে শ্রেণির ধারণাকে কার্যত জ্যামিতিক ভাবে দৃশ্যমান করে তুলেছেন তিনি। বেসমেন্টের ঘর থেকে দীর্ঘ সিঁড়ি বেয়ে অট্টালিকার দিকে উঠে যাওয়া, লুকোনো সিঁড়ি বেয়ে বাঙ্কারে নামা, উঠে আসা, আবার অঝোর বৃষ্টির রাতে সিঁড়ি ভেঙে বেসমেন্টের দিকে নেমে যেতে থাকা…।

এই ওঠানামার গল্পে বং কিন্তু করুণ রসটিকে আগাগোড়া এড়িয়ে গিয়েছেন। সব সেন্টিমেন্টালিটি ঝেড়ে ফেলছেন, বস্তাপচা মূল্যবোধের ধারণাও বাতিল করে দিচ্ছেন। যেমন ছবির শুরুতেই ঘরের মেঝেয় লটকে থাকা কিমকে ছেলেমেয়ের সামনে পায়ের ঠুসো মেরে ডেকে তোলে তার গিন্নি। তাতে কিম রেগে যায় না, বরং উঠে স্বাভাবিকভাবেই কথাবার্তা বলতে থাকে। দারিদ্রে নির্বিকারভাবে কর্কশ হয়ে উঠতে থাকে চরিত্রগুলো (আচমকাই মনে পড়ে ‘মেঘে ঢাকা তারা’ ছবিতে নীতার মাকে যিনি রোজগেরে মেয়ের বিয়ে দিতে চান না, যদিও ঋত্বিক ঘটক বিশ্বাসে-শৈলীতে সম্পূর্ণ ভিন্ন গ্রহের বাসিন্দা)। শুধু দারিদ্রেও আটকে থাকে না এই কর্কশতা। এই কিমই যখন পরে পার্ক পরিবারের ড্রাইভার হয়ে একাধিকবার বাবুকে বলে— ‘আপনি আপনার স্ত্রীকে খুব ভালবাসেন’, তার জবাব আসতে থাকে শীতল তাচ্ছিল্যে।

এই আপাত নির্মোহ চলন চূড়োয় পৌঁছয় সেই বৃষ্টিরাতে যখন মালিকদের ছুটি কাটাতে যাওয়ার সুযোগে খাদ্য-পানীয় ছড়িয়ে বসে জীবনের পক্ব স্বাদ নিচ্ছে বেসমেন্টের পরিবার। চুং-সুক ধরিয়ে দিচ্ছে, তাদের মালকিন শ্রীমতী পার্ক ‘বড়লোক তবু ভালমানুষ’ নন, বরং ‘বড়লোক বলেই ভালমানুষ’— টাকা সব ভাঁজভুঁজ ইস্তিরি করে সমান করে দেয়। এবং নিজের অতি প্রিয় যে কুকুরকে মালকিন তার ভরসায় ছেড়ে গিয়েছেন, খানাপিনা দেখে সে কুঁইকুঁই করে এগিয়ে এলে তাকে এক ঠুসো মেরে ভাগিয়ে দিচ্ছে। কেভিন ছাত্রীকে বিয়ে করে স্বপ্নরাজ্যের মালিক হওয়ার খোয়াব দেখছে আর চুং-সুকের প্রথমেই মনে হচ্ছে, ‘এ বাবা, আমি তা হলে রোজ বেয়াই বাড়িতে বাসন মাজছি?’ এর পর কিম যখন উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ চর্মচক্ষে প্রায় দেখে ফেলে এই বাড়িটাকে নিজের বাড়িই ভেবে বসছে, চুং-সুক ছেলেমেয়েদের বলছে— ‘এক্ষুনি যদি মালিক ফিরে আসে, তোদের বাবা আরশোলার মতো সরসরিয়ে গর্তে গিয়ে লুকোবে’। শুনে, বউয়ের জামার কলার চেপে ধরে মারতে যাচ্ছে কিম, পরের মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিচ্ছে, মুচকি হেসে ছেলেমেয়েকে বলছে— কেমন বুদ্ধু বানালাম তোদের! সত্যি বলতে, বৃষ্টিরাতের এই সিকোয়েন্সটিই ছবির সেরা সম্পদ। তুলনায় কাঁচা একটা প্লট থেকে মারাত্মক নাটকীয় উন্মোচনের দিকে যাওয়ার আগে একটা গভীর শান্ত হাইফেন— যা গোটা ছবির মূল চিন্তাসূত্রকে শিরদাঁড়ার মতো স্পষ্ট করে তুলেছে।

শ্রেণির আদলটিকে সিঁড়ি ছাড়া আর যে গোদা মেটাফরে ধরেছেন বং, তা হল গন্ধ— দারিদ্রের গন্ধ। সেই অঝোর বৃষ্টির রাতে আচমকা ফিরে এসে বাবু যখন লিভিং রুমের সোফায় শুয়ে স্ত্রীকে আদর করছেন, তাঁর নাকে এসে ধাক্কা দিচ্ছে সেই গন্ধ (‌সোফার নীচেই লুকিয়ে কিম, কেভিন, জেসিকা)। বাবু স্ত্রীকে বলছেন, ড্রাইভার লোকটি এমনিতে ভাল, কখনও সীমা ছাড়ায় না। শুধু তার গায়ে বুড়ো মূলোর মতো গন্ধ, সেটাই যা সীমা ছাড়িয়ে গাড়ির ব্যাকসিটে চলে আসে। এই গন্ধটা বাবু ফের পাবেন ক্লাইম্যাক্সে, যখন বাঙ্কার থেকে উঠে এসেছে এত দিন লুকিয়ে থাকা লোকটি— তার গায়েও। সেই রাতে কিন্তু ওইটুকুই। কারণ ব্যাকসিটের কথা উঠতেই বাবুর মনে পড়েছে গাড়িতে পাওয়া সেই প্যান্টির কথা, যা নিশ্চিতই ছেঁদো গরিব সস্তা কোনও মেয়ের যে আগের ড্রাইভারের সঙ্গে তাঁর দামি গাড়িতে শুয়েছিল এবং যে দোষে ছেলেটির চাকরি যায়। স্ত্রীর শরীর ঘাঁটতে-ঘাঁটতে বাবু বলছেন— ওই প্যান্টিটা কি এখনও তোমার কাছে আছে? তুমি যদি ওটা পরো, আই’ল গেট রিয়েলি ফাকিং হার্ড। স্ত্রী বলছেন— রিয়েলি? তা হলে আমায় ড্রাগ এনে দাও…। আর সোফার নীচে বাবার পাশে শুয়ে প্যান্টির মালিক জেসিকা মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছে।

ঠিক এই জায়গায় এসে বং স্রেফ নখের আঁচড়ে ছিঁড়ে ফেলছেন ধনতন্ত্রের এলিট অন্তর্বাস। কোনও ব্যাখ্যা ছাড়াই, প্রস্তাবনা ছাড়াই। যেন বৃষ্টিরাতের রঁদেভুর যে সূচনা হয়েছিল উল্টো প্রান্ত থেকে, তা-ই এসে আয়নার সামনে দাঁড়িয়েছে। উল্টো ছবি পড়ছে। কিন্তু ছবিটা সেই লোভ আর অবদমনেরই, ফলত পারভার্শনেরও। এর পরে আর চরিত্রগুলোকে ওখানে রাখার মানে হয় না, বরং তাদের বার করে নিচের মহলে হাবুডুবু খেতে পাঠিয়ে দেন বং।

বোঝাই যাচ্ছে, ‘প্যারাসাইট’ সেরা মৌলিক চিত্রনাট্যের শিরোপা এমনি পায়নি। বংয়ের সঙ্গে সেই কৃতিত্ব সহ-চিত্রনাট্যকার হান জিন ওনেরও। কিন্তু আরও যে দু’একটি গোত্রে ছবিটি মুগ্ধতা দাবি করে, তার একটি অবশ্যই জাং জে-ইলের করা আবহসঙ্গীত। প্রায় গোটা ছবিতে মূলত পিয়ানো-নির্ভর ক্লাসিক পিস ব্যবহার করছেন তিনি আর কত কিছু যে মিশিয়েছেন তাতে। অষ্টাদশ শতকের জার্মান (পরে ব্রিটিশ অভিবাসী) কম্পোজ়ার জর্জ ফ্রেডারিক হ্যান্ড্লের পিয়ানো পিস ও ইটালি-ঘরানার বারোক অপেরা থেকে শুরু করে হালফিলের ইটালীয় কম্পোজ়ার জিয়ান্নি মোরান্ডি পর্যন্ত তাঁর চলাচল। (পার্কদের বাড়িটি যে এক ইটালীয় স্থপতির তৈরি এবং পরে এক জার্মান পরিবার তা কিনে নেয়, তা কি নিতান্তই সমাপতন?) তবে সঙ্গীত নির্বাচনের মতোই চমকপ্রদ তার প্রয়োগের ভাবনাও। জাং এক-একটা পিস বাজাচ্ছেন একটানা— দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তরে যেতে গিয়েও তার ছেদ ঘটাচ্ছেন না— বরং বহু জায়গায় বাজনাকে এমন নিচু তারে নিয়ে যাচ্ছেন যাতে আবহের অন্য নানা শব্দের ঝনঝনা থেকে তা পৃথক করাই কঠিন হয়ে ওঠে। তা বেজে চলে মাথার মধ্যে বয়ে যাওয়া গুঞ্জনের মতো, কোনও এক সময়ে ফের উচ্চকিত হয়ে উঠবে বলে। অবচেতনগ্রাহ্য সুক্ষ্মতায় পৌঁছে যেতে চাওয়া এই প্রয়োগ সম্ভ্রম আদায় করতে বাধ্য।

আর মুগ্ধ করে হং কিউং-পিয়োর ক্যামেরা। বেসমেন্টের নোংরা কিন্তু দপদপে জীবনের আঁচ, অট্টালিকার উজ্জ্বল কিন্তু মার্জিত বনেদিয়ানা আর বাঙ্কারের পরিচ্ছন্ন কিন্তু শ্বাসরুদ্ধকর হলুদ-সুবজ আলোর প্যাটার্ন এবং তার মধ্যে অবিরত চলাচলে তিনি প্রায় অনায়াস। পরিচালকের অন্বিষ্ট শ্রেণিচিত্র আঁকতে গিয়ে তিনি যে শুধু উল্লম্ব গতায়াতের জ্যামিতি ধরেছেন তা নয়, আনুভূমিক তলেও বহু দৃশ্য এমন ভাবে কম্পোজ় করেছেন যাতে পাশাপাশি থেকেও দু’টি শ্রেণি দৃশ্যত পৃথক হয়ে যায়। বৃষ্টিরাতে পার্কের বাড়ি থেকে পালিয়ে কিম আর তার দুই ছেলেমেয়ের একের পর এক সিঁড়ি দিয়ে নেমে এসে জলডুবি বেসমেন্টে পৌঁছনো, সেখানে দপদপ করতে থাকা টিউব আর ছলছল করতে থাকা জলতল তো প্রায় ক্লাসিকের পর্যায়ে উত্তীর্ণ।

শিল্প নির্দেশনা আর চিত্রগ্রহণ হাত ধরাধরি করে চলে। শিল্প নির্দেশক লি হা জুনের সৌজন্যে সেই সমন্বয়টিও এ ছবিতে নজর কাড়ার মতো। আর যা ঠিকঠাক না গেলে গোটা আয়োজনই ব্যর্থ, বলতে হবে সেই অভিনয়ের কথাও। এ ছবিতে প্রায় প্রত্যেকেই নিজের সেরাটা দিয়েছেন। তবে কিমের ভূমিকায় সং কাং-হো, তার স্ত্রীর ভূমিকায় জাং হে-জিং বা পার্ক-পত্নীর ভূমিকায় জো ইয়েও-জিয়‌ং মনে থাকবেন অনেক দিন।

কিন্তু এরপরেও মন খুঁতখুঁত, হয়তো ভারতীয় দর্শক বলেই বেশি। রূপকথা বলার যে কায়দায় বং গোড়া থেকে ছবিটি বুনেছেন, তাতে ছাপোষা বাস্তবতার ধার না-ধারাটাই রীতি। গল্পকে যে গল্প হিসেবেই নিতে হয়, তার মধ্যেই ছড়ানো থাকে অনুভূতি আর জীবনবোধের মণিমাণিক্য, ভারতীয় মেনস্ট্রিমের দর্শকেরা তা দীর্ঘ দিন ধরেই জানেন। কিন্তু এই রীতি সিদ্ধ হয় তখনই যদি না তার চলন অনায়াস গল্পকেই বিব্রত করে, চোখে খোঁচা দিয়ে বলে— ‘এ তো গল্পের গরু গাছে!’

হাভাতে কিম পরিবার কী অনায়াসেই না এলিট পার্কদের জীবনে মিশ খেয়ে যায়! ইন্টারনেটে দু’চারটে লিঙ্ক ঘেঁটেই ‘আর্ট থেরাপিস্ট’ বনে যায় জেসিকা। রাতারাতি রাঁধা-বাড়ার বড়লোকি চাল রপ্ত করে ফেলে চুং-সুক। বাড়িতে লাগানো একটা বাল্ব মারফত গোপন বাঙ্কার থেকে অধুনা বাতিল ‘মর্স কোডে’ বার্তা আসতে থাকে এবং তা অন্বিষ্টজন ছাড়া কারও নজরে পড়ে না— বেশ ছেলেমানুষিই মনে হয় যেন। পাথরের দুটো জোরালো আঘাতে যে ভাবে রক্তে ভেসে পড়ে থাকে কেভিনের মাথা, তার পরে এক মাত্র রজনীকান্ত ছাড়া আর কারও পক্ষে বেঁচে ফেরাও প্রায় অলৌকিক। তবে এ সব ফোড়নের কম-বেশি যা-ও বা মেনে নেওয়া যায়, অন্যতম সেরা দৃশ্যে চারটে লোকের গায়ের মদের গন্ধ না পেয়ে (তার আগে ঘরে বোতলও ভেঙেছিল) ড্রাইভারের গায়ের ‘বুড়ো মুলো’র গন্ধ পান বাবু। এবং তা-ও যদি বা পান, ঝুঁকি বোধ করেন না, কারণ খোঁজেন না, যৌনতার ঘোরে চলে যান। মনে রাখতে হবে, এ ছবিতে তত্ত্বের চোরাস্রোতের উপরিতলে একটা জ্যান্ত থ্রিলারও চলছে, যাতে গন্ধই একটা ক্লু হতে পারে। সেখানে কাহিনির বদলে রূপককে জায়গা ছেড়ে দিলে, অগ্রাধিকার দিলে, গল্প ধাক্কা খেতে বাধ্য। যদিও গোটা জিনিসটাই বং করে চলেন অবিশ্বাস্য দ্রুততায়, দর্শককে খুঁটিনাটি নিয়ে বেশি ভাবার সময় প্রায় না দিয়েই।

প্রশ্ন হল, এ রকম একটা ছবি হঠাৎ মার্কিনিদের এত মনে ধরে গেল কেন? অস্কার ওরফে অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ডস হলিউড কারখানার নিজের পুরস্কার— বংয়ের  কথায় ‘লোকাল অ্যাওয়ার্ড’। কান, বার্লিন, ভেনিসের মতো কুলীন সব আন্তর্জাতিক পুরস্কারের সঙ্গে এর প্রধান ফারাক, বাছাই করা বিশেষজ্ঞজের (জুরি) বিচারে নয়, ছবির গুণমান বিচার হয় ‘অ্যাকাডেমি অব মোশন পিকচার আর্টস অ্যান্ড সায়ান্সেস’-এর সদস্যপদ পাওয়া চলচ্চিত্র শিল্পী ও কলাকুশলীদের ভোটে। এবং যে কোনও ভোটেই যা হয়, দুটো ভাল ছবির ভোট কাটাকাটিও তুলনায় নিরেস একটি ছবিকে জিতিয়ে দিতে পারে। তা ছাড়া, গত কিছু বছর ধরে অ্যাকাডেমি যে ভাবে অতি দ্রুত বিশ্বময় সদস্য বাড়ানোর নীতি নিয়ে চলছে, তাতে ইতিমধ্যেই ভোটারদের অন্তত পাঁচ ভাগের এক ভাগ আর মার্কিনি নন, বরং আন্তর্জাতিক। ফলে ভোটের প্যাটার্ন শুধু শ্বেতাঙ্গ-সংখ্যাগুরু ইংরেজিভাষী মেজরিটির মধ্যে আটকে থাকছে না, বরং সেই খোলসটা ভেঙে বেরিয়ে আসারই ইঙ্গিত দিচ্ছে।

কিন্তু প্যারাসাইটের হলিউড-বিজয়কে শুধু ভোট কাটাকাটি হওয়া না-হওয়া বা ভোটার প্যাটার্নের পরিবর্তন দিয়ে ব্যাখ্যা করা অসম্ভব। বরং তা এক বৃহত্তর সঙ্কট ও সম্ভাব্য পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। কারণ বড় সংখ্যক মার্কিনির ভোট না পেলে বাদামি চামড়ার অ-ইংরেজি কাহিনিচিত্রের এই তুমুল জয় সম্ভব ছিল না। পুঁজিবাদের মারে ক্লান্ত আমেরিকা, বেকারি-অসুস্থতা-রাষ্ট্রের নিস্পৃহতার আঁচে পুড়তে থাকা আমেরিকা, সোভিয়েতের পতনের পর তীব্রতর পুঁজিবাদের দুনিয়াদারি করে নিজেরই নীচতলাকে ফোঁপরা করে ফেলা যে আমেরিকা এখন ক্রমশ বার্নি স্যান্ডার্সের সামাজিক সুরক্ষার রাজনীতির দিকে ঢলে পড়ছে, সেই আমেরিকাই এই ছবিকে দু’হাত উপুড় করে ভোট দিয়েছে। বেসমেন্ট থেকে উঠে আসা মানুষগুলোর একটু ভাল থাকতে চাওয়ার মরিয়া চেষ্টা, তাদের প্রতি মুহূর্তের নিঃস্বতা আর অসহায়তার মধ্যে নিজেকে খুঁজে পেয়েছে এই ক্লান্ত ভীত আমেরিকা। ‘গল্পের ফুটোফাটার নিকুচি করেছে’ বলে তারা এই ছবিকে জাস্ট ভালবেসে ফেলেছে।

এই ভালবাসার গোলাপে কাঁটা হয়ে উঠতে পারত একটা জিনিস— মার্কসবাদ। ছবির পরতে-পরতে জড়িয়ে থাকা শ্রেণিচিহ্ন মার্কিনিদের আজন্ম-লালিত কমিউনিজ়ম ভীতিকে গোপন ব্যথার মতো চাগিয়ে তুলতে পারত। কিন্তু ডারউইনকে ঢাল করে বং শেষমেশ এক ‘নিরাপদ’ গল্পই বলেছেন, যেখানে বিষাদ আছে, ‘একদিন সূর্যের ভোর’ মার্কা ইউটোপিয়া আছে কিন্তু সিস্টেমকে দুমড়ে-মুচড়ে দেওয়ার রোখ নেই। সেই জায়গায় দক্ষিণ কোরীয় বং মার্কিনিদের সঙ্গে ভাসছেন একই নৌকায়। ছবির এক মোক্ষম মুহূর্তে শ্লেষে-কৌতুকে কিম জং-উনের কমিউনিস্ট উত্তর কোরিয়ার প্রতি কটাক্ষে তিনি শাণিত। শুধু কমিউনিস্ট শব্দটাই যা সরাসরি আসছে না। বং নিজে বলেছেন, ‘‘আমরা সকলেই একটি দেশের বাসিন্দা… ধনতন্ত্র।’’ কিন্তু তার বিপ্রতীপে মার্কসীয় মডেলটি সচেতনভাবেই শিকেয় তুলে রাখা থাকছে।

ছবিতে বেসমেন্টের পরিবারের সঙ্গে অট্টালিকার পরিবারের সংঘাতে ফিকে শ্রেণিচরিত্র যেমন রয়েছে, অন্য সব সমশ্রেণির নিম্নবিত্ত মানুষের সঙ্গে (আগের ড্রাইভার, কাজের মাসি ও তাঁর বাঙ্কার-বন্দি স্বামী) তাদের লড়াই আবার সরাসরি ডারউইন-কথিত ‘অন্তঃপ্রজাতি সংগ্রাম’ যেখানে বেঁচে থাকার জন্য একই প্রজাতির (এখানে একই শ্রেণির) প্রাণীরা নিজেদের মধ্যে লড়ে মরে। মনে রাখতে হবে, মার্কসবাদের গোড়ার কথা কিন্তু শ্রেণিশত্রু খতম করা নয়, বরং তাদের পরাস্ত করার সুদূরপ্রসারী লক্ষ্যে গরিব মানুষের নিজেদের লড়াইকে (অন্তঃশ্রেণি সংগ্রাম) আগে খতম করা— ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’। ডারউইন তাঁর প্রাকৃতিক নির্বাচনের তত্ত্বে যে সর্বস্তরে সবলের হাতে দুর্বলের নিকেশের কথা জানিয়েছিলেন, তার সরাসরি বিপ্রতীপেই মার্কসীয় চিন্তার অবস্থান। কিন্তু বং দুটো তাসই এক সঙ্গে খেলছেন।

ছবিতে কোন চরিত্রগুলোকে বং কীভাবে নিকেশ করলেন, তা লক্ষ্য করলেই বিষয়টি স্পষ্ট হবে। এক) আগের কাজের মাসি ও তাঁর স্বামী— এখানে অন্তঃশ্রেণি সংগ্রামে তারা পরাজিত, অতএব ডারউইনের দিব্যি, তাদের মরতেই হত। দুই) বাড়ির মালিক— গরিবির গন্ধে শেষ বার নাক কোঁচকানোর পরেই ‘বুড়ো মূলো’ কিমের হাতে। ইঙ্গিতটা স্পষ্ট— শ্রেণি শত্রুতায় নিহত। তিন) জেসিকা বাঙ্কারে লুকোনো লোকটির হাতে এবং এটাই সবচেয়ে চমকপ্রদ। আপাত ভাবে এটিও অন্তঃশ্রেণি-বদলা, কিন্তু অন্য এক ইঙ্গিতও আছে। গোটা ছবি জুড়ে বড়লোক অট্টালিকায় সে-ই সবচেয়ে স্বচ্ছন্দ, এতটাই যে মালিকদের অনুপস্থিতিতে তাকে বাথটাবে স্নান করতে দেখে ভাই কেভিনের উপলব্ধি— ‘ও যেন এখানকারই’। ভাইকে জাল সার্টিফিকেট বানিয়ে দেওয়া থেকে আগের ড্রাইভার আর কাজের মাসিকে তাড়ানো— শ্রেণি প্রতিদ্বন্দ্বীদের হটিয়ে নিজেদের জায়গা করে নেওয়ার যাবতীয় চক্রান্তের সে-ই মূল হোতা। সে জন্য তার কোনও অপরাধবোধ নেই। সেই বৃষ্টিরাতে দিলদরিয়া কিম যখন কাজ হারানো আগের ড্রাইভারের কথা তুলছে, জানতে চাইছে সে কেমন আছে, নতুন কাজ পেয়েছে কি না, হঠাৎ প্রচণ্ড উত্তেজিত হয়ে উঠে জেসিকা বলছে— অন্যকে নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে নিজেদের কথা বলো, আমাদেরই সাহায্য প্রয়োজন! একটা সময়ে মনে হতে থাকে সে যেন বুর্জোয়াদের থেকেও বেশি বুর্জোয়া, বেশি নিশ্চল, বেশি নিষ্ঠুর এবং একই শ্রেণিতে থাকার সুবাদে নিম্নবিত্তের পক্ষে বেশি মারাত্মক। ফলে বাঙ্কারের লোকটির হাতে তার হত্যারও যেন একটা প্রচ্ছন্ন শ্রেণিচরিত্র ফুটে উঠতে থাকে।

এই অসাধারণ নকশাটি বুনে বং আসলে একটা মৌলিক প্রশ্নকে আড়াল করেছেন। প্রশ্নটি হল: প্রাণিজগতে অনন্য মানুষ কি তবে ডারউইনীয় ভবিতব্যই মেনে নেবে? নাকি, স্যান্ডার্সের ধরনের সামাজিক সুরক্ষার রাজনীতি পুঁজিবাদের প্রতিস্পর্ধী না হোক অন্তত বিষ খানিকটা সরিয়ে নিতে হতে পারে বলে আমরা ধরে নিচ্ছি, অন্তত আশা করছি? এ এক অদ্ভুত পরিস্থিতি। শ্রেণি নিয়ে কথা বলছি, শ্রেণিযুদ্ধ নিয়ে কথা বলছি, ধনতন্ত্র নিয়ে কথা বলছি, কিন্তু মার্কস-এঙ্গেলসকে আলগোছে সরিয়ে রেখে— ইতিহাসকে, ঘটনাকে, আখ্যানকে শ্রেণিদৃষ্টিতে দেখার নিক্তিটাই যাঁদের তৈরি করে দেওয়া। এ যেন যিশুকে বাদ দিয়ে বাইবেল চর্চা! আর সম্ভবত সেই কারণেই একটা তুখোড় চিন্তার ছবি শেষের দিকে ধোঁয়াটে ভাববিলাস হয়ে উঠছে।

ছবির শেষে ছেলেমেয়ে নিয়ে শ্রীমতি পার্ক চলে যান কোনও অনির্দেশের দিকে। আর পুলিশের হাত থেকে বাঁচতে কিমকে গিয়ে লুকোতে হয় আগের জনের ছেড়ে যাওয়া বাঙ্কারে। সম্ভবত অনন্ত কালের জন্য— যত দিন না তার ছেলে অনেক টাকা জমিয়ে বাড়িটা কিনে বাবাকে মুক্ত করবে, যার কোনও সম্ভাবনা এক হাজার বছরের মধ্যে নেই, সকলেই জানে।

বং নিজের মতো করে বৃত্তটা সম্পূর্ণ করেন। কোনও শূন্যস্থানই পড়ে থাকতে পারে না, তাই বাঙ্কারেরও বাসিন্দা লাগে। এটাও প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের এক রীতি, যতক্ষণ মানুষের রাজনীতি ওই বাঙ্কার ভেঙে উড়িয়ে দিচ্ছে। বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয়, বং জেনেশুনেই চাবিটা নিজের পকেটে লুকিয়ে রেখেছেন। যা দিয়ে যৌথতার এবং পরিত্রাণের দরজাটা খোলা যায় তা আমাদের হাতে তুলে না দিয়ে পরিত্রাণহীন পতনবিন্দুটি দেখাতে চাইছেন তিনি। কিন্তু খটকা লাগে যখন দেখি বাঙ্কারে বসে কিম মালিককে খুন করার জন্য অনুতাপ করছে, ক্ষমা চাইছে। কেননা খুনের আগের মুহূর্তে ক্লোজ় আপে ধরা তার মুখের দৃঢ়তার সঙ্গে, শ্রেণিক্রোধের সঙ্গে এই অবস্থান মেলে না। বরং শ্রেণিচরিত্র হারিয়ে তা ব্যক্তিগত ও তাৎক্ষণিক আবেগের সরলতায় প্রক্ষিপ্ত হয়, ঘোলাটে মানবতাবাদের দরজায় গিয়ে কড়া নাড়ে।

এই নিরাপদ জোড়াতালিতেই একটি রাজনৈতিক রূপকথা ভালয় ভালয় শেষ হয়। গল্পের নানা মোড়ে নিজেকে আর নিজের চারপাশকে চিনতে পেরে দর্শক শিহরিত হয়। বিশেষত প্রথম বিশ্বের পশ্চিমি বাবুরা, কাঁচা নর্দমার গন্ধ যাঁদের অচেনা হয়ে গিয়েছে বহু দিন আগেই, হয়তো তাই এত বেশি ভাল লাগে।

*এই লেখায় উল্লিখিত কোরীয় নামগুলি সে ভাষার যথাযথ উচ্চারণ রীতি মেনে লেখা হয়নি, বরং গোদা রোমান রীতিই অনুসরণ করা হয়েছে। যেমন Kim নামটির উচ্চারণ আসলে ‘কিম’ নয়, ‘গিম’। অর্থাৎ ‘কিম কি-তেক’ নয়, প্রকৃত উচ্চারণ হওয়া উচিত ‘গিম গিতেক’। ‘কিম জং-উন’ নয়, ‘গিম জং-উন’। তেমনই Park নামের কোরীয় উচ্চারণ ‘পার্ক’ নয়, ‘বাক’। কিন্তু সাবটাইটেল পড়া দর্শকের কাছে নামগুলি অচেনা হয়ে যাবে, এই আশঙ্কায় সে পথ পরিহার করা হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে বাংলা হরফে প্রকৃত উচ্চারণ ধরাও যায়নি। এই অক্ষমতার জন্য ক্ষমাপ্রার্থী।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4879 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...