জিনাত রেহেনা ইসলাম
লেখক প্রাবন্ধিক, শিক্ষক।
বিশ্ব আতঙ্কিত নভেল করোনার সংক্রমণে। কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণে দেশের নয়া হাতিয়ার একদিনের ‘জনতা কার্ফিউ’। আগেই এসেছে ভিড় নিয়ন্ত্রণের বার্তা। এই দিন (২৩শে মার্চ, ২০২০) সকালেই ঘটে গেছে অঘটনও। প্রতিবাদকারীদের ওপর নিক্ষেপ করা হল অজানা রাসায়নিক ভর্তি বোতল। এই হামলা অনভিপ্রেত ও নিন্দনীয়। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠছে, দীর্ঘদিন ধরে চলা শাহিনবাগ ও পার্ক সার্কাসে বসে থাকা মানুষগুলো কোথায় যাবে? তাদের আন্দোলনের কী হবে? একবার উঠে গেলে কি ফিরতে পারবে তারা? এতদিনের লড়াই কি তবে অসমাপ্ত থাকবে? হাজারো প্রশ্নের মাঝে আশার আলো একটিই। আন্দোলনে বিপুল জনসমর্থন। মানুষ এতটাই সামিল মানসিকভাবে যে, চরমতম সঙ্কট মোকাবিলার মুহূর্তেও শাহিনবাগ-পার্কসার্কাস মন থেকে সরে যায়নি। আস্থা ও সহযোগিতার ক্ষণে আবেগ ও সহমর্মিতার ভাষা অনিশ্চয়তা ও সান্ত্বনার আবেগে জুড়ে বসেছে। সত্যি কখনও আন্দোলন থামে না। নেতৃত্ব ও কৌশল বদলায়। হয়তোবা লক্ষ্যও বদলায়। কিন্তু ফলাফল থাকে অপরিবর্তনীয়। এটাই আন্দোলনের ‘কারেন্ট’। মানুষের বিশ্বাস ও স্বপ্নবাহিত এই ‘কারেন্ট’ বার বার আগুন ছড়ায়। পুড়তে পুড়তে মানুষ আবার এক আন্দোলন জন্মের স্বপ্ন দেখে। অধিকারের ভাষা বদলের শর্ত খোঁজে। স্বাধীনতার এলোমেলো স্বপ্নগুলোকে গুছিয়ে নেয়। সাজিয়ে তোলে। কড়া নাড়ে গণতন্ত্রের সুবিশাল ফাটকে। কেননা এই ইমারতের প্রতিটি ইটে আছে তাদের পরিশ্রম। কথা ছিল, এই ফাটক পেরিয়ে যে ঘর সেটাই পুণ্যভূমি। এখানেই জীবনের সব অধিকার। এখান থেকে এক ইঞ্চি সরে যাওয়ার প্রশ্নই অবান্তর। জীবনের অধিকার যতদিন প্রাসঙ্গিক, গণতন্ত্রের বাড়িটাও ততদিনই মজবুত।
সংশোধিত নাগরিক আইনের বিরুদ্ধে দাদিদের জমায়েত ইতিহাসের পাতাবন্দি হয়েছে। সামাজিক আন্দোলনের মুখ হয়ে উঠেছে দাদিরা। এটি কোনও বিশেষ সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব নয়। এটাই ভারতের ঐতিহ্যের এক মুখ। এখান থেকেই দেশের সমাজভাবনার শুরু হবে আগামীতে। এই দাদি আসলে কারা? কেন বয়সের শেষপ্রান্তে এসেও অবিশ্বাস তাদের তাড়া করে বেড়াচ্ছে? এ প্রশ্ন বার বার চর্চায় আসবে আগামীতেও। এত প্রতিকূলতার পরেও আন্দোলন থেকে পিছু হটেননি মহিলারা। এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আর কিইবা হতে পারে। এখন প্রশ্ন জীবন টিকিয়ে রাখার। জীবন বাঁচলে আন্দোলন ঠিক দিশা খুঁজে নেবে। সদ্দিচ্ছা ও লক্ষ্য নিশ্চিত থাকলে মত ও পথ বদলাবে না। অপমানিতবোধ থেকে যে অসহায়তার অনুভব তা এত সহজে বদলের নয়। দেশের প্রতি দায়বদ্ধতার পরীক্ষাও এক বড় আন্দোলনের প্রস্তুতির পথ দেখায়। দেশের মানুষের প্রতি অবিচারের প্রশ্নে পথে নামা। এর অর্থই দেশের মানুষের চেয়ে বড় কিছু নেই। তাই সরে যাওয়ার মধ্যে কোনও আত্মগ্লানি নেই। ফিরে আসার মধ্যেও লুকিয়ে আছে বিরাট সম্ভাবনা।
উনিশ শতকে কোম্পানি যখন কৃষকদের কাছ থেকে জমি ছিনিয়ে নিয়ে নিলামে তুলছিল তখন তারা সাধারণ মানুষের সম্পদই শুধু ধ্বংস করছিল তা নয় তাদের অস্তিত্বও কেড়ে নিচ্ছিল। নতুন ব্রিটিশ আইনের শিকার হওয়া থেকে নিজেদের মুক্ত করতে মানুষ মরিয়া হয়ে উঠেছিল। তাদের একটিই প্রচেষ্টা ছিল দেশের মাটিতে নিজেদের অধিকার ও আগ্রহ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বংশানুক্রমিক পৈতৃক ভিটে অটুট রাখা। শাহিনবাগ ও পার্ক সার্কাসের মহিলাদের ক্ষেত্রে এই সেন্টিমেন্ট সমানভাবে কাজ করেছে। একটি জাতিকে বহিরাগত বলে দাগিয়ে দেওয়ার চেষ্টাতেই আপত্তি। নিজেদের বাড়িতে কি করে কেউ বহিরাগত হয়? বাড়ি তার বংশানুক্রমিক ভিটে। সেই আশ্রয়কে কেউ কি করে প্রশ্ন করতে পারে? এমন আপত্তিকর প্রশ্নের উত্তর খুজতেই পথে বসে অপেক্ষা করছিল মানুষ। উত্তর কেউ দেয়নি। উল্টে বসার অধিকার কতখানি তা নিয়েই চলেছে চাপানউতোর। উঠেছে তাদের একান্ত ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে অনধিকারচর্চা। তারপর আজ মহামারি মোকাবিলায় তাদের সমবেত হওয়ার অধিকার নিয়েও উঠেছে প্রশ্ন। প্রাথমিকভাবে ক্ষোভ হওয়ার কথা। কিন্তু আন্দোলন মানুষের জন্যই। মানুষের স্বার্থেই তাতে বিরতি টানা দরকার। ছেদ নয়। অবস্থানগত বদল মানে লক্ষ্য বদল নয়। অবস্থান মানে জায়গা। ভাবনা নয়। ঘরে ফেরা মানে নিজেদের সুরক্ষিত করা। লুকিয়ে পড়া নয়। সময়ের বিধিনিষেধ মানে নেওয়া মানে হার মানা নয়। দেশের মানুষের সঙ্গে কাঁধ মিলিয়ে সময়ের নির্দেশ মান্য করাই তো প্রকৃত নাগরিকের কাজ। এই নাগরিকের অধিকার হননযোগ্য নয় তাইত এত অভিমান। তা থেকেই প্রতিবাদ। গণঅবস্থানের ভাবনা। তাই মানুষের প্রয়োজনে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর মত মহান কাজ তারা করবে আশা করা যায়।
এবারে প্রশ্ন প্রত্যাবর্তনের। অনুমতি পাওয়ার। নিজেদের প্রাসঙ্গিকতা তুলে ধরার। ইতিহাস সাক্ষী আন্দোলন থেমে থাকে না। বিংশ শতকের মধ্যভাগ পেরিয়ে ওয়াশিংটনে গরীব মানুষের মার্চ অনেক প্রোটেস্ট ক্যাম্প গড়েছিল। সরকারের প্ররোচনায় বদলে ছিল অভিমুখ কিন্তু তা থামানো যায়নি। ক্ষুধা ও অপুষ্টির দিকে নজর ফেরাতে আন্দোলনকারীরা নিক্সনকে বাধ্য করেছিল। পরবর্তীকালে এই মার্চে লিগাসি অব্যাহত ছিল কমিউনিটি অ্যাকশন প্ল্যানের নামে। কাজ ছিল গরিবদের একইভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া। শাহিনবাগ-পার্ক সার্কাস নিজেই নিজেদের উদাহরণ। তারা এক টুকরো কাগজের বিনিময়ে উত্তরাধিকার ও পূর্বপুরুষদের কবরস্থানকে অস্বীকার করতে নারাজ। দেশের মাটিতে ঠিক কতটা লেগে আছে নিঃশ্বাস সেটার সমর্থনে কাগজ দেখাতে আগ্রহী নয়। তাই তাদের প্রতিবাদের ভাষা খুব সংযত ও যুক্তিপূর্ণ। তাদের প্রত্যাবর্তনের ক্ষেত্রে যদি অযথা ষড়যন্ত্র হয় তবে তা ভীষণ অনাকাঙ্ক্ষিত। সেক্ষেত্রে সকলের প্রতিবাদের ভাষা একরকম হওয়া দরকার। তাদের সঙ্গে সামিল হওয়ার জন্য এগিয়ে আসা দরকার। যারা নয়া আইনকে সমর্থন করছে তাদেরও হাত বাড়ানো দরকার। এতদিনের পরিশ্রমে সবরকমের প্রতিবন্ধকতাকে হার মানিয়েছে আন্দোলনকারীরা। প্রাকৃতিক প্রতিকূলতা ও আইনি প্রতিকূলতা ও নানারকম অভ্যন্তরীণ অভিঘাত অতিক্রম করে তারা এগিয়েছে। গুলি ছুটেছে, আন্দোলন ভাঙার প্রচেষ্টার মুখে হাতেনাতে ধরা পরেছে আততায়ীর বেশে অতিথি, তবু আন্দোলন স্তব্ধ হয়নি। তাই এদের প্রতি বিমুখ মানুষ হবে না প্রত্যাশিত।
আন্দোলনকারীদের দাবি সরকার মানবে কিনা সে প্রশ্ন অন্য। কিন্তু আন্দোলন চালানোর অধিকার সরকার কাড়তে পারে না। এটা খুব ন্যায্য দাবি। জায়গা বদলের আর্জি শাহিনবাগ মেনে নেবে কিনা সেটাও তাদের নিজেদের লড়াইয়ের কৌশলগত সিদ্ধান্ত। সেখানে কোনওরকম অসহযোগিতা ঘাতকের কাজ হবে। ইতিহাস বিশ্বাসঘাতকের যাপন লিপিবদ্ধ করতে ভোলে না। একদা আসিরগড় দুর্গে মুঘলঅধিপতি রাজপুতদের সরাতে ব্যর্থ হয়ে ভিন্ন পথ অনুসরণ করেছিল। শেষমেশ দুর্গের দখল নিয়েছিলেন ঠিকই কিন্তু রাজপুতদের সীমিত ক্ষমতার মধ্যে প্রবল শক্তিধর একদল সেনাবাহিনীকে দিনের পর দিন দোরগোড়ায় রুখে দেওয়াটাও ছিল তাদের জাত্যাভিমান। পরাজিত হলেও এই অভিমানই ছিল ওদের অস্তিত্বের প্রতীক। এতে সততা ও আত্মবিশ্বাস ছিল অপরিসীম। শাহিনবাগ সেই পথেই এগোবে এমন ভাবতে পারার মত দিগন্ত ওরাই আমাদের হাতে তুলে দিয়েছে। আমরা ভাববও।
দেশরক্ষার সৈনিক নাগরিক। দেশের ভাবমূর্তি অক্ষুণ্ণ রাখার দায়ও তাদের। সরকার জনগণের অভিভাবক। নিয়ন্ত্রক নয়। এই দেশের ইতিহাসেই রাজার ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণের জন্য সভা ও সমিতি ছিল। দেশের আইন নাগরিকের স্বার্থ সুরক্ষিত রাখার জন্যই তৈরি হয়। নাগরিকের কাছে তা যদি অস্পষ্ট হয় বা অনুকূল না মনে হয় তবে তা সংশোধন বা পরিবর্তনের দায় সরকারের। সেখান থেকে এক ইঞ্চি সরব না যদি সরকারের ঔদ্ধত্য হয়, তবে সেই সুরে জবাব দেওয়ার অধিকারও নাগরিকের বর্তায়। কেননা সরকাররের যে কোনও অবস্থানকে সংহত করার দায় নাগরিকের নেই। সরকারকে সহযোগিতার অঙ্গীকার মানে সরকার নির্দেশিত সব আইনের প্রতি নিঃশর্ত আনুগত্য প্রদর্শন নয়। আইন জোর করে মানতে বাধ্য করা গণতন্ত্রের ভাষা নয়। সরকারের কোষাগার জনগণের করের পয়সায় ভরে। তাই তাদের অভিমতের শেষতক গুরুত্ব থাকবে এটাই স্বাভাবিক। তাদের বক্তব্য বিবেচনা করা জরুরি। পাল্টা বিপক্ষ সমর্থকদের এককাট্টা করে সরকারের জোর দেখানোর প্রয়াস নিন্দার। তাই নাগরিকের অধিকার রক্ষায় সরকারকে পথ দেখানোও নাগরিকের কর্তব্য। শাহিনবাগ সেটাই করে দেখাচ্ছে। তারা বিচ্ছিন্ন কেউ নয়। দেশের নাগরিকের প্রতিনিধি তারা। সম্মানের সঙ্গে তাদের আন্দোলনের পথ উন্মুক্ত রাখা তাই সরকারের কাছে প্রত্যাশিত। সেটা না হলে আন্দোলনকারীদের সমর্থনে আরও মানুষের পথে নামা দরকার। যে বিশ্বাস থেকে তারা পথে নেমেছে সেই বিশ্বাসে সকলের একাত্ম হওয়া দরকার। এক্ষেত্রে আলেকজান্ডার ও পুরুর সেই বক্তব্যের প্রেক্ষিত বোঝা জরুরি। বন্দি ও পরাজিত পুরু বিজয়ী পরাক্রমী রাজার কাছে একজন রাজার আচরণ প্রত্যাশা করেছিলেন। দীর্ঘদিন আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া বিধস্ত মহিলারা সরকারের কাছে এক বিনীত সহনাগরিকের আচরণ প্রত্যাশা করলে হয়ত খুব ভুল কিছু করবে না। তাই ‘অল ইজ ওয়েল’ বলে আন্দোলনে আপাত বিরতি টানার সাহস তারা দেখাবে। এবং ঘরে ফিরে করোনার বিরুদ্ধে ঘোষিত বয়কটে সামিল হবে।