সুশোভন ধর
লেখক রাজনৈতিক কর্মী ও বিশ্লেষক।
ইয়েস ব্যাঙ্ক তৈরি হয় ২০০৩ এর ২১ নভেম্বর। এর ঠিক দু মাস পরে রানা কাপুরের তৈরি এই ব্যাঙ্ক ২০০৪-এর ২১ জানুয়ারি ব্যবসা শুরুর লাইসেন্স পায়। নয়া-উদারবাদের এই পোস্টার বয় ছিল কয়েকদিন আগে পর্যন্ত ভারতবর্ষের ‘সফল’ বেসরকারি ব্যাঙ্কিং-এর প্রতিমূর্তি। বেশ কিছু নামীদামী মিডিয়া হাউস এবং গ্লোবাল অ্যাডভাইজারি সংস্থা প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে ইয়েস ব্যাঙ্ককে ভারতের বিভিন্ন ব্যাঙ্কিং লিগ টেবিলের শীর্ষে স্থান দিয়েছিল। এছাড়া জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে কর্পোরেট ইনভেস্টমেন্ট ব্যাঙ্কিং, ট্রেজারি, ট্রানজাকশান ব্যাঙ্কিং এবং সর্বপরি, টেকসই ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থার জন্য বহু সম্মান লাভ করেছে ইয়েস ব্যাঙ্ক। এই ব্যাঙ্কের ওয়েবসাইটে গেলেই এই সমস্ত দাবি সহ অনেক লম্বা চওড়া ফিরিস্তি পাওয়া যাবে। কী নেই ইয়েস ব্যাঙ্কের? হাজারের ওপরে শাখা, প্রায় দু হাজার এটিএম নিয়ে তার সোনার সংসার। তবে এই মাসের গোড়ার দিকে গোল বাধে। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের একটি ঘোষণায় চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয় এবং ব্যাঙ্কের হাজার হাজার উদভ্রান্ত গ্রাহক সারা দেশের বিভিন্ন এটিএমগুলিতে নগদ প্রত্যাহারের জন্য ছোটাছুটি শুরু করেন। কোথাও দেখা যায় টাকা তোলার জন্য লম্বা সারি তো কোনও কোনও এটিএম খালি হয়ে পড়ে আছে। ঘোষণা করা হয় পঞ্চাশ হাজারের বেশি টাকা তোলা যাবে না। বিষয়টি জটিল হয় ইয়েস ব্যাঙ্কের ডিজিটাল ব্যাঙ্কিং পরিষেবা ৫ই মার্চ রাত থেকে বন্ধ হয়ে যাওয়ায়। এই ব্যাঙ্কের গ্রাহকরা তাদের সঞ্চিত অর্থ ইন্টারনেটের মাধ্যমে অন্য কোনও অ্যাকাউন্টে স্থানান্তর করতে না পেরে আরও বেশি চিন্তাগ্রস্ত হন। ব্যাঙ্ক শেষ পর্যন্ত দেউলিয়া হলে কী করবেন তাঁরা?
ইয়েস ব্যাঙ্কের এই ঘটনাগুলিতে আমরা অনেকেই, যাদের সঙ্গে এই ব্যাঙ্কের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক নেই, অবাক হয়েছি এবং ষাটের দশকের শেষে ভারতবর্ষের ব্যাঙ্ক জাতীয়করণের আগে ঘনঘন ব্যাঙ্ক পড়ে যাওয়ার ঘটনার পুনরাবৃত্তির আশঙ্কায় ভীত হয়েছি। ইয়েস ব্যাঙ্কের ঘটনায় কোটি কোটি ছোট আমানতকারীর হাজার হাজার কোটি টাকা লুট হয়েছে। সম্ভবত স্বাধীন ভারতের সবচেয়ে বড় আর্থিক জালিয়াতির নিদর্শন হতে চলেছে ইয়েস ব্যাঙ্ক। একথা স্পষ্ট যে এই ঘটনা কোনও এক-দুজনের বদমায়েশির ফল নয়। ব্যাঙ্কের প্রোমোটার, উচ্চ পর্যায়ের ম্যানেজমেন্ট, অডিটর, বড় বড় ঋণগ্রহণকারী, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক সহ বিভিন্ন নিয়ামক সংস্থা, সকলেই যুক্ত এর সঙ্গে। এদের সম্মিলিত অপকর্মের খেসারত দিতে হচ্ছে বিভিন্ন ছোট আমানতকারী এবং বিশেষ করে অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের, যারা তাঁদের সঞ্চয় দিয়ে ইয়েস ব্যাঙ্কেকে বিশ্বাস করেছিলেন।
প্রশ্নগুলো সহজ আর উত্তরও তো জানা
কয়েকটি স্পষ্ট প্রশ্নের এখনও পর্যন্ত কোনও উত্তর পাওয়া যাচ্ছে না।
ডিএইচএফএল-এর মতো জালিয়াতিতে কলঙ্কিত একটি সংস্থা এক বছরের বেশি সময় ধরে তদন্তাধীন রয়েছে। ঘটনা হল যে এই কোম্পানির সঙ্গে অন্যান্য অনেক ব্যাঙ্ক এবং সংস্থার যোগাযোগের খবর উঠে এলেও ইয়েস ব্যাঙ্কের সঙ্গে এদের যোগাযোগের কোনও খবর কখনও প্রকাশিত হয়নি। ইয়েস ব্যাঙ্কের সঙ্কটের সময়ে সেই যোগাযোগের ঘটনা আমাদের সামনে উঠে আসছে। আশ্চর্য বিষয় হল যে ডিএইচএফএল-এর তদন্তকারীরা অন্যান্য অনেক সংস্থার নাম বললেও ইয়েস ব্যাঙ্কের নাম কোনদিনও মুখে আনেননি। ইয়েস ব্যাঙ্ক নিয়ে তদন্তের সময় ঝুলি থেকে এইসব বেড়াল বেরোচ্ছে। তাহলে কি ধরে নিতে হবে যে এইসব ইচ্ছাকৃতভাবে গোপন করা হয়েছিল?
ব্যাঙ্কিং শিল্পের সাধারণ বৃদ্ধির হার যেখানে ১০-১২ শতাংশ সেখানে ইয়েস ব্যাঙ্ক বছরের পর বছর ধরেই ধারাবাহিকভাবে ৩০ শতাংশ বৃদ্ধির গল্প শোনাচ্ছে। এই অস্বাভাবিক বৃদ্ধি দেখেও রিজার্ভ ব্যাঙ্ক সহ আর্থিক নিয়ামক সংস্থাগুলি চুপ করে ছিল কেন? এই নিয়ে কোনদিনও কোনও প্রশ্ন তোলা হয়নি। তাহলে কি দিনের পর দিন ইয়েস ব্যাঙ্ককে ইচ্ছাকৃতভাবে ছাড় দেওয়া হয়েছিল?
ভারতবর্ষের কর্পোরেট জগতের কেষ্ট-বিষ্টুরা দীর্ঘদিন ধরেই ব্যাঙ্ক-ঋণ খেলাপ এবং ব্যাঙ্কের টাকা মারায় সিদ্ধহস্ত হয়ে উঠেছেন। তাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বহু ব্যাঙ্কের অনাদায়ী ঋণের পরিমাণ গগনচুম্বী হওয়ার ফলে ব্যাঙ্কিং শিল্পের আজ নাভিশ্বাস উঠেছে। বহু ক্ষেত্রেই দেখা গেছে যে তাদের ব্যবসায় এত টাকা ঋণ দেওয়ার কোনও বাস্তবতা ছিল না। জি গ্রুপ, এসেল গ্রুপ, রিলায়েন্স (এডিজি) গ্রুপ, ডিএইচএফএল, ইন্ডিয়া বুলস, ইউবি গ্রুপ, গীতাঞ্জলি হীরা এবং জেট এয়ারওয়েজের মতো বহু পরিচিত খেলোয়াড় দিনের পর দিন ধরে এই অপকর্ম চালিয়ে গেছে। এই পুঁজিপতিরা একটা ব্যাঙ্কের টাকা মেরে আরেকটা ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নিতে পারদর্শী ছিলেন এবং মজার কথা হল ইয়েস ব্যাঙ্ক এই সমস্ত রথী-মহারথীদের করজোড়ে আমন্ত্রণ জানিয়েছে। এদের ঋণ দেওয়া হয়েছে কাগজপত্র ঠিকমতো পরীক্ষা না করে বা কোনও জামানত বা কোল্যাটেরাল সিকিউরিটি ছাড়াই। এই জাতীয় দশটি ব্যবসায়িক সংস্থা ইয়েস ব্যাঙ্ক থেকে চৌত্রিশ হাজার কোটি টাকার মতো ঋণ নিয়েছে। ইয়েস ব্যাঙ্কে যখন এইসব চলছে তখন রিজার্ভ ব্যাঙ্ক এবং ইয়েস ব্যাঙ্ক বোর্ডের সদস্যরা কি নাকে সর্ষের তেল দিয়ে ঘুমাচ্ছিলেন?
অনিল আম্বানি গোষ্ঠীর ইয়েস ব্যাঙ্ক থেকে নেওয়া ১২,৮০০ কোটি টাকার ঋণ আদৌ ফেরত পাওয়া যাবে কি না কেউ বলতে পারছেন না। ইয়েস ব্যাঙ্ক নিয়ে তুলকালাম চলাকালীন তার অফিস একটি বিবৃতি জারি করে জানিয়েছে যে ইয়েস ব্যাঙ্ক থেকে নেওয়া ঋণ পুরোপুরি সুরক্ষিত আছে এবং সাধারণ ব্যবসার জন্যে তা গ্রহণ করা হয়েছিল। তারা আরও জানায় যে রিলায়েন্স গ্রুপ ইয়েস ব্যাঙ্ক লিমিটেডের ঋণ পরিশোধ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এই অনিল আম্বানির আইনজীবীরাই গত মাসে লন্ডনের আদালতে বলেছিলেন যে তিনি দেউলিয়া হয়ে গেছেন এবং ২০১২ সালে তার সম্পদের পরিমাণ ছিল ৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার যা বর্তমানে ৮৯ মিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। তারা আদালতে আরও বলেছিলেন তার সমস্ত লায়াবিলিটি বা আর্থিক দায় বিবেচনা করলে তাঁর সম্পদের মোট পরিমাণ শূন্যে দাঁড়াবে। অনিল আম্বানি কোথা থেকে ইয়েস ব্যাঙ্কের ঋণ শোধ করবেন?
ইয়েস ব্যাঙ্কের ঋণখেলাপি অনেক বড় খেলোয়াড় করোনাভাইরাস বা অসুস্থ বোনকে দেখাশুনো করার অজুহাতে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটের তদন্তে অংশ নেওয়া এড়িয়ে চলেছেন। আসল কথা খুব স্পষ্ট। তারা সকলেই সময় কাটানোর চেষ্টা করছেন এবং আশায় আছেন যে ঝড়ঝাপটা শেষ হলে তাদের আইনজীবী এবং ঘনিষ্ঠজনদের সাহায্যে তদন্তে ধামাচাপা দিয়ে দেবেন। এরই মধ্যে তারা জনসাধারণের অর্থ লুট করার জন্য নতুন নতুন মৃগয়াক্ষেত্র এবং আরও বেশি ব্যাঙ্কের সন্ধান করতে থাকবেন। আর ঝামেলা বেশি বাড়লে বিদেশে পালানোর রাস্তা তো খোলা আছেই।
ইয়েস ব্যাঙ্কের প্রোমোটার শ্রী রানা কাপুর মহাশয় সম্পর্কে যত কম বলা যায় তত ভাল। তিনি আমানতকারীদের অর্থ লুটপাট করার জন্য অনেক উদ্ভাবনী উপায় খুঁজে বের করেছেন। বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা তাঁর ও তাঁর পরিবারের নামীদামী সম্পত্তির বহর দেখলে পরিষ্কার হয়ে যায় তিনি কী করেছেন এবং কেন করেছেন। ব্যাঙ্ক থেকে যত টাকা লুট গেছে তার সঙ্গে এই সমস্ত সম্পত্তি এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট কি যুক্ত করতে পারবে? সে সম্ভাবনা খুবই কম কারণ নামে-বেনামে সম্পত্তির জাল এমনভাবে ছড়ানো আছে যে সেগুলো ধরতে পারা মুশকিল। এছাড়া ৬ই মার্চ ২০২০ তারিখের পাঞ্জাব ও হরিয়ানা হাইকোর্টের একটি রায় এই কাজ করতে পারার ক্ষেত্রে যতটা প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা যায় ঠিক তাই করেছে। এই রায় বলছে যে এই সম্পত্তিগুলি কোনওটিই যুক্ত করা যাবে না যতক্ষণ না এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে পারবে রানা কাপুর ও তাঁর পরিবারের বিরুদ্ধে যে যে ফৌজদারি মামলা চলছে, সেই সমস্ত কার্যকলাপ থেকেই এই সম্পত্তি ক্রয় করা হয়েছে। নেট ফলাফল হল রানা কাপুর বা তার পরিবার তাদের বেশিরভাগ সম্পদ হারাবেন না। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে ভারতবর্ষের বিচারব্যবস্থা যতটা না আপনার-আমার পক্ষে তার থেকে অনেক বেশি পুকুর চুরি করা পুজিপতিদের পক্ষে।
পুনর্গঠন প্রক্রিয়া
পুনর্গঠন প্রক্রিয়ার নামে স্টেট ব্যাঙ্ক ও রিজার্ভ ব্যাঙ্ক ৮,৯০০ কোটি টাকার এটি-১ পারপেচুয়াল বন্ডের মূল্য শূন্য করে দিয়েছে নূন্যতম চিন্তাভাবনা না করে। এই বন্ডগুলি শেয়ারের মতো। এবং সেই কারণে এটা সাধারণ মানুষের মধ্যে খুবই কম ছাড়া হয় বা প্রায় ছাড়াই হয় না। এর শর্তাবলি ভীষণ জটিল এবং সাধারণ মানুষের স্বার্থের পক্ষে নয়। বেশিরভাগ উন্নত দেশে এই ধরনের বন্ড সাধারণ ক্রেতাদের জন্য ছাড়া হয় না কিন্তু ভারতে বিষয়টা সম্পূর্ণ উল্টো।
বহু সাধারণ মানুষ সেকেন্ডারি মার্কেট থেকে শর্তাবলি না জেনে এই বন্ড কিনে থাকেন। যেহেতু এই বন্ডের সুদের হার সামান্য বেশি তাই বহু অবসরপ্রাপ্ত মানুষ এই বন্ড কেনেন। এই মুহূর্তে সেই সমস্ত মানুষের অবসরকালীন পরিকল্পনা অনিশ্চিত কারণ এই বন্ডের মূল্য কার্যত শূন্য। ইয়েস ব্যাঙ্কের নতুন বিনিয়োগকারীরা বন্ডের মূল্য কেন শূন্য ঘোষণা করলেন তা সাধারণ বুদ্ধিতে ধরা যাচ্ছে না।
এই সমস্ত বিষয় থেকে অনুমান করা সহজ যে সম্ভবত ইয়েস ব্যাঙ্কের ভেতরের বিভিন্ন অনিয়ম ও গণ্ডগোল ধামাচাপা দেওয়ার ইচ্ছাকৃত প্রচেষ্টা ছিল। ইয়েস ব্যাঙ্কের বিষয়টি যে দ্রুততার সঙ্গে ‘সমাধান’ করা হয়েছে তা ভারতীয় ইতিহাসে নজিরবিহীন। ইয়েস ব্যাঙ্কের আন্তরিক ও নিরপেক্ষ তদন্ত কী আসলে দেশের আর্থিক ক্ষেত্রের হাড় পাঁজরা বের করে দিতে পারে এই ভয় থেকে এমন তড়িঘড়ি করা হল? আমরা কী কোনওদিন জানতে পারব ইয়েস ব্যাঙ্কে ঠিক কী ঘটেছিল এবং কোন কোন বড় রথী-মহারথীরা এই কেলেঙ্কারির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন? এই ঘটনাটিকে ধামাচাপা দেওয়ার একটা মরিয়া প্রয়াস দেখা গেছে সরকারের তরফে। প্রশ্ন হল কেন এবং কার জন্য?
রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ভূমিকা
ইয়েস ব্যাঙ্কের ঘটনা দেখায় ভারতের রিজার্ভ ব্যাঙ্ক আমানতকারীদের স্বার্থ দেখতে পুরোপুরি ব্যর্থ। এবং এটা ঘটছে এমন সময় যখন ভারতবর্ষের ব্যাঙ্কিং শিল্প এক কঠিন এবং দীর্ঘ সঙ্কটের মধ্যে দিয়ে চলেছে। একদিকে অর্থনৈতিক সঙ্কট চলছে এবং অন্যদিকে ব্যাঙ্কগুলি ক্রমবর্ধমান অনাদায়ী ঋণের ভারে ন্যুব্জ পড়ছে। ইয়েস ব্যঙ্কের সমস্যার কথা বহুদিন ধরে বাজারে উড়ছে। এক বছর আগে রবণীত গিলকে এই ব্যাঙ্কের সিইও হিসেবে নিযুক্ত করার পরেও রিজার্ভ ব্যাঙ্ক ইয়েস ব্যাঙ্ককে বাঁচানোর কোনও কার্যকরী ভূমিকা নিতে পারেনি। কয়েক মাস আগে পাঞ্জাব মহারাষ্ট্র কো-অপারেটিভ ব্যাঙ্কের ক্ষেত্রে যা হয়েছিল এক্ষেত্রেও তার পুনরাবৃত্তি দেখা গেছে।
গত তিন বছর ধরে ইয়েস ব্যাঙ্কের টালমাটাল অবস্থা খবরে আছে। ২০১৬ এবং ২০১৭, টানা দু বছর ধরে ইয়েস ব্যাঙ্ক ভুল হিসাব দেখিয়ে গেছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ধারাবাহিকভাবে বোর্ডের সদস্য ও পরিচালকদের পদত্যাগ। প্রমোটারদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ সঙ্ঘাত। অনাদায়ী ঋণ বৃদ্ধি, মূলধনের অপর্যাপ্ততা, পুঁজি জোগার করার ব্যার্থতা, নিয়মকানুন লঙ্ঘন এবং সম্পদের ভুল শ্রেণিবদ্ধকরণ। বিষয়টি গোচরে থাকা সত্ত্বেও, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক হস্তক্ষেপ করেনি এবং এই অব্যবস্থাপনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি। ২০১৮-র সেপ্টেম্বরে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক তৎকালীন এমডি এবং সিইও রানা কাপুরকে, তার সময়কালের (জানুয়ারি ২০১৯) শেষে ইয়েস ব্যাঙ্ক ছেড়ে যেতে বলে। রবণীত গিল ২০১৮-র মার্চ মাসে নতুন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসাবে নিযুক্ত হন। এবং পরে, রিজার্ভ ব্যাঙ্কের প্রাক্তন ডেপুটি গভর্নর রামা সুব্রামানিয়াম গান্ধিকে ইয়েস ব্যাঙ্কের বোর্ডে অতিরিক্ত পরিচালক হিসাবে নিয়োগ করে।
মজার বিষয় হল, চরম ডামাডোলের মধ্যেও ইয়েস ব্যাঙ্ক নতুন নতুন ঋণ প্রদান অব্যাহত রাখে। ২০১৭ থেকে ২০১৯ সালে তাদের মোট ঋণ ১,৩২,০০০ কোটি টাকা থেকে বেড়ে ২,৪১,০০০ কোটি টাকায় দাঁড়ায়। এর থেকে স্পষ্ট যে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক ইয়েস ব্যাঙ্ককে পতনের হাত থেকে রুখতে কোনও কার্যকরী ব্যবস্থা নেয়নি। রানা কাপুরকে জোর করে সরানোর পরেও রিজার্ভ ব্যাঙ্ক কেন নিষ্ক্রিয় থাকল? বলতেই হচ্ছে, ইয়েস ব্যাঙ্কের এই সঙ্কটের জন্য তারাও সমানভাবে দায়ী। অতীতে, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের ব্যাঙ্কের ব্যাপারে তত্ক্ষণাৎ সংশোধনমূলক পদক্ষেপ নিয়েছিল। ইয়েস ব্যাঙ্কের ক্ষেত্রে অন্যাথা হল কেন?
এক মাসের জন্য ইয়েস ব্যাঙ্ককে বিধিনিষেধে রাখার পরে, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক একটি খসড়া পুনর্গঠন প্রকল্প তৈরি করেছে যেখানে স্টেট ব্যাঙ্ক বিনিয়োগ করে এই রুগ্ন ব্যাঙ্কের ৪৯% স্বত্ব কিনবে। এলআইসি সহ আরও কয়েকটি ব্যাঙ্ক এসবিআই নেতৃত্বাধীন কনসোর্টিয়ামের মাধ্যমে এই বেসরকারি ব্যাঙ্কটিকে পতন থেকে বাঁচাতে বিনিয়োগ করবে। কিন্তু পিএমসি ব্যাঙ্কের বিষয়টি দেখলে পরিষ্কার বুঝতে পারব যে ঐ ব্যাঙ্কটিকে বাঁচাতে এখনও সরকার বিশেষ কিছু করে উঠতে পারেনি যেখানে পিএমসি ব্যাঙ্কের মোট আমানত ছিল মাত্র ১১,০০০ কোটি টাকা। এছাড়াও, একই সরকার যেখানে ২০২০ সালের অর্থনৈতিক সার্ভেতে সরকারি ক্ষেত্রের বেসরকারিকরণের ওকালতি করেছে তারা এখন রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের ব্যাঙ্কগুলিকে বেসরকারি ব্যাঙ্কের অংশীদারিত্ব নিতে বলছে কেন? ইয়েস ব্যাঙ্কের ঘটনার জন্য বহু মানুষ, সঠিকভাবেই, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক এবং সরকারি গাফিলতির দিকে আঙুল তুলছেন। কিন্তু বিষয়টি কি শুধুমাত্র গাফিলতি আর অবহেলায় সীমাবদ্ধ, না কি স্বেচ্ছায় ঘটতে দেওয়া হয়েছে?
আরও দৃঢ় ও সুদূরপ্রসারী সমাধানের জন্য
ইয়েস ব্যাঙ্কের পরিচালকদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত এবং সরকার ও রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কারা এই ঘটনার সঙ্গে যুক্ত তার নিরপেক্ষ তদন্ত করতে হবে। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের নিষ্ক্রিয়তা ও ভূমিকার একটি স্বাধীন তদন্ত হওয়া উচিত। রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের ব্যাঙ্কগুলিকে আরও শক্তিশালী করার সঙ্গে সঙ্গে বেসরকারি ব্যাঙ্কের ওপর বিধিনিষেধ আনা দরকার এবং এই সমস্ত ব্যাঙ্কগুলির রাষ্ট্রীয়করণ না করলে ইয়েস ব্যাঙ্কের ঘটনার বহু পুনরাবৃত্তি আমরা দেখব। এর মধ্যেই আরবিএল ব্যাঙ্ক ও ইন্ডাসইন্ড ব্যাঙ্ক নিয়ে আলোচনা শুরু হয়ে গেছে। সরকার, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক ও অন্যান্য নিয়ামক সংস্থাগুলি কড়া ভূমিকা না নিলে আমরা আরও অনেক বড় ট্র্যাজেডির সাক্ষী থাকব।
আসলে ব্যাঙ্কিং ব্যবসা বেসরকারি হাতে ছেড়ে দেওয়া চলবে না। ব্যাঙ্কিং শিল্পের সামাজিকীকরণ খুব জরুরি। এর অর্থ বেসরকারি ব্যাঙ্কগুলি বাজেয়াপ্ত করা এবং গণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণে রাখা (ব্যাঙ্ক কর্মচারী, গ্রাহক সমিতি এবং স্থানীয় সরকারী প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি দ্বারা)। ব্যাঙ্কিং শিল্পের লক্ষ্য হওয়া উচিত জনসেবা। পুঁজিপতিদের মৃগয়াক্ষেত্র নয়। ব্যাঙ্কিংয়ের মাধ্যমে উত্পন্ন আয় সাধারণ মানুষের উন্নয়নের জন্য ব্যবহৃত হওয়া দরকার। একইসঙ্গে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের আমূল সংস্কার করতে হবে এবং তাদের লক্ষ্য উদ্দেশ্য অবশ্যই নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করা উচিত।
পুনশ্চ
আমি কোনও ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব আমদানি করতে চাইছি না কিন্তু এ কথা কাকতালীয় হলেও সত্যি যে ইয়েস ব্যাঙ্কের ঋণখেলাপিরা আবার ভারতীয় জনতা পার্টিকে মোটা টাকা চাঁদা দিয়েছেন। নিচের তালিকায় কয়েকটা উদাহরণ দেওয়া হল। তবে নামের লিস্ট যে আরও লম্বা তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই।
অনিল আম্বানি | ২০ কোটি |
এসেল গ্রুপ | ৪০ কোটি |
রেডিয়াস ডেভেলাপার | ৫০ লক্ষ |
ডিএইচএফএল | ১৯.৫০ কোটি |
আরকেডব্ল্যু | ১০ কোটি |