দেবব্রত শ্যামরায়
লেখক গদ্যকার ও রাজনৈতিক ভাষ্যকার।
ভারী বিষয় নিয়ে কিছুটা হালকা চালে কথাবার্তা শুরু করা যাক।
হোয়াটস্যাপে দুই বন্ধুর কথোপকথন চলছে।
প্রথম বন্ধু। বাড়িতে বসে বেশ বোর হচ্ছি। বুঝলি?
দ্বিতীয় বন্ধু। আমিও। কী করা যায় বল তো? চল একটা সিনেমা দেখে আসি! ‘রইস’ বেরিয়েছে। দেখবি।
প্রথম বন্ধু। না না। তার চেয়ে বরং ‘চার্লিজ অ্যাঞ্জেলস’ দেখে আসি চল। পয়সা উসুল হয়ে যাবে।
ঠিক এই সময় কথোপকথন জানালায় একটি তৃতীয় ব্যক্তির উদ্ভব ঘটে। অনাহূত অতিথিটির নাম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক। আজেবাজে সিনেমা দেখে সময় নষ্ট কোরো না হে। সিনেমা যদি দেখতেই হয়, যাও, ‘কেদারনাথ’ দেখে এসো।
হতভম্ব দুই বন্ধুর মুখে অর্থাৎ আঙুলে আর কথা সরে না।
অর্থাৎ রাষ্ট্র ব্যক্তিনাগরিকের একান্ত ব্যক্তিগত পরিসরে ঢুকে পড়ে নাক গলানোর উপক্রম করেছে, এটি তা নিয়ে সোশাল মিডিয়ায় উড়ে বেড়ানো একটি হালকা মস্করা। এহেন হালকা রসিকতাটির মূল বক্তব্যটিকে ২০২০ সালের মার্চ মাসে দাঁড়িয়ে আর সামান্য বা হালকা বলে মনে হচ্ছে না, যদি আমরা নিচের খবরটির দিকে তাকাই।
খবরটি এই যে— প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির অধীনে ভারত সরকার একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ ও সচল তথ্যের আধার বা ডেটাবেস তৈরি করছেন, যাকে National Social Registry বলা হচ্ছে, যার দ্বারা ভারতের ১২০ কোটি জনসাধারণের প্রত্যেকের প্রতিটি সামাজিক ও অর্থনৈতিক পদক্ষেপ নথিবদ্ধ ও প্রয়োজনে অনুসরণ করা যাবে। ‘পদক্ষেপ’ শব্দটি নন-টেকনিক্যাল, একটু ভেঙে বললে, এই ডেটাবেস থেকে ভারতবর্ষে বসবাসকারী একজন মানুষ কবে জন্ম নিচ্ছে, কবে বিবাহ করছে, কাকে বিয়ে করছে, কবে সম্পত্তি ক্রয় করছে, কবে এক শহর থেকে অন্য শহরে যাচ্ছে, কবে সন্তানের জন্ম দিচ্ছে, ব্যাঙ্কে কত টাকা রেখে কবে মারা যাচ্ছে, এই যাবতীয় তথ্য মাত্র কয়েকটি ক্লিকে জানা যাবে। এমনকি, ২০১৯ সালের অক্টোবর মাসে ভারতের নীতি আয়োগ এই প্রস্তাবও করেছেন, ভারতের প্রতিটি বাড়ি-কে ইসরো-র তৈরি ‘ভুবন’ নামের geo-spatial পোর্টালটির সঙ্গে ট্যাগ করে দিতে, যাতে কোন মানুষ কোন ঠিকানায় থাকেন, তা ভৌগোলিক মানচিত্রের সাহায্যে নিমেষে বোঝা যায়। বলা বাহুল্য, একজন ব্যক্তি সম্বন্ধে এই যাবতীয় তথ্যের Navigator বা প্রবেশ-বীজ হবে আধার অর্থাৎ আমাদের Unique Identification Number।
হোক না, এরকম একখানা সর্বব্যাপী ও সর্বগ্রাসী ডেটাবেস তৈরি হলে মন্দ কী?
এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে মনে করিয়ে দেওয়া যাক, উপরের অনুচ্ছেদে সচেতনভাবে জনসাধারণ বা এদেশে বসবাসকারী মানুষ শব্দবন্ধদুটি ব্যবহার করা হল, ‘নাগরিক’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়নি। কারণ এনআরসি-এনপিআর-সিএএ পরবর্তী ভারতবর্ষে ‘নাগরিক’ শব্দটি আর সকলের জন্য প্রযোজ্য নয়, অন্তত সরকার বাহাদুর সেরকমটাই ভাবেন, এবং এই ডেটাবেস নাগরিক ও অ-নাগরিকের বিভাজনেও এক কার্যকরী ভূমিকা নেবে।
National Social Registry বা জাতীয় সমাজপঞ্জী-র ক্ষমতা ও ভবিষ্যতে এর প্রয়োগটা বোঝার আগে এর ইতিহাসটা অল্প কথায় জেনে নেওয়া দরকার।
Social Registry-র প্রথম ইটটি পাতা হয়েছিল বছর পাঁচেক আগে। ২০১১ সালে আদমসুমারিতে প্রাপ্ত জাতিভিত্তিক আর্থসামাজিক তথ্যগুলিকে আরও নির্ভুল ও আপডেট করার প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল, কারণ সরকার নানা জনদরদি প্রকল্পের মাধ্যমে দরিদ্ররেখার নিচে থাকা নাগরিকদের যে সুবিধেগুলি দিয়ে থাকে, সেগুলির কার্যকারিতা সুনিশ্চিত করার দরকার ছিল। এমন একটি নির্ভুল ও তথ্যঘন ডেটাবেস দরকার ছিল, যার মাধ্যমে ঠিক লোকের হাতে ঠিক পরিষেবাটি পৌঁছে দেওয়া যায়, কল্যাণমূলক প্রকল্পের দধিটুকু যেন কোনও সুবিধেভোগী নেপোয় মেরে দিতে না পারে।
সদুদ্দেশ্য, সন্দেহ নেই। অন্তত এমনটাই ভেবেছিলেন শ্রী মনোরঞ্জন কুমার, ২০১৫-তে ভারত সরকারে গ্রামীণ উন্নয়ন মন্ত্রকের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা। তিনি ভেবেছিলেন এমন একটি তথ্যের আধার বানাতে হবে যা ভারতীয় নাগরিকদের ক্রমশ জটিল হতে থাকা অর্থনৈতিক অবস্থানের স্তরগুলিকে বুঝতে পারবে৷ এই জানাবোঝার গভীরতা যত বাড়বে, বোঝা যাবে কোন পরিবারটি প্রধানমন্ত্রী গৃহনির্মাণ যোজনায় পাকা ঘর বানানোর অনুদান পেতে পারে, কোন পরিবারের ছাত্রী স্কলারশিপ পাওয়ার যোগ্য, কোন ব্যক্তি ব্যবসার জন্য ক্ষুদ্র ঋণ পাওয়ার অধিকারী। এখানেই শেষ নয়, এই ডেটাবেসটির বিশেষত্ব এই যে এটি self-updating ও dynamic হবে। নভেম্বর ২৭, ২০১৫ সালে মন্ত্রককে লেখা একটি নোটে মনোরঞ্জন কুমার লিখলেন, “To be effective social registry SECC (Socio-Economic Caste Census) would need continuous updating to become dynamic social registry.” অর্থাৎ শুধুমাত্র ডেটাবেস বা তথ্যের আধার একবার তৈরি হলেও হল না, তা নির্দিষ্ট সময় অন্তর নিজেই নিজেকে আধুনিকীকরণ করবে, যার ফলে তথ্যগুলি updated থাকবে, ডেটাবেসে থাকা তথ্যগুলি কখনওই পুরনো বা তামাদি হয়ে যাবে না।
শ্রী মনোরঞ্জন কুমারের সেই স্বপ্নের Social Registry-র কাজ আজ প্রায় শেষ হওয়ার মুখে। ২০১৯-এ অবসর নিয়েছেন মনোরঞ্জন। অবসর নেওয়ার কিছুদিন আগে থেকেই মনোরঞ্জনের মনে হতে শুরু করে যে উদ্দেশ্য নিয়ে এই ডেটাবেস গঠন করা হয়েছে, তা ক্রমশ ব্যর্থ হতে চলেছে। তিনি বলছেন, “আমি দেখতে পাচ্ছি ভারত ক্রমশ একটি নজরদার ও নিয়ন্ত্রক রাষ্ট্রে পরিণত হতে চলেছে, একটি শক্তিশালী পুলিস স্টেট। আর আমার বিশ্বাস কোনও দেশকে উন্নতি করতে হলে, তার ব্যক্তি ও সংস্থা দুটোর ওপরেই রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ যথাসম্ভব কম থাকা দরকার।”
মনোরঞ্জন কুমারের এহেন মত পরিবর্তনের বেশ কিছু কারণ রয়েছে। আমরা এই লেখায় কিছুক্ষণ আগেই বলেছিলাম, আধার নাম্বার এই Social Registry-র বীজ, অর্থাৎ এক ব্যক্তির আধার নাম্বারের মাধ্যমে তাঁর সম্পর্কে যেকোনও তথ্য এই সমাজপঞ্জী থেকে রাষ্ট্র হস্তগত করতে পারে। আধার নাম্বারের ব্যবহারের সীমানা নির্দেশ এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে ৩২টি পিটিশনের মামলায় সুপ্রিম কোর্টের রায় ছিল, আধার নাম্বার শুধুমাত্র গরিব মানুষকে ভর্তুকি দেওয়ার জন্য ব্যবহার করা যাবে। অর্থাৎ এখনও অবধি সর্বোচ্চ আদালতের দেওয়া সুরক্ষাকবচে ব্যক্তির তথ্যের গোপনীয়তার অধিকার সুরক্ষিত। কিন্তু অতি সম্প্রতি কেন্দ্র সরকার আধার আইনটিকে সুবিধেমতো সংশোধন করার পথে হাঁটছে, যা একবার করা গেলে সুপ্রিম কোর্টের রায়টির আর কোনও অর্থ থাকবে না, গোপনীয়তার অধিকারকে সুকৌশলে এড়িয়ে যাওয়া যাবে। এছাড়াও, আধার আইনে আরেকটি সংশোধনী আসতে চলেছে, যার ফলে একটি মন্ত্রককে নিজের আধার রেকর্ড ব্যবহার করতে দেওয়ার ছাড়পত্র দিলে, নাগরিক সমস্ত মন্ত্রক বা দপ্তরকেই আধার-রেকর্ড ব্যবহার করার ছাড়পত্র দিয়েছেন ধরে নেওয়া হবে। অতএব, সাধু সাবধান!
শ্রী মনোরঞ্জন কুমার অথবা আমরা কি খুব বেশি ভয় পাচ্ছি? এমন কোনও আশঙ্কায় ভুগছি, যা অসঙ্গত?
আপাতত একটিমাত্র উদাহরণ দেওয়া যাক। ২০১৯ সালের এপ্রিল মাসে অর্থাৎ লোকসভা নির্বাচনের ঠিক আগে পঞ্জাব থেকে ২ কোটি নাগরিকের আধার রেকর্ড সম্বলিত হার্ড ড্রাইভ উদ্ধার করা হয়েছিল। এছাড়াও তেলেঙ্গানা ও অন্ধ্রপ্রদেশ থেকে আরও ৭.৮ কোটি আধার রেকর্ড সম্বলিত হার্ড ড্রাইভ পুলিশ বাজেয়াপ্ত করে৷ দ্বিতীয় ঘটনার SIT অনুসন্ধানের ভারপ্রাপ্ত আই জি স্টিফেন রবীন্দ্র জানাচ্ছেন, সম্ভবত টিডিপি দলের ক্যাডাররা সেবা মিত্র অ্যাপের সাহায্যে এই বিপুল সংখ্যক নাগরিকের নাম ভোটার লিস্ট থেকে মুছে দেওয়ার ষড়যন্ত্র করেছিল। আর কে না জানে, অপছন্দের নির্বাচকদের ভোটার লিস্ট থেকে উড়িয়ে দেওয়ার অর্থ নির্দিষ্ট মতের নাগরিকের ভোটে মসনদে শাসকের স্থায়িত্ব সুনিশ্চিত করা। ভোটও হল, গণতন্ত্রের তকমাটিকে অক্ষত রাখা গেল, আবার একনায়কতন্ত্রও কায়েম করা গেল, এমনটা করা গেলে তো সোনায় সোহাগা!
অর্থাৎ জনদরদি প্রকল্পগুলি নির্ভুলভাবে কার্যকর করার ঘোষিত লক্ষ্য নিয়ে যে জাতীয় সমাজপঞ্জীর সূত্রপাত হয়েছিল, তার মধ্যে নিহিত বিপুল তথ্যের খনি ক্রমশ অনেকান্ত ক্ষতিকর সম্ভাবনার পথ খুলে দিয়েছে। ঠিক হাতে যেসব তথ্যের সদব্যবহার সম্ভব, সঙ্কীর্ণ স্বার্থকেন্দ্রের হাতে পড়লে সেইসব তথ্যেরই দানবিক প্রয়োগ হতে পারে। গত পাঁচ-ছয় বছরে আমাদের দেশে গণতান্ত্রিকতার সূচক ক্রমশ পাতালে নামছে, শাসকের ফ্যাসিস্ট ও নিয়ন্ত্রক চরিত্র প্রতিদিন একটু একটু করে স্পষ্ট হচ্ছে, সেখানে National Social Registry প্রকৃতপক্ষে একটি সময়বোমা। জনদরদি প্রকল্পগুলিও আজ অজুহাতমাত্র, একের পর এক আর্থসামাজিক ভর্তুকি কমিয়ে দেওয়া বা বন্ধ করে দেওয়ার পথে হাঁটছে সরকার, এই সময়ে সমাজপঞ্জীর ব্যবহারিক মূল্য রয়েছে শুধুমাত্র নজরদার রাষ্ট্রে। যে রাষ্ট্রে ব্যক্তির স্বাধীনতার পরিসর ক্রমে কমে আসে, যেখানে রাষ্ট্র আমার ঘরে ঢুকে খাদ্যাভ্যাস থেকে শুরু করে আমার ধর্মপালন এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে আমার সঙ্গীনির্বাচনেও নাক গলাতে চায়। আমার ব্যক্তিগত তথ্যের ভিত্তিতে নিদান দিতে চায় আমি বা আপনি কে এদেশের নাগরিক, আর কে নাগরিক নয়।
লেখার শুরুতে মস্করাটি অতিকথন ছিল। রাষ্ট্র আমার সিনেমা দেখা বা না দেখা ঠিক করে দেয় না। অথবা এও হতে পারে, মস্করাটি অতিকথন ছিল না। কারণ আমরা এতদিনে জেনে গেছি, রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন শাসক জানতে আগ্রহী, মহম্মদ আখলাকের হিম ফ্রিজে কোন পশুমাংস রাখা আছে!