স্যার ববি রবসন প্রদীপদাকে বললেন, “হাউ মেনি গোলস ইউ ওয়ান্ট?”

অলোক মুখার্জি

 

 

 

 

 

 

 

 

আমার খেলোয়াড় জীবনের একেবারে প্রথম থেকেই আমি পি কে ব্যানার্জির সান্নিধ্য পেয়েছি। ৭৮ সালে আমি  ইস্টার্ণ রেলে যোগ দিই, সেখানে তখন প্রদীপদা আমাদের কোচ। সেই বছরই কোয়েম্বাটোরে রেলের সর্বভারতীয় একটা টুর্নামেন্ট হয়েছিল। প্রদীপদার কোচিং-এই আমি অল ইন্ডিয়া রেলওয়েজের হয়ে সন্তোষ ট্রফিতে খেলার সুযোগ পাই। তারপরের দুবছর রেলের হয়ে খেলার পর ৮১ সালে আমি মহামেডান স্পোর্টিং-এ সই করি। ততদিনে প্রদীপদা জাতীয় দলের কোচ হয়েছেন। তখন আইএফএ বলল সারা দেশ থেকে চল্লিশজনকে এশিয়ান গেমসের জন্য ট্রায়ালে ডাকা হবে। আমি তখন মহামেডানের হয়ে লিগ খেলছি। ওই চল্লিশ জনের লিস্টে আমার নাম ছিল না। কিন্তু সেবছর কলকাতা লিগে আমি এত ভালো খেললাম যে লিগ শেষ হয়ে যাওয়ার পরেই ট্রায়ালের জন্য আমাকে বোম্বেতে ডাকা হল। আমি চান্স পেলাম এবং প্রথমবার দেশের হয়ে খেলতে আমি দুবাই গেলাম। এরপর থেকে আমাকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। ইন্ডিয়া টিমে লেফট ব্যাক হিসেবে শ্যামল ব্যানার্জিকে বসিয়ে আমি খেললাম, শ্যামলদা পরে অবশ্য রাইট ব্যাক খেলেছেন, কিন্তু লেফট ব্যাকের জায়গাটা আমার জন্যই বাঁধা হয়ে গেছিল। ৮২ এশিয়ান গেমসে আমি এক নম্বর প্লেয়ার হলাম এবং ওই বছরই বর্ষসেরা ফুটবলার হলাম। এই পুরো সময়টা ধরে আমি প্রদীপদার গাইডেন্স পেয়ে এসেছি। এমনকি ৯৪ সালে আমি মোহনবাগান থেকে খেলা ছাড়ি, সে বছর মোহনবাগান লিগ চ্যাম্পিয়ন হল, আমরা ডুরান্ড জিতলাম। সেই টিমে বিজয়ন, আনচেরি, ক্রিস্টোফার, চিবুজোর মতো প্লেয়াররা ছিল, ইস্টবেঙ্গলে তখন বাইচুং, কৃষানু দে এরা সবাই খেলছে, তা সত্ত্বেও আমি আমার ৩৬ বছর বয়সে আবার বর্ষসেরা ফুটবলার নির্বাচিত হলাম। তখন প্রদীপদা আমাদের টেকনিকাল ডিরেক্টর,শঙ্কর ব্যানার্জি ছিলেন কোচ।

এই যে আমি চোদ্দ বছর ফুটবলার খেলেছি, এই সময়ে আমি কোচ হিসেবে অমলদাকেও দেখেছি, প্রদীপদাকেও দেখেছি। অমলদা নিঃসন্দেহে একজন বিরাট মাপের কোচ, অত্যন্ত ভদ্র একজন মানুষ ছিলেন, কিন্তু আমার খেলোয়াড় জীবনে আমাকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছিলেন প্রদীপদাই। প্রদীপদা যেমন আমাদের ভুল হলে বকাবকি করতেন, তেমনি ভালোওবাসতেন। আর আমরা তাঁকে মেনেও চলতাম। আর এ কথা মানতেই হবে, উনি তো কোনওদিন ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান-মহামেডান খেলেননি, ইস্টার্ন রেলের মতো একটা দল থেকে খেলে একটা প্লেয়ার ভারতকে নেতৃত্ব দিয়েছেন, অলিম্পিক খেলেছেন, এমন গ্ল্যামার তো কারও মধ্যে আমরা দেখিনি। ভারতবর্ষের সর্বকালের সেরা ক্রীড়াবিদের তালিকা তৈরি করলে তার মধ্যে প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম অবশ্যই আসবে। প্রদীপদা শুধু খেলাধুলোতে সফল ছিলেন এমন নয়, খেলা ছাড়ার পরে তিনি কোচিং জীবনেও চূড়ান্ত সফল। এ থেকেই বোঝা যায় মানুষটির ফুটবল সেন্স কীরকম ছিল!

প্রদীপদার আরেকটা বড় গুণ ছিল, তিনি খেলার মাঠে ভুলচুক হলে বকাঝকা করতেন ঠিকই, কিন্তু বাইরে কোন  জায়গায় বা জনসমক্ষে কোনও প্লেয়ারকে ছোট করতেন না। মাঠে মানুষটা একরকম, মাঠের বাইরে কোনও সাক্ষাৎকারে কোনও খেলায়াড়কে বিন্দুমাত্র অসম্মান করতেন না, তা সে নিজের দলের খেলোয়াড় হোক, অথবা বিরোধী টিমের।

আমি প্রদীপদার খেলা দেখিনি। কিন্তু আমি খেলতে এসে কোচ হিসেবে প্রদীপ ব্যানার্জির ডেমনস্ট্রেশন, বল কন্ট্রোল, বল টাচ এসব দেখেছি। ৮১ সালের ওঁর বয়েস তেতাল্লিশ বছর, সেই বয়সে ওঁর বল টাচ, শুটিং, চলাফেরা এসব দেখলেই বোঝা যায়, মানুষটা তাঁর সেরা দিনগুলিতে কীরকম ছিলেন! মাঠের বাইরে বাঘের মতো বিচরণ ছিল তাঁর। পি কে ব্যানার্জি, চুনী গোস্বামী, বলরাম, এঁরা সবাই গড-গিফটেড প্লেয়ার ছিলেন।

খেলা ছাড়ার পরেও প্রদীপদার সঙ্গে আমার সম্পর্ক অটুট ছিল। উনি ন মাস ধরে আনন্দবাজারে টিম করলেন, একশো বছরের সেরা এগারোজনের টিমে উনি আমাকে জায়গা দিয়েছেন। সত্তর দশক থেকে সুদীপদা, আশির দশক থেকে আমি, এছাড়া সুধীর কর্মকার, জার্নেল সিং আর অরুণ, বাকী সব পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের প্লেয়ার। আনন্দবাজার থেকে আমাকে ফোন করে যখন জানালো, আমাকে বলা হল অলোক, তুমি অর্জুন পাওনি ঠিকই, কিন্তু প্রদীপ ব্যানার্জির কাছ থেকে এই সম্মান পাওয়াও কোনও অংশে কম নয়।

একটা ম্যাচের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। ৮২ সালে আমরা দক্ষিণ কোরিয়ায় পিএসভি আইন্দোভেনের সঙ্গে খেলতে গেছিলাম। আইন্দোভেনের কোচ ছিলেন স্যার ববি রবসন। আমার রাইট আউট ছিল ৭৮-এর ওয়ার্ল্ডকাপ ফাইনালের কারকফ ব্রাদার। ওখান থেকে ফিরে এসে প্রদীপদা আমার সম্বন্ধে আনন্দবাজারে লিখেছিলেন, এরকম সাহসী, এরকম দৃঢ় ব্যাক গত চল্লিশ বছরে আমাদের দেশের ফুটবলে আসেনি। আমি কারকফকে আটকে দিয়েছিলাম। আমরা তিরাশি মিনিট এক গোলে জিতছিলাম। আইন্দোভেনের গোলকিপার থেকে আপফ্রন্ট পর্যন্ত সব্বাই ওয়র্ল্ড কাপার। খেলা শুরুর আগে স্যার ববি প্রদীপদাকে বলেছিলেন, “হাউ মেনি গোলস ইউ ওয়ান্ট? ফিফটিন?” প্রদীপদার খুব মানে লেগেছিল কথাটা। উনি আমাদের খেলা শুরুর আগে বলেছিলেন, “ভুলে যাও কে ওয়র্ল্ড কাপার! তোমাদেরও দুটো করে পা আছে, দুটো করে হাত আছে৷ ওদেরও দুটো করে পা আছে, দুটো করে হাত আছে। আজকে ওদের দেখিয়ে দাও!” আমাদের টিমও তখন ভালো ছিল। গোলে ভাস্করদা, রাইট ব্যাক কম্পটনদা, লেফট ব্যাক আমি, মনোরঞ্জন, সুদীপ চ্যাটার্জি, প্রসূন, প্রশান্ত, পারমিন্দর, হারজিন্দর, বিদেশদা, সাবির আলি, মানস। আমরা দারুণ লড়াই করেছিলাম। নেমেই গোল করে দিয়েছিলাম। ওরা পাগল হয়ে গেছিল। তিরাশি মিনিট অবধি এক গোলে জিতছিলাম। তারপর কম্পটনদার লেগে গেল। আমরা দেখতে গেছি। রেফারি খেলা স্টার্ট করতেই মাঝমাঠ থেকে কিক করে গোল করে দিয়েছে। যাই হোক, সেবার ইন্ডিয়া টিম দারুণ খেলেছিল, আমরা দারুণ প্রশংসা পেয়েছিলাম।

প্রদীপদা যেদিন চলে গেলেন, আমি চার-পাঁচ ঘণ্টা ওঁর কাছে ছিলাম। শ্মশানে অবশ্য যাইনি। তার আগের শনিবারও ওঁকে দেখতে হাসপাতালে গিয়েছিলাম। প্রদীপদাকে এই অবস্থায় দেখার পর চোখের জল ধরে রাখা যায় না। লোকটা তো আমাদের জীবনে অনেক কিছু দিয়েছেন। প্রদীপ ব্যানার্জিকে মানুষ ভুলবে  না। এরকম মানুষ এরকম ফুটবলার আর জন্মাবে না।

 


সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে অনুলিখিত

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4879 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...