মইদুল ইসলাম
আমি প্রদীপদার কোচিং-এ একবছরই খেলেছি। আমি তো মহামেডানেই বেশি খেলেছি। ইস্টবেঙ্গলে আমি এইট্টি নাইন-এ এসেছিলাম যখন আমি মহামেডান ছেড়ে দিলাম। ছেড়ে দিলাম মানে ক্লাবটা তো আমিই দেখতাম সব, কিন্তু ওমররা যখন এল তখন আমি ক্লাব ছেড়ে দিয়ে বাড়িতেই ছিলাম। প্রদীপদা তখন ইস্টবেঙ্গলের কোচ। প্রদীপদা ইস্টবেঙ্গল অফিশিয়াল যারা ছিল— প্রশান্ত ঘোষ, পল্টুদা— ওদের বলল যে, তোমরা মইদুলের সঙ্গে কনট্যাক্ট করো, ওকে আমি মিডফিল্ডে খেলাব। ও মিডফিল্ডে খুব ভালো খেলবে, তোমরা গিয়ে ওর সঙ্গে কথা বলো। তা ওরা আমার বাড়িতে এল। আমি বললাম আমি তো খেলা ছেড়ে দিয়েছি। তা ওরা বলল, না প্রদীপদা তোমাকে সই করাতে বলেছেন।
আমি এমনিতে বাংলা টিমেও কখনও প্রদীপদাকে কোচ হিসেবে পাইনি। কারণ আমার এইট্টি ওয়ানে হার্টের প্রবলেমটা হয়েছিল। ভেলোরে ছিলাম অনেকদিন। সেই সময় ডাক্তাররাও বলেছিল আমি আর খেলতে পারব না। সেই এইট্টি ওয়ানে। একমাস ভেলোরে ছিলাম সেই সময়। তিনবার ভর্তি হয়েছিলাম। ডাক্তাররা তো আশঙ্কা করছিলেন আমি মারাও যেতে পারি। সে যাই হোক, ওই কারণে আমি তো বেশি প্র্যাকটিস করতাম না। আমি ইন্ডিয়া টিমেও যেতাম না তাই। ডাক্তারের বারণ ছিল বেশি প্র্যাকটিস করা। তা প্রদীপদা বলল, ও কম প্রাক্টিসই করবে, কিন্তু ও-ই ম্যাচ খেলে দেবে। তারপর তো যাইহোক খেললাম টেললাম।
তা যা বলছিলাম, প্রদীপদার সঙ্গে সম্পর্ক তো অনেকদিনের। আমাকে ভালোবাসত খুব। খুবই ভালবাসত আমাকে। আমাকে বলত তোর যদি হার্টের প্রবলেমটা না থাকত রে, তোকে যে আমি কোথায় নিয়ে যেতাম! আমি তো এক বছর ইস্টবেঙ্গলে ছিলাম। এছাড়াও প্রদীপদার সঙ্গে আমার বাড়িতে যাতায়াত ছিল। প্রদীপদার বাড়িতে মাঝে মাঝেই যেতাম আমি। আমার তো বাড়ির সামনেই। আমার ছেলেমেয়ে, আমার ওয়াইফকেও উনি খুব ভালবাসতেন স্নেহ করতেন। কাগজে টাগজে যখনই লিখতেন কিছু, আমার সম্পর্কে প্রশংসা করতেন। উনি তো মানুষটাই খুব স্নেহপরায়ণ ছিলেন। আর প্রদীপদার আরেকটা গুণ আমি দেখেছি সেটা হল উনি কখনও কাউকে ছোট করেননি। সে বড় প্লেয়ারই হোক ছোট প্লেয়ারই হোক, যাকে হয়তো চিনিও না তাকেও প্রদীপদা এনকারেজ করতেন।
কোচ হিসাবে প্রদীপদা এক্সট্রাঅর্ডিনারি। আমি যখন এইট্টি নাইনে ইস্টবেঙ্গলে এলাম তখন মনোরঞ্জন, তরুণ দে, মস্তান তিনটে স্টপার ছিল ইস্টবেঙ্গলে। প্রদীপদা আমাকে মিডফিল্ডে খেলালেন। আমি মহামেডান ক্লাবের হয়ে সব ট্রফিই জিতেছি, শুধু ডুরান্ডটাই পাইনি কখনও। তা প্রদীপদা ডুরান্ডে আমাকে বললেন, তোকে আমি মিডফিল্ডে খেলাব। এই মিডফিল্ডে খেলিয়ে খেলিয়ে এমন হল, তখন ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের রেগুলার হাফ যারা ছিল তারাই সাইডলাইনে চলে গেল। সুদীপ ছিল আমার সঙ্গে। সুদীপ চ্যাটার্জি। সেমিফাইনালে আমার পায়ে সাতটা স্টিচ পড়েছিল। তখন তো সিনগার্ড টার্ড পড়তাম না আমরা। চিবুজারের সঙ্গে ট্যাকেলে আমার পায়ের সিনের জায়গাটা পুরো ফেটে গিয়েছিল। তারপর ওখানে তো আর্মির ডাক্তার। ওরা সেই সুচ ফোটাতে মানে স্টিচ করতে পারছিল না আর কি। প্রদীপদা তো রেগে যাচ্ছে– ধোর কবেকার না কোন আর্মি! চল্লিশ বছর আগে যুদ্ধ করেছে। এখন সব ভুলে গেছে। প্রদীপদা যেমন বলত আর কি! তারপর আমাকে নিয়ে গেল নার্সিংহোমে। সেখানে আমার পায়ে সাতটা স্টিচ পড়ল। তার পরের পরের দিন ফাইনাল। মোহনবাগানের সঙ্গে। তা সবাই চিন্তা করছে আমি খেলতে পারব কিনা। তা মনা, কৃশানু, বিকাশ ওরা প্রতিদিন সকালবেলা টিম করত প্রদীপদার সঙ্গে। প্রদীপদা বলল, না না। মইদুল ঠিক খেলবে। সবাই বলছিল ও পারবে? সাতটা স্টিচ পড়েছে। মনা বলল, না বাবা। মইদুলদা কোন একটা জুনিয়র প্লেয়ারের সিনগার্ড নিয়ে এসে ব্যান্ডেজ ট্যান্ডেজ বেঁধে যা লম্ফঝম্প করছে সকাল থেকে, এরপর টিমে না রাখলে আমাকেই ফেলে দেবে ছাদ থেকে। যাইহোক আমি খেললাম। চ্যাম্পিয়নও হলাম। চিমা ছিল আমাদের।
অমল দত্তের কথাও এ প্রসঙ্গে বলতে হয়। অমলদাকে আমি মহামেডানে কোচ করে নিয়ে এসেছিলাম আশি সালে। অমলদাও খুব ভালো মানুষ ছিল, খুব ভালো কোচও ছিল, আমাকেও খুব ভালোবাসত, আমার বাড়ির সঙ্গেও খুব ভালো রিলেশন ছিল। দুজনের কোচিং করার ধরনটা দুরকম ছিল। প্রদীপদা যেমন সিনিয়র প্লেয়ারদের নিয়ে কাজ করত, অমলদাকে দেখেছি জুনিয়ার প্লেয়ারদের তোলার চেষ্টা করতে, আলাদা করে নজর দিতে। মহামেডান ক্লাবে দেখেছি জুনিয়র ছেলেদের আলাদা করে প্র্যাকটিস করাতেন, আলাদা করে খুব খাটাতেন। দুজনেই খুব ভালো কোচ। দুজনেরই অনেক জ্ঞান আছে। প্রদীপদার সাফল্য অনেক বেশি। প্রদীপদা প্লেয়ার হিসাবেও অনেক বড় মাপের প্লেয়ার ছিল।
আর প্রদীপদা ছিল অসাধারণ মানুষ। যখন আমি মহামেডান খেলতাম তখন একবার ইস্টবেঙ্গল মহামেডানের খেলা কালিকটে। তা দুই ক্লাবের ড্রেসিংরুমের মাঝে একটা কাপড় ফেলা। দুপাশে দুটো দরজা। তা ইস্টবেঙ্গল আগের দিন আমাদের কাছে এক গোলে হেরে গেছে। তখন ডাবল লেগ ফাইনাল হত। এবার প্রদীপদা ওদের ড্রেসিংরুমে চেঁচাচ্ছে, তোমরা মইদুলকে বিট করতে পারছ না? এই তোমরা প্লেয়ার? আমি একটুখানি কাপড়টা সরিয়ে বললাম, প্রদীপদা আজকেও পারবে না। আর কি রেগে গেছে প্রদীপ দা! বলে, তুমি চুপ করো। তুমি বদমাশ! সেটাই বলছি, আমি মহামেডানে খেললেও প্রদীপদার সঙ্গে আমার সম্পর্ক বরাবরই খুবই ভালো ছিল।
প্রদীপদাকে কোনওদিন কাউকে ছোট করতে, লুক ডাউন করতে দেখিনি। কোনওদিনই কাউকে লুক ডাউন করত না। অনেক লোকই আছে যারা অন্যকে লুক ডাউন করে। প্রদীপদা, সে হয়তো একদম নতুন প্লেয়ার, প্রদীপদা তার সম্পর্কেও বলত, জানিস তো মইদুল এই ছেলেটা এরিয়ান্সে এসেছে, ওর কিন্তু এই আছে সেই আছে.. এইরকম। কখনওই প্রদীপদাকে কারও এগেনস্টে বলতে শুনিনি।
অসাধারণ জ্ঞান ছিল সব ব্যাপারে। সারা পৃথিবীর খোঁজখবর রাখতেন। আমার ছেলের বিয়েতে সে তো অনেক বড় বড় আইপিএস আইএএস ডাক্তার সব এসেছিল। প্রদীপদা সবার মধ্যমণি। খুব জমাটি লোক ছিলেন। চিরদিন ছোট ক্লাবে খেলেও অত গোল করেছেন, দেশের হয়ে খেলেছেন, ওনার কৃতিত্বের তো কোনও শেষ নেই। খুব পাংচুয়াল ছিলেন। আমার সাথে এটা খুব হত। আমিও ঘড়ির কাঁটা ধরে চলি তো। প্রদীপদার কাছে যখন যেতাম টেতাম, তখন প্রদীপদা বলত, বাবা মইদুল তো সাহেব! ওর এক মিনিট লেট নাই। যদি প্রদীপদার কাছে আটটার সময় যাওয়ার কথা হয়, আমি ঠিক সাতটা পঞ্চান্নয় চলে যেতাম। প্রদীপদা বলত, বাবা আমি বসে আছি ওই জন্য। বলত, বাবা মইদুল একমাত্র সাহেব! যদি কোথাও প্রদীপদাকে চিফ গেস্ট করে নিয়ে টিয়ে যাওয়ার হত, পুলিশের খেলা টেলা থাকলে, আমি তো ওগুলো অরগানাইজ করতাম, প্রদীপদাকে বলে দিতাম, প্রদীপদা আমি কিন্তু ঠিক এতটার সময় আসছি। রেডি থাকবেন। প্রদীপদারও এই গুণটা দারুণ ছিল। একদম ঘড়ির কাঁটায় রেডি হয়ে বসে থাকতেন। আমি যেই গিয়ে হর্ন মারতাম, বেরিয়ে আসতেন। বলতেন, আমি জানি মইদুল এক মিনিটও লেট করবে না।
আমাকে অত্যন্ত ভালোবাসতেন, স্নেহ করতেন। আমাদের বাড়ি আসা যাওয়া ছিল। আমার ছেলেমেয়েদেরও প্রদীপদা খুব এনকারেজ করত। ছেলেকে বলত, দেখ তোর বাবা সেই মেদিনীপুরের গ্রাম থেকে এসে তোকে আজকে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে পড়াচ্ছে। তোকে কিন্তু এত বড় হতে হবে যে বাবার নাম উজ্জ্বল করতে হবে। মেয়েকেও খুব ভালোবাসত। মেয়ে যখন ইংরেজি অনার্স নিয়ে পড়তে শুরু করল, প্রদীপদার ছোট মেয়েও তো ইংরেজি নিয়ে পড়েছে, প্রদীপদা আমাকে বলেছিল, তানিয়ার যখনই দরকার হবে আমার মেয়ের কাছে পাঠিয়ে দিবি। ও তো ওর দিদি হয়, ওকে দেখিয়ে দিতে পারবে, এনকারেজ করতে পারবে। আমার মেয়ে আমেরিকাতে ডক্টরেট করতে গেল, সেখান থেকে এল, প্রদীপদার বাড়িতে নিয়ে গেলাম, প্রদীপদা খুব এনকারেজ করলেন। আমার ছেলেকেও খুব স্নেহ করতেন উনি। আমার ফেসবুকে ছেলে ছেলের বউয়ের সঙ্গে প্রদীপদার ছবিও আছে। আমার ছেলে যখন সেন্ট জেভিয়ার্স থেকে পাশ করে চাকরি পেল, প্রদীপদার কাছে নিয়ে গেলাম। প্রদীপদাকে বললাম, প্রদীপদা আমার ছেলে পুলিশে জয়েন করেছে। প্রদীপদা খুব খুশি হল। বলল, তোর বাড়ির বিরিয়ানিটা হেবি। আবার খেতে যেতে হবে। এই বিরিয়ানি খাওয়ার কথা প্রদীপদা অসুস্থ হওয়ার পরও বলেছে, মইদুল তোর বাড়ির বিরিয়ানিটা একবার গিয়ে খেতে হবে। বেচারার সে আর খাওয়া হল না।
সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে অনুলিখিত