কামরুজ্জামান কাজল
বংশানুক্রমিক
বাজার থেকে বাবা ফিরে আসতেই মাকসুদ এর চোখ চকচকে করে ওঠে! কাপড় ছেড়ে বাবা যেই বাথরুমে গেল, টুশ করে মাকসুদ বাবার ঘরে ঢুকে পড়ে।
ঘরে ঢুকেও আবার জানলা দিয়ে উকি মেরে একবার দেখে নেয় মাকসুদ, না আশে পাশে কেউ নাই। তবে সময় কম। যে কোনও মুহূর্তে যে কেউ এসে পড়তে পারে। বাবা কেবল বাথরুমে ট্যাপের পানি ছাড়ছেন, মধ্যবিত্ত বালতিটায় পানি পড়ার শব্দ, এই ঘর থেকেও শুনতে পায় মাকসুদ।
বাবার শার্ট আলনার কোনার দিকটায় ছড়িয়ে রাখা। ঘামে ভেজা। উপরে ফ্যান ঘুরছে। পা টিপে টিপে মাকসুদ আগায়। ভাবে, বাবার পকেটে কত আছে? কত টাকা সরালে বাবা টের পাবে না! দুই টাকার পাখিওয়ালা নোট হলে চলবে, পাঁচ টাকা হলে আরও ভালো হয় তবে দশ টাকার উপরে কখনও সাহস করেনি মাকসুদ। বাবার যে হিসাবের টাকা!
আগেও বহুবার এইভাবে টাকা নিয়েছে মাকসুদ। সেই সময়ে অত ভয়ডর ছিল না ওর। ধরাও খেয়েছে অনেকবার! বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ধরা খেয়েছে মায়ের হাতে, একেবারে হাতেনাতে! তবে মা ভালো। একটু রাগারাগি করে, হালকা কান মলে দিবে অথবা সর্বোচ্চ হলে হাতের বেলনা বা খুন্তি দিয়ে বাড়ি দিলেও টাকা চুরির কথা বাবাকে বলত না।
সেইবার বড় আপু দেখে ফেলেছিল। বড় আপু ডাইরেক্ট গিয়ে বাবার কাছে বলে দিল— আব্বা আপনার ছেলে টাকা চুরি করা শিখে গেছে। এই টাকা নিয়ে কী করে, কার সাথে সাথে ঘুরে ওকে জিজ্ঞাসা করেন। কুটনি একটা!
তবে আজ, এইবার টাকা চুরি করে ধরা খাইলে, মানসম্মান থাকবে না। কারণ মাকসুদ নিজেও ইদানিং ভালো অঙ্কের টাকা রোজগার করে। ইদে বেড়াতে এসে বাবার সাথে মশকরা করতে ইচ্ছা হল। ব্যস, বাবার ঘরে ঢুকে পড়ে মাকসুদ।
বাথরুমে ট্যাপের আওয়াজ বন্ধ হয়েছে। ফোটায় ফোটায় ট্যাপ থেকে পানি পড়তে পড়তে একবারেই শুনসান। বারদুয়েক গামছা ঝাড়ার শব্দটাও খেয়াল করে মাকসুদ। বাথরুমের দরজা যেকোনও মুহূর্তে খুলে যাবে, আর দেরি না।
আলনাতে ছড়িয়ে রাখা বাবার ঘামে ভেজা শার্টটা ধরে মাকসুদ আশেপাশে তাকায়। আস্তে করে বুকপকেটে হাতটা ঢুকিয়েই শিউরে ওঠে মাকসুদ!
বাবার পকেটে কোনও টাকাপয়সা নাই। বেশ কয়েক বান্ডিল ছোট বড় দায়িত্ব, হাজারি টেনশন, আর খুচরো কিছু হতাশার কয়েন সেখানে!
হঠাৎ পায়ের শব্দ। মাকসুদ আজও মায়ের কাছে ধরা পড়ে গেল। সামনে দাঁড়িয়ে ওর বৃদ্ধ মা চোখ মোছে। মা আসলেই অনেক ভালো। মাকসুদ শিওর— মা আজকেও এই চুরির কথা বাবাকে বলবে না।
ফ্রন্ট ডেস্ক
সকাল সকাল মাসিক ডিপিএস খুলতে এসেছিলেন এক দম্পতি। দুজনাই অল্পবয়েসি। মেয়েটার ভেজা চুলের সিঁথিতে টকটকে লাল সিঁদুর। আচার আচরণ দেখলেই বোঝা যায়, রিসেন্টলি বিয়ে হয়েছে। ছেলেটা একটু পরপরই স্ত্রীর কাছে ঘেঁষে ফিসফিস করে শলাপরামর্শ করছে।
আমি বললাম— কত টাকার ডিপিএস খুলবেন? ছেলেটি মুখ ফসকে বলে ফেলল দুই হাজার টাকা স্যার। বলেই আবার মেয়েটির দিকে তাকায়। মেয়েটি ঘাড় নেড়ে সায় দেয়। আমি জিজ্ঞেস করলাম কয় বছর মেয়াদি? ছেলেটি মেয়েটির কানের কাছে গিয়ে ফিসফিস করে। তিন বছর করেন স্যার। মেয়েটি আবার ছেলেটির কানের কাছে কী একটা বলতেই মুচকি হেসে ছেলেটি বলে— আগে হোক তো!
কী হবে, বুঝলাম। এই সময়ে একজন লম্বা জুব্বা টুপি দাড়িওয়ালা লোক আমার সামনে এসেই বিরাট সালাম দিল। লোকটির গায়ের আতরের গন্ধে পুরা ব্যাঙ্ক ভরে যাচ্ছিল।
প্রচণ্ড ভিড়, কাজ করতে করতে ঘাম ছুটে যাচ্ছিল। আমার ব্যস্ততা দেখে লোকটি আফসোসের সুরে বলতে থাকে— বুঝলেন স্যার, এই দুনিয়ার কাম কোনও কামই না। আসল কাম তো আখিরাতের…
আমি ভাউচারে উনাকে সাইন দিতে বললাম। লোকটি হঠাৎ হিসেবি হয়ে উঠল— স্যারের বোধহয় ভুল হচ্ছে, তিন মাসের সুদ তো আরও আসার কথা! আমি উনাকে বুঝিয়ে দিলাম, ভ্যাট ট্যাক্সের ব্যাপারস্যাপার। লোকটি দাড়িতে হাত বুলিয়ে আবার— এই দুনিয়ার কামকাজ নিয়ে হতাশা প্রকাশ করতে লাগলেন।
ফরেন রেমিটেন্স নিতে একজন লোক আসলেন। তাকে সেবা দিতে ছুটে গেলাম। এর মাঝেই একটা কাগজ নিয়ে এসে মধ্যবয়েসি মহিলা বললেন— অ্যাকাউন্টটা সচল আছে কিনা দেখে দিতে হবে। আমি আবার ছুটি। দেখে বললাম— হ্যাঁ সচল আছে। কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে আবার জিজ্ঞেস করলেন— ঠিক তো, অ্যাকাউন্ট বন্ধ হয় নাই? আমি নিশ্চিত করলাম, না না বন্ধ হয় নাই। মহিলাটি কী ভেবে চলে গেলেন।
লোন সেকশনে সেদিন একজন সত্তরোর্ধ্ব বৃদ্ধ এসেছেন। সাথে তাঁর ছেলে। আমি নাম ধাম জিজ্ঞেস করছিলাম। লোকটি কোনওমতে উত্তর দিচ্ছিলেন, মাঝে মাঝে উনার ছেলেও সাহায্য করছিল। চাচা কোন গ্রাম? বৃদ্ধ লোকটি দুইটা কাশির মাঝখানে উত্তর দিলেন— পাতিলাপাড়া। আপনার বাবার নাম? বললেন। আবার জিজ্ঞেস করলাম— আপনার স্ত্রী? লোকটি কিছুক্ষণ ভেবে ছেলেকে জিজ্ঞেস করে— কিরে আওলাদ তোর মায়ের নামডা জানি কী? আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলাম। লজ্জামুখে বৃদ্ধ নিজেই আবার সাফাই দিলেন—সেই কবেকার কথা…
সেদিনের সেই মহিলা আবার কাগজে নাম্বার লিখে এনেছেন। স্যার অ্যাকাউন্টটা কী সচল? আমি দেখে বললাম, হ্যাঁ সচল আছে তো! আপনি না সেদিনও অ্যাকাউন্টটা দেখতে আসছিলেন? মহিলা কিছু বলেন না। চুপচাপ চলে যায়।
কয়েকদিন পর আবার সেই মহিলা। হাতে কাগজ। অ্যাকাউন্ট সচল আছে কিনা দেখবেন। আমার সন্দেহ হল। জিজ্ঞেস করলাম, অ্যাকাউন্টটা তো আপনার না। অ্যাকাউন্টের মালিক আপনার কে হয়? মহিলা চুপ করে থাকেন। আমি চরম বিরক্তি নিয়ে বললাম— সচল আছে তো চাচী। এইভাবে অন্যের অ্যাকাউন্ট চেক করার নিয়ম নাই। বলেই আবার কাজে ডুব দিলাম।
সারাদিন পর ব্যাঙ্ক শেষ করে বের হচ্ছি। ব্যাঙ্কের নিচে একটা বাটি হাতে করে সেই মহিলা। আমার সামনে এসে বললেন, অ্যাকাউন্টটা আমার ছেলের স্যার। তিন মাস আগে অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছে। ছেলে তো আর নাই, কী করব স্যার! ওর কথা মনে হলে অ্যাকাউন্টটা দেখতে আসি। যখন শুনি অ্যাকাউন্টটা সচল আছে, মনে হয় আমার ছেলেটাও বেঁচে আছে। বলেই চোখ মুছতে মুছতে বাটিটা আমার হাতে দিয়ে বললেন— তেলের পিঠা স্যার। আমার ছেলেটার খুব পছন্দের ছিল…
নওশান মিসয়াই
আদিবাসী বন্ধু নওশান মিসয়াই যখন ওর গোপন ইচ্ছাটা বলল, আমরা সকলেই হো হো করে হেসে দিলাম!
নওশান মিসয়াই এই শহরে নতুন। কী এক কারণে পাহাড় ছেড়ে আমাদের এই দমবন্ধ করা ঘিঞ্জিতে উঠেছে, আর কেমনে কেমনে যে আমাদের সাথে বন্ধুত্ব হল সেটা হুট করে কারও খেয়াল হয় না। তবে আপাতত নওশান মিসয়াই রওনা হয়েছে কাঠের দোকানে। জানলা কিনবে৷
সেইদিন রাতের মিল খেয়ে আমরা তখনও কাজের বুয়াটাকে গালাগাল দিচ্ছিলাম, মহিলা রান্না করে, না ইয়ারকি? এর ভেতরেই নওশান মিসয়াই হুড়মুড় করে আমাদের ছোট্ট ব্যাচেলর মেসটাতে ঢুকে পড়ে৷ ওর হাতে ছোটখাটো একটা কাঠের জানলা!
আমরা একে একে নওশানকে রিমান্ডে নিলাম, অই শালা রোহিঙ্গা ঘরবাড়ি নাই তুই জানলা দিয়ে কী করবি? নওশান ওর ছোট ছোট চোখগুলো আরও ছোট করে রাখে। আতিক খেকিয়ে ওঠে, অই চাইনিজের বাইচ্চা, এই ছোট্ট ঘরে পাঁচজনই ঠিকমতো থাকতে পারি না, আবার জানলাডা কই রাখবি? নওশান মিসয়াই কী যেন ভাবে। তারপর হঠাৎই হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করে।
সুতরাং নওশান মিসয়াই এবং তার জানলা নিয়ে আমরা আর জল ঘোলা করলাম না।
সেদিন ছুটির দিনে, আতিক ফোনে কার সাথে যেন কথা বলছিল— নওশান আতিকের পা-টা জানলার উপর থেকে সরিয়ে প্রণাম করায় আমরা বেশ বিস্মিত হই। আমি বললাম কিরে তোদের কি জানলারও দেবতা আছে নাকি? কথাটা আরেকটু আগাইত, বাসা থেকে আম্মা ফোন করায় আমি সাইডে সরে আসলাম।
আমাদের সবারই বাসা বা বাইরে থেকে ফোন আসে, কিন্তু নওশান মিসয়াই-এর ফোন আসে না। ওকে জিজ্ঞাস করলে বলে— পাহাড়ি এলাকায় নেটওয়ার্ক দুর্বল… আমাদের অবশ্য অন্য ধারণা, নওশানের নিজের নেটওয়ার্কেই ঝামেলা আছে!
প্রায় রাতেই নওশান জানলাটা নিয়ে বাইরের বেল্কুনিতে গিয়ে প্রার্থনা করে। আমরা ঘুমের মধ্যেই হাসি। নওশান কিছু বলে না, চুপচাপ জানলার দিকে তাকিয়ে থাকে৷ সেদিন মেসের আর সবাই বাইরে বেড়াতে যাওয়ায় আমি আর নওশান ছিলাম রাতে৷ নওশান যখন জানলার দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে মন্ত্রপাঠ করছিল আমি কাছে গিয়ে দাঁড়াই। নওশানের কাঁধে হাত দিয়ে বলি, দোস্ত পাগলামু তো অনেক হল, মান অভিমান ভুলে দেশে ফিরে যা।
নওশান আমার দিকে তাকিয়ে হেসে বলল, আয় তোকে আমার দেশ দেখাই। বলেই জানলার পাল্লাটা খুলে আমাকে ঢুকিয়ে দিল। আমিও কিছু না বুঝেই ছোট্ট জানলার ভেতর গলে যেতে লাগলাম।
প্রথমে আমি মেঘ দেখলাম। তারপর দেখলাম পাহাড়ের বড় বড় টিলা। প্রচণ্ড বাতাসে আমার চোখমুখ বুজে আসছিল, একটু ধাতস্থ হতেই বুঝতে পারলাম আমি ভাসছি। কিন্ত হাত নাড়তে গিয়ে কেমন ফটফট আওয়াজ শুনে বুকটা ধড়াস করে কেঁপে উঠল৷ আমার হাতের বদলে পালক! পায়ের দিকে তাকাতেই সন্দেহটা কেটে গেলো, হ্যাঁ আমি পাখিই হয়ে গেছি৷
কিরে বন্ধু, আমার পাহাড়ের দেশ কেমন লাগছে? উত্তর করতে ভয় পাচ্ছিলাম, কণ্ঠটাও যদি পাখির মত কিচিরমিচির শোনায়! তবে উড়তে উড়তে ভালোই লাগছিল। বেশ কিছুক্ষণ ওড়ার পর নওশানকে বললাম, এইবার জানলা দিয়ে আমাকে বের কর।
কইরে নওশান
নওশান
নওশাইন্না..
নওশান জানলা বন্ধ করে কোথাও গেছে হয়ত। হয়ত ঘুমাইছে। নয়ত আশেপাশে গেছে, অগত্যা অপেক্ষা করতে থাকি
আমি অপেক্ষা করি নওশান ঘুমায়
আমি অপেক্ষা করি নওশান কোথাও থেকে ফিরে আসে না
আমি ডানা ঝাপটাই, ছটফট করি, নওশান আমাকে ভুলে যায়..
শেষ পর্যন্ত রাগ অভিমান আর অসহায় ডানা নিয়ে আমি উড়তে শুরু করি, পাহাড়ের দেশে। আমি মেঘ দেখি না, সবুজ দেখি না, পাহাড়ের গা ঘেঁষে এঁকেবেঁকে চলা নদীটাও দেখি না, আমি শুধু উড়তে থাকি। আমার চোখ খুঁজতে থাকে একটা জানলার।
উড়তে উড়তে ক্লান্ত হয়ে, একটা গাছের উপর কেবলই আমি ডানা ছড়িয়ে বসেছিলাম, হঠাত একটা সুতায় আমার পা আটকে গেল। এইবার সত্যিই আর চাপ নিতে পারছিলাম না।
ফাঁদে আটকা পড়ে আমি ঝুলে আছি। সামনের আগুন ঝলসানো ভবিষ্যতের কথা ভাবতেই বুকটা হিম হয়ে আসছিল। হাফপ্যান্ট পরা শিকারি ছেলেটি এসে আমাকে দুই হাত চেপে ধরে পাখির খাঁচাটায় ঢুকিয়ে জানলাটা আটকে দিল।
আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখলাম ছেলেটিকে, এই তো সেই নওশান মিসয়াই…
তেরাং তৈকালাই
আদিবাসী বালকটি খাঁচার ভেতর আমাকে বন্দি করে হাঁটা শুরু করল। আমি বিস্ময়ে থ!
চারিদিকে দম বন্ধ করা সবুজ। উঁচুনিচু ভেজা রাস্তা। বালকটি শিস দিতে দিতে হাঁটে। ছোট্ট খাঁচার ভেতর দুলতে দুলতে আমি প্রশ্ন করি— কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমাকে? বলেই মুখ চেপে ধরি। আমার মুখে কোনও ভাষা নেই। পাখির মত চি চি আওয়াজ বের হচ্ছে!
মুখ চেপে ধরার সময় হাতের বদলে পালক দেখে নিশ্চিত হলাম— আমি পাখি হয়ে গেছি এবং ধীরে ধীরে সব মনে পড়ে গেল।
নওশান মিসয়াই! কে যেন পাহাড়ের ওপর থেকে ডাকল। বালকটি থেমে, ঘাড়টা একটু ঘুরিয়ে উপরের দিকে তাকাল। তারপর শিস দিতে দিতে আবার হাঁটা শুরু করল। পাহাড়ি গিরিখাত দেখতে দেখতে আমি শুধু অবাক হয়ে ভাবি, আমার পাখি হয়ে যাবার কথা।
কুমিংকো র্যাটাকু কাসে পারহে মিসয়াই— ডাকটা শুনেই বালকটি হেসে দেয়। পেছন ঘুরে বৃদ্ধাটির দিকে তাকিয়ে খিলখিল করে বলে উঠে— আফাওর য তেইতু এইঙ্গয়ে তিরাংসারাতল প্রিওং শাঃ। ভাষাটা না বুঝলেও বুঝতে পারি বালকটি আমাকে দেখিয়ে উল্লাস করছে।
অনুমানে যা বুঝলাম বৃদ্ধাটি বালকটির দাদীগোত্রীয় কেউ হবে। হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে অনেকক্ষণ বালকটিকে কীসব বুঝাচ্ছিল। বালকটি মনখারাপ করে খাঁচা সহ আমাকে বৃদ্ধাটির কাছে দিয়ে আবার শিস দিয়ে হাঁটা শুরু করল।
বৃদ্ধাটির গায়ে উলের জামা, তার উপর একটা কালো চাদর পেঁচানো। মুখে বয়সের ছাপ পড়লেও কোথায় জানি একটা বেখাপ্পা ব্যাপার আছে চেহারায়। খাঁচার ভেতর আমাকে দেখেই বেচারির মুখটা মলিন হয়ে আসছিল। কী একটা ভেবে বৃদ্ধাটি ওর কালো চাদর দিয়ে খাঁচা সহ আমাকে ঢেকে দিল। তারপর থেকে আমি কিছু দেখতে পাই না। শুধু শুনি। নানারকম ভাষা। অনেক লোকের আনাগোনা। হাসাহাসি, ফিসফিসানি। নদীর শব্দ, নৌকার শব্দ। থেমে যাওয়ার শব্দ। শ্বাস প্রশ্বাস।
আশপাশের সম্বোধন থেকে যা বুঝলাম বৃদ্ধাটির নাম প্রিওং শাঃ। যখন সে থামল, আমার খাঁচাটি রেখে একটু দূরে সরে গেল। না, চাদরটি সরাল না প্রিওং শাঃ। কেবল খাঁচার জানলাটা খুলে দিল। আমি কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাম। না, কালো চাদরটি সরছে না। আস্তে আস্তে খাঁচার ভেতর থেকে বের হয়ে আসি। বিশাল চাদরটি আমি দুই হাতে সরাতে চেষ্টা করি। ডাক দেই— প্রিওং শাঃ দয়া করে কালো চাদরটি সরান— বলেই আমি অবাক।
আমার কণ্ঠ মানুষের মত! কালো চাদরটি যখন ক্রমাগত সরানোর জন্য চেষ্টা করছিলাম, ঠিক তখনই টের পেলাম। আমি পাখি থেকে আবার মানুষ হয়ে গেছি।
কালো চাদরের ভেতর আমি হাঁসফাঁস করতে থাকি। বের হতে চাই। পারি না। সামনেই দাঁড়িয়ে আছে প্রিওং শাঃ। চাদরের ভেতর আমার ডাক শুনে অঝোরে কাঁদতে থাকে। তেরাং তৈকালাই ঝর্ণা ভেসে যায় অলকানন্দার জলে।
তৈদুলং তিঘা
আমার যখন জ্ঞান ফিরে এল তখন পাহাড়টিতে ঝুম বৃষ্টি। এদিক ওদিক তাকিয়ে আমি কিছুই মনে করতে পারছিলাম না। কেবল মাথার কাছে রাখা ছিল একটা কালো চাদর।
চাদরটি কোনওরকম মাথার উপর দিয়ে আমি চারপাশটা উঁকি দিচ্ছিলাম। চারিদিকে ছোট বড় অসংখ্য পাহাড়। বৃষ্টির স্বচ্ছ জল পাথর বেয়ে বেয়ে নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে। এই পাথুরে পাহাড়টা যেন বুকের ভেতর চেপে ধরছিল আমাকে। আমি চিৎকার দিলাম।
পাহাড়ে পাহাড়ে প্রতিধ্বনিত হল চিৎকারটি। কিন্তু কণ্ঠটি আমার না। অথচ স্পষ্ট মনে হয়, এই কণ্ঠটি আমার পরিচিত। আমি আরও কয়েকবার ডাক দিলাম, কিন্তু পাহাড় থেকে শুধু একটা ডাকই ভেসে এল— নওশান মিসয়াই!
ঠিক সেই মুহূর্তেই আমার সব মনে পড়ে গেল! কীভাবে আমি মানুষ থেকে পাখি হয়ে গিয়েছিলাম, কীভাবে সেই পাহাড়ি শিকারি আমাকে খাঁচায় পুরে নিয়ে গিয়েছিল প্রিয়ং শাঃ-এর কাছে। সব।
পাহাড়ের এককোণে কয়েকটি সিড়ি দেখতে পেলাম। খুব সম্ভবত নতুন ঝর্ণা সৃষ্টি হচ্ছে। সেখান দিয়ে অল্প অল্প জল ধাপে ধাপে নিচের দিকে গড়িয়ে পড়ছে। কোনও কিছু না ভেবেই আমি সেই পাথুরে সিঁড়ি দিয়ে নিচের দিকে নামতে লাগলাম।
সিঁড়ি দিয়ে আমি অনবরত নামতেই থাকি। ডানে বামে এমনকি নিচের দিকেও আর তাকাই না। কেবল নামতে থাকি। উপরের সিঁড়ি থেকে নিচে। তার নিচে। আমার চোখ মুখে শুধুই অবিশ্বাস! এসব কী হচ্ছে আমার সাথে। বুকের ভেতর নিজেকে আর ফিরে না পাওয়ার হতাশা। পাহাড়ে তখনও প্রতিধ্বনিত হয়েই চলেছে—নওশাআআআআন, নওশান মিসয়াই।
নামতে নামতে সন্ধ্যা নেমে আসে। আমি ক্লান্তি হই না। চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। আমার পায়ের নিচে গড়িয়ে পড়া জল। বেয়ে বেয়ে নিচের সিঁড়িতে পড়ে। আমিও নামতে থাকি। একটা সময় জল আর নিচে পড়ে না, আমিও সিঁড়ি খুঁজে পাই না। নিচে পা বাড়াই। না, আর নিচে নামা যায় না। চারপাশ তাকিয়ে আমি অবাক হই। চারপাশে শুধু জল, স্বচ্ছ জলের ধারা। বুঝতে পারলাম আমি চলে এসেছি গভীর অতলে, সম্ভবত কোনও নদীর তলদেশে।
একটা জলের স্রোত এসে আমার কাছে এসে থামতেই আমি হাত বাড়িয়ে স্পর্শ করি। জলের স্রোতটি দরজা হয়ে খুলে যায় আমার সামনে। সেখানে নৌকা নিয়ে অপেক্ষা করছিল সেই শিকারি কিশোরটি, যে আমাকে পাখি ভেবে খাঁচায় পুরেছিল— সেই নওশান মিসয়াই!
আমার কাঁধে থাকা সেই কালো চাদরটি দেখে সে মুচকি হাসে। হাত বাড়িয়ে আমাকে নৌকায় তোলে। নৌকাটি চলতে শুরু করলে ঠান্ডা বাতাসে আমার শীত শীত করে। নওশান মিসয়াই ইশারা দিয়ে আমাকে চাদরটি গায়ে পরে নিতে বলে। চাদরটি বড় করার জন্য ঝাড়া দিতেই আমি শিউরে উঠি।
নদীটির নাম তিঘালঙ। নৌকাটি আমাকে নিয়ে চলছে। নওশান মিসয়াই চলে যাবার সময় বলেছিলাম, আবার দেখা হবে কি? সে মুচকি হেসে ঐদূর পাহাড়ের দিকে ইশারা করেছিল। কীভাবে যেন আমার গায়ে কালো চাদরটি বদলে হয়েছে হলুদ-কমলা সিড়ি সিড়ি নকশা কাটা চাদর। সেখানে পাহাড়ি ভাষায় কী যেন একটা লেখা— মনে হয় আমি বুঝি, মনে হয় বুঝি না।