গণতান্ত্রিক ভারতের এই বিপুল ক্ষতির দায় কে নেবে

দুষ্মন্ত দাভে

 




লেখক সুপ্রিম কোর্টের বরিষ্ঠ আইনজীবী এবং সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি। মূল লেখাটি ইংরাজিতে গত ২৮শে মার্চ ‘দি ওয়্যার’ পত্রিকায় প্রকাশিত।

 

 

দেশ একটা বড় সমস্যার মুখোমুখি। এর সমাধানের জন্য সেনাবাহিনীর সহায়তা নেওয়া উচিত।– এই ছিল আমার গতকালের (২৬শে মার্চ ২০২০)[1] লেখার মূল প্রতিপাদ্য। স্বীকার করে নেওয়া ভালো আমি এই সমস্যার ভয়াবহতাটা বুঝেই উঠতে পারিনি।

আমার গতকালের মূল্যায়ন পুরোপুরি ভুল ছিল।

পুরো শুক্রবারটা বিভিন্ন টিভি চ্যানেলগুলি দেখলাম। আঞ্চলিক টিভি চ্যানেলগুলোও। এবং যা দেখলাম, একটা জাতি হিসাবে আমরা তা কখনওই প্রত্যক্ষ করিনি।

বিভিন্ন শিল্পশহরগুলি থেকে বেরিয়ে হাজার হাজার অভিবাসী শ্রমিক হাইওয়ে দিয়ে হাঁটছেন। নিজেদের গ্রামে ফিরছেন তারা। তাঁদের কাঁধে তাঁদের বাচ্চারা। তাঁদের সঙ্গী মহিলাদের সঙ্গে নিজেদের মূল্যবান জিনিসপত্র। তাঁরা প্রত্যেকেই ক্ষুধার্ত ক্লান্ত বিধ্বস্ত বিমর্ষ— নিয়তির ওপর নিজেদের সম্পূর্ণ সঁপে দিয়ে হাঁটছেন তাঁরা। প্রত্যেকেই একই ভাষায় জানাচ্ছেন, তাঁদের মালিকরা তাঁদের জন্য কোনও অর্থ এবং খাবারের ব্যবস্থা করতে পারেনি, তাঁদের ভবিষ্যৎ নিয়ে কোনও আশার কথা শোনাতে পারেনি।

এবং তাঁরা দ্ব্যর্থহীনভাবে রাজ্য এবং কেন্দ্রীয় সরকারের ওপর তাদের ক্ষোভ বিরক্তি হতাশা ব্যক্ত করছেন। তাঁরা জানাচ্ছেন সরকারগুলো তাদের কথা ভাবল না, তাদের জন্য কিছু করল না, তাদের এমনভাবে ছেড়ে দিল যে নিজেদের ব্যবস্থা তাদের নিজেদেরই করে নিতে হবে।

গোটা দেশজুড়ে কয়েক লক্ষ মানুষ এখন যে অবস্থার মধ্যে দিয়ে চলেছেন তাকে অনায়াসে জাতীয় লজ্জা বলে অভিহিত করা যায়। ১৯৪৭-এর দেশভাগের পর আর এত ব্যাপক গণস্থানান্তর দেশ দেখেনি সম্ভবত। আমাদের সংবিধান তাঁদের যে যে অধিকার দিয়েছে সেগুলি যে শুধুমাত্র লঙ্ঘিতই হচ্ছে তা নয়, নির্লজ্জভাবে লঙ্ঘিত হচ্ছে। তাঁদের সম্মান মর্যাদা বলে আর কিছু নেই। এমনকি তাঁদের বেঁচে থাকার অধিকার— সেও তাঁদের এই যাত্রার প্রতিটা মুহূর্তেই ভয়াবহ বিপন্নতার সম্মুখীন।

কোনও সভ্য দেশ পারে এই আতঙ্ককে বাড়তে দিতে? আমরা কি কোনওভাবেই আমাদের সহনাগরিকদের এই অবর্ণনীয় দুর্দশা উপেক্ষা করতে পারি?

তাঁদের ওপর এই যে নির্যাতন চাপিয়ে দেওয়া হল, এতে কি তাঁদের কোনও দোষ ছিল? ছিল! একটাই দোষ– তারা গরীব!

এঁরাই কিন্তু ভোট দিয়ে কেন্দ্র সরকার এবং রাজ্য সরকারগুলি নির্বাচন করেছেন। আর এখন এঁদের জন্য বরাদ্দ কেবল উপেক্ষা। এঁদের স্রেফ ভুলে মেরে দেওয়া হয়েছে।

প্রথম কথা হল কেন এরকম একটা পরিস্থিতি তৈরি হতে দেওয়া হল? চিন গত একুশে জানুয়ারি প্রথম কোভিড ১৯ সংক্রমণকে মহামারি হিসেবে সরকারিভাবে ঘোষণা করে। ২৩শে জানুয়ারি সেখানে হুবেই প্রদেশ সহ বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ব্যাপক আকারে লকডাউন ঘোষণা করা হয়। নভেল করোনাভাইরাস নিয়ে হু তাদের প্রথম নির্দেশিকাটি[2] দেয় গত ১০ই জানুয়ারি এবং ২৪শে জানুয়ারি ঘোষণা করে যে এটি একটি আন্তর্জাতিক বিপদ হতে চলেছে[3]। ১৩ই মার্চ হু ইউরোপকে এই অতিমারির নতুন কেন্দ্র হিসেবে ঘোষণা করে। আর আমাদের দেশে? হ্যাঁ, এখন এদেশে যাতায়াতের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে বটে, কিন্তু তা করার পরেও জনজীবনে যে সমস্ত সঙ্কটগুলি দেখা দিতে পারে সেগুলি সামাল দেওয়ার জন্য আমাদের সরকার যথেষ্ট কার্যকরী কোনও পরিকল্পনা করে উঠতে পারেনি।

সরকারের কেউই ১৯শে মার্চের আগে পর্যন্ত এই বিষয়টি নিয়ে কোনওরকম ভাবনাচিন্তাই করেননি। ১৯শে মার্চ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দেশবাসীর উদ্দেশে প্রথম ভাষণ দেন এবং ২২শে মার্চ একটি জনতা কারফিউয়ের ডাক দেন। ততদিনে ইতালি ৩৪০৫ জনকে হারিয়ে ফেলেছে। এইরকম একটা সংখ্যাই সম্ভবত আমাদের সরকারের ঘুম ভাঙাতে সাহায্য করেছিল।

কিন্তু তারপরও সরকার খুব একটা কিছু পরিকল্পনা করেনি। পার্লামেন্টে স্বাভাবিকভাবেই কাজকর্ম চলছিল। মধ্যপ্রদেশ বিধানসভায় আস্থা ভোট নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের অপেক্ষা করা হচ্ছিল। আশা করা হচ্ছিল সেখানকার কংগ্রেস সরকারকে সরিয়ে সেখানে একটা বিজেপি সরকার বসানো যাবে। এমনকি সুপ্রিম কোর্টও এই নাটকে অংশ নিল! সংবিধান এবং সাংবিধানিক নৈতিকতার তোয়াক্কা না করে ২০শে মার্চ মধ্যপ্রদেশে আস্থা ভোটের রায় দিয়ে দিল। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিল সবাই মধ্যপ্রদেশের সরকার বদলানোর জন্য বেশ তাড়াহুড়োয় রয়েছে। সম্ভাব্য লকডাউনটার আগেই সেটা সেরে ফেলতে চাওয়া হচ্ছে। হ্যাঁ, তখন সরকার অন্তত এটা বুঝে গিয়েছিল যে আজ হোক কাল দেশজুড়ে লকডাউন বলবৎ করতেই হবে।

তারপর ২৩শে মার্চ সংসদ একটা ভোট অন অ্যাকাউন্ট পাশ করে হঠাৎ করেই মুলতুবি হয়ে গেল। মধ্যপ্রদেশে একজন নতুন মুখ্যমন্ত্রী শপথ নিল। সরকার সমস্ত অন্তর্দেশীয় উড়ানের অবতরণ ঘোষণা করল যেটা চব্বিশে মার্চ মধ্যরাত থেকে কার্যকরী হবে। এর ফলে সমস্ত সাংসদ, ধনী এবং ক্ষমতাবানেরা নিরাপদেই নিজের ঘরে আরাম করে ফিরে যেতে পারল। এই একই সুবিধা কিন্তু গরিবদেরও দেওয়া যেত। যে যতক্ষণ না অভিবাসী শ্রমিকরা যাঁরা নিজেদের বাড়িতে ফিরে যেতে চান তাঁরা ফিরে যেতে পারেন, ততক্ষণ ট্রেন এবং বাস চালু রাখা হবে— শুধু এটুকু ব্যবস্থা করে। কিন্তু তা করা হল না। এই সমস্ত নাটকের পরে ২৪শে মার্চ রাত আটটার সময় জাতির উদ্দেশ্যে তাঁর দ্বিতীয় ভাষণে প্রধানমন্ত্রী তিন সপ্তাহ ধরে দেশজোড়া লকডাউনের ঘোষণা করলেন, যেটা তার ৪ ঘণ্টা পর থেকেই শুরু হয়ে যাবে।

তাঁর এই ঘোষণা স্বাভাবিকভাবেই লাখো লাখো দেশবাসীকে ব্যস্তসমস্ত করে তুলল। ভাষণ শেষ হওয়ার এক ঘণ্টার মধ্যেই দেখা গেল হাজার হাজার মানুষ, অবশ্যই যাদের পয়সা আছে, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস কেনার জন্য দোকানগুলিতে লাইন লাগিয়েছেন। খুবই স্বাভাবিক। কারণ তার ভাষণে এ সম্পর্কে কিছুই বলা হয়নি। যেটা বলা হয়েছিল, সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিংয়ের পরামর্শ, সেটা এইভাবে হাওয়ায় মিলিয়ে গেল।

এই কঠিন সময় যাদের বেঁচে থাকাটা সবচেয়ে বেশি সমস্যার হতে যাচ্ছে সেই দরিদ্র জনসাধারণের জন্য তাঁর ভাষণে কোনওরকম সুচিন্তিত পরিকল্পনার কথা ছিল না। এমনকি সেরকম কোনও পরিকল্পনার আদৌ আভাস পর্যন্তও ছিল না।

বলতেই হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রীর এই ঘোষণাটি তার ২০১৬র ৮ই নভেম্বরের নোটবন্দির ঘোষণার মতই কঠোর এবং বেদনাদায়ক।

এই সময়ে সরকার দেশজুড়ে ট্রেন চলাচল বাতিল ঘোষণা করল। যুক্তিটা হচ্ছে ট্রেনগুলি ফাঁকা যাচ্ছে। রাজ্য সরকারগুলি আন্তঃরাজ্য পরিবহনে নিষেধাজ্ঞা জারি করতে শুরু করল। ফলে কার্যত গণপরিবহন ব্যবস্থাই থমকে গেল। এই অবস্থায় আটকে পড়লেন এই লাখ লাখ মানুষ। এঁরা এমনিতে সারা বছর শহরে অস্বাস্থ্যকর অমানবিক পরিবেশে ঝুপড়িতে থাকতে বাধ্য হন। কিন্তু তখন তাঁরা সেগুলো ছেড়ে নিজেদের গ্রামের নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে ফিরতে চাইছেন।

এটা পরিষ্কার যে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শদাতারা এই ভয়ানক ট্র্যাজেডিটি আদৌ মাপতেই পারেননি। এবং ফলত এটা ঠেকানোর জন্যও কোনও ব্যবস্থা নিতে পারেননি। অথচ বিষয়টা বোঝা গেলেই এই মর্মান্তিক পরিস্থিতি পুরোপুরিই ঠেকানো যেতে পারত। ব্যবস্থা করা যেতে পারত ব্যাপক ত্রাণ এবং পুনর্বাসনের।

এই ব্যাপক মাত্রার ন্যক্কারজনক অবহেলা ঘটল এমন একটা দেশে যেটা নাকি গণতন্ত্র, যার মাথার উপর রয়েছে ভারতের সংবিধান, এবং বর্তমানে যার নেতৃত্ব দিচ্ছেন এমন একজন প্রধানমন্ত্রী নিজের দক্ষতার ওপর যাঁর গর্বের সীমা নেই! দেশের একজন নাগরিক হিসেবে এর চেয়ে বেদনাদায়ক আর কী ঘটতে পারে!

যদি প্রাইভেট সেক্টরে এমন ঘটনা ঘটত তাদের বিরুদ্ধে ক্রিমিনাল অ্যাকশন নেওয়া হত। গণতন্ত্রের সুবিধা হচ্ছে এখানে পাবলিক লাইফে কেউ দায়বদ্ধ নয়। শাস্তি পাওয়া তো দূরের কথা।

জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত নষ্ট হওয়া সময়টা আর যাই হোক ভালো শাসনব্যবস্থার বিজ্ঞাপন দেয় না।

এমনকি এখনও পর্যন্ত এরকম কোনও নিদর্শন দেখা যাচ্ছে না যাতে বোঝা যায় ক্ষমতায় থাকা লোকজন এই ভয়াবহ বিপর্যয়টা সম্পর্কে যথেষ্ট উপলব্ধি করতে পেরেছেন। আমরা দেখছি কেন্দ্র এবং বিভিন্ন রাজ্য সরকারের মন্ত্রীরা এবং আমলারা কিছু ফাঁকা প্রতিশ্রুতি দিয়ে যাচ্ছেন। দেখেছেন এঁদের? টিভিতে আসছে— ফিটফাট, পরিষ্কার! কারও মুখে দরদের কোনও চিহ্ন দেখেছেন? আর্থিক প্যাকেজের এই মুহূর্তে কোনও অর্থ নেই। কী হবে আর্থিক প্যাকেজ দিয়ে? পেট ভরবে? যে অসহনীয় দুর্দশার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন মানুষগুলো তার কোনও সুরাহা হবে? এই মুহূর্তে তাঁদের ওই জিনিসগুলিই দরকার।

আপাতত আশা করা যাক ক্ষমতার শীর্ষে যারা বসে আছেন তারা গত ৭২ ঘন্টায় প্রতিটি দেশবাসী যত চোখের জল ফেলেছেন বা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়া অবধি যত চোখের জল ফেলবেন, তার প্রতিটিকে স্বীকৃতি দেবেন; এই প্রতিটি চোখের জলের জন্য কে বা কারা দায়ী তাদের খুঁজে বার করবেন; এবং তাদের এই মর্মান্তিক অপদার্থতার জন্য যথাবিহিত শাস্তি দেবেন। তাহলেই এটা বলা যেতে পারে যে সরকার একটা কাজের জিনিস, সে কাজ করতে চায়।

তবে সবচেয়ে বড় কথা হল, সবার আগে প্রধানমন্ত্রীকে কাজ করে দেখাতে হবে। তাকে সরকারের ক্ষমতার রশি নিজের হাতে শক্ত করে ধরতে হবে, ভেতরের এবং বাইরের সর্বোৎকৃষ্ট প্রতিভাদের চিহ্নিত করে তাদের কাজে লাগাতে হবে এবং মানুষের বিশ্বাসযোগ্যতা ফিরিয়ে আনতে হবে। কেবলমাত্র তবেই দরিদ্র জনগণের প্রকৃত সহায়তা করা সম্ভব হবে। এর আর কোনও বিকল্প রাস্তা নেই।


[1] https://thewire.in/government/distributing-essential-supplies-in-a-locked-down-nation-needs-the-armys-help

[2] https://www.who.int/news-room/articles-detail/who-advice-for-international-travel-and-trade-in-relation-to-the-outbreak-of-pneumonia-caused-by-a-new-coronavirus-in-china

[3] https://www.who.int/docs/default-source/coronaviruse/situation-reports/20200124-sitrep-4-2019-ncov.pdf

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4650 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Comment

  1. মজা হচ্ছে,এটাই পরাধীনতার শৃঙ্খল মুক্তির জন্য উপায় বাতলাতে নেমেছিল শিক্ষিত সম্প্রদায় । পরবর্তী পর্যায়ে শিক্ষিত সম্প্রদায়ের একটা বড় অংশ তখন দেখল বাহ , এইভাবে যদি আমরা আমাদের একটা কমন মিনিমাম programme ঠিক করতে পারি, অর্থাৎ শাষন ও শোষন ও পোষন এই নীতি কে সামনে‌ রেখে বিত্তবান ও শিক্ষিত শ্রেণীর একটা বলয় তৈরি করে আমাদের দেশ কে সো called Democracy রূপ দিয়ে চালিয়ে যাচ্ছে

আপনার মতামত...