সতীশ গুজরাল— এক আশ্চর্য পথ-চলার সমাপ্তি

সতীশ গুজরাল | শিল্পী

বিষাণ বসু 

 




লেখক গদ্যকার, প্রাবন্ধিক, চিকিৎসক।

 

 

ইন্দ্রপতন শব্দটা অতিব্যবহারে এত জীর্ণ হয়ে গিয়েছে, সতীশ গুজরালের মৃত্যুকে আলাদা কী শব্দ দিয়ে বর্ণনা করা যায়, ভেবে পাচ্ছি না। দেশে চিত্রকর বা ভাস্করদের পরিচিতি ও সম্মান এতখানিই কম— প্রায় কোনও সংবাদপত্র বা ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় তেমন গুরুত্ব সহকারে প্রকাশিত হল না তাঁর মৃত্যুসংবাদ। ছবি-ভাস্কর্যের খোঁজ যাঁরা রাখেন, তাঁরা বাদ দিয়ে ঠিক কজন তাঁর নামটুকুর সঙ্গে পরিচিত— সেও অবশ্য বলা কঠিন।

অথচ, সতীশ গুজরাল ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠতম শিল্পীদের একজনই শুধু নন এক বিচিত্র বহুমুখী প্রতিভা— এদেশের শিল্পজগতের মডার্নিজমের অন্যতম আদিপুরুষ— অনেকে তাঁকে দেশের প্রথম মডার্নিস্ট বলে থাকেন। তাঁর শিল্পকৃতির সঙ্গে স্বল্পপরিচিত যাঁরা তাঁকে স্রেফ দেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দ্রকুমার গুজরালের ভাই বলে চেনেন, একটু মনে করিয়ে দেওয়া যাক, যদি এভাবেই ভাবতে চান, ইন্দ্রকুমার যথেষ্ট কৃতি মানুষ হলেও, ভাবীকাল, সম্ভবত, তাঁকে সতীশ গুজরালের দাদা হিসেবেই মনে রাখবে।

জন্ম অধুনা পাকিস্তানে। ছেলেবেলায় গুরুতর অসুস্থ হয়ে শ্রবণশক্তি হারিয়েছিলেন। আট বছর বয়স থেকে এক নিস্তব্ধ দুনিয়ার বাসিন্দা হয়ে আঁকড়ে ধরেছিলেন শিল্পকেই। স্বাধীনতাপূর্ব পাকিস্তানের লাহোরে মেয়ো স্কুল অফ আর্টে শুরু শিল্পশিক্ষা, শিক্ষক ছিলেন খ্যাতনামা কবি-লেখক-সাংবাদিক নোবেলজয়ী রুডইয়ার্ড কিপলিং-এর বাবা জন লকউড কিপলিং। পরবর্তীকালে বোম্বের স্যার জে জে স্কুল অফ আর্ট। আর পুরো জীবনটা বিভিন্ন শিল্পমাধ্যম ধরে এক অবিশ্বাস্য জার্নি। নিজেই বলতেন, বেশ কিছুদিন একই মাধ্যম নিয়ে পড়ে থাকতে তাঁর ভালো লাগে না, একঘেয়ে বোধ হয়, কাজেই বিভিন্ন মাধ্যম খানিকটা একঘেয়েমি কাটিয়ে ওঠার জন্যেই। একথা হয়ত অনেক শিল্পীর ক্ষেত্রেই সত্যি। কিন্তু, বিস্ময়কর হল, সব মাধ্যমেই তাঁর অসামান্য নিজস্বতার স্বাক্ষর ও অনায়াস শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন।

যেমন ধরুন, চিত্রশিল্পে নামডাক অর্জনের পরে একদিন, লোহরি উৎসব (আমাদের পৌষ পার্বণের তুল্য) উদযাপনের মুহূর্তে, আচমকা, জ্বলতে থাকা আগুনের কাঠ যেন তাঁকে হাতছানি দেয়— আর, তিনি পোড়া কাঠ ব্যবহার করে, খোদাই করে জন্ম দেন এক আশ্চর্য শিল্পমাধ্যমের! যে মাধ্যমে ভাস্কর্য বা রিলিফ ওয়ার্ক, দুধরনের কাজেই তাঁর সাফল্য ছিল প্রশ্নাতীত।

পোড়া কাঠের কাজ

আবার, স্থাপত্যবিদ্যায় কোনও প্রথাগত ট্রেনিং ছাড়া যখন তিনি আর্কিটেক্ট হিসেবে কাজ শুরু করেন, সমালোচনা কম আসেনি। আসলে, পশ্চিমে আধুনিকতা বা উত্তর-আধুনিকতা স্থাপত্যশিল্প ও শিল্পকলায় এসেছিল হাত ধরাধরি করে, কিন্তু এদেশের মাটিতে তেমন করে ভাবার প্রচলন হয়নি। অতএব, শিল্পী যখন স্থাপত্যের জগতে পা রাখছেন, সমালোচনা ছিল অনিবার্য— আশৈশব বধিরতা সম্ভবত সমালোচনা অগ্রাহ্য করার ক্ষেত্রে তাঁর সহায় হয়েছিল— ভাগ্যিস! তা না হলে, দেশের শ্রেষ্ঠতম কিছু আর্কিটেকচার সম্ভবপর হত না।

নয়া দিল্লির বেলজিয়াম দূতাবাস তাঁর স্থাপত্যশিল্পের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিদর্শন, আর্কিটেক্টদের আন্তর্জাতিক সংগঠন সেটিকে গত শতকের বিশ্বের শ্রেষ্ঠ হাজারটি স্থাপত্যের অন্যতম বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন। কিন্তু, শুধুমাত্র বেলজিয়ান এমব্যাসি ভবনের কথায় সীমাবদ্ধ থাকলে স্থাপত্যের ক্ষেত্রে সতীশ গুজরালের ব্যাপ্তির সামান্যই বলা হয়। মনে রাখা যাক, দিল্লির ইউনেস্কো ভবন, গোয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবন, রিয়াধে সৌদি রাজপরিবারের গ্রীষ্মাবাস, অথবা উত্তরপ্রদেশের মায়াবতীর শাসনকালে তৈরি হওয়া আম্বেদকর মেমোরিয়াল, এদেশে সমকালীন স্থাপত্যে যার জুড়ি মেলা ভার।

বেলজিয়াম দূতাবাস

গুজরালের স্থাপত্য মানেই শিল্পের সঙ্গে নাটকীয়তাকে মেলানো— বিশাল প্রবেশদ্বার, চওড়া পরিসর, বাসস্থান হলে সরু করিডোরের রহস্যময়তা। স্থাপত্যকে শিল্পের নজরে দেখার প্রচলন এদেশে এখনও সেভাবে নেই— সেজন্যেই অজস্র কুৎসিত বিল্ডিং-এ ঘেরা থাকে আমাদের পারিপার্শ্বিক, উচ্চবিত্তের আবাসনও হয়ে ওঠে শিল্পসুষমাহীন, স্রেফ কেজো কংক্রিটের জঙ্গল— স্থাপত্যকে যথার্থ শিল্পমাধ্যম হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার প্রয়াসে, এদেশে পথপ্রদর্শক সতীশ গুজরালই।

অবশ্য, এমনটাই হয়ত ছিল প্রত্যাশিত। সমকালীন বিশ্বের শিল্পকর্মের সঙ্গে পরিচিত হতে বাকিরা যখন পাড়ি দিয়েছিলেন প্যারিস কিম্বা লন্ডন, তিনি বেছে নিয়েছিলেন মেক্সিকো। হ্যাঁ, সেই মেক্সিকো— যেখানে দিয়েগো রিভিয়েরা বা সিক্যুইরস বদলে দিচ্ছেন ম্যুরালের সংজ্ঞা— ঠিক সেই সময়েই গুজরাল হাতেকলমে কাজ শিখতে শুরু করেন তাঁদের কাছে। ম্যুরাল শিখতে যাওয়ার পেছনে যুক্তিটিও ছিল খুব পরিষ্কার— পেইন্টিং তো শেষমেশ ঠাঁই পাবে বড়লোকের ড্রয়িংরুমে— ম্যুরাল থাকবে প্রকাশ্যে, সর্বসাধারণের চোখের সামনে। রিভিয়েরার কাছ থেকে কাজ শেখার পাশাপাশি আজন্ম বন্ধুত্বের সম্পর্ক তৈরি হয় নোবেলজয়ী কবি ওক্তাভিও পাজ-এর সঙ্গে। ঘনিষ্ঠতা হয়, এমনকি, এক নিভৃত দুনিয়ার বাসিন্দা রহস্যাবৃতা ফ্রিডা কাহলো-র সঙ্গেও— যে বন্ধুত্ব স্থায়ী হয় ফ্রিডার জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত।

ভাস্কর্য 

আবার অন্যদিকে, তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন ফয়েজ। হ্যাঁ, সেই সময়কার বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি, পাকিস্তানের ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ। ফয়েজ ছিলেন দাদা ইন্দ্রকুমারের বন্ধু, কবিতা পড়ে শোনাতেন প্রায়ই। একদিন ইন্দ্রকুমার ফয়েজকে বলেন, তাঁর ছোটভাই শিল্পী, খুব কবিতা ভালোবাসেন। কিন্তু, বধির— কবিতা শোনার সুযোগ নেই। ফয়েজ কি পারেন নিজের বইখানা রেখে যেতে। না, ফয়েজ বই রেখে যান না, একদিন এসে চুপ করে বসে থাকেন সতীশের কাছে— শুরু হয় কথোপকথন। এক আশ্চর্য বন্ধুত্বের সূচনা সেখান থেকেই। পরবর্তীকালে ফয়েজ বলেছিলেন, আমি যদি কবি না হতাম, তাহলে শিল্পী হতে চাইতাম। আর ছবি আঁকলে, সতীশ গুজরালের মতো ছবি আঁকার স্বপ্ন দেখতাম।

কবিতার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক অবশ্য তার আগে থেকেই। আট বছর বয়সে গুরুতর অসুস্থ হওয়ার কথা তো শুরুতেই বলেছি। শ্রবণশক্তি হারিয়ে ফেলার পাশাপাশি পায়ের সমস্যার জন্যে তাঁকে একের পর এক অস্ত্রোপচারের সম্মুখীন হতে হয়, শয্যাশায়ী থাকতে হয় অনেকগুলো বছর। শয্যাশায়ী থাকার বছরগুলো— বধির হওয়ার কারণে ইশকুলে না যেতে পারা— আর পাঁচটা বাচ্চার সঙ্গে তাঁর বড় হওয়ার দিনগুলোর ফারাক প্রচুর। তিনি নিজেই বলতেন, আমাকে যখন জিজ্ঞেস করা হয় আমার শৈশবের কথা, আমি নিজেকেই প্রশ্ন করি, আচ্ছা, আমার কি আদপেই শৈশব বলে কিছু ছিল!! সেই বয়স থেকেই সঙ্গী হয় বই— কবিতা— বারো বছর বয়সে পড়তে থাকেন গালিব আর ইকবাল।

শৈশবে শ্রবণশক্তি হারালেও, সতীশ গুজরালের বাকশক্তি ছিল অটুট। সামনে থাকা পরিচিত মানুষের ঠোঁটের নড়াচড়া দেখে দিব্যি আন্দাজ করতে পারতেন, সামনের মানুষটি ঠিক কী বলতে চাইছেন। এই বধিরতার মধ্যেই তিরিশ বছর বয়সে শেখেন ইংরেজিতে কথোপকথন, এমনকি স্প্যানিশও— সে খুব কম আশ্চর্য কৃতিত্ব নয়। সত্তর বছর বয়সে কানের অপারেশন করিয়ে শ্রবণশক্তি ফিরে পাওয়ার সময়ে চিকিৎসকরা বলেছিলেন, তাঁরা যতজনের উপর এই অপারেশন করেছেন, তাঁদের মধ্যে শৈশবে শ্রবণশক্তি হারিয়ে ফেলার পরেও কথা বলার ক্ষমতা অটুট থাকার একমাত্র নজির সতীশই। আর সেজন্যেই এত বেশি বয়সে এত বড় ঝুঁকিবহুল অপারেশন করতে আগ্রহী তাঁরা।

প্রীতীশ নন্দীর সঙ্গে আলাপচারিতায় তিনি শুনিয়েছিলেন নিজের শ্রবণশক্তি ফিরে পাওয়ার সেই অলৌকিক অনুভূতি। হ্যাঁ, বাষট্টি বছর এক স্তব্ধ শব্দহীন জগতের বাসিন্দার সামনে খুলে যাচ্ছে শব্দের আশ্চর্য জগত, সতীশ গুজরাল বলছিলেন— আচমকা যেন শুনতে পেলাম অজস্র বাজি পুড়তে শুরু করেছে আমার পাশে… অনেক অনেএএক শব্দ… কিন্তু, আমি সবচেয়ে চমকে গিয়েছিলাম নিজের গলার শব্দ শুনে… নিজের গলা শুনে যেন আমার আশ মিটছিল না কিছুতেই… কখনও জোরে, কখনও আস্তে, কখনও ফিসফিস করে, দ্রুতলয়ে কিম্বা মন্থরগতিতে— আমি শুধু কথা বলছিলাম, আর নিজেই নিজের গলাটা চিনতে চাইছিলাম।

ভাস্কর্য — আরও দুটি

মাঝের বছরগুলো ধরে, এক নিজস্ব শিল্পভাষা, শিল্পজগতে এক নিজস্ব কণ্ঠস্বর নির্মাণে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি। পোড়ানো কাঠ কিম্বা ব্রোঞ্জ ভাস্কর্য— কখনও দেওয়াল জুড়ে বিশালাকৃতি ম্যুরাল— যার অন্যতম শ্রেষ্ঠ দুটি আছে দিল্লির আইটিসি মৌর্য হোটেলে— আর পেইন্টিং তো আছেই।

সতীশ গুজরালের শিল্পকর্ম বা পেইন্টিং নিয়ে বিশদ আলোচনার সুযোগ স্বল্প পরিসরে নেই। শুধু এটুকুই বলার, বিষয়নির্বাচন কিম্বা আঙ্গিক— উভয়ক্ষেত্রেই তিনি স্বকীয়। বিশেষত, ক্যানভাসে একটি বিশেষ টেক্সচার তৈরি করে অস্বচ্ছ রং ব্যবহার করার প্রচলন এনেছিলেন তিনি। যে স্টাইল তাঁর সমকালীন যেকোনও শিল্পীর থেকে আলাদা। আর তাঁর ক্যানভাসের সামনে দাঁড়ালে এক ত্রিমাত্রিকতার আভাস মেলে— প্রায় রিলিফ ওয়ার্কতুল্য— রঙের ব্যবহার ও গভীরতা আশ্চর্য। সত্যি বলতে কি, বইয়ের পাতা বা কম্পিউটারের পর্দায় দেখে পেইন্টিং-এর একটা আভাস পাওয়া সম্ভব, দক্ষ ও অভ্যস্ত চোখ তার সঙ্গে মাধ্যম ও ছবির মাপের উল্লেখ থেকে অনেকখানি কল্পনা করে নিতেও সক্ষম, কিন্তু, ছবির সামনাসামনি দাঁড়ানোর অভিজ্ঞতার কোনও বিকল্প হতে পারে না। তবু, অধিকাংশ ক্ষেত্রে বইয়ের পাতা থেকে ছবি দেখার বাইরে সামনাসামনি ছবি দেখার সুযোগ আমাদের সবসময় হয় না। কিন্তু, সতীশ গুজরালের ছবি সামনে দাঁড়িয়ে না দেখলে ছবির আশ্চর্য গভীরতা বা রঙের চোখধাঁধানো উজ্জ্বলতার কিছুই আঁচ পাওয়া যায় না।

পেইন্টিং

পেইন্টিং-এর পাশাপাশি বলা জরুরি তাঁর ড্রয়িং-এর কথাও। তাঁর সময়কার শিল্পীদের মধ্যে নিখাদ ড্রয়িং-এর দক্ষতায় সতীশ গুজরাল ছিলেন অন্যতম শ্রেষ্ঠ। ড্রয়িং-কে পেইন্টিং বা স্কাল্পচারের খসড়ার বাইরে একটি আলাদা শিল্পমাধ্যম হিসেবে সেসময় খুব বেশি শিল্পী ধরতেন না। তুলট কাগজের উপর সতীশের গ্রাফাইট ড্রয়িং ভারতীয় চিত্রকলার স্থায়ী সম্পদ হিসেবেই বিবেচিত হবে। পেইন্টিং বা ড্রয়িং, উভয়ক্ষেত্রেই, রেখা বা জ্যামিতিক তলের দক্ষ ব্যবহার তাঁর ছবিকে দিয়েছে এক আশ্চর্য ছন্দ— আপাতজটিল সারল্য— যে ছবি একবার দেখলেই শিল্পীর স্বকীয় ধারা বিষয়ে সংশয়ের অবকাশ থাকে না।

ড্রয়িং

সতীশ গুজরাল বলতেন, যেসময় ছেলেরা বাইরে বন্ধুদের সঙ্গে হুল্লোড় করে বেড়াচ্ছে, তাঁর দিন কেটেছে বিছানায় শুয়ে, কবিতার বই আঁকড়ে। বাইরের জগতটাকে নিজের চোখে দেখার পরিবর্তে কবিতার চোখ দিয়ে দেখতে গিয়ে বাস্তবচ্যুত হয়েছিলেন তিনি। কাজেই, ছবি তিনি আঁকতেন, কিন্তু, তাঁর শিল্পী হয়ে ওঠা সম্ভব হত কিনা, সন্দেহ আছে। সেই শিল্পীতে উত্তীর্ণ হওয়া সম্ভবপর হয়েছিল দেশভাগ আর দাঙ্গা প্রত্যক্ষ করে। তাঁর ভাষায়, আমি মৃত্যু দেখতাম, হত্যা দেখতাম— রোজ, একাধিক— আর দেখতাম মানুষের প্রতি মানুষের ঘৃণা, বিদ্বেষ। বধির হওয়ার কারণে অন্যের সঙ্গে আদানপ্রদানের ক্ষেত্রেও সীমাবদ্ধতা থাকত, তার থেকেও জন্ম নিত রাগ, বিরক্তি। সতীশের প্রথম জীবনের ছবি, অতএব, ডার্ক— অন্ধকারাচ্ছন্ন কিছুটা। মেক্সিকো থেকে ফেরার শেষে সে ছবিতে আসে অন্য বাঁক। এরই মাঝে ডাক আসে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের পোর্ট্রেট আঁকার। তাঁর আঁকা বেশ কিছু পোর্ট্রেট পার্লামেন্ট হাউজের দেওয়ালের সম্পদ। সে-ও তাঁর শিল্পীজীবনের অন্যতম উল্লেখযোগ্য পর্যায়। আর এই পোর্ট্রেট আঁকার সময়েই তিনি নেহরুর নজরে আসেন। স্বাধীনতার পর দেশের পুনর্নিমাণ তখন চালু হয়েছে পুরোদমে। বড় বড় সরকারি বিল্ডিং তৈরির সময় সে ভবন সাজানোর জন্যে নির্দিষ্ট অর্থ বরাদ্দের সরকারি স্তরে ভাবনাটিও সতীশ গুজরালের প্রত্যক্ষ প্রভাবেই।

কিন্তু, তাঁর শিল্পকর্মের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ বদল আসে কিরণ গুজরালের সঙ্গে বিবাহের পরে। শিল্পীদের জীবনে সঙ্গী/সঙ্গিনীর গুরুত্ব বহুল-আলোচিত বিষয়, কিন্তু, সতীশ গুজরালের শিল্প নিয়ে কথা বলতে হলে কিরণ গুজরালকে বাদ দিয়ে আলোচনা অসম্পূর্ণ রয়ে যাবে। বাইরের জগতের সঙ্গে সেতু হয়ে দাঁড়িয়ে, সতীশের জীবনের ক্লান্তি-বিরক্তিটুকু শুষে নিয়েছিলেন তিনি। তাঁর সঙ্গে সম্পর্কের পরেই সতীশের ছবিতে আসে রঙের জোয়ার। ঠিক তেমনই, সত্তর বছর বয়সে, শ্রবণশক্তি ফিরে পেয়ে সতীশ গুজরাল ভাসেন শিশুসুলভ উচ্ছ্বাসে— ছবি হয়ে ওঠে ধ্বনিবহুল— ভরে ওঠে গায়ক-বাদক আর হইচইয়ে।

আসলে, সতীশ গুজরাল ছিলেন আদ্যন্ত ছটফটে একজন মানুষ। একটানা কোনও পথ ধরে চালিয়ে যাওয়া, নিজেকে পুনরাবৃত্ত করে চলা— এসব ছিল তাঁর বিলকুল নাপসন্দ। রামকিঙ্কর সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, রবীন্দ্রনাথ তাঁকে উপদেশ দিয়েছিলেন, শোন, যা কিছু চোখের সামনে পাবি, নিবি, আর একেবারে ছিবড়ে করে ফেলে দিবি— তারপর আর ফিরে চাইবি না। এ আদর্শ যেন আত্মস্থ করেছিলেন সতীশ— একেকবার একেক পথ ধরে এগিয়েছেন, সে যাত্রার শীর্ষে পৌঁছেছেন, আর, তারপর সেদিকে আর পিছন ফিরে তাকাননি। আঙ্গিক বা বিষয়— চারপাশের জগত দেখেছেন শিশুসুলভ কৌতূহল আর বিস্ময় নিয়ে। দেশের ক্রিকেটপ্রেম, এমনকি আইপিএল নিয়েও এঁকেছেন ছবি। না, ক্যাজুয়াল কোনও এলেবেলে কাজ নয়— তাকেও পৌঁছে দিয়েছেন শিল্পের উৎকর্ষে।

একটু আগেই বলছিলাম, সতীশ গুজরালের শিল্পী হয়ে ওঠার মূলে ছিল দেশভাগের ট্রমা চাক্ষুষ করা— জমিয়ে আড্ডা দিতে ভালোবাসতেন তিনি প্রিয় মানুষদের সঙ্গে, খুলে বসতেন গল্পের ঝাঁপি, সে গল্পে অনেকখানিই জুড়ে থাকত দেশভাগের ঘটনার স্মৃতিচারণ। সেই স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে প্রায়শই চোখ ভরে উঠত জলে। হ্যাঁ, দেশভাগ আর দাঙ্গা যে গভীর দাগ কেটে গিয়েছিল তাঁর সদ্যযৌবনে, সে ক্ষত থেকে আমরণ মুক্ত হতে পারেননি তিনি। তাঁর সেই পর্যায়ের ছবি ডার্ক অবশ্যই— সময়টাই তো ডার্ক— তবু, অনেকেই মনে করেন, চিত্রকর সতীশ গুজরাল অমর হয়ে থাকবেন শুধুমাত্র তাঁর পার্টিশন সিরিজের কাজের সুবাদেই।

পেইন্টিং– পার্টিশন সিরিজ

আজ এই লেখা যখন লিখতে বসেছি, চারপাশে লকডাউন, পরিস্থিতির বিচারে এ হয়ত ছিল অনিবার্য, কিন্তু, একথা কখনওই অস্বীকার করা যায় না, যে, এই লকডাউনে বড় বিপদে পড়ে গিয়েছেন দেশের এক বিপুল সংখ্যার মানুষ। শহরে দিনমজুরি করে সংসার নির্বাহ করতেন যাঁরা, খিদের জ্বালায় তাঁরা গ্রামে ফিরতে চাইছেন— যানবাহনের অভাবে হেঁটে ফিরছেন— কোলে শুকনো-মুখ শিশু, মাথায় অস্থায়ী সংসারের হাঁড়িকুঁড়ি— আড়াইশো কি পাঁচশো কিলোমিটার হেঁটে ফিরতে চাইছেন আমার দেশেরই মানুষ।

স্বাধীনতা-দেশভাগের পর এই উপমহাদেশের মাটিতে এমন বিপুল সংখ্যায় পায়ে চলে মাইগ্রেশনের নজির কম।

আগের সেই অনিবার্য মাইগ্রেশন এক ধাক্কায় ছবি-আঁকিয়ে থেকে শিল্পীতে পরিণত করে দিয়েছিল সতীশ গুজরালকে।

বয়স হয়েছিল। শেষের দিকটায় অসুস্থও ছিলেন বেশ। তবু, একে সমাপতন ছাড়া আর কী-ই বা বলা যায়! আজকের মাইগ্রেশনের মুহূর্তটি তিনি বেছে নিলেন চলে যাওয়ার জন্যে। খুব ক্লিশে শোনালেও, বলে রাখা যাক, সতীশ গুজরালের শূন্যস্থান পূরণ করা সহজ নয়। কিছু কিছু জার্নি এমন ব্যতিক্রমী হয়, যার পুনরাবৃত্তি অসম্ভব। শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে নিজস্ব পথ নির্মাণ করা, নিজের পথ ধরে শীর্ষে উত্তরণ— সতীশ গুজরাল এক অনন্য শিল্পী।

তাঁর উপর নির্মিত সংক্ষিপ্ত তথ্যচিত্র (A Brush with Life) শেষ হয় তাঁরই মুখে ইকবালের এই অনবদ্য কবিতা দিয়ে–

খুদকো কর বুলন্দ ইতনা
কে হর তকদির সে পহলে
খুদা বান্দে সে খুদ পুছেঁ
বাতা তেরা রাজা কেয়া হ্যায়

(নিজেকে এমন উচ্চতায় নিয়ে যাও, যে, প্রতিবার তোমার ভাগ্য লেখার মুহূর্তে ঈশ্বর যেন তোকেই প্রশ্ন করেন, বল, তোর কী ইচ্ছে)

হ্যাঁ, নিজেকে সেই উচ্চতায় তুলে নিয়ে যেতে পেরেছিলেন তিনি।

তবু, এই মাইগ্রেশনের ধাক্কাও কি জন্ম দেবে নতুন কোনও মহান শিল্পীর? উত্তরটা পেতে আরেকটু সময় লাগবে। আপাতত, আমিত্বের আবরণে আচ্ছাদিত এই আমাদের কাছে সতীশ গুজরালের শিল্পকৃতি হয়ে থাকুক দুনিয়া দেখার একান্ত খড়খড়ি।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4879 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...