সন্দীপ রায়
লেখক চলচ্চিত্রনির্মাতা।
নিমাইকাকার সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় ৬৮ সালে। তখন গুপী গায়েন বাঘা বায়েন-এর শুটিং চলছে। উনি একদিন আমাদের বাড়িতে এলেন এবং সেইসময় থেকেই যে বাবার প্রোডাকশন ফোটোগ্রাফার হিসেবে উনি বাবার সঙ্গে থেকে গেলেন, বাবার শেষ ছবি ‘আগন্তুক’ অবধি সেই সম্পর্ক অটুট ছিল। সেটা নিঃসন্দেহে নিমাইকাকার জীবনেরও এক দীর্ঘ এবং উল্লেখযোগ্য একটা অধ্যায়। এমনকি বাবা চলে যাওয়ার পরেও আমার ছবিগুলির সঙ্গে উনি যুক্ত ছিলেন। ফটিকচাঁদ, উত্তরণ, গুপী বাঘা ফিরে এল— আমার অনেক ছবিতেই নিমাইকাকা আমাদের সঙ্গে কাজ করেছেন। আর শুধু তো সত্যজিৎ রায় ও তাঁর সিনেমা নয়, তার বাইরেও নিমাই ঘোষের প্রচুর ভালো ভালো কাজ রয়েছে। তিনি বাংলার থিয়েটার নিয়ে প্রচুর ছবি তুলেছেন, পেইন্টারদের ওপর কাজ করেছেন, আদিবাসী এমনকি এই কলকাতা শহরের ওপরেও কাজ করেছেন৷ তবে উনি বাবার সঙ্গে কাজ করার সুবাদেই সবচেয়ে বেশি পরিচিতি পেয়েছেন। পৃথিবীর ইতিহাসে আর দ্বিতীয় কোনও ব্যক্তি আছেন কিনা আমি জানি না, যিনি একজন চলচ্চিত্রনির্মাতার সঙ্গে এত নিবিড়ভাবে যুক্ত থেকে প্রায় তাঁর chronicler হিসেবে কাজ করেছেন।
বংশীকাকা, বংশী চন্দ্র গুপ্ত ছিলেন বাবার ছবিগুলির শিল্প নির্দেশক। উনি নিমাইকাকাকেও চিনতেন। বংশীকাকাই নিমাইকাকাকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে এসেছিলেন। নিমাইকাকাই প্রথমে বাবার ইউনিটের সঙ্গে থেকে ছবি তোলার ইচ্ছেপ্রকাশ করেন। এরপর বীরভূমে যখন ‘গুপী গায়েন বাঘা বায়েন’-এর কাজ হচ্ছিল, উনি কিছু ছবি তোলেন ও বাবাকে দেখান, বাবার সেগুলো খুব পছন্দ হয়। সত্যি কথা বলতে কী, নিমাইকাকা আসার আগে তো বাবার তেমন কোনও প্রোডাকশন ফটোগ্রাফার ছিলেন না। নিমাইকাকার কাজ দেখে বাবার মনে হয়েছিল, একজন পেশাদার ফটোগ্রাফার যদি আউটডোরে ছবি তোলেন, মন্দ কী! ছবি তৈরির সময়টাও ডকুমেন্টেড থাকবে। এছাড়াও ফিল্মের প্রচারের সময়ও তো নানা ছবি লাগে, সেগুলোও পাওয়া যাবে। সেই থেকে নিমাইকাকা আমাদের সঙ্গে রয়ে গেলেন, ভীষণভাবে আমাদের সঙ্গে মিশে গেলেন। উনি শুধু শুটিং-এ যেতেন এমন নয়, বাড়িতেও আসতেন, বাবার কাজের ছবি তুলতেন। ক্রমে নিমাইকাকা আমাদের পরিবারেরই একজন সদস্য হয়ে গিয়েছিলেন।
আগন্তুক বাবার শেষ ছবি। তারপরেও আমার সঙ্গে নিমাইকাকা কাজ করেছেন। ওঁর সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ শেষদিন অবধি ছিল। যদিও শেষদিকে শরীরটা খুবই ভেঙে পড়েছিল। তার আগে আমাদের বাড়িতে প্রায়ই চলে আসতেন। আমরা যে ‘রায় সোসাইটি’ বলে যে সংস্থা তৈরি করেছি, তার বেশ কিছু অনুষ্ঠানে উনি গিয়েছিলেন। নিমাইকাকা জীবনের শেষদিন পর্যন্ত ভীষণভাবেই আমাদের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন৷
নিমাইকাকার একটা বিরাট বড় গুণ ছিল উনি ছবি তোলার জন্য ফ্ল্যাশ ব্যবহার করতেন না। সেই কারণে খুব সন্তপর্ণে, কাউকে বিরক্ত না করে উনি অসামান্য সব মুহূর্ত পেয়ে যেতেন। ফ্ল্যাশ ব্যবহার করলে দ্বিতীয় শটে মানুষ কিছুটা সচেতন হয়ে যায়, মুহূর্তগুলো হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে, নিমাইকাকা তা কখনও হতে দেননি।
বাবাকে নিয়ে ওঁর তোলা ছবির একটা বড় অংশ নিমাইকাকা দিল্লি আর্ট গ্যালারিকে দিয়েছেন। সেই কারণে আমি পরের দিকে যখন ওঁর কাছে কোনও বিশেষ ছবির জন্য গেছি, উনি মাঝেমধ্যেই বলেছেন যে সব ছবি আর ওঁর কাছে নেই, স্ক্যান করা কিছু ছবি রয়েছে, সেগুলি আমাকে ব্যবহার করতে দিয়েছেন। অবশ্য এখনও ওঁর বাড়িতে নিশ্চয়ই কিছু ছবি থেকে যাবে। আশা করি, ওঁর ছেলে সাত্যকি সেগুলোর ঠিকঠাক দেখাশুনো করবেন। সাত্যকি নিজেও একজন খুব ভালো ফটোগ্রাফার। অবশ্য দিল্লি আর্ট গ্যালারিকে ছবিগুলি দিয়ে দিলেও নিমাইকাকার তোলা অথচ আমার অদেখা ছবি তেমন কিছু নেই। ছবি তুললেই উনি আমাদের বাড়িতে আসতেন। প্রথমে বাবাকে দেখাতেন। আমাদের দেখাতেন৷ তা সত্ত্বেও— নিমাইকাকা হাজার হাজার ছবি তুলেছেন— কিছু ছবি আমার জানার বা দেখার বাইরে রয়ে গেলেও যেতে পারে।
নিমাইকাকা পদ্মশ্রী পেয়েছিলেন। তবু আমি বলব, ওঁর আরও বেশি স্বীকৃতি পাওয়া উচিত ছিল৷ উনি তো শুধু বাবার ছবি তুলেছেন তা তো নয়, ঋত্বিক ঘটক, মৃণাল সেন অথবা উত্তমকুমার ইতাদি অনেকের প্রচুর ছবি তুলেছেন। ওঁকে কোনওদিন ঘরে বসে থাকতে দেখিনি। সবসময় কিছু না কিছু করছেন। বিশেষ করে উনি যেভাবে বাংলার থিয়েটারকে কভার করেছেন, আর কোনও ফটোগ্রাফার তা করেছেন বলে জানি না। থিয়েটারের স্বর্ণযুগের নানা কিংবদন্তি ব্যক্তিত্বদের থেকে শুরু করে শম্ভু মিত্র, উৎপল দত্ত, তাপস সেন প্রভৃতির ছবি, ইতিহাস ও নাটকের নানা মুহূর্ত ডকুমেন্ট করে রেখেছেন নিমাইকাকা। আমি অবশ্য জানি না সেইসব অমূল্য ছবিগুলি এখন কোথায় রয়েছে।
নিমাইকাকা ডিজিটাল যুগে কোনওদিন ছবি তোলেননি৷ সেই সময় অর্থাৎ অ্যানালগ যুগে ছবি তোলা, তার ঠিকটাক রক্ষণাবেক্ষণ যথেষ্ট খরচসাপেক্ষ ছিল। নিমাইকাকা এদিক দিয়ে ভীষণ খুঁতখুঁতে ছিলেন। যে ছবিগুলি তুলতেন, সেগুলিকে অত্যন্ত ভালোবাসতেন, খুব যত্নে রাখতেন। ওঁকে কোনওদিন ছবি তোলার সময় কোনও দ্বিতীয় শ্রেণির সরঞ্জাম ব্যবহার করতে দেখিনি। প্রিন্টগুলো যাতে ভালো থাকে, বাড়িতে নেগেটিভ যেখানে রাখতেন, তার টেম্পারেচারটাও নিয়ন্ত্রিত থাকত। এই ছবি তোলার নেশা নিমাইকাকাকে কোনওদিন কোনও আর্থিক সুবিধে দেয়নি। উনি অবশ্য মোটর ভেহিকলসে চাকরি করতেন। ফলে ছবি তোলার খরচের দিকটা হয়তো পুষিয়ে নিতে পারতেন। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হল, ওঁর তোলা ছবি উনি যেভাবে যত্নে রাখতেন, সেটা সত্যিই একটা শিক্ষণীয় ব্যাপার ছিল। ধরুন, আমি আশির দশকে ওঁর বাড়ি গেছি, গিয়ে বললাম, “আমার গুপী গায়েনের শুটিং-এর সময়কার একটা ছবি প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। তোমার কাছে কি চট করে পাওয়া যাবে?” উনি ঠিক পাঁচ মিনিটের মধ্যে আমাকে ঠিক ছবিটা বের করে দিতেন। এতটাই নিখুঁত ছিল ওঁর ক্যাটালগিং!
নিমাইকাকার সঙ্গে আমার ও আমার পরিবারের অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে। আমরা একসঙ্গে বহু জায়গায় শুটিংয়ে গেছি। যেহেতু আমাদের ভালোবাসা ছিল এক— ফোটোগ্রাফি, দেখা হলেই ফোটোগ্রাফি নিয়ে প্রচুর কথা হত আমাদের। একটা বয়েসের পরে তো বন্ধুস্থানীয় হয়ে গিয়েছিলাম আমরা। মনে আছে, উনি একবার ইংল্যান্ড থেকে ফ্রান্সে গিয়েছিলেন কার্তিয়ের ব্রেসোঁ-র সঙ্গে দেখা করতে৷ আমরা ইংল্যান্ডেই ছিলাম, উনি ব্রেসোঁ-র সঙ্গে দেখা করে আবার আমাদের কাছে ফিরে এলেন। আর আজ উনি যখন আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন, সেটা এমনই দুর্দিনে গেলেন যে ওঁকে শেষ দেখা দেখতে যেতে পারলাম না। লকডাউনের জন্য বাড়ি থেকে বেরোনো গেল না। এই আফসোসটা বাকি জীবন থেকে যাবে। অবশ্য উনি মারা যাওয়ার মাস দেড়েক আগে আমার সঙ্গে দেখা হয়েছিল। তখন আমরা পরিকল্পনা করছিলাম যে বাবার শতবর্ষ আসছে, কীভাবে ভালো করে উদযাপন করা যায়। উনি বলেছিলেন, উনি ভাবছেন, আরেকটু ভেবে আমাকে জানাবেন। ওঁর সেই ভাবনাটাও আর আমার জানা হল না।