চার নম্বর নিউজডেস্ক
একটা ভাইরাল অ্যাটাকে কাবু গোটা পৃথিবী। কয়েকটি দেশকে বাদ দিলে, বিশ্বের প্রায় প্রত্যেকটা দেশের মানুষ গৃহবন্দি। ভারতবর্ষে লকডাউন শুরু হয় ২৪শে মার্চ। তার আগে, ২২শে মার্চ হয় একটি মক ড্রিল। তারও আগে থেকেই, সর্বত্র একটাই উপদেশ– বাড়িতে থাকুন, সুস্থ থাকুন, ‘সামাজিক দূরত্ব’ বজায় রাখুন। ‘সামাজিক দূরত্ব’ শব্দবন্ধটা কতটা সুপ্রযুক্ত, তা নিয়ে অবশ্য ঘোরতর বিতর্ক রয়েছে। কিন্তু, সে তর্কে না-ঢুকেও বলা যায়– যতটা না অসুখে, তার চেয়েও অনেক বেশি আতঙ্কে, গোটা পৃথিবী কার্যত স্তব্ধ। দৈনন্দিন জীবন থেকে শুরু করে বিশ্ব-অর্থনীতি– করোনা ভাইরাসের আতঙ্কের সামনে কার্যত হাঁটু মুড়ে বসে পড়েছে গোটা মানবসভ্যতাই।
কিন্তু পুরোটা হয়তো ঠিক বলা হল না। সকলেই ভয় পেয়ে হাঁটু মুড়ে বসে পড়েছেন– এমনটা নয়। এ-দেশে, বিদেশেও ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীরা মরণপণ লড়াই করে চলেছেন ভাইরাসের হানাদারির হাত থেকে আক্রান্তদের বাঁচাতে। তাঁদের পাশাপাশিই, আরও অসংখ্য স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা এগিয়ে এসেছেন আমাদের বেঁচে থাকাকে আরও একটু সুন্দর, আরও একটু সহনীয় করে তুলতে। এমনই একটি সংস্থা, ‘কেয়ারমঙ্গার’। এঁরা বলছেন, “ভয় নয়, প্রচার হোক সহৃদয়তার।” ভারতে লকডাউন শুরু হওয়ার দশম দিনে, এই লেখা যখন আপলোড হতে যাচ্ছে, তখন কেয়ারমঙ্গার-এর সদস্যসংখ্যা ২২ হাজার ছাড়িয়েছে। আরও ঠিকঠাক বলে গেলে, সংখ্যাটা এই মুহূর্তে ২২,৪১৮।
করোনা ভাইরাসের জেরে বেসরকারিভাবে ‘সামাজিক দূরত্ব’ অভ্যাস করা ভারতবর্ষে শুরু হয়ে যায় ১৫ই মার্চের সপ্তাহ থেকেই। বেশ কয়েকটি বেসরকারি সংস্থা তাদের কর্মীদের ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’-এ পাঠিয়ে দেন। সেই সময়ে, বেঙ্গালুরুর বাসিন্দা, মাহিতা নাগরাজের কাছে সুদুর ইউনাইটেড কিংডম থেকে একটা ফোন আসে। বৃদ্ধ বাবা-মাকে কিছু দরকারি ওষুধ পৌঁছে দিতে মাহিতাকে অনুরোধ করেন তাঁর এক খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তার কয়েক ঘণ্টা পরেই, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে আর একটি অনুরোধ আসে– “আমার বাবা-মায়ের কাছে মাসকাবারি খাবারদাবার পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করে দিতে পারবে?” পরপর এই দুটি ফোন মাহিতাকে চিন্তায় ফেলে। সত্যিই যদি লকডাউন হয় ভারতবর্ষে, তা হলে তাঁর বাকি বন্ধুদের বাবা-মাকে কারা দেখবে? কে জোগাড় করে দেবে তাঁদের জন্য খাদ্যদ্রব্য? কে এনে দেবে ওষুধ?
মাহিতা বেঙ্গালুরুর এক ডিজিটাল মার্কেটিং প্রফেশনাল। তিনি একজন সিঙ্গল মাদারও বটে। তাই সমাজের কিছু-কিছু সমস্যা অন্যদের থেকে হয়তো বা একটু বেশিই বোঝেন। আসন্ন সমস্যার কথা ভাবতে ভাবতে, ফেসবুকে তিনি একটি পোস্ট করেন– কেউ সাহায্য চাইলে যেন তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এই পোস্টের প্রতিক্রিয়া দেখে অভিভূত হয়ে যান মাহিতা। সারা দেশ সাড়া দেয় তাঁর পোস্টে, এবং শুধু সাহায্য চেয়ে নয়, সাহায্য করতে চেয়েও। সাহায্যকারীরা সংখ্যায় অনেক বেশি।
এখান থেকেই জন্ম নেয় একটি ফেসবুক গ্রুপ– ‘কেয়ারমঙ্গারস ইন্ডিয়া’। এদের একটাই কথা– চারিদিকে এত ভয়ের আবহে সবাই যখন এত সন্ত্রস্ত, আমরা না হয় সহৃদয়তার কথাই বলি। ১৭ই মার্চে জন্ম এই গ্রুপের, এবং ইতিমধ্যেই ২২ হাজার মানুষ একটা অন্যরকমের পথচলায় নেমে পড়েছেন। আর সেই পথচলায় নেতৃত্ব দিতে গিয়ে কী বলছেন মাহিতা? বলছেন, “বর্তমান পরিস্থিতি খুবই ভয়ঙ্কর। এই পরিস্থিতিতে যারা অসহায়, আমরা তাঁদের সাহায্য করার চেষ্টা করছি। চেষ্টা করছি ভয়ের বদলে ভালোবাসার ভাবনাকে ছড়িয়ে দিতে।”
‘কেয়ারমঙ্গারিং’-এর ব্যাপারে মাহিতা জানতে পারেন বিবিসি-র করা ক্যানাডার একটি খবর থেকে। অসহায় মানুষকে সাহায্য করার এই প্রবণতা ক্যানাডার টরন্টো থেকে শুরু হয়ে কয়েকদিনের মধ্যেই ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে।
আজ পৃথিবীর প্রায় প্রত্যেকটি দেশ থেকেই পরার্থপরতার এমন একাধিক ঘটনা এই দুঃসময়ে আমাদের উজ্জীবিত করছে। ব্রিটনরা বয়স্কদের কাছে স্যুপ পৌঁছে দিচ্ছে, যারা কোয়ারান্টিনে আছেন আমেরিকানরা তাঁদের জন্য বাজার করে পৌঁছে দিয়ে আসছেন, আমাদের কলকাতা শহরেই স্বেচ্ছাসেবীরা এগিয়ে আসছেন রাস্তার কুকুরদের খাওয়াতে, গরিবদের ঘরে অতি প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র পৌঁছে দিতে।
এ-কথা মানতেই হবে যে, শুধু আতঙ্ক এবং ত্রাস নয়, করোনাভাইরাস এ-বিশ্বে সহৃদয়তাকেও ভাইরাল করে দিয়েছে। এটুকুই বোধহয় আশার আলো– মনুষ্যত্ববোধের প্রত্যাবর্তন।
ভারতবর্ষেও কেয়ারমঙ্গারিং বেশ ছোঁয়াচে হয়ে উঠেছে! প্রথম ২৪ ঘণ্টায় ২০০ সদস্য, এবং এক সপ্তাহে প্রায় সাড়ে ছ হাজার স্বেচ্ছাসেবী যুক্ত হয়ে যান এই প্রচেষ্টায়। আজকের সংখ্যা আপনারা আগেই জেনেছেন। তবে কয়েকদিনের মধ্যেই মাহিতা বুঝতে পারেন যে, ফেসবুকে স্বেচ্ছাসেবীরাই বেশি যোগাযোগ করছেন। যাঁদের সাহায্যের প্রয়োজন, তাঁরা নয়। তাই তিনি একটি হেল্পলাইন নম্বর চালু করেন। তারপর থেকে, মাহিতার কথায়, “ইটস গন ক্রেজি!”
হেল্পলাইন নম্বরটি +৯১ ৯৫৯১১ ৬৮৮৮৬ (ভারতবর্ষের যে কোনও জায়গার জন্য এই নম্বরটি প্রযোজ্য)।
‘কেয়ারমঙ্গারস ইন্ডিয়া’ তাঁদের সাহায্য করছে যাঁদের স্বাস্থের জটিলতার ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি– বয়স্ক, বা যাঁদের আগে থেকে কোনও অসুস্থতা আছে, যারা প্রতিবন্ধী, বা যাঁদের সন্তানের বয়স এক বছরের কম। এক সপ্তাহের মধ্যে মাহিতা হাজারের ওপর ফোন কল পেয়েছেন। যদিও অনেকেই এটা জানতে ফোন করছেন যে, নম্বরটি আসল কি না, তবুও ইতিমধ্যেই কয়েকশো মানুষকে সাহায্য পৌঁছে দিয়েছে এই হেল্পলাইন। তাঁদের ফেসবুক পেজেই দেখতে পাওয়া যাবে সেইসব অসংখ্য উদাহরণ।
শুধু দেশ থেকেই নয়, বিদেশ থেকেও প্রচুর মানুষ যোগাযোগ করছেন তাঁদের বয়স্ক বাবা-মা অথবা দাদু-দিদার জন্য সাহায্য চেয়ে। প্রত্যেকটি অনুরোধের সঙ্গে সবচেয়ে কাছের স্বেচ্ছাসেবীকে যুক্ত করে দেওয়া হচ্ছে যথাসম্ভব শীঘ্র।
“আমার এটা ভেবেই ভালো লাগছে যে কত লোক সাহায্য করতে চান। এই মুহূর্তে আমাদের বাড়িতে এবং জীবনে কেয়ারমঙ্গারিংটাই সবথেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দিনে সাড়ে চারশো ফোন-কল নেওয়া সহজ না হলেও, রোজ রাতে ঘুমটা ভালো হয় এই ভেবে যে দিনটা নষ্ট করিনি আমি, কাজের কাজ করেছি কিছু একটা। তাতেই আমার চলবে,” স্পষ্ট কথা মাহিতার।