মৈত্রীশ ঘটক
লেখক লন্ডন স্কুল অফ ইকোনমিকস-এ অর্থনীতির অধ্যাপক। মূল রচনাটি ইংরাজিতে গত ২৮শে মার্চ এনডিটিভির ই-কাগজে প্রকাশিত এবং লেখকের অনুমত্যনুসারে পুনঃপ্রকাশিত।
অপরিসীম দারিদ্র্য বিপর্যয়ের অভিঘাতকে কতটা ভয়ঙ্কর চেহারা দিতে পারে, শহরে, কাজের ক্ষেত্রে রুজিরুটির বন্দোবস্ত বন্ধ হওয়ায় নিজেদের গ্রামের উদ্দেশ্যে অভিবাসী শ্রমিকদের মাইলের-পর-মাইল পায়ে হেঁটে চলার মর্মন্তুদ ছবিগুলি সেই সত্যকেই সামনে নিয়ে আসে। সংক্রমিত হবার ভয় সকলেরই, তবু দরিদ্রশ্রেণির মানুষের ঝুঁকি অনেক বেশি, কারণ এই লকডাউন-অবস্থা সহ্য করে বেঁচে থাকার ক্ষমতা তাঁদের অনেক কম। হয় রোগে ভুগে মরা, নয় না-খেতে-পেয়ে— এ-ভিন্ন এঁদের পথ নেই।
করোনা ভাইরাস কোভিড-১৯-এর প্রাদুর্ভাব-জনিত স্বাস্থ্যসঙ্কট ও তার ফলে সামগ্রিক স্বাস্থ্যব্যবস্থার ওপর বাড়তে-থাকা চাপই শুধু নয়, বিপদটা আরও ব্যাপ্ত এবং গভীর। ভূমিকম্প-পরবর্তী ঝটকার (aftershock) মত এই ভাইরাস আক্রমণও নানাবিধ পরোক্ষ সঙ্কটের সম্ভাবনা নিয়ে আসে, যা মূল বা প্রত্যক্ষ বিপদের ফলের সঙ্গে তুলনীয়। এই সঙ্কট সকলকেই স্পর্শ করে বটে, তবে এর প্রকোপ সবচেয়ে বেশি ভোগ করেন সমাজের দরিদ্রশ্রেণি ও অরক্ষিতজন (এই দুই গোষ্ঠীকে এক মনে করে নেবার কারণ নেই, যেহেতু অরক্ষিতজনের মধ্যে দরিদ্র নন অথচ বয়স্ক ও অশক্ত মানুষও থাকতে পারেন)। এই অপ্রত্যক্ষ বিপদ চাহিদা ও জোগানসমস্যার জোড়া ফলা নিয়ে একযোগে আঘাত করে। জোগানপ্রবাহ ব্যাহত হলে ভোক্তা ক্ষতিগ্রস্ত হন। আপনি যদি বিত্তবান হন অথবা আপনার যদি আয়ের নিশ্চয়তা থাকে (যা বাঁধা মাইনের চাকরিতে থাকে), তাহলে আপনি বিপদের দিনে আঘাত কিছুটা সামলে উঠতে পারবেন। কিন্তু মোট দক্ষ বা অদক্ষ শ্রমিকশ্রেণির কত শতাংশের ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য? অসংগঠিত ক্ষেত্রে শ্রমিকের অনুপাত হল মোট শ্রমশক্তির প্রায় ৮০-৯০%, তাই এই আর্থিক নিরাপত্তার সুরক্ষা খুব অল্প সংখ্যার মানুষেরই থাকে। বাকিদের পরবর্তী বিপদ আসে আয়ের ওপর আঘাতের মাধ্যমে। দরিদ্রের কাছে বিপদ তাই দুদিক থেকেই সমান।
এমতাবস্থায় কেন্দ্রীয় সরকারের ত্রাণ প্যাকেজকে, এবং বিভিন্ন রাজ্য সরকারের (বিশেষ করে কেরলের, তার সঙ্গে আমাদের রাজ্যেরও উল্লেখ করা উচিত) নেওয়া পদক্ষেপগুলিকে স্বাগত জানাতেই হয়। এই ত্রাণ প্যাকেজ-ব্যাতিরেকে তিন সপ্তাহের লকডাউনের পরোক্ষ ফলাফল কোভিড-১৯-এর প্রত্যক্ষ বিপদকে ছাপিয়ে যেতে পারত। সবথেকে বড় কথা, একটি মূল বিষয়কে এই প্যাকেজ প্রাপ্য মান্যতা দিয়েছে। দরিদ্র ও অরক্ষিত মানুষের হাতে নগদ টাকা হস্তান্তর ও গণবণ্টন ব্যবস্থায় জোগান দ্বিগুণ করে খাদ্যসুরক্ষার নিশ্চয়তা– এই দুই পদক্ষেপ একসঙ্গে নিয়ে সরকার জোগান ও চাহিদার দ্বিমুখী সমস্যার সমাধানের প্রচেষ্টা দেখিয়েছেন। জোগানশৃঙ্খলা ব্যাহত হলে শুধু নগদ অর্থ কোন কাজে আসবে? একইরকম ভাবে, দোকানে জিনিসের অভাব না থাকলেও ক্রেতার অর্থের অভাব সমস্যার সমাধান করতে পারবে না। সাধারণভাবে, দরিদ্রশ্রেণীর মানুষকে সহায়তা নগদ অর্থের মাধ্যমে দেওয়া উচিত, না সম-অর্থের ব্যবহার্য বস্তু (যেমন, রেশন ব্যবস্থার মাধ্যমে খাদ্য) এ নিয়ে বিতর্ক আছে। তবে এই বিপুল বিপর্যয়ের মোকাবিলায় এই বিতর্ক অবান্তর– এই দুইয়ের মেলবন্ধনেই কার্যকরী সমাধান সম্ভব।
তবু কিছু বিষয়ে আশঙ্কা থেকেই গেল।
প্রথমত, বিপর্যয়ের দীর্ঘ সময়কালে এই বিপুল সংখ্যক মানুষের জীবন ও জীবিকা সুরক্ষিত করার মত যথেষ্ট অর্থ এই প্যাকেজে বরাদ্দ করা হল কি? এক কোটি সত্তর লক্ষ টাকা আমাদের জিডিপি-র এক শতাংশেরও কম (ফেব্রুয়ারি মাসে প্রকাশিত ২০১৯-২০ অর্থবর্ষের জিডিপি-র আগাম অনুমানের পরিমার্জিত হিসাব-অনুযায়ী)। তদুপরি এই প্যাকেজে এমন বেশ কিছু প্রকল্প আছে যেগুলি আগে থেকেই বলবৎ রয়েছে। সুতরাং সেই সব প্রকল্পের জন্য বণ্টিত অর্থও আগে থেকেই সরকারের তরফে দেওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী কিষাণ সম্মান নিধি যোজনা, বা পিএম-কিষাণ প্রকল্প এমনই একটি প্রকল্প। এই প্রকল্পের আওতায় প্রতিটি কৃষক পরিবারকে বছরে ছয় হাজার টাকা, অর্থাৎ মাসে পাঁচশো টাকা করে দেওয়া হয়। হতে পারে যে এটা সূচনা। তবু যেখানে প্রাণ বাঁচানোটাই মুখ্য, সেখানে অর্থের বরাদ্দ, সাময়িকভাবে হলেও, বাড়ানোটা জরুরি কারণ এই অঙ্ক প্রয়োজনের তুলনায় নেহাতই স্বল্প।
দ্বিতীয়ত, এই প্যাকেজে জন ধন অ্যাকাউন্ট আছে এমন মহিলাদের (২০.৮ কোটির মত) আগামী তিন মাসের প্রতি মাসে ৫০০ টাকা করে দেওয়া হবে। তা ছাড়া, তিন কোটি বরিষ্ঠ নাগরিক ও বিধবাকে এককালীন এক হাজার টাকা করে দেওয়া হবে। এখন, অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ করেন এমন বহু মানুষের জন ধন অ্যাকাউন্ট নেই (মোট অ্যাকাউন্টের সংখ্যা ৩৮.৩ কোটির মত, যেখানে মোট জনসংখ্যা ১৩৩ কোটি, আর কর্মরত বা কর্মসক্ষম জনসংখ্যা অন্তত ৫০ কোটি)। সুতরাং, প্রকৃতপক্ষে দীনদরিদ্র এমন অনেকেরই এই ব্যবস্থায় বাদ পড়ে যাবার অবকাশ থাকছে। তাই এই অবস্থায় ইউনিভার্সাল ইনকাম ট্রান্সফার বা সার্বিক আয় হস্তান্তর সবথেকে কার্যকর হতে পারত– প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিক একটা থোক টাকা পাবেন (এবং অপ্রাপ্তবয়স্কদের জন্যে তাদের মাতা বা পিতা বা ভারপ্রাপ্ত অভিভাবকও একটা থোক টাকা পাবেন)। ঠিক, দরিদ্র নন এমন কিছু মানুষও এর সুবিধা পেয়ে যাবেন। কিন্তু অর্থনীতি তার নিজের ছন্দ ফিরে পেলে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কর আদায়ের মাধ্যমে এই বর্ধিত খরচ তুলে নেওয়া যেতে পারে, আর তার ভার পড়বে তুলনায় সচ্ছল শ্রেণির লোকেদের ওপরে বেশি। তাই আখেরে এই অর্থ সচ্ছল শ্রেণির লোকেদের থেকে দরিদ্র শ্রেণির লোকেদের কাছেই বণ্টিত হত। কিন্তু বিপর্যয়ের সময় কার সাহায্য প্রাপ্য কার নয়, সেটা দেখতে গিয়ে সময় ও সম্পদের অপচয় হত না।
প্রকৃতপক্ষে মানুষের প্রাণ বাঁচানোই যখন মুখ্য উদ্দেশ্য, তখন বজ্র-আঁটুনি দিতে গিয়ে কিছু অভাবগ্রস্তকে সুরক্ষাবলয়ের বাইরে রেখে দেবার ঝুঁকি নেওয়ার থেকে যারা অভাবী নন, তাঁদের কাছেও সাহায্য পৌঁছে গেলে ক্ষতি নেই। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে যে আমি ও কার্তিক মুরলীধরন সম্প্রতি একটি নিবন্ধে লিখেছি, যে সমস্ত পরিবারকে পিএম-কিষাণ প্রকল্পের আওতায় আনা উচিত, এবং আমাদের হিসাব অনুযায়ী এতে খরচ পড়বে জিডিপি-র শতকরা এক শতাংশ। বর্তমানে পিএম-কিষাণ বাবদ সরকারের খরচ হচ্ছে জিডিপি-র ০.৫ শতাংশ। প্রদেয় অর্থের পরিমাণ দ্বিগুণ করলেই সুবিধাভোগীদের চিহ্নিতকরণ বাবদ খরচ ও প্রকৃত অভাবীকে বাদ দেওয়ার মত ভুল থেকে বাঁচা যায়।
তৃতীয়ত, বণ্টনব্যবস্থার একটি প্রধান সীমাবদ্ধতার কথা মাথায় রাখতে হবে। আমরা যেমন জানি, যে এই ধরনের একটা বিপর্যয়ের সময় জোগান দিয়ে চাহিদাপূরণের জন্য শুধুমাত্র বাজারের ওপর নির্ভর করে থাকলে চলে না, আমরা এ-ও জানি যে রাষ্ট্রের ক্ষমতারও সীমাবদ্ধতা আছে। ১৩০ কোটির দেশে, যেখানে দুই-তৃতীয়াংশের বাস গ্রামে, আর খেটে-খাওয়া মানুষজনের মধ্যে মাত্রই দশ শতাংশ যুক্ত আছেন সরকারি দপ্তরে অথবা সংগঠিত ক্ষেত্রে, সেখানে অসংগঠিত ক্ষেত্রের (যেমন বাজারের সব্জিবিক্রেতা) এবং স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সাহায্য-ব্যতিরেকে বণ্টনব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠে এই বিপুল পরিমাণ মানুষের কাছে তাঁদের নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র পৌঁছে দেওয়া কীভাবেই বা সম্ভব? এই বিপদের দিনে এই জোগানশৃঙ্খলাকে ধারণ এবং চালনা করবার ক্ষমতা রাষ্ট্রের বা সংগঠিত ক্ষেত্রের নেই। এর আশু অর্থ, লকডাউন ব্যবস্থা কার্যকর করতে আইনরক্ষকদের আরও কিছুটা ধৈর্য ও সহনশীলতার পরিচয় রাখতে হবে। ঘরের বাইরে কাউকে দেখলেই অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না-করে (সংবাদমাধ্যমে পরিবেশিত তথ্য অনুযায়ী বলপ্রয়োগ করে, এবং কমপক্ষে একজন মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়ে) তাকে ঘরে ফেরত পাঠানোর উদ্যোগ নিলে ফল হিতে বিপরীত হবে। কঠোরভাবে লকডাউন নিশ্চিত করতে গিয়ে আপৎকালীন জোগানশৃঙ্খলা যদি বিঘ্নিত হয়, তবে তার ফল হবে মারাত্মক, এবং তার অভিঘাত হবে জনস্বাস্থ্যসঙ্কটের থেকে অনেক বেশি তীব্র। অনাহারে মৃত্যুই যদি ভবিতব্য হয়, তবে রোগ ভোগের থেকে বাঁচিয়ে কী লাভ?
এমন সঙ্কটকালে মানুষের প্রাণ বাঁচানো আর ক্লেশ কমানোই স্বাভাবিকভাবে অগ্রাধিকার পাবে। অবশ্যই এ-সবের জন্য চোকাতে হবে অর্থনৈতিক মূল্য। তবে “অর্থনীতি” শব্দের অর্থ কী? চাহিদা ও জোগানের পরস্পর সম্পর্কযুক্ত এ এমন এক শৃঙ্খল যা আমাদের সবাইকে বেঁধে রেখেছে পারস্পরিক প্রয়োজন ও নির্ভরতার বন্ধনে। এই সংযোগের শৃঙ্খলের অঙ্গ যে মানুষ, অনাহারে বা জ্বরাগ্রস্ত হয়ে সে-ই যদি ধ্বংসের মুখোমুখি হয়, তবে শেয়ার বাজারের সূচকই হোক বা জিডিপি– শেষ পর্যন্ত বাঁচানো যাবে না কোনওটাই। আজ আমাদের সকলের একটাই শত্রু, যদিও খালি চোখে তাকে দেখা যায় না। নানান মতের বিভেদ সরিয়ে রেখে এই শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাওয়াই আমাদের আশু কর্তব্য। হয় সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে ভেসে থাকা, নয় মৃত্যু। যে কোনও যুদ্ধের মত এই লড়াইয়েও আক্রমণকারীকে প্রতিহত করে চলার সঙ্গে দুর্বলের রক্ষা করাও আমাদের সমান কর্তব্য। অন্যথায় আমাদের জয় হবে অসার, নিরর্থক।