সুশোভন ধর
লেখক রাজনৈতিক কর্মী, রাজনৈতিক ভাষ্যকার।
করোনা ভাইরাস মহামারি এক বিপজ্জনক জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসাবে দেখা দিয়েছে এবং শেষ পর্যন্ত এই রোগে কত মানুষ আক্রান্ত হবেন তার কোনও অনুমান, পূর্বাভাস বা আন্দাজ অন্তত এই মুহূর্তে নেই। চিন ছাড়াও ইতিমধ্যে শিল্পোন্নত দেশগুলি, অর্থাৎ পশ্চিম ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার অগুনতি মানুষ এই রোগে ভীষণভাবে আক্রান্ত হয়েছেন। আমরা দেখছি কীভাবে ইতালি, স্পেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, ইত্যাদি দেশে মৃত্যু-মিছিল চলছে। এই তথাকথিত উন্নত দেশগুলির স্বাস্থ্যব্যবস্থা কার্যত ভেঙে পড়েছে এবং এই রোগ কোনওক্রমে ঠেকিয়ে রাখা তো দূরের কথা, করোনা ভাইরাস সংক্রমণের ফলে উদ্ভূত পরিস্থিতি সামাল দিতে ল্যাজেগোবরে হচ্ছেন শিল্পোন্নত দেশের সরকার ও প্রশাসনের মাথারা। আমাদের আশঙ্কা যে এই রোগ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে ছড়িয়ে পড়লে আক্রান্ত এবং মৃতের সংখ্যা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তার কোনও ইয়ত্তা নেই। আমারা ইতিমধ্যে ইরানের অবস্থা দেখেছি। আট কোটির সামান্য বেশি জনসংখ্যার এই দেশে ইতিমধ্যে আক্রান্ত হয়েছেন প্রায় বিয়াল্লিশ হাজার মানুষ যার মধ্যে তিন হাজারের কাছাকাছি মারা গেছেন। অবশ্য ইরানের মানুষের এই সঙ্কটজনক অবস্থার জন্য দায়ী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত অবরোধ। এই অবরোধের ফলে ওখানে কোনও ওষুধ ও চিকিত্সার সরঞ্জাম, ইত্যাদি প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না।
প্রশ্ন হল বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও সর্বোপরি চিকিৎসা বিজ্ঞানের এই বিপুল অগ্রগতির পরেও এই মহামারির সামনে আমরা এত অসহায় কেন? চোখের সামনে এই মৃত্যুমিছিল চলতে থাকার পরেও কেন আমরা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসে থাকতে বাধ্য হচ্ছি? প্রশ্নটা সাধ্যের না সদিচ্ছার?
স্বাস্থ্যব্যবস্থার সঙ্কট
আমরা জানি যে এই মুহূর্তে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্বের সর্বাধিক মানুষ করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। প্রায় দুই লক্ষ আক্রান্তের মধ্যে মাত্র চার হাজারের সামান্য কিছু বেশি মানুষ সুস্থ হতে পেরেছেন। এক করোনা ভাইরাস সেদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার বেহাল অবস্থা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। ইতিমধ্যে বেশিরভাগ হাসপাতাল জানিয়ে দিয়েছে যে অর্থাভাবে তারা এতটাই অসহায় যে কোনও আর্থিক ত্রাণ না পেলে তারা অতি শীঘ্রই ঝাঁপ ফেলতে বাধ্য হবেন। মার্কিন দেশের এক বিপুল সংখ্যক মানুষের স্বাস্থ্যবিমা নেই এবং ওইদেশে চিকিৎসা এতটাই ব্যায়বহুল যে খরচের আতঙ্কে বহু মানুষ ডাক্তারের কাছে যান না এবং এখনও যেতে পারছেন না। এমনিতেই এই সঙ্কটের অনেক আগে থেকেই ওখানে অন্যান্য উন্নত দেশের তুলনায় মাথাপিছু অনেক কম চিকিৎসক এবং হাসপাতালের শয্যা ছিল। এখন গোদের ওপর বিষফোঁড়া। এই মহামারি কতজনকে গ্রাস করবে তা হলফ করে বলা যাছে না কারণ বহু মানুষ উপসর্গ দেখেও এখনও অবধি পরীক্ষা করাতে যাননি এবং তাঁরা সকলে পরীক্ষা করাতে চাইলে কী হবে বলা মুশকিল। কারণ মার্কিন দেশে সেই পরিকাঠামো নেই। জীবনযাপনের জন্য অতি প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যপরিষেবাকে মুনাফার আখড়ায় পরিণত করলে কী পরিণতি হতে পারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এখন অবশ্য বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়ে এবং এই বছরের শেষে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের কথা ভেবে অনেক ভূতের মুখেই রামনাম শোনা যাচ্ছে। অনেকেই আমতা আমতা করে বলছেন “আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থা অন্যান্য উন্নত দেশের মতো করতে হবে। সরকারি ক্ষেত্রের প্রসার ঘটাতে হবে।” কিন্তু এই সব অন্তঃসারশূন্য লোক ঠকানো কথায় এই বিপদ কতটা ঠেকানো যাবে তা নিয়ে বহু প্রশ্ন থেকেই যায়। আসলে মার্কিন স্বাস্থ্যব্যবস্থা এই মহামারির জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিল না।
বেসরকারিকরণ
আসলে স্বাস্থ্য নিয়ে বহুদিন ধরেই পৃথিবীজুড়ে যে ধরনের ছিনিমিনি খেলা চলছে এই মহামারি তা জনসমক্ষে নগ্নভাবে ফাঁস করে দিয়েছে। একদিকে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের জন্য সরকারি ব্যায় সঙ্কোচের অজুহাতে বিভিন্ন সরকার এবং বিশ্বব্যাঙ্ক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা ভাণ্ডার, এশীয় উন্নয়ন ব্যাঙ্ক, আফ্রিকান উন্নয়ন ব্যাঙ্ক, ইত্যাদি বহুপাক্ষিক প্রতিষ্ঠানগুলি, সারা বিশ্বে এমন অনেক নীতি কার্যকর করেছে যার চাপে জনস্বাস্থ্যব্যবস্থা শিকেয় উঠেছে। স্বাস্থ্যক্ষেত্রে কর্মী সঙ্কোচন, ঠিকা কর্মী নিয়োগ, হাসপাতালগুলির শয্যাসংখ্যা কমানো, স্থানীয় স্বাস্থ্যকেন্দ্র বন্ধ করা, ওষুধের দাম ও স্বাস্থ্যপরিষেবার ব্যয় বৃদ্ধি, পরিকাঠামো ও স্বাস্থ্যসরঞ্জাম খাতে কম বিনিয়োগ, বিভিন্ন স্বাস্থ্যক্ষেত্রের বেসরকারিকরণ, বড় বেসরকারি ওষুধ শিল্পের স্বার্থে চিকিত্সাশাস্ত্রের গবেষণা ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে সরকারি ক্ষেত্রের বিনিয়োগ হ্রাস, ইত্যাদি, ইত্যাদি। অন্যদিকে বলা হয়েছে যে সরকারি প্রতিষ্ঠান অদক্ষ এবং সেই কারণেই অলাভজনক। তথাকথিত এই অদক্ষ ব্যবস্থা কখনওই উপযুক্ত স্বাস্থ্যপরিষেবা দিতে পারবে না। আসলে দিনের পর দিন অর্থাভাব এবং অপ্রতুল বিনিয়োগের কারণে বহু দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা উপচে পড়া রোগীর ভারে ধুঁকছিল। সেই সুযোগ নিয়ে নয়া-উদারবাদের পাণ্ডারা এবং তাদের পেটোয়া গণমাধ্যমগুলি স্বাস্থ্য পরিষেবাকে মুনাফার মৃগয়াক্ষেত্র বানিয়ে তুলতে একসাথে ঝাঁপিয়ে পড়ে। শিক্ষা, বাসস্থান, খাদ্য, ইত্যাদি মানুষের জীবনযাপনের জন্য জরুরি অন্যান্য সব গুরুত্বপূর্ণ পরিষেবার মতন স্বাস্থ্য ক্ষেত্রটিকেও আলু-পটল কেনাবেচার স্তরে নামিয়ে আনতে লাভ-ক্ষতির গল্প ফাঁদে। পরিষেবার সংজ্ঞা বদলে তা তুলনা করা হয় অন্যান্য বাজারি কেনাবেচার সাথে। প্রচার করা হয় যে খোলাবাজার সর্বোত্তম কেননা বেসরকারি হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলি তাদের নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতার ফলে আমাদের দোরগোড়ায় উৎকৃষ্ট স্বাস্থ্যব্যবস্থা উপহার দেবে। আসলে এদের লক্ষ্য ছিল স্বাস্থ্যপরিষেবা ব্যবসায় পরিণত করা। ধনকুবের ওয়ারেন বুফের কোম্পানি বার্কশায়ার হ্যাথওয়ের অনুমান ২০১৮ বিশ্বজুড়ে স্বাস্থ্যপরিষেবা ব্যবসার বাজার ছিল ৮,৪৫২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার যার ২০১৪ সাল থেকে যৌগিক বার্ষিক প্রবৃদ্ধি হার (কম্পাউন্ডেড অ্যানুয়াল গ্রোথ রেট) ছিল ৭.৩% এবং আশা করা হচ্ছে যে ভবিষ্যতে এই হার বেড়ে দাঁড়াবে ৮.৯%। এর সুবাদে ২০২২ এই বাজার গিয়ে দাঁড়াবে ১১,৯০৯ বিলিয়ন বা ১১.৯ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার।
করোনা ভাইরাস এই ‘উৎকৃষ্ট’ স্বাস্থ্যব্যবসার স্বরূপ আমাদের সামনে তুলে ধরেছে। এবং মনে করিয়ে দিচ্ছে কীভাবে উন্নততর এবং আদর্শ পুঁজিবাদী প্রয়োগ হিসাবে গণ্য নয়া-উদারবাদ আমাদের জনপরিষেবাগুলিকে কার্যত লোপাট করে দিয়েছে। সমাজিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা ও স্বাস্থ্যপরিষেবাকে মুনাফা-চালিত ব্যবসায় পরিণত করেছে, নিম্নবিত্ত শ্রমজীবী মানুষের বিপন্নতার সুযোগ নিয়ে মুনাফা অর্জন করেছে, মানবিক সুরক্ষা ও সুস্বাস্থ্যের বদলে অনটন ও অনিশ্চয়তার পৃথিবী উপহার দিয়েছে এবং সর্বোপরি সামাজিক বৈষম্য বাড়িয়ে তুলেছে।
বেসরকারিকরণের সর্বোত্তম উদাহরণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হলেও পৃথিবীর সব দেশই কমবেশি একই লাইনে হেঁটেছে। ইউরোপে একই মাত্রায় বেসরকারিকরণ না হলেও ২০২০ সালের ইউরোপীয় স্বাস্থ্যব্যবস্থা গত ৩০ বছর বা এমন কি ১০ বছর আগের তুলনায় অনেক বেশি বেসরকারি যদিও দেশ বিশেষে কিছু কিছু ফারাক আছে। ইউরোপের সরকারি ক্ষেত্রের বেসরকারিকরণ প্রক্রিয়া, যার পোশাকি নাম নিউ পাবলিক ম্যানেজমেন্ট, প্রথমে ইংল্যান্ডে শুরু হলেও পর পর অন্যান্য দেশে ছড়িয়ে পড়ে। যদিও ফ্রান্স, জার্মানি ও স্পেন এখনও ব্যাতিক্রম হিসাবে টিকে আছে। নিউ পাবলিক ম্যানেজমেন্টের মূল বক্তব্য ছিল স্বাস্থ্যক্ষেত্রের বেসরকারিকরণ তাকে আরও দক্ষ করে তুলবে। এভাবেই ক্রমশ স্বাস্থ্যক্ষেত্রে সরকারি ব্যয় কমতে থাকে। ওইসিডি-র স্বাস্থ্য সম্পর্কিত তথ্য থেকে জানা যায় যে ১৯৯০ সাল থেকে বেশিরভাগ ইউরোপীয় দেশে স্বাস্থ্যপরিষেবা সংক্রান্ত সরকারি ব্যয় উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। পূর্ব ইউরোপের কয়েকটি দেশে এই হ্রাস ৩০ শতাংশেরও বেশি হয়েছে।
অনেকগুলি নেতিবাচক পরিণতির মধ্যে প্রথমেই বলতে হয় হাসপাতালের শয্যাসংখ্যা হ্রাস পাওয়া। মাথায় রাখতে রাখতে হবে ইউরোপীয় হাসপাতালগুলি প্রধানত সরকারি, এবং তারা নিখরচায় অত্যন্ত উন্নতমানের ও ব্যয়বহুল চিকিৎসা প্রদান করে এবং জনসংখ্যার বিশাল অংশ এই প্রতিষ্ঠানগুলির ওপর নির্ভরশীল। ব্যয় সঙ্কোচনের অন্যতম ব্যবস্থা হিসাবে হাসপাতালের শয্যাসংখ্যা ধাপে ধাপে হ্রাস করা হয়েছে। ১৯৯০ সাল থেকে পুরো ইউরোপ জুড়ে (ফিনল্যান্ড বাদে) নিরাময়কারী হাসপাতালে শয্যাসংখ্যা উল্লেখযোগ্য হ্রাস পেয়েছে। যে ইতালিতে এই মুহূর্তে মৃত্যুমিছিল চলছে এবং সেই সুবাদে আমরা শুনেছি যে সেদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা বিশ্বের দ্বিতীয় স্থানে! সেখানেও একই কাণ্ড ঘটেছে। ১৯৯০ সালে প্রতি হাজার জনপ্রতি ইতালিতে হাসপাতালের শয্যা সংখ্যা ছিল ৭ যা বর্তমানে ২.৬। এই তথ্যগুলি ঘাঁটলে বুঝতে অসুবিধা হয় না করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে কেন ভেঙে পড়েছে ইতালি ও অন্যান্য দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা।
১৯৯০-২০১৫ ইউরোপীয় দেশগুলিতে শয্যাসংখ্যা হ্রাস
এই রোগ তৃতীয় বিশ্বে ছড়িয়ে পড়লে মৃত্যুর সংখ্যা মাত্রা ছাড়িয়ে যাবে কারণ এই দুনিয়ার (কিউবা বাদে) ভঙ্গুর জনস্বাস্থ্যব্যবস্থা গত ৪০ বছর ধরে নয়া-উদারবাদী নীতির প্রকোপে, কার্যত, নামমাত্র টিকে আছে। এই দেশগুলিতে, বেসরকারি স্বাস্থ্যক্ষেত্রের মূল লক্ষ্য পরিষেবা সরবরাহ নয়, ব্যবসার মাধ্যমে মুনাফা বাড়ানো। আমাদের সমাজগুলিতে বেসরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থার জাল সুদূরবিস্তৃত যার বেশিরভাগই লাইসেন্সবিহীন, অনিয়ন্ত্রিত এবং কোনও রকমের নিয়মকানুনের দ্বারা পরিচালিত নয়। এবং এখানকার স্বাস্থ্যকর্মীদের বড় অংশই আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নয়।
তবে বহুজাতিক কর্পোরেশন সহ বড় বড় বেসরকারি সংস্থাগুলিও চুপ করে বসে নেই। তারা বাজারে মূলত উচ্চ-আয়ের অংশকে ধরার চেষ্টায় আছে। বেসরকারি ক্ষেত্রের পক্ষে নীতি পরিবর্তনের জন্য বিশ্বব্যাঙ্ক, আইএমএফ, এশীয় উন্নয়ন ব্যাঙ্ক, আফ্রিকা উন্নয়ন ব্যাঙ্ক থেকে শুরু করে ইউএসএইড (মার্কিন সরকারের অসামরিক বৈদেশিক সাহায্য প্রদানকারী সংস্থা), গেটস ফাউন্ডেশন, ইত্যাদি বহুদিন ধরে তদ্বির করছে, চাপ বাড়াচ্ছে, ঋণ বা অন্যান্য আর্থিক অনুদানের ক্ষেত্রে শর্ত হিসাবে রাখছে। একদিকে তারা স্বাস্থ্যক্ষেত্রে সরকারি ভর্তুকি কমানোর দাওয়াই দিচ্ছে আর অন্যদিকে বিশ্বব্যাঙ্কের একটি সংস্থা আন্তর্জাতিক ফাইন্যান্স কর্পোরেশন বহুদিন ধরেই বেসরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থার জন্য ভর্তুকির ওকালতি করছে। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ ব্রাজিল যেখানে বেসরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থা সরকারি কোষাগারের অর্থানুকূল্যে ফুলে ফেঁপে উঠেছে।
একটা উদাহরণ থেকেই স্পষ্ট বোঝা যাবে যে এ সবের পরিণাম বলা বাহুল্য সাধারণ মানুষের পক্ষে যায়নি। ফেব্রুয়ারি ২০১৮তে প্রকাশিত বেসরকারিকরণের ওপর বিশ্বব্যাঙ্কের একটি সমীক্ষা (The World Bank Research Observer, Volume 33, Issue 1, February 2018, Pages 65–102) স্বীকার করছে যে ৯৯টি দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার নিরীক্ষণ করে তারা বুঝতে পারছে যে সরকারি তত্ত্বাবধানে যক্ষ্মারোগের সংখ্যা কমে এলেও বেসরকারি ক্ষেত্রে অনুরূপ ফল মিলছে না। অন্যান্য বহু সমীক্ষা ও গবেষণা দেখায় যে স্বাস্থ্যক্ষেত্রের বেসরকারিকরণের ফলে এক বড় অংশের মানুষ স্বাস্থ্যব্যবস্থার বাইরে চলে যাচ্ছেন কারণ মৌলিক চিকিৎসা ও ওষুধপত্রের দাম এত বেড়ে যাচ্ছে যা তারা বহন করতে পারছেন না। এছাড়া আর অনেক উদাহরণ আছে যা বিশদে ব্যাখ্যা করতে গেলে পাতার পর পাতা ভরে যাবে।
কারও পৌষ মাস
করোনা ভাইরাসের প্রকোপ বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে যাওয়ার পর সারা বিশ্বে কার্যত শেয়ার বাজারে ধস নেমেছে। কিন্তু এই বিশ্বব্যাপী মহামারির মধ্যে একটি মাত্র শিল্পের শেয়ারের মূল্যের চোখে পড়ার মতো। ওষুধ শিল্পের শেয়ারের দাম কিন্তু হুহু করে বাড়ছে। ফ্রান্সের জিলো সায়েন্সেসের করোনা ভাইরাসের চিকিত্সার জন্য অ্যান্টিভাইরালের ক্লিনিকাল ট্রায়ালের খবর বাজারে আসা মাত্র ওই কোম্পানির শেয়ারের মূল্য ২০% বেড়ে যায়। আইএনও-৪৮০০ নামের একটি পরীক্ষামূলক ভ্যাকসিনের কথা ঘোষণার পরে ইনোভিও ফার্মাসিউটিক্যালসের শেয়ারের মূল্য ২০০% বেড়ে যায়। মাস্ক প্রস্তুতকারী আলফা প্রো টেক-এর ২৩২%, টেস্ট কিট প্রস্তুতকারী কো-ডায়াগনস্টিকসের শেয়ারের মূল্য ১,৩৭০% বেড়ে যায়। এই পড়তি বাজারে যেখানে অনেক বড় বড় রাঘববোয়াল তলিয়ে গেছে ওষুধ কোম্পানির শেয়ার নিয়ে এত উল্লাসের কারণ কী? তাহলে কি তারা এই মহামারির মধ্যে বিপুল বাণিজ্যিক লাভের সম্ভাবনা দেখছে? আর্থিক বাজারের বিশেষজ্ঞরা কি এই কারণেই বিনিয়োগকারীদের ফার্মা কোম্পানির শেয়ার কেনার পরামর্শ দিচ্ছেন?
এমনিতেই ওষুধ শিল্পে বিভিন্ন মার্জার বা একত্রীকরণ এবং মাঝারি ও ছোট সংস্থাগুলিকে কিনে নেওয়ার মাধ্যমে একচেটিয়া ব্যবসার ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। এছাড়া পেটেন্ট আইনের মাধ্যমে যথাসম্ভব প্রতিযোগিতার সম্ভাবনা কমিয়ে সংস্থাগুলির লক্ষ্য মুনাফার পাহাড় গড়া। ইত্যবসরে ফার্মাসিউটিক্যাল সংস্থাগুলির কাছে করোনা ভাইরাস হাতে চাঁদ পাওয়ার মতো। এই বিশ্বব্যাপী সঙ্কট তাদের বিক্রয় ও মুনাফা বিপুল বাড়িয়ে তুলবে এবং মহামারি যত খারাপ দিকে যাবে তাদের মুনাফা বৃদ্ধির সুযোগ তত বেশি হবে। খতিয়ে দেখলে বোঝা যাবে যে বড় কর্পোরেট ফার্মা কোম্পানির ছোঁয়াচে রোগের প্রতিরোধ নিয়ে গবেষণায় কোনও আগ্রহ নেই। ছয়ের দশক থেকেই করোনা ভাইরাস গোত্রের সন্ধান পাওয়া গেলেও আজ পর্যন্ত কোনও প্রতিষেধক আবিষ্কার হল না কেন? এমনকি সার্স বা মার্স বেশ কিছুদিন আগে ঘটে যাওয়ার পরেও তারা এ ব্যাপারে চুপ করে বসে ছিল কেন? একদিকে অর্থাভাবে সরকারি স্বাস্থ্য গবেষণা কেন্দ্রগুলি ধুকছে অন্যদিকে বড় ফার্মার আগ্রহ খুব কম বা কোনও আগ্রহ নেই বললেই চলে। তাদের পছন্দ রোগ নিরাময়ের জন্য আবিষ্কারে পয়সা ঢালা। আমরা যত বেশি অসুস্থ হব তারা তত বেশি মুনাফা করবে। আমরা সুস্থ থাকলে তারা যে অসুস্থতা বোধ করবে এ কথা বলাই বাহুল্য।