সন্তোষ পাল — নয়

মৃণাল চক্রবর্তী

 

পূর্ব প্রকাশিতের পর

দীপ্তি আর আমার চোখ মিলে গেল এক সঙ্গে। ও ঠিক সেরকম করে হাসল যেমন করে মনে হয় আমিও হাসলাম।

–তুমি তো খুব একা ইন্দ্রদা, তাহলে এমন ছটফট করো কেন পালিয়ে যাবার জন্যে?

খুব নিচু গলায় দীপ্তি বলল। আমাকে একটু চুপ করে থাকতে হবে এখন। নাহলে বুকের ভেতর গেজিং পাহাড়ের ঠান্ডা ঢুকে পড়বে। কুয়াশা হয়ে। তাছাড়া সত্যিই তো আমি জানি না কেন দু-তিন দিন পরেই, হাসি-গল্প-আড্ডার দু-তিন দিন পরে পরেই, ভেতরটা কেমন যেন ফেটে পড়ব, সব ভেঙে যাবে, রান, রান রান ফর গুড, করতে থাকে। তবে আমি অন্য কথা বললাম।

–আমার কোথাও কেউ নেই, কোচবিহারের গল্পটাও মিথ্যে। তবে ওরই কাছাকাছি কোথাও আমার তেইশ বছর বয়েসে একটা আশ্চর্য কোকিল ডেকেছিল। আজ পর্যন্ত আমি ওরকম ডাক আর শুনিনি। চৈত্রের দুপুর ছিল সেটা। অনেকগুলো শিমুল গাছ ছিল পাশাপাশি। শিমুলের আগুন জ্বলছিল। আর একটা কোকিল ডেকেছিল কোনও একটা গাছ থেকে। অমন ডুকরে কাঁদে না কোকিল। হয়ত আমার জন্যেই ডেকেছিল। অল্প গরম লাগছিল। শরীরের এখানে-ওখানে জমতে থাকা ঘামের ওপর দিয়ে নেশা ধরানো হাওয়া। আর একবার ওই ডাকটা শোনার জন্যেই এবার আমি উত্তরবঙ্গে এলাম।

দীপ্তি খুব মন দিয়ে আমার কথা শুনছিল।

–জানি অন্য কথা বললাম।
–আর তখন যে ওই পুরনো কালের মেলার কথা বলছিলে, সেখানে যেতে চাইছ কেন?
–এটা তোর দ্বিতীয় প্যাঁচের প্রশ্ন।
–তোমার কি মনে হচ্ছে ওখানে গেলে আর একবার সেই কোকিলের ডাকটা শুনতে পাবে?

এটা একটা খুব অন্য রকমের কথা বলল দীপ্তি। আমি মাথা নাড়ালাম, জানি না।

–কারা যেতে পারে ওই মেলায়?

দীপ্তি খুব আলতো গলায় বলল। নিশ্বাস পড়ার শব্দের মতো।

–আমি জানি না। তবে ওই মেলায় সব হারিয়ে যাওয়া মানুষেরা আসে।
–যারা যায়, তারা কি হারিয়ে যায়? একবার গিয়ে ফিরে আসতে পারে?

এবার দীপ্তি আমার দিকে তাকিয়ে স্পষ্ট গলায় জিগ্যেস করল।

 

এর কিছুক্ষণ পরে আমরা পাহাড়ি পথ ধরে পেলিং-এর দিকে যাচ্ছিলাম। গাড়ির ভেতরটা এখন চুপচাপ। ভুতো মদ খায়নি, কিন্তু অঘোরে ঘুমোচ্ছে, তেমন নাক ডাকার শব্দ নেই। আমি শুনেছি গভীর ঘুমে নাক ডাকে না। তাহলে ভুতো সম্ভবত ওর শান্তির ঘুম ঘুমোচ্ছে। মিতলি গান শুনছে বাবা-মার মাঝখানে বসে। দীপ্তি দূরে তাকিয়ে আছে। এবার আমি সামনে বসেছি।

টুরিস্টে ঠাসা গাড়ি যাচ্ছে আসছে। আমাদের ড্রাইভারকে বলে দেওয়া হয়েছে কারও কোনও তাড়া নেই। পেলিং থেকে আমরা ইয়াকসাম যাব।

পেলিং-এ আমরা দুই বন্ধু একটা ঝোপড়ায় ছিলাম। হেলিপ্যাডের পাশে তিনটে মাত্র ঝোপড়া। পেমিয়াংসিতে একটা হোটেল আছে কিন্তু সেখানে উঠতে ব্যথা ছিল। আমাদের সাধ্যে কুলোচ্ছিল না। ঝিরিং-এর সঙ্গে আমরা একই ঘরে থাকতাম। কয়েকজন বিদেশি টুরিস্ট ছিল আশপাশের ঝোপড়ায়। সেখানে এক সকালে আমি সরাসরি কাঞ্চনজঙ্ঘাকে দেখি। দেখতেই থাকি। একে একে বিদেশিরা বেরিয়ে আসে, ছবি তুলতে থাকে। এক যুবক হাত বাড়িয়ে সঙ্গিনীকে বারণ করে ছবি তুলতে। ছিক-ছিক শব্দটা থেমে যেতে চার পাশে আর একটাও শব্দ রইল না। মুখোমুখি আমি আর কাঞ্চনজঙ্ঘা। জয়দীপ ঘুম থেকে উঠে এসে বলল, বন্ধু, কী ঠান্ডা! এরপর ঝিরিং উঠে চা বসাল রান্নাঘরে। আমরা ওর পাশে গিয়ে গা সেঁকতে বসলাম।

এই সব ভাবতে ভাবতেই পেলিং পৌঁছে গেলাম। যা ভেবেছিলাম ঠিক তাই দেখলাম। অনন্ত পিকনিক চলছে। মোটা মোটা সোয়েটার জ্যাকেট মাথার টুপি এমনকি গ্লাভস পরে অগুন্তি মেয়ে-পুরুষ-কাচ্চাবাচ্চা চেঁচাচ্ছে। এদিক ওদিক দেখিয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘা খুঁজছে। কিন্তু সে মেঘের আড়ালে।

ভুতো গাড়ি থেকে নেমে আড়মোড়া ভাঙল। তারপর বলল, এ কী রে সালা! সার্কাস নাকি!

আমরা চার জন এদিক-ওদিক হাঁটলাম। সব দোকান খোলা, সব দোকানে ভিড়, সবাই খাচ্ছে, চা খাচ্ছে। আর গোটা দৃশ্যের ওপর পর্দা টেনে দিচ্ছে আগেকার সেই হেলিপ্যাডের জায়গায় গজিয়ে ওঠা আলিশান হোটেল। ওইখান দিয়ে আমরা সংগাচোলির দিকে উঠছিলাম। তখন ওখানে একটা হেলিপ্যাড ছিল, যেখানে কোনও হেলিকপ্টার নামত না।

চার দিক থেকে গাড়িওলারা চেঁচাচ্ছে, ইয়াকসাম, খেচিপেরি, দার্জিলিং, শিলিগুড়ি আর দলে দলে মানুষ বিভিন্ন গাড়িতে উঠে যাচ্ছে।

–সামনের দিকের গাড়িগুলো সব ইয়াকসামই যাচ্ছে। ওইদিকে রাস্তা।

আমি বললাম। সবাইয়ের মুখেই হতাশার জলছবি। কেউই যেতে রাজি হল না। ড্রাইভারও দুঃখ পেল আমাদের অনাগ্রহে। এই ঝলমলে সকালে তিনটে মানুষ তার হট স্পটগুলোকে পাত্তা দিল না। আমি তার মন রাখার জন্যে বললাম, ভুতোর দিকে তাকিয়ে, আসলে এখন ট্যুরিস্ট সিজন তো। খুব ভিড়।

–তুই কি এখান থেকেই চলে যেতে চাস?

ভুতো না-দেখা কাঞ্চনজঙ্ঘার দিকে তাকিয়ে বলল। আমার এই সময় কী করা উচিত ছিল বন্ধুরা? ওকে জড়িয়ে ধরা উচিত ছিল না? ওর অভিমানের পাথর ভেঙে দিয়ে বলা উচিত ছিল না, আমি যাব না রে? তারপর গলা জড়াজড়ি করে দুই বন্ধুর কাঁদা উচিত ছিল না? এত প্রেম আমি কোথা পাব নাথ, তোমারে হৃদয়ে রাখিতে? আমার ফেকলু জীবনে এত ভালবাসা আমি কোথায় পাব? কে পারে এমন করে মেঘের দিকে তাকিয়ে বলতে, তুই কি এখান থেকেই চলে যেতে চাস?

–না। এখান থেকে না। পরে। চল, ওকে আমরা বলি একটু ফাঁকা কোনও জায়গায় নিয়ে যেতে।

ভুতো মাথা নাড়ল, মানে হ্যাঁ।

কিন্তু ফাঁকা জায়গা কোথাও নেই। এমনকি আমরা অনেকটা নেমে রাভংলার পথে গিয়েও দেখলাম, রাশি রাশি গাড়ি আর মানুষ। যাচ্ছে বা আসছে। দীপ্তি পুরো সময় হুঁ হাঁ করে গেছে মিতলির সঙ্গে। এখন বলল—

–এদিকটায় না এলেই হত। তিনচুলে বা ওদিকে কোথাও যদি যেতাম। শুনেছি ওসব জায়গা এখন ফাঁকা।

–ভুল শুনেছ। ভুতো একটা সিগারেট ধরাল, ওসব জায়গাই এখন আগে ভর্তি হয়। আমি অনেক খোঁজখবর করে এসেছি। তাছাড়া অত নির্জন জায়গায় আমার ভয় করে।

ভুতো একদম সত্যি কথা বলছিল। আমাকেও একবার বলেছিল, ওর ফাঁকা জায়গা ভাল লাগে না। কিন্তু মিতলি শব্দ করে হেসে ভুতোর একটা হাত জড়িয়ে ধরল।

মেঘ কাটছে ধীরে ধীরে। এরপরেই আমরা কোনও একটা খাবার দোকানে ঢুকব। ভুতো আবার মদ খেতে আরম্ভ করবে। পুরনো গল্পটাই ফিরে আসবে কিন্তু তখন আমি থাকব না। আমার ভেতরে ভাটির টান বাড়ছে। নদীর জল সরসর করে সরে যাচ্ছে, পায়ের তলায় বহমান বালি। আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি এই ভাটিগাঙ বেয়েই আমি সন্তোষ পালের কাছে পৌঁছব। এটাই সঙ্কেত। উনি যেখানেই থাকুন ঠিক বুঝতে পারবেন আমি ডাকছি। কেউ একজন ডাকছে। সে হয়ত আমার চেয়ে কম বা বেশি ইন্দ্রজিৎ, যে এখন লেনিন সরণি পার হতে গিয়ে শুনছে অনুভব করছে ভাটির টান। নীল জামা আর খয়েরি প্যান্ট পরে থাকা সন্তোষ পালের কাছে চলে যাচ্ছে সেই বেদন।

আমি ঝিমোচ্ছিলাম ড্রাইভারের পাশে বসে। গাড়ি একটা বাঁক নিতেই একটু বেসামাল হয়ে মাথাটা গাড়ির দরজায় ঠুকে গেল। চশমা তুলতে তুলতে চার রকমের প্রতিক্রিয়া দেখলাম এবং শুনলাম: মিতলির হাসি, ড্রাইভারের অবুঝ চাউনি, ভুতোর গলায় ‘কীরে, ওরম করছিস কেন?’ আর দীপ্তির গলায়, ‘এ বাবা! তুমি পেছনে এসে বসো।’ এর মধ্যে ভুতোর কথায় আমি খচে গেলাম। ও কী বলতে চায়, আমি ইচ্ছে করে মাথা ঠুকেছি?

–আমি কি শখ করে ধাক্কা মেরেছি রে, কেলানে! রীতিমত ফ্যাঁস করে উঠলাম। মিতলি আবার হাসল।

–তোমার মুখটা যা দেখাচ্ছিল না, আঙ্কল!

–ওরকম দেখায়। তোর মাথা ঠুকে গেলে তোকেও ওরকম লাগবে। আমি রেগে যাবার নাটক করেই বললাম।

এইভাবে বাইরের আকাশে মেঘ কাটছিল আর আমার মনে বাড়ছিল সেই চোরাস্রোতের টান।

কোথায় যেন আমরা খেলাম। ও, এই জায়গাটা লেগশিপ। প্রথমে চিনতে পারিনি। আমিও বেশ খানিকটা মদ খেয়ে ফেললাম ভুতোর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। নিজেকে সাহস জোগাচ্ছিলাম। বেশ হাসাহাসির মধ্যে দিয়েই খাওয়া শেষ হল। আমরা যখন হোটেলে নামলাম তখন প্রায় তিনটে বাজে।

গাড়ি থেকে নামার সময় ভুতো ড্রাইভারকে বলল, আমাকে দেখিয়ে—

–একটু পরে এই স্যর চলে যাবেন। উনি যেখানে যেতে চান নিয়ে যেও। তারপর রেসর্টে ফিরে এসো। আমরা কাল সকালে নেমে যাব।

দীপ্তি আর মিতলি দুজনেই ভুতোর দিকে তাকিয়ে। ও একটুও মাতাল হয়নি, একটুও আবেগের চাপে পড়েনি।

–চল, দুজনে মিলে তোর জিনিসগুলো গুছিয়ে ফেলি।

আমার কাঁধে হালকা করে হাত রেখে বলল, চল।

 

(আবার আগামী সংখ্যায়)

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4596 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...