সংক্রমণের দিনরাত

সংক্রমণের দিনরাত | সর্বজিৎ সরকার

সর্বজিৎ সরকার

 

কিছু শুনতে পাচ্ছ নিরুপম?

না, চারপাশ এত নিস্তব্ধ, থমথম করছে। নিরুপম ভালো করে শোনার চেষ্টা করল। কোনও শব্দ নেই আশেপাশে।

জানলার সামনে একটু ফাঁকা জায়গা। পাশে একটা নতুন বিল্ডিং উঠছে। চারতলা সমান ইট আর সিমেন্টের গাঁথনির ফাঁকে ফাঁকে ছোট বড় খোপগুলো, যেন দাঁত নেই এমন এক একটা হাঁ মুখ তাদের, তার দিকে তাকিয়ে হাসে। মুখ ভ্যাংচায়। কোনওদিন তাদের জানলা হয়ে ওঠবার কথা ছিল, সব কিছু ঠিক থাকলে।

সব কিছু ঠিক থাকলে! কেন? সব কিছু ঠিক নেই নিরুপম?

ফাঁকা জায়গাটার পরেই এক চিলতে রাস্তা চোখে পড়ে। অন্যসময় হলে এই রাস্তায় সারাক্ষণ গাড়ি, বাইক, স্কুটার, সাইকেল, রিকশা, আর কিছু না হোক, দু চারটে লোক যেতে দেখা যায়। অথচ এখন? কিছু নেই। কেউ নেই। শুধু মাঝে মাঝে দু একটা পুলিশ ভ্যান কিম্বা জিপ মাইকে অ্যানাউন্স করতে করতে চলে যাচ্ছে। ঘরে থাকুন। খুব প্রয়োজন ছাড়া বাইরে বেরোবেন না। মাস্ক ব্যবহার করুন। দোকানে নিজে থেকে কিছুতে হাত দেবেন না। দূরত্ব বজায় রাখুন। আপনাদের সুস্থ রাখার জন্যেই এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। মেনে চলুন। বিশ্বব্যাপী এই সংক্রমণের বিরুদ্ধে আমরা লড়ছি, লড়ব। আমরা জয়ী হবই।

পুলিশ ভ্যান চলে গেলেই জায়গাটা আবার শুনশান, নিস্তব্ধ হয়ে যায়। পুরো এলাকা যেন দমবন্ধ করে আছে। শ্বাস নিতে ভয়। শ্বাস ছাড়তেও আতঙ্ক। তবু এ তো দিনের বেলায়! এখন তবু মাঝেমাঝেই পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে। আর রাতে? ঠিক যেই আলো পড়ে আসে, বাড়িগুলোর গায়ে লেগে থাকা ছায়া আরও জমাট বাঁধে, আর একটা বাড়ির ছায়া অন্য আর একটা ছায়ার মধ্যে মিশে যেতে শুরু করে, তখন? শুধু ছায়ায় ছায়া মিশে থাকা। কোথাও গাঢ়, কোথাও একটু হালকা। এমন খাদক অন্ধকার এ শহর কখনও দেখেনি।

দিনের বেলায়, শহর ধূসর নেই আর। চৈত্রদিন শেষ হয়ে আসছে। গাছে সবুজ আগেই এসেছে। আর এই কদিনে, নিরুপম, খেয়াল করেছে, রাস্তায় ধোঁয়া আর ধুলো না থাকায় সেইসব পাতাদের অনেক সহজ সবুজ বলে মনে হয়। নিস্তব্ধতার ঘেরাটোপে আটকে থাকা শহরের বিষবায়ু নেই। এই কথা গাছেরা জেনে গেছে। গাছের পাতারা জেনে গেছে। তারা জানে তাই, যেন পাখিরাও জেনে গেছে সব কথা। সকালের দিকে, আগে যা প্রায় শোনাই যেত না! এখন শোনা যায়। এক রকম নয়। অনেক ধরনের পাখির ডাক আজকাল শুনতে পায় সে। সে নয় শুধু। নিরুপম জানে, এত চড়াই, এত ডাহুক, এত শালিখের ডাক, আরও কত সব অজানা পাখির ডাক, বহুকাল শোনেনি এ শহর।

সেদিনই তো, কী আশ্চর্য, ঘরবন্দি সে, এই ছোটঘরের জানলায় দাঁড়িয়ে ছিল, হঠাৎ শোনে একটা কোকিল ডাকছে। কু কু করে সেই ডাক খুব ছোট ছোট শ্বাস ছাড়ার মত। তীরের কাছে এসে ছোট ঢেউ যেভাবে হালকা করে ভাঙে, অনেকটা সেরকম। আর যেই সে, ছোটঘর থেকে সামনের বড় ঘরটায় গেছে, অমনি শোনে একটানা স্বরে কোকিলের ডাক, দীর্ঘ শ্বাসে কুউউউ করে ডেকে উঠছে। ছোট ঘরের জানলার কোকিল আর সামনের ঘরের কোকিলটা কি একই ছিল? কে জানে! নিরুপমের মনে হয়েছিল সেদিন, একটু হলেও দিনের আলো পালটে যাচ্ছে যেন। আর, এক মুহূর্তের জন্যে হলেও, কিছুটা হালকা লাগছিল মনটা।

কিন্তু রাতের কথা আলাদা।

বাইরের আলো যত পড়ে আসে, ঘরের ভেতরের চেয়ার টেবিল বুকশেলফ খাট এমন কি ঐ কালচে সবুজ পেপারওয়েটকেও কেমন অচেনা, দানবের মত মনে হয়। যেন কোনও অমঙ্গল, কোনও অশুভর সংকেত নিয়ে আসছে তারা। দুদিন আগের ঘটনা, মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গিয়েছিল নিরুপমের। উঠে বাথরুমে যাচ্ছে, হঠাৎ চোখে পড়ল রান্নাঘরের দেয়ালে যে পেতলের ঘড়িটা টাঙানো ছিল সেটা পড়ে আছে মেঝেতে। ডায়ালের কাঁচটা কোনাকুনি তিন ভাগে ফেটে গেছে। ঘড়ির কাঁটা আটকে আছে রাত আড়াইটের ঘরে। কখন পড়ল! মেটালের ঘড়ি। আওয়াজে ঘুম ভাঙল না তার! চমকে গিয়েছিল সে রাতে, নিরুপম।

এরকমই ছোট ছোট সব ঘটনা ঘটছে ইদানিং। কেমন যেন অলুক্ষুণে ইঙ্গিত মনে হয় আজকাল। সারাক্ষণ দম আটকে আসে।

*

কিছু শুনতে পাচ্ছ নিরুপম? কে যেন আবার ফিসফিস করে বলে ওঠে তার কানের কাছে।

নিরুপম চমকে গিয়ে ডানদিক বাঁদিক তাকায়। কেউ কোথাও নেই আশেপাশে। সেই অর্ধনির্মিত বাড়িটার অসম্পূর্ণ  জানলার খোপগুলো ঠিক একইভাবে তার দিকে চেয়ে হাসছে, মুখ ভ্যাংচাচ্ছে। কোনওদিন তাদের জানলা হয়ে ওঠবার কথা ছিল, সব কিছু ঠিক থাকলে। ঘরের জানলা। এখনও ঘর হয়নি। জানলাও না। শুধু আকারটুকু পড়ে আছে।

কারা কথা বলছে? বিল্ডিং-এর গায়ে ওই না তৈরি হওয়া জানলার খোপগুলোই কী কথা বলছে তার সাথে? নিরুপমের মাথার ভেতরটা কেমন ঝাপসা হয়ে আসে। পরিষ্কার করে কিছু ভাবতে পারে না সে। না, কোনও শব্দ নেই তার কাছে যা দিয়ে সে এই সময়টাকে ধরে রাখতে পারে। না দিন, না রাত। কোনওটারই আর কোনও হিসেব রাখতে পারছে না সে। সব কেমন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে একটু একটু করে। নিজের মনেই মাথা নাড়ল নিরুপম। নেই! জাস্ট নেই। কী হারিয়ে যাচ্ছে তার? তাদের?

*

সকাল থেকে অনেক কাজ ছিল তার। ঘরে একাই সে তবু কাজ যেন হঠাৎ করেই অনেক বেড়ে গেছে তার। আর অদ্ভুত ব্যাপার, যা সে জীবনে করেনি, ভাবেইনি কখনো, এখন ঠিক সেইগুলোই সে ভাবছে। সকাল থেকে যা কিছু করছে প্রতিটা কাজের হিসেব রাখছে সে। যেন সেগুলো ঠিক নিত্যনৈমিত্তিক কাজ নেই আর। হেলাফেলার কাজ নয় কোনওটাই। যেন এই কাজগুলো ঠিকঠাক করার ওপরেই তার বাঁচা মরা নির্ভর করে আছে। একদিকে দিয়ে সেটা ভালোই হয়েছে অবশ্য। ঘরে বন্দি থাকাটা এক বিচ্ছিরি বিষাদ তৈরি করে। অবসাদগ্রস্ত করে মাঝে মাঝে। সেটাকে বাড়তে দেওয়াটা ঠিক নয়। সে তাই ঘুম থেকে উঠেই এক চিলতে বারান্দার ফুলের টবে জল দেয়। ফুল নেই যদিও একটাতেও। শেষ শীতে সব পাতাও ঝরে গেছে। ডাল ভাঙা। ফুল ধরেনি আর। শখ করেই কেনা হয়েছিল একদিন। নিয়মিত পরিচর্যা না পেতে পেতে মরেই গেছে এক সময়। এখন, এই থম মেরে থাকা দিনকালে, ঘরে আটকে থেকে সেই সব মরা গাছেই রোজ নিয়ম করে জল ঢালে সে। যদি আবার বাঁচে। যদি পাতা আসে আবার। যদি ফুল ধরে আবার কোনওদিন। আবার। কখনও।

জল দেওয়া শেষ করেই আগের দিনের বাসনগুলো মেজে নেয়। কোনও কোনও দিন রাতেই এসব করে নেয় সে। কিন্তু আজকাল কী যে হয়েছে। হয়ত এ বিল্ডিং-এর সব ফ্ল্যাটের লোকজন গৃহবন্দি বলেই, জল চলে যায় তাড়াতাড়ি। তখন সকালেই সব মাজা ধোয়া করা। তারপর ঘর ঝাঁট দেওয়া। যতটা সম্ভব মোছামুছি করা। বাসি জামাকাপড় কাচা। ফ্রিজে একসঙ্গে দু দিনের খাবার রাখা থাকে। সে সব বার করে দেখাটাও যেন এক কাজ। কোনটা ধরে রেখে খেতে হবে, কোনটা আগে, কোনটা পরে, কোনটা বা এখনই, এইসব হিসেব করাটাও যেন খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে এখন।

*

কেমন যেন স্লো মোশনের একটা সিনেমার দৃশ্যের ভেতর ঢুকে পড়েছি আমরা, তাই না নিরুপম? সেই অদৃশ্য কণ্ঠস্বর আবার কথা বলে ওঠে কানের পাশে। এতক্ষণে নিশ্চিত হয় নিরুপম। হ্যাঁ, ওই জানলার খোপগুলোই কথা বলছে তার সঙ্গে। আর কেউ হতেই পারে না! কিন্তু এরা কথা বলছে কেন? আর কী করেই বা বলছে?

এ কথার কোনও উত্তর দেয় না ওই চৌকো খোপগুলো। হিসহিস করে কেমন ভাবে হাসে। গা শিরিশির করে, বিশেষ করে রাতের দিকে, যখনই চোখ পড়েছে নিরুপমের, তখনই। ভেতরটা পুরো অন্ধকার। কেমন খাঁ খাঁ করা অন্ধকার। ভয় করে দেখলে।

কোনও দিন কী আর সম্পূর্ণ তৈরি হবে বাড়িটা?

হ্যাঁ। হবে। নিশ্চই হবে। এই একুশ দিন কেটে গেলেই আবার তো শুরু হবে বাড়ির কাজ। নিজেই নিজেকে প্রবোধ দেয় নিরুপম। চেষ্টা করে ভেতরের অস্থিরতাকে শান্ত করতে। কখনও পারে। কখনও পারে না।

*

স্লো মোশনের দৃশ্য! হ্যাঁ, কথাটা যেই বলুক খুব একটা ভুল বলেনি বোধহয়। নিরুপম ভাবে। একটা জায়গায় এসে পুরো দুনিয়াটাই হঠাৎ করে যেন আটকে গেছে এক জায়গায়। আগে এগোচ্ছে না। যেন কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই আর। মানুষের থেকে অনেক ক্ষমতাবান কিছু একটা যেন স্তব্ধ করে দিয়েছে সব।

রাতের দিকে দাঁড়িয়ে ছিল সে জানলায়। থম মেরে আছে বাইরেটা। আকাশ ঝকঝকে পরিষ্কার মাত্র এই কদিনেই। কটা দিন? মাত্র তো সাত দিন, তাতেই এই! চৈত্র শেষের আকাশে ছেঁড়া মেঘ ভাসছে। তার ফাঁকে আধভাঙা চাঁদ। নতুন বাড়িটার ইটের গাঁথনির গা বেয়ে চারতলা সমান ভারা বাঁধা। মেঘ আর চাঁদের যুগল এই রাতের মোহন আকাশে ভেসে ভেসে সেই ভারার বাঁশের ডগায় এসে থেমে আছে।

পৃথিবী সুস্থ থাকলে এই রাত্রির আকাশের আহ্বানে কত কবিতা, কত গান, কত যে প্রেমের চিঠি লেখা হয়ে যেত এতদিনে। কথাটা মনে হতেই ফিক করে হেসে ফেলল নিরুপম। তার মনে হল, হ্যাঁ, এখনও লেখাই যায়, বলাই যায় সে সব প্রেমের কথা, অনুপম আশার কথা, বলাই যায় এখনও। কিন্তু সে হবে বানানো কথা। ভয় আর আতঙ্ককে পাশ কাটানোর জন্যে বানিয়ে বানিয়ে নিজেকে আর অন্যকে স্তোকবাক্য বলা। ওতে কোনও সুরাহা হয় না শেষ অবধি। নিজেকে আর অন্যকে চোখ ঠারা যায় শুধু। আর সত্যি কি এটাই নয় যে, ভালো থাকার মিথ্যে বিজ্ঞাপন দিয়ে গেছে সে এত দিন। এতগুলো বছর। আর শুধু সে কেন, সে, তার আশেপাশের মানুষেরা, এই দুনিয়ার প্রত্যেক রাষ্ট্রপ্রধান আর তাদের প্রতিনিধিরা, এক কথায় মানুষের এই তথাকথিত সভ্যতা, এই কথাটাই কি বোঝাতে চায়নি নিজেদের, যে আমরা সকলে ভালো আছি, নিরাপদে আছি, উন্নতি আর অগ্রগতির সঠিক রাস্তায় আছি। আর আজ, যেন এক ঝটকায়, নিমেষের মধ্যে, তাদের এই দাম্ভিক আস্ফালন কেমন একটা ন্যালাখ্যাপার মত নড়বড়ে, দিশাহীন, ধ্বস্ত হয়ে পড়ল। আজ সমস্ত নিরাপত্তার ঘেরাটোপ হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ছে চারিদিকে। কেউ নেই, কেউ নেই যে পারে, এই অচেনা আতঙ্কের থেকে এই পৃথিবীর মানুষকে মুক্তি দিতে।

*

এত ভেবো না নিরুপম। সেই কণ্ঠস্বর আবার কথা বলে ওঠে। ঘুম আসছে না তোমার, তাই তো? তাহলে এসো, কয়েকটা ছবি দেখাই তোমায়।

ভুলে যাও বরং তারা তোমায় বলেছিল আরও দ্রুত চলতে। গতি বাড়াতে। আরও অনেক বেশি গতি বাড়াতে। গতি বাড়াও, গতি বাড়াও। গতি এত বাড়াও যেখানে নিজের ঘূর্ণন নিজেই তুমি টের পাবে না। এতটা বেশি সেই গতির তীব্রতা যেখানে তোমার চারপাশ আর তুমি নিজেও তোমার চোখের সামনে থেকে অদৃশ্য হয়ে যাবে একসময়। যেখানে তুমি নিজেই তোমার ঝাপসা হয়ে আসা ছবি। একটা ধূসর অ্যালবাম যেন। সময় ছুঁয়ে দিয়ে গেছে তোমায়। হলুদ আর ছোপছোপ খয়েরী পাতা পড়ে আছে পথে। তাতে কয়েকটা আঁচড়ের দাগ। হারিয়ে যাওয়া অক্ষরপথ। চির নৈঃশব্দের দেশ। স্মৃতি ছাড়া আর কোনও অবলম্বন নেই কারও কাছে।

এখন, এখানে, একটি জলের ফোঁটা জলের বুকে পড়ে। সেই জলবিন্দুর পতন ধ্বনি ক্রমাগত এই আঁধার বাতাসে অনুরণিত হওয়ার আগেই দ্বিতীয় তৃতীয় চতুর্থ এবং এভাবেই পরপর জলের বিন্দু নীচে পড়তে থাকে। একটির থেকে অন্যটির পতনের দূরত্ব, তাদের মধ্যবর্তী সময়সম্পর্ক যেন মাপা। নির্দিষ্ট। আর যেহেতু চারপাশ সম্পূর্ণ নিস্তব্ধতায় ছেয়ে আছে, তাই এই দৃশ্যে সেই পতনধ্বনি একটানা, কিছুটা বা একঘেয়ে এক সুর তোলে।

পায়ের নীচে জল, কাদা, জায়গায় জায়গায় ভাঙাচোরা গর্ত। চারপাশটা একবার তাকিয়ে দেখল নিরুপম। আলো অন্ধকারের ভিতর মনে হল কয়েকটা খিলান যেন দাঁড়িয়ে আছে। তাদের ওপারে কী আছে দেখা যাচ্ছে না স্পষ্ট। অসচ্ছ কুয়াশার মোড়ক যেন ঢেকে আছে তাদের। আর তাকেও। মাঝে মাঝে কোথা থেকে ধোঁয়া উঠে এসে বাতাসে মিলিয়ে যাচ্ছে ফের। জল পড়ার শব্দ। একটা ক্লান্তিকর পুনরাবৃত্তি। একটানা, একঘেয়ে, একটা ছন্দ। নিমেষে তার মনে হল, এও একটা সুর। একটা তাল। কিন্তু কী ভাবে যেন বেঁধে ফেলেছে নিরুপমকে! প্রবল এক নিগড়। যেন হাত পা বাঁধা। পড়ে আছে সে এক জায়াগায়। চাইলেও বেরোতে পারছে না সেখান থেকে।

আচ্ছা নিরুপম, স্টকার-এর এই দৃশ্যটির কথা মনে পড়ছে তোমার? সেই যেখানে স্টকার আর তার দুই সঙ্গী, লেখক আর প্রফেসর, ট্রলিতে বসে পরিত্যক্ত রেল লাইনের ওপর দিয়ে সেই রহস্যময় ‘জোন’-এর দিকে এগোচ্ছেন। দুপাশে ভাঙাচোরা রেল ইয়ার্ড সরে সরে যাচ্ছে। চারপাশে পুরনো মেশিনের স্তুপ। জং ধরা, ক্ষয়ে যাওয়া। পুরো পর্দা জুড়ে শুধু এই তিনজনের মুখ। এক একবার এক একজনের প্রতিক্রিয়া ধরা পড়ছে। প্রত্যেকের মুখে এক অজানা আশঙ্কা। ভয়। উৎকণ্ঠা।

লেখক তাকিয়ে আছেন পিছনের দিকে। প্রফেসর একবার সামনে দেখছেন, একবার পিছনে। স্টকার, তো, কিন্তু সরাসরি তাকিয়ে আছে সামনের দিকে। যেন সম্মোহিত। ওই অজানা জোন তাকে কোনও জাদুবলে যেন তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে সামনের দিকে। লোকে বলে সেখানে পৌঁছলে সব আকাঙ্খা সফল হয়। লোকে এও বলে যে সেখান থেকে কেউ ফিরে আসে না। বিপন্নতার এই স্বভূমি তাকে টানছে। তাকে আর তার দুই সঙ্গীকে। তাদের প্রত্যেকের আসার কারণ আলাদা। ভিন্ন তাদের চাওয়া। তবু তারা সকলেই নিজেদের সব কিছুকে বাজি রেখেছে শুধু এই বিপজ্জনক ‘জোনে’ যাবে বলে।

নিরুপম বুঝতে পারে না হঠাৎ তারকোভস্কির সিনেমার কথা এখানে ঢুকে পড়ল কী করে!

কণ্ঠস্বর থামে না। সেই অদ্ভুত ফ্যাঁসা স্বরে কথা বলতেই থাকে। এই যে তিনজন মানুষ, এরা প্রত্যেকেই কিন্তু আলাদাভাবে ভাবছে। বুঝলে নিরুপম। লেখক হয়ত ভাবছেন তার ফেলে আসা জীবন, তার অতীত, তার সামাজিক অস্তিত্বের কথা। প্রফেসর হয়ত ওই ফেলে আসা পৃথিবী আর অনাগত দেশের মাঝে দ্বিধাগ্রস্ত। স্টকার হয়ত কিছুই ভাবছে না। তার বিপর্যস্ত সংসার আর পরিবারের কথা কিছুই মনে করতে পারছে না। অনেকটা তোমার মতোই। সে শুধু সামনের দিকে চেয়ে থাকে।

তাদের মুখের পাশ দিয়ে দুপাশের পরিত্যক্ত রেল ইয়ার্ড শুধু সরে সরে যায়।

এই অবধি, সেই কণ্ঠস্বর যতক্ষণ কথা বলছিল, নিরুপম আজ রাতে, চারপাশের দম আটকানো স্তব্ধতার মধ্যে, নিজেকে দেখতে পাচ্ছিল।

হঠাৎ সেই স্বর চুপ করে যায়। তারপর বলে, জানো, বছর খানেক আগে একটা লোক, সে কিছুটা আধখ্যাপা টাইপ, এমনিতে সেলসম্যানের কাজ করেছে সারা জীবন, ওদিকে আবার লেখালেখিও করে, সে একটা লেখা লিখেছিল এই সিনেমাটা নিয়ে। আচ্ছা দাঁড়াও, তোমাকে পড়ে শোনাই সেই লেখাটা থেকে কিছুটা জায়গা। লোকটা লিখেছিল—

“ওই দৃশ্যে, প্রত্যেকের মুখের ওপর ক্যামেরা ক্লোজ করে থাকে বলে, মনে হয় যেন মুখগুলি স্থির হয়ে আছে। আর পিছনের দৃশ্যপট গতিশীল। যেন চলছে। যেন সময়। সাথে চলে, পিছনে সরে যায়। কে কাকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে, কে কাকে ছেড়ে যাচ্ছে বোঝা যায় না। সময় আমাদের ছেড়ে যাচ্ছে? না কি, আমরা সময়কে? আর এই পুরো ভ্রমণপথে একটাই রং লেগে থাকে। সে রং জীর্ণতার। ক্ষয়ের। নষ্ট হয়ে মরচে ধরে যাওয়া লোহার রং। সে রং সিপিয়া।

এক পরিচিত ভুবন ছেড়ে অন্য এক অচেনা বিপজ্জনক ভুবনে চলে যাওয়া। এক সময়কে অতিক্রম করে অন্য এক সময়ে পাড়ি দেওয়া। এক চেনা জীবনকে ফেলে রেখে অন্য এক কুহকী জীবনের টানে এগিয়ে চলা। কোনটা বাস্তব। কোনটাই বা বিভ্রম। কোনটা সত্যি। আর কোনটাই বা মিথ্যা, আমরা কেউ জানি না। আমাদের কিছু নেই, শুধু এই যাত্রাটুকু আছে। শুধু এই চলাটুকুই যা সত্য। বিপন্ন, পতনশীল, জুয়াড়ির সত্য।

আর ঠিক এখনই, দু পকেটে দুই হাত রেখে, এক মাথা এলোমেলো চুল ঝাঁকিয়ে, তারকোভস্কি বলেন,

‘হ্যাঁ, এ কথা সত্যি যে জুডাস তাঁকে বিক্রি করে দিয়েছিলেন।

কিন্তু কে কিনেছিল তাঁকে?

জনগণ। হ্যাঁ, জনগণ। কিন্তু জনগণ তো সরল, বোধহীন। ভুল করে, হ্যাঁ ভুল করে, কিন্তু না জেনে, না বুঝেই।

আর যারা এই বেচাকেনায় মদত দিয়েছিল, সেইসব স্ক্রাইব, সেই ফারিসীস যারা, তারা কিন্তু শিক্ষিত, জ্ঞানী, প্রবঞ্চক। তারা জানত কীভাবে লোককে ঠকিয়ে কীভাবে ক্ষমতা করায়ত্ত করতে হয়।

তাহলে…

তাহলে এটা তো সব সময়েই সম্ভব যে, কেউ না কেউ, শিক্ষিত, বিদ্বান, জ্ঞানী, ক্ষমতাবান কেউ, আমাদের যে কোনও সময়ে বেচে দিতেই পারে।

তাহলে আমরা যারা বুঝি না, সময়ে সময়ে ভুল করি, সরল মনে বিশ্বাস করি, বিপথে যাই, কী করব আমরা?

নিজেদের ক্রুশ আমরা নিজেরাই বহন করব। সব হারিয়ে। সব ছেড়ে। দিশাহারা না হয়ে। নীরবে। শুধু এ কথা বলার জন্য যে, অন্তত এই শক্তিটুকু যেন না হারায় আমাদের।’”

রাত বাড়ে। নিরুপম আচ্ছন্নের মত এতক্ষণ শুনছিল এসব কথা। এমনিতেই তার ঘুম আসে না ওষুধ না খেলে। এখন এই অন্ধকার দিনে আরও যেন ঘুম চলে গেছে তার। তার মধ্যে এইসব কথা, ভালো লাগে না তার। অসহায় লাগে আরও।

মনে হয় লোকটা ঠিকই লিখেছিল। অদৃশ্য কণ্ঠস্বর বলে। কথাটা কী জানো নিরুপম, আসলে ঘর খুঁজছিল ওরাও।

এবারে খটকা লাগে নিরুপমের। সে অস্ফুটে বলে, ওরা, মানে কারা?

এই যে যাদের ভয়ে তোমাদের লুকিয়ে থাকতে হচ্ছে। জানলার ফাঁকা খোপ বলে নিরুপমকে। এই তো ধরো না, যেদিন তোমাদের প্রধানমন্ত্রী অ্যানাউন্স করলেন আগামী একুশ দিন সকলে ঘরে থাকুন, বাইরে কেউ বেরোবেন না। ঠিকই করেছিলেন যদিও কারণ ওরা এসে যাওয়ার ফলে তোমাদের আর পালানোর রাস্তা ছিল না কোনও। কিন্তু তার ফলে কী হল তোমাদের দেশে? লাখো লাখো লোক রাস্তায় বেরিয়ে পড়ল। ঘরে ফিরবে বলে। যেখানে তারা থাকত এতদিন সেটা তো তাদের ঘর ছিল না, ছিল আস্তানা। নিজেদের ঘর ছেড়ে বহুদূরে তোমাদের শহরগুলোতে আস্তানা ছিল তাদের। দিন রাত খাটলে তবে দুমুঠো খাবার আর থাকার জায়গা পেত তারা। কাজের জায়গা নেই, খাবারও নেই, রাস্তায় নামা ছাড়া গতি কী বলো?

কী উত্তর দেবে ভেবে পেল না নিরুপম। আমতা আমতা করে বলবার চেষ্টা করল, কিন্তু এরা তো তারা নয়।

জানলা এবার হা হা করে হেসে উঠল। না, এরা তারা নয়। আবার এরাই তারা। দুটোই সত্যি। তোমাদের নিরাপত্তার ঘেরাটোপের বাইরে যারা যারা আছে, যারা যারা ছিল এতদিন, যাদের ঘর না পোড়ালে তোমাদের বাড়ি শহর কলকারখানা মার্কেট কিছুই তৈরি হবে না, তাদের সংক্রমণের থেকে রেহাই পেতে একদিন না একদিন তো পালাতেই হত তোমাদের। না হয় আজই হল। এভাবেই হল। আর একটা কথা কী জানো নিরুপম, এরা না এসে পড়লে এভাবে, তোমাদের সভ্যতার সমীকরণগুলো পাল্টাত না হয়তো। কিন্তু তার ফলে মরে যেত এই গ্রহটা। এখন আর কী হবে জানি না। কিন্তু এই গ্রহটা হয়ত বেঁচে গেল এ যাত্রায়।

নিরুপম জানলা দিয়ে বাইরের আকাশটা দেখতে চেষ্টা করল। এ শহরের আকাশে সপ্তর্ষিমণ্ডল, এত উজ্জ্বল, স্পষ্ট, আলোকিত হয়ে আছে, জীবনে এই প্রথম দেখতে পেল সে।

 

 

 

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4648 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...