হিশাম বুস্তানি
অনুবাদ: অমর মিত্র
হিশাম বুস্তানির জন্ম ১৯৭৫ সালে। জর্ডনের কবি এবং ছোটগল্পের শিল্পী। তিনি সামাজিক আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছেন অনেক ক্ষেত্রে। আরবি ভাষায় লেখেন। ওই দেশের শ্রেষ্ঠ পুরস্কারে ভূষিত। এই গল্পটি ইংরেজি থেকে অনূদিত। তাঁর কবিতা এবং গল্প বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ হয়েছে। বাংলায় এই অনুবাদ দ্বিতীয়। তাঁর সঙ্গে পরিচয় ও বন্ধুতা হয়েছিল কাজাখস্থানে এশীয় লেখক সম্মেলনে। তাঁর এই ক্ষুদ্র গল্পটিতে প্রতিষ্ঠান এবং লেখকের সম্পর্ক, এক ভয়ানক সঙ্কট ফুটে উঠেছে। ইংরেজিতে গল্পটি কোয়ান্টাম লিপ নামে প্রকাশিত। বাংলায় নামটি অনুবাদকের।
জায়গা বদল হয়ে গিয়েছিল।
আমি আমদের সেই সেই প্রাচীন শহরের চেনা প্রতিবেশীদের ভিতর আর ছিলাম না। সেই ধ্বংস হয়ে আসা বাড়ি, সেই ভাঙাচোরা দেওয়াল, সেই প্রায় প্রত্নযুগের ভারি সিলিং পাখা যা কিনা কখনও কখনও সামান্য বাতাস দিয়ে ধুলো ওড়াতে থাকে, আমি সেখানে নেই। সেই একজনেরও বসার উপযোগী নয় এমন মরচে পড়া চেয়ারে বসে আকাশকুসুম স্বপ্ন দেখার জায়গায় নেই আমি।
জায়গা বদল হয়ে নতুন প্রতিবেশীর দুয়ারে গেছে বলা যায়। একটি গল্পের বদলে এখন দুটি গল্প বলতে হবে। জায়গাটিতে একটি বাংলোবাড়ি, বাগান আছে সামনের দিকে। একটি সুইমিং পুল আছে পিছনে। এ ব্যতীত একটি নিরাপত্তারক্ষীর গৃহ, লাল টালির ছাদ এবং বাতানুকুল ব্যবস্থা। এর সঙ্গে সিন্দুকভরা স্বপ্ন।
তার লেখক বন্ধুরা তাকে সেই বাংলো ভিলায় ডেকেছিল, তারা বলেছিল, “এসো, এই আস্তানা সুলতানের নিঃশর্ত উপহার।” সুতরাং সে গিয়েছিল লেখক বন্ধুর কাছে।
***
যখন সে কাচের দরজা ঠেলে তার মাথা ভিতরে প্রবেশ করাল, ঠান্ডা বাতাস এসে ঝাপটা মারল বিন্দু বিন্দু ঘামে ভরা কপালে। একটি বড় খোলা জায়গা এসে পড়েছে সে। জায়গাটি প্রায় শূন্য, শুধু একটি দোলনা সিলিং থেকে ঝুলছিল। দোলনায় আবছা হয়ে বসে থাকা একটি কালোছায়া চোখে পড়ছিল। তার এক হাতে একটি ইলেক্ট্রিক করাত, অন্য হাতে কাগজের বান্ডিল।
সেখানে কসাইয়ের হুক থেকে বিভিন্ন আকারের মুণ্ডহীন ভেড়ার দেহ ঝুলতে দেখল সে। ঘরের দেওয়াল ছিল শাদা, তার গায়ে লাল ছিটে।
কালোছায়া আগন্তুকের লক্ষ্য হয়ে উঠল।
“আমি ওর মাথায় ল্যান্ড মাইন দেখতে পাচ্ছি।” এক শবদেহ বলল।
“আমি দেখতে পাচ্ছি পেনসিল, ছবি এবং প্রশ্নমালা।” আর এক দেহ বলল।
“আমি দেখতে পাচ্ছি মুণ্ডহীন দেহ কসাইয়ের হুক থেকে তার মাথার ভিতরে ঝুলে আছে।” তৃতীয়জন বলল কারণ লেজ উঁচুতে তোলা সমস্ত দেহই উপর থেকে দুলছিল। দেওয়াল রক্তের ছিটেয় ভরে উঠেছিল।
কালোছায়াটি আগন্তুকের কাছে ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠছিল।
“একজনের জন্য একটি ছোট, আঁটোসাটো ফ্রেম দরকার, যাতে তার মাথাটি অনেক বড় দেখায়।’’ বলল একটি শবদেহ।
“ওই যে মাথা, ওর মুখে একটি সোনার চামচ আছে, আমাদের নিজেদের সব বুঝে নিতে হবে।” অন্য শবদেহ বলল।
“ওই মাথাটি এক ভঙ্গি সর্বস্ব ব্যক্তির, এক কামুক, মেধাবী ব্যক্তির।” তৃতীয়জন বলল। লেজ উঁচুতে তোলা সমস্ত দেহই উপর থেকে দুলছিল। দেওয়াল রক্তের ছিটেয় ভরে গেছে।
কালোছায়া তার ইলেকট্রিক করাত ধারালো করতে থাকে কাগজের বান্ডিলে ঘষে ঘষে। পাতাগুলিকে করাত দিয়ে ঘা মারছিল কালোছায়া। দেওয়ালের লাল ছিটে তখন যেন ঘুরতে থাকে। তার ফলে একটি হাতুড়ি ও একটি কাস্তে জেগে উঠে একত্র হয়ে যায়, আবার আলাদা হয়ে যেতে থাকে। না। এইটি এক পঞ্চমুখী তারা, অথবা এটি হতে পারে, বিশেষভাবে আঁকা তীরের মতো জিম (আরবি বর্ণমালা) এবং মানচিত্র[1]… এইটি কি এক জয়তিলক? সূর্য? কৃষক? শ্রমিক? ছাত্র? রঙের টান থেকে তৈরি হওয়া বিভিন্ন নকশা গড়িয়ে গিয়ে ঘুরছিল। ঘুরতে ঘুরতে ঘরের একটি কোণে চুঁইয়ে পড়ে এক নদীর জন্ম দিয়েছিল। সেই নদী বয়ে যাচ্ছিল ঘরের মেঝে দিয়ে পিছনের দরজার দিকে। লাল নদী গিয়ে পড়েছিল সুইমিং পুলে।
কালোছায়া তার ইলেকট্রিক করাত ধারাল করতে থাকে কাগজের বান্ডিলে ঘষে ঘষে। কাগজে ঘা মেরে মেরে। দেওয়ালের লাল ছিটে তখন ঘুরতে থাকে। “এসো, দীক্ষিত হও।” কাচের দরজা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দেওয়া ব্যক্তিকে সেই মসীকৃষ্ণ ছায়া বলল। “এসো, এখানেই আরোগ্য” শবদেহ দুলতে দুলতে বলল। আরও রক্ত ছিটকে যেতে থাকে দেওয়ালে। “এসো।”
***
[মনের ভিতরের ঘূর্ণী]
সাঁতারের জলাশয়ের স্বচ্ছ জল এখন ঈষৎ লাল কারণ রক্তের নদী সেখানে এসে মিশেছিল। আগুন জ্বালানো হল নিচে, ভৃত্যরা জলাশয়ের প্রান্তে দাঁড়িয়েছিল। লাঠি দিয়ে জল নাড়ছিল যতক্ষণ না থকথকে, কর্দমাক্ত হয়ে ওঠে। তারপর তা ঠান্ডা করা হল এবং পর পর কাগজের প্লেটে তা ভাগ করে দেওয়া হল। এ কথা বলার যে কাগজে প্লেট তৈরি করা হয়েছে সেই কাগজ এক সময় বইয়ের পৃষ্ঠা ছিল। অপরাহ্নবেলায়, শবদেহরা সাঁতারের পুলের পাশে পাতা টেবিল চেয়ারে এসে ক্রিম এবং স্ট্রবেরি মিশিয়ে সেই হিমেল মণ্ড খেতে বসল।
[দরজার ভিতর দিয়ে যে মাথাটি ভিতরে প্রবেশ করেছিল তার ভিতরে কী মন্থন হচ্ছিল।]
তুমি শুধুমাত্র নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করছিলে। তোমার ভিতরের অসম্ভব সহ্যশক্তি বিস্ফোরিত হয়ে অপভাষা বেরিয়ে আসছিল। এক অস্ফুট আর্তনাদের ভিতর থেকে শব্দরা ছড়িয়ে পড়ছিল। একটি বালক ব্যালকনি থেকে নিচে পড়ে গেলে যেমন হয়, অনেকটা তেমন আর্তনাদ। শব্দগুলি যেন একটি শব্দার্থ অভিধানের উপর ঝরে পড়ছিল। এর ভিতরে উল্লেখ্য, প্রায় বৈপ্লবিক ঘটনা এই যে মিথ্যাবাদী লোকটি এসে ঘুরতে ঘুরতে থুতু ফেলতে ফেলতে বলল, “ওকে একটা চেয়ার দাও।” হ্যাঁ, সুলতান বলল। চেয়ার, টিসু পেপার ইত্যাদি এসে গেল যা দিয়ে সে তার গুহ্যদ্বার মুছতে পারবে মলত্যাগের পর।
তুমি কে? তুমি কী? জাঁকজমকে ভরা দেহের ভিতরে থাকা একটি দানব দেখতে পাচ্ছি?
মুণ্ডচ্ছেদ করা ভেড়াগুলির নৈঃশব্দ সুলতানের সিংহাসন ঘিরে থাকে।
***
বাইরের দরজায় একটি বড় আয়না দেখল সে যখন ঐ জায়গা ত্যাগ করে আসছিল। আয়নায় সে দেখল সে আগের মতোই আছে। বদলে যায়নি। তার পিছনের সেই গৃহ ক্রমশ সুলতানের প্রাসাদে পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছিল।
সে আয়নায় থুতু ছিটাতে লাগল যতক্ষণ না তার মুখের ভিতরটা শুকিয়ে যায়। “আমি কীরকম গর্দভ।”
সে আয়নায় ঘুষি মারল, তার হাত আয়না ভেদ করে গেল। সে আয়নায় লাথি মারল। তার পা অন্যদিক দিয়ে বেরিয়ে গেল। সে তার মাথা আয়নায় রেখে আয়না ভেদ করে বেরিয়ে এল। সে তারপর যখন ঘুরে তাকায়, পরিবর্তন সম্পূর্ণ হয়ে গেছে। তার সামনে তখন সুলতানের প্রাসাদের সোনালি ফটক, প্রহরীরা এবং লুকানো ক্যামেরা। সে এদিক ওদিক খুঁজে একটি পাথরের টুকরো পায়, সেটি আয়নার কাচে ছুঁড়ে মারে। আয়না চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায়। সে ঘুরে ছুটে পালিয়ে যেতে থাকে। পালানো খুব কঠিন ছিল। কিন্তু সে পারে। সে দেখতে পায় সে তার পুরনো প্রতিবেশীদের কাছে এসে গেছে, যেখানে ছোট ছোট ছেলেরা ফুটবল খেলছে, পুরনো ফুটবল পায়ে নিয়ে ছুটছে। ব্যালকনিতে কাচা জামাকাপড় ঝুলছিল।
সে হাসল, মাথা দোলাতে দোলাতে তার নিজের বাড়ির পথে চলল। সে হাঁটছিল ধীরে ধীরে।
[1] আরবি বর্ণ জিম এবং তীর চিহ্নিত লম্বা মানচিত্র মিলিয়ে প্যালেস্টাইন লিবারেশন ফ্রন্টের লোগো। আরবি ভাষার বর্ণমালা জিম প্যালেস্টাইন লিবারেশন ফ্রন্ট গ্রুপের নামের প্রথম বর্ণ। মানচিত্রটি প্যালেস্টাইনের। তীর চিহ্ন হল ফিরে পাওয়ার অধিকার। এই নকশা তৈরি করেছিলেন প্যালেস্তাইনের লেখক এবং চিত্রকর, ঘাসান কানাফানি যাঁকে ১৯৭২ সালে ইজরায়েল খুন করে বেইরুট শহরে। — অনুবাদক