সঙ্কটকাল — তৃতীয় বর্ষ, দ্বাদশতম যাত্রা

স্টেশন মাস্টার

 

চার নম্বর প্ল্যাটফর্মের এপ্রিল সংখ্যার সম্পাদকীয় প্রস্তুত করিতে-করিতেই সংবাদ পাইতেছি, সারা বিশ্বে করোনাভাইরাসের আক্রমণে মৃতের সংখ্যা ৫০ হাজার ছাড়াইয়াছে। মারণ ভাইরাস চিনের পর প্রথমে ইউরোপ, ও তাহার পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তাহার থাবা বসাইয়াছে – ইতালি, স্পেন, ফ্রান্স ও ব্রিটেনে মৃত্যুমিছিল অব্যাহত থাকিতে-থাকিতেই মার্কিনদেশে আক্রান্তের সংখ্যা দুই লক্ষাধিক, মৃতের সংখ্যা পাঁচ সহস্রের অধিক। ভারতের পরিস্থিতি, অন্তত এখনও, তুলনায় ভাল – আক্রান্তের সংখ্যা গত একমাসের মধ্যে দুই সহস্র অতিক্রম করিলেও (৩ মার্চ দেশে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল মাত্র তিন) মৃতের সংখ্যা অনধিক ষাট – যদিও চিকিৎসাবিদ ও বিশেষজ্ঞগণ সতর্ক করিতেছেন, গতিক সুবিধার নহে, ভারতের মতো জনবহুল দেশে আক্রান্তের সংখ্যা বহুগুণ বাড়িতে পারে – দেশের মোট জনসংখ্যার মাত্র পাঁচ শতাংশও যদি আক্রান্ত হয়েন তবে সে সংখ্যা দাঁড়াইবে প্রায় সাড়ে ছয় কোটি, আর আক্রান্তের দুই শতাংশও যদি মারা পড়েন তাহা হইলে মৃতের সংখ্যা পঁহুছিবে ১৩ লক্ষের কাছাকাছি।

উদ্বেগ নিতান্ত অমূলক নহে। তাহার প্রথম ও প্রধান কারণটি হইল, ভাইরাসঘটিত এই ব্যাধিটির মারণক্ষমতা সার্স, মার্স  বা ইবোলা-র ন্যায় প্রচণ্ড না-হইলেও সংক্রাম্যতা বহুগুণ বেশি – অতি অল্প সময়ে তাহা বহু মানুষের মধ্যে ছড়াইয়া পড়িতে পারে। ইহার অর্থ অতি পরিষ্কার – অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে বিপুলসংখ্যক আক্রান্তকে সেবা করিতে গিয়া চিকিৎসা-পরিকাঠামোর উপর চাপ প্রবলতর হইয়া উঠে, এবং সে চাপ সামাল দিতে না-পারিয়া চিকিৎসাব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভাঙিয়া পড়ে – গত কয়েক সপ্তাহে ঠিক যে অভিজ্ঞতার সাক্ষী হইয়াছে ইতালি, স্পেন ও ফ্রান্স। পরিস্থিতি এমনই গুরুতর হইয়া উঠিয়াছে যে, মার্কিন রাষ্ট্রপতি শ্রী ট্রাম্পকেও তাঁহার প্রারম্ভিক অহমিকা ত্যাগ করিয়া বন্ধু দেশগুলির নিকট ভেন্টিলেটর ও অন্যান্য চিকিৎসা-সামগ্রীর জন্য জোড়হস্তে দরবার করিতে হইয়াছে।

ভারতকে লইয়া সমধিক দুশ্চিন্তা ঠিক এই জায়গাটিতেই। একদিকে অপ্রতুল চিকিৎসক ও সেবাকর্মী এবং মান্ধাতার আমলের নড়বড়ে পরিকাঠামো লইয়া বিশাল সংখ্যক রুগির পরিষেবার সুবন্দোবস্ত করার সুকঠিন চাপ, ও অন্যদিকে জনস্বাস্থ্য-বিষয়ে নাগরিক সচেতনতার হাঁড়ির হাল আমাদিগকে অত্যন্ত বিপজ্জনক এক বিন্দুতে দাঁড় করাইয়া দিয়াছে। এমত অবস্থায়, পরিস্থিতির গুরুত্ব উপলব্ধি করিতে সরকার যথেষ্টর চাইতেও বেশি কালক্ষেপ করিয়াছেন – গত ১৩ মার্চ তারিখে, চিনের উহান প্রদেশ যখন করোনার আক্রমণে উজাড় হইয়া যাইতেছে, তখনও কোভিড-সংক্রান্ত পরিস্থিতিকে ‘হেল্‌থ ইমারজেন্সি’ নহে বলিয়া বার্তা দিয়া কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক সবিশেষ মূঢ়তার পরিচয় দিয়াছেন।

তৎপরবর্তী কালে সরকারবাহাদুরের কানে জল ঢুকিয়াছে – বিলম্বিত বোধোদয়ে নড়িয়া বসিয়া প্রথমে জনতা কারফিউ ও পরে তিন সপ্তাহব্যাপী গৃহবন্দিত্ব ঘোষণা করিয়া করোনা আক্রমণের মোকাবিলায় সবিশেষ উদ্যোগী হইয়াছেন। থালা-বাটি-কাঁসর-ঘন্টা বাজাইয়া ডাক্তারদিগকে অভিবাদন জ্ঞাপন কিংবা অতি-সাম্প্রতিক ‘দীপালিকায় জ্বালাও আলো’-র কুনাট্যরঙ্গে না হয় না-ই ঢুকিলাম, কিন্তু, ভারতের মতো এমন বিশাল ভূখণ্ডে, যে দেশে মোট জনসংখ্যার ৭০ শতাংশের বেশি মানুষ জীবিকার প্রয়োজনে অসংগঠিত ক্ষেত্রের উপর নির্ভরশীল, যাঁহাদিগের একদিন কাজে বাহির হইতে না-পারার অর্থ পরদিবস অরন্ধন – সেখানে মাত্র চারঘন্টার নোটিশে তিন সপ্তাহব্যাপী সর্বাত্মক ‘লকডাউন’ ঘোষণা যে এক পর্বতপ্রমাণ অব্যবস্থা ও বিশৃঙ্খলার জন্ম দিতে পারে, কার্যক্ষেত্রে সে-কথাও তাঁহারা বিলম্বে বুঝিয়াছেন। ফলে যাহা ঘটিবার তাহাই ঘটিয়াছে – বাস, ট্রেন ও সর্বপ্রকার পরিবহনমাধ্যম স্তব্ধ, ফলে অচিরাৎ রাজধানী দিল্লিতে কর্মরত অসংখ্য ঠিকাশ্রমিককে স্বগৃহে ফিরিবার জন্য দিশাহারা অবস্থায় ছুটাছুটি করিতে দেখা গিয়াছে। আরশোলা বা মশা মারিতে যেভাবে যথেচ্ছ কীটনাশক সিঞ্চন করা হয়, বিভ্রান্ত নাগরিকদের শরীর তাক করিয়া সেইভাবে রাসায়নিক ঔষধ প্রয়োগ করার ছবি ‘ভাইরাল’ হইয়াছে। সহস্রাধিক নিরুপায় মানুষ পোঁটলাপুটুলি বাঁধিয়া, সন্তানদিগকে কোলে-কাঁখে নিয়া পরিবারের হাত ধরিয়া পদব্রজে দেহাতের বাড়িতে ফিরিতে বাধ্য হইয়াছেন, তাঁহাদের কেহ-কেহ ক্ষুধায় ও পথশ্রমে পথেই প্রাণ হারাইয়াছেন – সে ছবিও আমরা সংবাদমাধ্যমে দেখিয়াছি। কেরল, মহারাষ্ট্র ও অন্যান্য রাজ্যে কর্মরত এ-রাজ্যের শ্রমিকরা রাজ্যসরকারের উদ্যোগে কোনওক্রমে বাংলায় ফিরিয়াছেন, কিন্তু তাঁহাদিগের কতজন যে অজ্ঞাতসারে মারণ ভাইরাসের বীজ নিজদেহে বহন করিয়া আনিয়াছেন তাহা অদ্যবধি নিরূপণ করা যায় নাই। এরই মধ্যে ‘ফিজিক্যাল ডিসট্যান্সিং’-সংক্রান্ত যাবতীয় চেতাবনিকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ প্রদর্শন ও লকডাউনের নির্দেশ উপেক্ষা করিয়া রামনবমী উপলক্ষে যোগী আদিত্যনাথের উপস্থিতিতে মেলার উদ্‌বোধন হইয়াছে, পঞ্জাবে হোলা মহল্লার উৎসব চলিয়াছে, তিরুপতিতে নিয়মিত ভক্তসমাগম ঘটিয়াছে, মরকজ তবলিগি জামাতের সমাবেশ হইয়াছে। গৃহবন্দিত্বের নির্দেশকে ছুটির সহিত গুলাইয়া ফেলা জনতা পরমোৎসাহে থলিহস্তে বাহির হইয়া পড়িয়াছেন, অত্যাবশ্যকীয় দ্রব্যাদি ক্রয়বিক্রয়ের নামে বাজারে, চায়ের দোকানে এবং যত্রতত্র গা ঘেঁষাঘেঁষি করিয়া কালাতিপাত করিয়াছেন – পরিণামে লকডাউনের অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্যটিই কার্যত ব্যর্থ হইল কি না, তাহা লইয়া বিস্তর প্রশ্ন উঠিয়া গিয়াছে।

এমত পরিস্থিতিতে চার নম্বর প্ল্যাটফর্মের এপ্রিল সংখ্যার মূল বিষয়-অভিমুখ ইহা ব্যতীত অন্য কিছু হইতেই পারিত না। কিন্তু দৈনিক সংবাদপত্র ও টেলিভিশন-মিডিয়ার প্রাত্যহিক ২৪ ঘন্টাব্যাপী সংবাদ-স্রোতের বাহিরে আর কী-কী ধরনের সংবাদ আমরা পাঠকদের দিতে চাই, তাহা লইয়া প্রশ্ন ছিল। সম্পাদকমণ্ডলী সিদ্ধান্ত করিয়াছেন, আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যার গতানুগতিক দৈনন্দিন আখ্যানের বাহিরে গিয়া এই গভীর সঙ্কটের সময়টিকে বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে স্থাপন করিয়া দেখাই উচিত কার্য হইবে – করোনাভাইরাসের আক্রমণের সম্ভাব্য সুদূরপ্রসারী অর্থনৈতিক, সামাজিক-সাংস্কৃতিক, মনস্তাত্ত্বিক ও পরিবেশগত ফলাফলগুলিকে এই অবসরে বুঝিবার চেষ্টা করিলে মন্দ হইবে না। মূলত সেই গুরুতর প্রতিপাদ্যটিকেই মাথায় রাখিয়া এপ্রিল সংখ্যার প্রচ্ছদকাহিনি সঙ্কটকাল-এর বিষয়গুলিকে সাজানোর প্রয়াস করা হইয়াছে। লিখিয়াছেন জঁ দ্রেজ, মৈত্রীশ ঘটক, প্রবীর মুখোপাধ্যায়, রেজাউল করীম, বিষাণ বসু, কৌশিক দত্ত, সুশোভন ধর, প্রতীপ নাগ, ইন্দ্রিতা সাহা সুব্রত রানা। তৎসহ, বিষয়গত গুরুত্ব ও প্রাসঙ্গিকতা অনুধাবন করিয়া পড়গুম্মি সাইনাথ, জেফ্রি স্যাক্‌স, দুষ্মন্ত দাভে হর্ষ মন্দরের পূর্বপ্রকাশিত চারিটি অতি মূল্যবান নিবন্ধ আমরা বাংলায় অনুবাদ করিয়া পুনঃপ্রকাশ করিলাম।

এতদ্ব্যতীত যে কথা জানাইবার – সম্পাদকমণ্ডলীর মনে হইয়াছে, এই স্তব্ধ অনিশ্চয়তার প্রহরে আমরা আমাদিগের পরিচিত চারিপাশকে যেভাবে অকস্মাৎ পালটাইয়া যাইতে দেখিতেছি, তাহাও কোথাও লিপিবদ্ধ থাকা দরকার। কীভাবে পালটাইতেছে আমাদিগের পরিচিত যাপন… কীভাবে দূষণতাড়িত ও কোলাহলক্লিষ্ট প্রাত্যহিকতার স্থান লইতেছে নির্জন নগরপথ, নীল আকাশ ও পাখির কলতান… সে কথাগুলিও অনুচ্চস্বরে লিখিয়া রাখা দরকার বইকী! এই প্রণোদনা হইতেই আমরা লকডাউন ডায়েরিজ নামে একটি বিশেষ বিভাগ শুরু করার পরিকল্পনা করিয়াছি। এটি শুরু হইতেছে মাসপয়লার মেল ট্রেনেরই সঙ্গে, কিন্তু চলিবে নিয়মিত, ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত – প্রতিদিনই এক বা একাধিক লেখা এই চলমান বিভাগটিতে প্রকাশিত হইতে থাকিবে। বিভাগটি শুরু হইল যশোধরা রায়চৌধুরীশৈলেন সরকারের দুটি ব্যক্তিগত গদ্যরচনা দিয়া।

সম্প্রতি প্রয়াত হইয়াছেন বিশ্রুত চিত্রী সতীশ গুজরাল ও আলোকচিত্রী নিমাই ঘোষ। স্মরণ বিভাগে তাঁহাদের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করিলেন যথাক্রমে বিষাণ বসু এবং সন্দীপ রায়অভিজিৎ সুকুল। নিকারাগুয়ার প্রয়াত কবি এর্নেস্তো কার্দেনালকে স্মরণ করিলেন শুভ্র বন্দ্যোপাধ্যায়

আমাদিগের অন্যান্য সকল নিয়মিত বিভাগ – যথা গল্প, অণুগল্প, প্রবন্ধ, কবিতা, ধারাবাহিক উপন্যাস যথাযথ প্রকাশিত হইল। রহিল পুস্তক-পরিচিতির হুইলার্স স্টল, ফোটো-ফিচার কেবিন গ্রাফিত্তি, ভ্রমণবৃত্তান্ত ডিসট্যান্ট সিগন্যাল ও শেষ পাতে ভাল খবর।

পরিশেষে নিবেদন, এক ঘোরতর কঠিন সময়ের মধ্য দিয়া চলিয়াছি আপনি, আমরা – প্রত্যেকেই। ভাইরাসের এই ভয়াল আক্রমণের ঋতু একদিন অতিক্রান্ত হইবেই – কাল হউক বা পরশু। কিন্তু, তাহার পর, সভ্যতা যখন মৃতের স্তূপ সরাইয়া মাথা তুলিয়া দাঁড়াইবে, সেই ক্ষণে যেন আমরা তাহার জন্য ম্লানিমামুক্ত এক নূতন দিগন্ত প্রস্তুত করিয়া তুলিতে পারি।

প্রণাম লহিবেন। ভাল থাকিবেন…

 

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4880 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...